বই হল অভিজ্ঞতা,তথ্য ,চিন্তা কে ধারণ করে থাকা একটা প্রাচীনতম 'যন্ত্র' বিশেষ। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, ভৌগলিক তথ্য, দেশভ্রমণের বিচিত্র পথ নির্দেশ, নানান ধরণের শিল্পমাধ্যমের সৃজন কাজ, সব কিছু সংরক্ষন করা থাকে বই এর মধ্যে। প্রাচীনতম বই বা গ্রন্থ গুলো সম্বন্ধে জানতে গেলে দেখা যায় - যীশুখৃষ্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই মানব সভ্যতার সাথে বই আছে। হাজার হাজার যুদ্ধ , ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় হওয়া সত্ত্বেও বেশ কিছু প্রাচীন বই থেকে গেছে।কখনো মানুষের স্মৃতি তে, পাথরের গায়ে লিপি হয়ে, কক্ষনো গ্রামের বুড়োর গল্পে, বছরের পর বছর হয়ে আসা কবি গানে, নাটকে, ধর্মস্থানের গোপন ঘরে আরও কত অজানা জায়গায়। আসলে জীবনের সাথে জড়িয়ে ভাষার অগ্রগতির সাথে চলতে চলতে সে গুলো থেকে গেছে। পাথর, বিশেষ কিছু গাছের পাতা, হাতে তৈরি কাগজ, জন্তুর চামড়া,দেবালয়ের গায়ে, লিপিবদ্ধ করে রাখা আছে। বহু বই আবার ধর্মাচরণের সাথে যুগযুগ ধরে চলে আসছে। তেমনি কিছু প্রাচীন বই-এর কথা এবারে আনলাম তোমার জন্য- যাদের পোকারা খেয়ে শেষ করতে পারেনি।
ঋকবেদঃ
প্রাচীনতম গ্রন্থ। গুরু শিষ্য পরম্পরাতে স্মৃতির মাধ্যমে চলে আসছিল এই গ্রন্থটি। লিখিত রূপ কবে এলো সঠিক জানা যায় না। এটি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ। এর সৃষ্টি কাল নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে তবে খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৯০০ অব্দের মধ্যে এটি রচিত হয়েছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন।যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় যে সাম গান গুলি গাওয়া হত এটি তার সংকলন। আরও তিনটি বেদ আছে।সামবেদ, যজুর্বেদ,ও অথর্ববেদ। সামবেদ আসলে ঋকবেদের মধ্যে থাকা কিছু সাম গানের সংকলন। যজুর্বেদে যজ্ঞ পুরোহিতের জন্যে বেঁধে দেওয়া নিয়ম কানুন। অথর্ববেদে আছে জাদুমন্ত্র।
ইলিয়াডঃ
হোমারএর লেখা ট্রয়ের যুদ্ধের ওপর লেখা এই মহাকাব্য টি তে মোট ১৬০০০ লাইন আছে। খৃস্টপূর্ব ১১৯৪ থেকে ১১৮৪ এর রচনা কালের আনুমানিক সময় সীমা। ২৪ টি সর্গে লেখা এই অপূর্ব কাহিনীর চরিত্র রা যথাক্রমে, হেক্টর, হেলেন, অ্যাকিলিস ইত্যাদি।
ওডিসিঃ
ইলিয়াড-এর সিকুয়েল হিসাবে ওডিসি লেখেন হোমার। ওডিসি হল ট্রয়ের যুদ্ধ শেষ করে ইথাকারের রাজা ওডিসিয়াস বা ইউলিসিস-এর দেশে ফিরে যাবার গল্প। দশ বছর ধরে, বিভিন্ন রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে ট্রয় থেকে ইথাকা ফেরেন ওডিসিয়াস। সেইসব অভিজ্ঞতার গল্প লিপিবদ্ধ আছে ওডিসি তে।
রামায়ণঃ
কবি বাল্মীকির রচনা।এই মহাকাব্যটি রচিত হয়েছে খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর আগে। রামের স্ত্রী সীতার অপহরণ, আর্য- অনার্য যুদ্ধ, সিঙ্ঘল দ্বীপ বিজয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখা। রাম, লক্ষণ, সীতা ,রাবন, হনুমান, বিভীষণ, মেঘনাদ, প্রভৃতি বিবিধ আকর্ষণীয় চরিত্রে ভরপুর এক মহাকাব্য। অনেকে ধর্মগ্রন্থ বলে বিশেষ সন্মান করে থাকেন।
মহাভারতঃ
এই দীর্ঘতম মহাকাব্যটি বেদব্যাসের রচিত। রচনাকাল খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে খৃস্টিয় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ছড়ানো। সে সময়ের রাজনীতি, সমাজনীতি যুদ্ধব্যবস্থা,মেয়েদের জীবন, সব কিছু এই মহাকাব্যে আছে। এর মধ্যে 'গীতা' বলে যে অংশ টি আছে তাকে হিন্দুধর্মগ্রন্থ হিসাবে ব্যাবহার করা হয়।
পুরাণঃ
খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ দেবদেবীদের কাহিনী, সাধারন মানুষের জীবন চর্চা, রাজনীতি আর কিছুটা ঝাড়ফুঁক ,তুকতাক নিয়ে লেখা পুরাণগুলি। মোট ১৮ টা পুরাণ পাওয়া যায়।
শিল্পীর তুলিতে মেগাস্থিনিসের ভারতে আগমন।
ইন্ডিকা (Indika/ Indica):
সেলুকাসের দূত হয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-এর কাছে আসেন মেগাস্থিনিস। তাঁর লেখা এই ইন্ডিকা বই টি। খৃস্টপূর্ব ৩০২ থেকে ২৮৮ অব্দের মধ্যে তিনি ভারতে পাটলিপুত্র আসেন। মূল গ্রন্থ টি পাওয়া যায় না। তাঁর উত্তরসূরিরা নানান জায়গায় বইটির বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে ব্যবহার করেছেন। বইটিতে তৎকালীন রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, জীবিকা, সব কিছু নিয়ে প্রচুর তথ্য আছে। সেইসব তথ্যের মধ্যে বেশ কিছু ভুল এবং অবান্তর তথ্য থাকলেও, ধর্ম নিরপেক্ষ ধরণের লিপিবদ্ধ সংগ্রহ হিসাবে এই বই ঐতিহাসিকদের কাছে অমুল্য।
পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সী (Periplus of the Erythraean Sea or Periplus of the Red Sea ):
বাংলায় যাকে বলা যায়, 'ভারত মহাসাগরে ভ্রমণ'। খৃঃ প্রথম শতাব্দীর তৃতীয় বা শেষে এটি রচনা। দুঃখের বিষয় এই উৎকৃষ্ট বইটি কার লেখা জানা যায় না। তবে আন্দাজ, কোন এক গ্রিক নাবিকের লেখা। ভারতের বন্দর, পোতাশ্রয়, আমদানি রপ্তানি, পণ্যদ্রবের নিখুঁত বর্ণনা আছে এখানে। বর্তমান রেড সী বা লোহিত সাগর গ্রীকদের কাছে এরিথ্রিয়ান সী নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রীকদের কাছে ভারত মহাসাগর এবং পারস্য উপসাগরও এর অংশ হিসাবে চিহ্নিত ছিল।
ফা-হিয়েনের যাত্রাপথ
ফো কুয়ো কি -Fo- kouo-ki Foguoji ('Record of Buddhist Kingdoms')
এই বই-এর লেখক চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন। বইটি তে ৪০ টি অধ্যায় আছে। ফা-হিয়েন মধ্য এশিয়া, উত্তর পশ্চিম ভারত ,এবং মধ্য ভারত অতিক্রম করে উত্তর ভারত এসেছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত স্থান গুলিতেই মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাঁর লেখায় কোথাও তৎকালীন রাজার নাম অবধি নেই।
হিউয়েন সাং-এর যাত্রাপথ
Si- yu- ki /Datang-Xiyu-Ji ('Records of the Western Regions of the Great Tang Dynasty')
এই বই-এর নাম বাংলা করলে হয় 'পশ্চিম দেশের স্মৃতি'। লিখেছেন চৈনিক বৌদ্ধ ভিক্ষু পরিব্রাজক হিউয়েন সাং Xuanzang / Hsüan-tsang। পরিব্রাজন পর্বে হিউয়েন সাং যে সমস্ত দেশের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করেছিলেন, সেই সব দেশের বিবরণ এই বইতে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্ম আর বিজ্ঞান উভয় বিষয়ে এটি সমৃদ্ধ। এই বই থেকে হর্ষবর্ধনএর রাজত্ব কাল সম্বন্ধে জানা যায়।
আল-বিরুনী
তাহ্কিক-ই-হিন্দ /Taḥqīq mā li-l-hind min maqūlah maqbūlah fī al-ʿaql aw mardhūlah ('Verifying All That the Indians Recount, the Reasonable and the Unreasonable')
বাংলা ভাষা তে এই বইটির নাম 'হিন্দুস্থান অনুসন্ধান' । গ্রহনক্ষত্র বিদ, বিজ্ঞানী, ভৌগলিক, ভাষাবিদ, আল-বিরুনী এর রচয়িতা।গজনীর সুলতান মামুদের সাথে তিনি ভারতে আসেন।ভারতবর্ষের বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল।তিনি সংস্কৃত ভাষাতেই সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন।'তাহ্কিক-ই-হিন্'দ এ তিনি যত টা না বাস্তব ভারতবর্ষে র কথা লিখেছেন তারচেয়ে বই থেকে জেনে লিখেছেন অনেক বেশি। যদিও তাঁর এই বই থেকে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায় সেই সময়ের ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু শাসনের। বইটির রচনা কাল ১০৩০ খৃস্টাব্দ।
এছাড়া বহু প্রাচীন বই আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যের 'দীপ বংশ', 'মহা বংশ' যাদের অন্য একটা নাম আছে 'সিঙ্ঘলি ইতিবৃত্ত'। 'মহা বংশ' র ঐতিহাসিক মুল্য অসীম। রাজা অশোকের জীবন নিয়ে লেখা।জাতকের গল্প বৌদ্ধ সাহিত্যের লোক রঞ্জক দিক। জাতক সাধারন ভাবে দেখলে গল্প। কিন্তু ওই সময়ে বণিকদের একটা প্রাধান্য দেখে জানতে পারা যায় আর্থিক উন্নতির লক্ষণ। খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর আরও একটি বই হল 'জৈন ভাগবতি সূত্র'। ষোড়শ মহাজনপদ-এর কথা এখান থেকেই পাওয়া যায়। অশ্বঘোষের 'বুদ্ধ চরিত', পানিনি র 'অষ্টাধ্যায়ি' , পতঞ্জলি র 'মহাভাষ্য', কালিদাসের 'রঘুবংশম', বাণভট্টের 'হর্ষ চরিত', পৃথিবীর প্রাচীনতম বাইবেল Codex Sinaiticus। আরও অজস্র গ্রন্থ সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তেমনি এই আদিকাল থেকেই, নানা কারণে, বিশেষত বিভিন্ন যুদ্ধের কারণে, চিরকালের মত হারিয়ে গেছে কত সহস্র বই, ধ্বংস হয়েছে কত শত পাঠাগার, চিরকালের মত হারিয়ে গেছে কত তথ্য।
ইস যদি সব গুলো ঠিক মতো রক্ষা করা যেত।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া