ব্যাঙ্গালোরের অসংখ্য লেকের মধ্যে আমার প্রথম পছন্দ ‘সল কেরে’। ‘সল’ কথাটা কান্নাডা ‘সাওালা’ কথার অপভ্রংশ, যার মানে ‘মাটি’। আর‘কেরে’ মানে লেক। সারা বছর পাখিদের সমারোহ থাকে সল কেরেতে। তাই সল কেরের সঙ্গে পক্ষীপ্রেমিকদের আত্মার যোগ। ‘সল’ কথাটা তাদের কাছে ‘সোল (Soul / আত্মা)’ এর সমতুল্য।
পাখিদের ব্যবহার আর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষন করলে একটা বছরকে মোটামুটি তিনটে ঋতুতে ভাগ করা যায় ।
মার্চ থেকে জুন –পাখিদের বংশবৃদ্ধির সময়। এই সময় পাখিরা বাসা তৈরী করে, ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে ছোট্ট ছোট্ট পাখি জন্মায়।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর – ছোট্ট পাখিরা আস্তে আস্তে কিশোর হয়ে ওঠে। বাবা মা তখনো তাদের ঘিরে থাকে, সব রকম বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করার প্রানপন চেষ্টা করে ।
অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী – কিশোর পাখিরা পুরোপুরি স্বাবলম্বি হয়ে যায়। নিজের খাবার নিজে জোগাড় করে নিতে শিখে যায়।
এই সময় ব্যাঙ্গালোরের পাখির জগতে আরও একটা লক্ষনীয় পরিবর্তন হয়। শীতের দেশ থেকে দলে দলে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসতে শুরু করে। রঙ বেরঙের পাখিতে ভরে ওঠে লেক ও লেক সংলগ্ন গাছপালা। পাখি দেখার জন্যে ভীড় করে নানা বয়সের মানুষ, ফটোগ্রাফার ও পাখি পর্যবেক্ষকদের দল ।
গত কয়েক বছরে সল কেরেতে দুশোরও বেশি প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে।
তাদের মধ্যে থেকে কয়েকটা পাখির গল্প রইলো ।
সিনেরাস টিট / রামগাংরা (Cinereous Tit)
অনেকটা চড়ুইয়ের মতো সাইজ। চকচকে কালো মাথা। কালো রঙের একটা দাগ চলে গেছে ঠোঁট থেকে পেট দিয়ে লেজ বরাবর। সাদা আর ধূসর রঙের দাগ কাটা ডানা। সব মিলিয়ে খুব আকর্ষনীয় দেখতে।
প্রাধান খাদ্য পোকামাকড়, ফল, ফুলের কুঁড়ি ইত্যাদী। খাওয়ার সময় কখনো কখনো পা দিয়ে পোকাকে ধরে ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে ছিড়ে খায়। শক্ত ফল খাওয়ার সময় গাছের ডালে আছড়ে ভেঙ্গে নেয়।
সবুজ বাঁশপাতি (Asian Green Bee Eater)
উজ্জ্বল সবুজ রঙের পাখি। গলার কাছে নীলাভ। মাথার ওপর দিকটা হাল্কা সোনালী। চোখ বরাবর কালো দাগ। দল বেঁধে গা ঘেঁসাঘেঁসি করে গাছের ডালে বসে থাকতে ভালোবাসে।
মৌমাছি, ফড়িং ইত্যাদী নানা রকম উড়ে বেড়ানো পোকামাকড় ধরে ধরে খায়। খাওয়ার আগে পোকামাকড়কে গাছের ডালে বারবার আছড়ে হুল ও বিষ বার করে নেয় ।
দোয়েল (Oriental Magpie Robin)
সাইজে বুলবুলির থেকে একটু ছোট। পুরুষ দোয়েলের মাথা গলা কালো। পেটের দিকটা সাদা। স্ত্রী দোয়েলের মাথা ও গলা ধূসর। পোকামাকড়, কেঁচো, ফুলের মধু ইত্যাদী এদের প্রধান খাদ্য। অনেক সময় গাছের মগডালে বসে সুরেলা গলায় গান গায়। অন্য পাখিদের ডাক খুব ভালো নকল করতে পারে।
দোয়েল পাখি বাংলাদেশের জাতীয় পাখি । বাংলাদেশের টাকার নোটে এই পাখির ছবি আছে।
পাতি কুট (Common Coot)
সারা গা কালো । শুধু ঠোঁট আর কপালটুকু সাদা। জলজ উদ্ভিদ, শ্যাওলা, ফল, শস্যকণা, ছোট ছোট জলজ প্রানী, অন্য পাখির ডিম ইত্যাদী খায়।
বেশীর ভাগ সময় দল বেঁধে জলে সাঁতার কাটে। কখনো কখনো খেলাচ্ছলে বা মারামারি এড়ানোর জন্যে জলের ওপর দিয়ে দ্রুত দৌড়ে যেতে দেখা যায়।
জলপিপি (Bronze-winged Jacana)
লম্বা পা। ব্রোঞ্জের মতো চকচকে বাদামী রঙের ডানা। মাথা ও গলা সবুজাভ কালো। চোখের ওপর দিয়ে একটা সাদা লম্বা দাগ চলে গেছে।
পি -পি -পি করে ডাকে বলে এদের নাম জলপিপি। এদের পা ও পায়ের আঙুলগুলি খুব লম্বা হয়।
জলজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড় খায়।
ব্লু ক্যাপড রক থ্রাস (Blue capped Rock Trush)
এরা পরিযায়ী পাখি। গরম কাল কাটায় হিমালয়ের পাদদেশে। সেখানে ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। শীত পড়লে উড়ে আসে দক্ষিন ভারতে । শীত ফুরোলে আবার ফিরে যায় হিমালয়ে।
পুরুষ পাখির রঙ খুব উজ্জ্বল। মাথাটা নীল । শরীরের উপরের অংশ প্রধানত নীল ও কালো রঙের। পেটের দিকটা কমলা। স্ত্রী পাখিদের গায়ের ওপরের অংশ বাদামী, পেটের দিকটা সাদা আর বাদামী মেশানো।
গিরিয়া হাঁস (Gargeny)
এই পরিযায়ী হাঁসরা গরম কালে ইউরোপে থাকে। ওখানেই ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে বাচ্চা জন্মায়। শীত পড়লে ওরা দল বেঁধে আকাশ পথে পাড়ি দেয়। শীতকাল কাটায় দক্ষিন আফ্রিকা, অস্টেলিয়া, ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের নানান জলাশয়ে। গরম পড়লে আবার ফিরে যায় ইউরোপে।
পুরুষ পাখিরা স্ত্রী পাখির তুলনায় দেখতে বেশি আকর্ষনীয়। মুখটা বাদামী। সাদা চওড়া একটা দাগ আছে চোখের ওপর। ডানাতেও সাদা দাগ থাকে।
শঙ্খচিল (Brahminy Kite)
কবি জীবনানন্দ দাশের ”আবার আসিব ফিরে” কবিতার লাইন গুলো মনে আছে?
"আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে—এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়,—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে...”
এই সেই শঙ্খচিল । ধবধবে সাদা মাথা ও বুক। খয়রী ডানা। মূলতঃ শিকারী পাখি। অনেক সময় আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। ছোট পাখি, সাপ, মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদী শিকার করে খায়।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার অফিসিয়াল ম্যাসকট শঙ্খচিল।
গয়ার (Oriental Darter)
জলের মধ্যে যখন সাঁতার কাটে তখন সাপের মতো লম্বা গলাটা বেরিয়ে থাকে জলের ওপর। তাই অনেকে একে সাপ পাখি বলে ডাকে।
এরা জলের নীচে ডুবে শিকারের সন্ধান করে। শিকার ধরে জলের ওপর ভেসে উঠে শিকারটিকে গিলে খায়। এদের সুচালো ঠোঁট শিকার ধরায় ও শিকারকে ঘায়েল করতে সাহায্য করে । ছোট মাছ, ব্যাঙ এদের প্রধান খাদ্য।
অনেক সময় এই পাখিদের ডাঙায় বা গাছের ওপর ডানা মিলে বসে জলে ভেজা পালক শুকোতে দেখা যায়।
পাকড়া ঝাড়ফিদ্দা (Pied Bushchat)
পুরুষ পাখির দেহ প্রধানত কালো । ডানার প্রান্ত আর পেটের একদম তলার দিকে সামান্য সাদা। স্ত্রী পাখিরা প্রধানত বাদামি।
নীলগিরিতে বসবাসকারী তোড়া উপজাতির মধ্যে একটা গল্প চালু আছে। এক পুরোহিত দুধ মন্থন করছিল। হঠাৎ মন্থন শেষ না করেই সে ঝর্না থেকে জল আনতে চলে যায়। যাওয়ার আগে মন্থন করার লাঠিটাকে দুধ থেকে সরাতে ভুলে গিয়েছিল। ঘর থেকে বেরোনোর সময় এক কালো পাখি এসে পুরোহিত বাধা দেয়। পুরোহিত বিরক্ত হয়ে তার হাতে লেগে থাকা মাখনটুকু ছুঁড়ে দেয় পাখির গায়ে । পরে পুরোহিত জল আনতে গিয়ে মারা যায়। কিন্তু তার হাতের সেই মাখন সাদা দাগ হয়ে কালো পাখির গায়ে আটকে রয়ে যায়। তাই তোড়া উপজাতির মানুষদের কাছে এই পাখি দেখা শুভ লক্ষন।
রাঙা মানিকজোড় (Painted Stork)
বেশ বড়সড় সাদা জলচর পাখি। ঘাড়, গলা ও পিঠ সাদা। ডানার পালকে কালো ডোরা দাগ। লেজের পালকের শেষে উজ্জ্বল গোলাপি রঙের আভা।
মাছ, ব্যাঙ, চিংড়ি, কাঁকড়া, জলজ পোকামাকড় খায়। গাছের ওপরে অনেক পাখি মিলে একসঙ্গে কলোনি করে বাসা বানিয়ে থাকে।
হট্টিটি (Red-wattled Lapwing)
রুপোলী বাদামী ডানা, লেজ আকারে ছোট ও কালো। মাথা ঘাড় ও বুকের রঙ কালো। চোখের চারিদিকে লাল রঙ।
ছোট মাছ, পোকামাকড় কীটপতঙ্গ, ব্যাঙ, কেঁচো ইত্যাদী খায়।
এদের ডাককে ইংরেজীতে অনুকরন করলে অনেকটা এরকম শোনায় - Did we do it? Did we do it?