সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আমি সদ্য ইন্দোনেশিয়াতে থাকতে এসেছি। এসেই খেয়াল করলাম, চারদিকে আমাদের পরিচিত 'বাটিক' ছাপার জামাকাপড়ের দোকান খুব বেশি। এখানকার সাধারণ মানুষ ও খুব বাটিকের জামাকাপড় পড়তে পছন্দ করেন। বাটিক ইন্দোনেশিয়ার নিজস্ব শিল্পকলা। বাটিকের উৎপত্তিস্থল ইন্দোনেশিয়ায় পৌছাবার আগে পর্যন্ত আমারও এই বিষয়ে খুব ধারণা ছিল না। ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও, এই ধরনের কাপড়ের সর্বপ্রথম ব্যবহার সিঙ্গাপুর, নাইজেরিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়ায় শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। আমি জানতে পারলাম জাভা দ্বীপের যোগজাকার্তা শহতেই বাটিকের কাজ প্রথম শুরু হয়। তাই সুযোগ পেয়েই তিন-চার দিনের জন্য চলে গেলাম সেখানে, এই প্রাচীন এবং আন্তর্জাতিক শিল্পকলা কাছ থেকে দেখার জন্য।

যোগজাকার্তায় এই দোকানে বাটিকের ইতিহাস জানা যায়, বাটিক শেখাও যায়

ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের শহর যোগজাকার্তা ( ইয়োগইয়াকার্তা/ Yogyakarta)বা ইয়োগ্যা এই দেশের ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এছাড়াও, এই দেশের এক মাত্র এই অঞ্চলটিই এখনও দেশের সুলতানের অধীনে রয়েছে। জাকার্তা থেকে প্রায় ৫৫০ কিমি দূরে অবস্থিত যোগজাকার্তা পৌঁছানো যায় প্লেনে( ১ ঘন্টা), ট্রেনে ( ৬-৭ ঘন্টা) বা বাসে ( ১২-১৩ ঘন্টা) । জাভা এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন শিল্প এবং সংস্কৃতি চর্চায় এই স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ।

বাটিক শব্দটি জাভানিজ শব্দ 'আম্বাটিক' থেকে এসেছে। 'আম্বা' অর্থাৎ লেখা এবং 'টিক' অর্থাৎ ডট বা টিপছাপ দিয়ে একটা রেখা তৈরি করা। পুরো কথাটার অর্থ এমন ডট বা ছাপ দিয়ে লেখা/ আঁকা। প্রাচীনকালে বাটিক তৈরি করা হতো কাপড়ের মধ্যে মোমের ব্যবহারের সাহায্যে। এই শিল্পটিকে বংশ পরম্পরা অনুসারে পরিবারের মধ্যেই হস্তান্তর করা হতো। ইন্দোনেশিয়ার মানুষজনের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাথে এই শিল্পটি গভীরভাবে জড়িত।এই শিল্পে ব্যবহৃত রং এবং কারুকার্যের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের সৃজনশীল এবং আধ্যাত্মিক বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়। বহুকাল আগে, ১৩০০ শতাব্দীতে এটি ব্যবহৃত হতো রাজ পরিবার এবং অভিজাত সম্প্রদায় মানুষজনের পোশাক তৈরি করার জন্যে। ডাচ ঔপনিবেশিক শাসনকালে, জাভার সাধারণ মানুষ বাটিকের জামা কাপড় পড়া শুরু করে। বিংশ শতাব্দীতে এটি সর্বস্তরের মানুষজনের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই দেশের স্থানীয় বাসিন্দারা যে কোনও বিশেষ দিন , ধর্মীয় উৎসব এবং বিবাহ অনুষ্ঠানের সময় বাটিকের জামা কাপড় পরাকে প্রাধান্য দেয়। ২০০৯ সালে , ইউনেস্কো 'বাটিক' কে 'ইন্টানজিবল কালচারাল হেরিটেজ' (Intangible Cultural heritage)বলে চিহ্নিত করে। আমাদের দেশে ২ অক্টোবর গান্ধী জয়ন্তী হিসেবে পালন করা হয় । ইন্দোনেশিয়াতে এই দিনটি জাতীয় বাটিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং গর্ব প্রকাশ করার জন্যে সেদিন তারা বাটিকের পোশাক পরে। এছাড়াও, এই ঐতিহ্য প্রচার করার জন্যে সরকার সকলকে প্রতি শুক্রবার করে বাটিক পড়ার জন্যে অনুপ্রাণিত করে। এমন কী স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এইদিন বাটিকের পোশাক পরে।


কাপড়ের নকশায় মোমের প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে


কাপড়ের নকশায় মোমের প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে


বাটিকের নকশা


নকশা আঁকার জন্য গলানো মোম


হাতেকলমে শেখানোর জন্য হাসিমুখ মাস্টারমশাই তৈরি

যোগজাকার্তাতে আমরা দেখলাম কেমন ভাবে কাপড়ের ওপর মোম দিয়ে নকশা করা হচ্ছে। হাতেকলমে শেখার সুযোগও রয়েছে সেখানে। দেশের এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের বাটিক কারুকার্য দেখতে পাওয়া যায় যেটা সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে বহন করে। মূলত ৪ প্রকারের বাটিক দেখতে পাওয়া যায় - বাটিক ব্লক , বাটিক স্ক্রিন (স্টেনসিল ব্যবহার করা হয়), বাটিক লুকিস (হাতে আঁকা) এবং টাই আর ডাই বাটিক।


শহরের বিখ্যাত বাটিকের দোকান


নানা ধরনের ইন্দোনেশিয় বাটিক

আমাদের দেশেও বাটিক প্রিন্ট-এর কাপড়ের খুবই কদর। বিশেষ করে বাংলার বাটিকের সাথে একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে । এই শিল্পটি মানুষের মনে ভালোবাসার জায়গা বানিয়ে নিয়েছে এবং বাটিক প্রিন্টের নানা প্রকার পোশাক পরিচ্ছদ যেমন শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, বিছানার চাদর আমাদের সবার বাড়িতেই দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই ভারতের শান্তিনিকেতনে প্রথম বার বাটিকের আত্মপ্রকাশ হয়। ১৯২৭ সালে জাভা দ্বীপে ভ্রমণকালীন তিনি এই শিল্পটি দেখে মুগ্ধ এবং প্রভাবিত হন । জাভার রাজা তাঁকে বাটিকের পোশাক উপহার দেন। তিনি বাংলায় বাটিক শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন। আমাদের এখানে বাটিক তৈরির পদ্ধতিকে সহজ করে তোলার জন্যে তুলির ব্যবহার করা শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে সেটা 'তুলি বাটিক' নামে পরিচিতি লাভ করে। জাভা দ্বীপে রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কর, যিনি সেখান থেকে বাটিক তৈরি করার পদ্ধতি শিখে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী শান্তিনিকেতনে তুলি বাটিকের প্রচারে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেন।

বাটিকের ইতিহাস জানার পরে একটি স্থানীয় বাটিকের দোকানে গিয়ে, ইন্দোনেশিয়ার বাটিকে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার রঙ এবং কারুকার্য নিজের হাতে পর্যবেক্ষণ করে দেখতেই হল। চোখের সামনে এত সুন্দর সব কাপড় দেখে, কিছু কেনাকাটাও করে ফেললাম। এরপর থেকে যখনই আমি বাটিকের পোষাক পড়ব,আমি এই ভেবে গর্বিত হব যে আমি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক প্রাচীন ঐতিহ্যকে আজও মর্যাদা দিয়ে চলেছি।


আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা