সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
মানুষ যা দেখতে চায়

- বুস্টার ডোজ নিয়েছিস?
- নাহ! তুই?
- একটাই নিয়েছি, ওটা বুস্টার কি না জানি না।
- কোথায়?
- স্কুলে দিচ্ছিল যেটা।
- ও। আমি যাইনি।
- তাহলে?
- তাহলে আবার কী, ওসব এখন কেউ দেখছে না।
- চাপ লাগে ভাই। রিস্ক নেওয়ার কী দরকার?
- আমার লাগে না। বাড়িতে সবারই হয়েছিল। সবাই ঠিক হয়ে গেছে।
- কেউই নেয়নি?
- গেছিল, প্রথমবারের টা। সেকন্ড টাইম গেছে কি না জানি না। গেছিল বোধহয়...
- পিসিরা দুর্গাপুরে থাকে। ওরা এখনো মাস্ক পরে বেরোয় কোথাও গেলে।
- এখানে ওসব লাগবে না। বেকার।
- কী জানি... দু বছর যা গেল। মানসের দাদু, রতনের বাবা... কদিনের জ্বরেই!
- তোর হঠাৎ এখন এইসব মনে পড়ছে কেন?

কথাটা বলেই চটাস করে পায়ের ওপর বসা মশাটা মারল সুজন। কথা হচ্ছিল, কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকিয়ে ছিল না। দুজনেই তাকিয়ে ছিল নদীর স্রোতের দিকে। বালির চরের দিকে। ক্রমে আলো কমে আসা পশ্চিম দিকের আকাশের দিকে। নদীর চরে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে। ঘাট থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে নদী। বালির চর ছড়িয়ে আছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। চরে বসে অনেকেই গল্প করে বিকেলের দিকে এসে। খেলেও ছেলেরা। সাইকেল নিয়ে আসে। তারপর অন্ধকার নামার আগে একে একে চলে যায়। মথুরাচণ্ডীর ঘাট দিয়ে নেমে এই চরে নেমে আসা অনেক সহজ। এদিকটা আলোও বেশি। মন্দির আর ঘাটের আলো ছড়িয়ে থাকে চারদিকে সন্ধ্যে থেকেই। অন্য দিকগুলো ঝুপ্পুস অন্ধকার। দক্ষিণ দিকের ব্রিজটা ঠিক করে দেখা যায় না অন্ধকার নামলে। ব্রীজের ওদিকটা বল্লভপুর শ্মশান।

স্টেশন অঞ্চল পার করে কিছুটা এগোলেই গির্জাপাড়া। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে প্রতিষ্ঠিত, এদিককার প্রাচীনতম গির্জা — ওয়েসলিয়ান মেথডিস্ট চার্চ। সেই গির্জার নামেই অঞ্চলের নাম গির্জাপাড়া। সেই গির্জা থেকে সরে বাইপাসের রাস্তা ধরে চলে গেলেই ওদের গ্রাম — মথুরাডিহি। সুজন আর অভি দুজনেই অধুনা বর্ধিষ্ণু নিউ মথুরা অঞ্চলের ছেলে। তাই মাঝে মাঝেই সাইকেল করে মথুরাচণ্ডীর মন্দিরে আসে বন্ধুরা মিলে।

বালিতে ফুটবল খেলার একটা আলাদা মজা আছে। জল কমে এলে নদীর চরে ফুটবল খেললে মনে হয় সমুদ্রের ধারে বালিতে ফুটবল খেলছে। মোবাইল ফোন নিয়ে এসে ওদের আর এক বন্ধু অসিত ছোটো ছোটো ভিডিও করে। অসিতের দাদার ফেসবুক অ্যাকাউণ্ট আছে, সে ওইসব ভিডিও এডিট করে, তাতে মিউজিক দিয়ে আপলোড করে। সেগুলোকে বলে রিল্‌স্‌। রিল্‌স্‌গুলো অবাক হয়ে দেখে সুজনরা। এই নদীর চর, মন্দির, জলে ঝিলমিল করা রোদ, গাছপালা — কী সুন্দর লাগে! আশ্চর্য রকম কমে যায় অথবা বদলে সকলের গতি আর নড়াচড়া, কী দারুণ গান বাজে... ঠিক সিনেমার মত!

সুজনের এমন ভালো স্মার্টফোন নেই। আর অভির বাড়ি থেকে ওকে দেবে না স্মার্ট ফোন, বাবা বলেছে হাইস্কুল পাশ করলে তবে স্মার্ট ফোন দেবে। সে এখনো চার বছর! অসিতের দাদা আসানসোলে কোথাও বড়ো শোরুমে কাজ করে, তার দুটো স্মার্ট ফোন। তারই একটা মাঝে মাঝে নিয়ে খেলার মাঠে চলে আসে অসিত। দু-একবার লুকিয়ে স্কুলেও নিয়ে গেছিল। নেট কানেকশন সবসময়ে ভালো থাকে না। তখন ভিডিওগুলো আটকে আটকে যায়। সবাই অধৈর্য হয়ে ফোনের দোষ দেয় আর অসিতের দাদাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এই নিয়ে হাতাহাতিও হয়ে গেছে একবার। তার পর থেকেই আর স্কুলে নিয়ে যায় না ফোনটা। ফোনের কিছু হলে ওর দাদা আস্ত রাখবে না।

অভির মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দামোদরের চরে এমনিই বসে থাকার। সবাই চলে গেলেও ও বসে থাকে। এই যে একটু একটু করে আলো কমে আসে, মেঘ আর আকাশের রঙ বদলে যায়, জলের রঙ বদলে যায়। এত রকম পাখি আসে, আবার চলে যায়। এগুলো দেখতে ভালো লাগে অভির। খেলতে খেলতে মত্ত হয়ে গেলে এসব দেখার মন থাকে না। সবাই চলে গেলে খেয়াল করে। কেমন ঝিরি ঝিরি পাতা নদীর দিক থেকে আসা বাতাস বইলেই গাছ থেকে পড়ে উড়ে উড়ে যায়। কীভাবে পাখিগুলোকে একটু বেশিক্ষণ দেখলেই আলাদা করে চেনা যায়। চর পড়ে গেলেও, বয়ে যাওয়া খাতের এক এক অংশে কেমন ঘুর্ণি স্রোত বোঝা যায়। রোজ নয়, মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ এইসব দেখে তারপর ফেরে অভি... সেদিন দেরি হয়ে যায়। ছিন্নপত্রে বোটে বসে লেখা রবি ঠাকুরের চিঠিগুলোর কথা মনে পড়ে। সব না, কিছু কিছু চিঠি। যেখানে এমনই নদীর চর। ক্রমে দিন ফুরিয়ে অন্ধকার নেমে আসা, অনন্ত চরাচর... এইসব ছবি ফুটে ওঠে। মামার বাড়ি গিয়ে 'ছিন্নপত্র' বইটা গত বছরই দেখেছে অভি। মামাতো দিদির থেকে নিয়ে কয়েকটা চিঠি পড়েছে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে — শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর, চলন বিল। পড়তে পড়তেই মনে হয়েছে... কী আশ্চর্য, আগে এতবার এখানে এসে এভাবে মনে হয়নি! অথচ এখন এলেই মনে পড়ে! মনে হয়!

অভিকে পৌঁছে দিতে হবে বলেই সুজন থেকে যায় মাঝে মাঝে। অসিত, দেবু, ফটিক, ওরা সব চলে গেছে। শুধু এই দুজনই রয়ে গেছে। একটাই সাইকেল। অন্যদিনের মত, আজও অভিকে ডবলক্যারি করে ওদের পাড়ায় পোঁছে দিয়ে নিজের বাড়ি ফিরবে সুজন। কথার পিঠে কথা হয়, যেহেতু চুপ করে একটানা বসে থাকা যায় না। সুজন বেশি কথা বলে না, ওর ধাতে নেই। অভি চেষ্টা করছে একটু জোর করেই, বরফ ভাঙার চেষ্টা।

'হঠাৎ এখন এইসব মনে পড়ছে কেন?'
কথাটা বলেই সুজন উঠে দাঁড়াল। সন্ধ্যে হচ্ছে, এবার ফিরতে হবে। অভিও উঠে পড়ল ওর দেখাদেখি, প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, 'আজ স্কুলে বিধান স্যার বলছিলেন কাউকে যেতে যেতে...'
- কী?
- এই... সব ফালতু। চারপাশে সবার জ্বর, সবাই কাশছে।
- ঠিকই বলেছেন।
- চাপ লাগে জানিস তো?
- আজ একটু কাজ আছে বাড়িতে... অন্ধকার হয়ে এলো।

সমস্যাটা হল, কিছুদিন যাবৎ সুজন ঠিক করে কথা বলছে না অভির সঙ্গে। এক ক্লাসের বন্ধু, একসঙ্গে খেলে... অথচ সেদিনের পর থেকে কথা বলছে না ঠিক করে। অভিও পারছে না স্বাভাবিক হতে। অন্যদের সঙ্গে আজ আর সেদিনের ঝামেলার রেশ সে অর্থে নেই। থাকার কথাও না। অনেকেই জানে কে কেমন। কিন্তু সুজন সেদিনের পর থেকেই আর অভির সঙ্গে আগের মত কথা বলছে না। আজ যে খেলার পরে থেকে গেল, এটাই অনেক মনে হচ্ছে। অথচ একটা সরি বললে মিটে যেত হয়ত। আসলে, অভি এটাও বুঝতে পারছে না, এখন আর সরি বলে কতটা কী পরিবর্তন হবে। ভবিষ্যতে আবার এমন পরিস্থিতি এলে কী করবে অভি? সুজনের জায়গায় অভি থাকলে, কী করত সুজন?

ক্লাসে বিধান বাবু একবার বলেছিলেন, মানুষ ক্ষমা করার বিষয়ে যদি বা সচেতন, কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গে আরোই সংকুচিত হয়ে পড়ে।

চার দিন আগের কথা, স্কুলে সেদিন ক্লাস টেস্ট। প্রথম পিরিয়ড সমর বাবুর... ভূগোল ক্লাস। সেদিন সুজনের আসতে দেরি হল একটু। ওকে দরজার কাছে দেখেই সমর বাবু বলে উঠলেন, 'বাবা সুজন... নদীতে মাছ ধরতে গেছিলে, না সব মাছ বেচে তবে এলে?' ওঁর এভাবে কথা বলার একটা অভ্যেস আছে। রেগে ধমক দেন না, গায় হাত ও তোলেন না। এমনই হাসতে হাসতে কাউকে সকলের কাছে হাসির পাত্র করে তোলেন। সকলে হেসেও ফেলে। তখনকার মত কেউ আর ভাবে না, যে একদিন আগে তাকে নিয়েও এমনই কিছু বলেছিলেন স্যার। বা দুদিন পর বলবেন আবার। সুজন মাথা নিচু করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। স্যার ঢুকতে দিলেন না। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। কিছুক্ষণ সমর বাবু বললেন — এবারে গিয়ে আসন গ্রহণ করো... আর দেখো সঠিক উত্তর ছাড়া আর কী কী মনে পড়ে?

সুজন ঘামছিল, বুকের কাছের দুটো বোতাম খোলা দেখেই মনে হচ্ছিল জোরে সাইকেল চালিয়ে এসেছে। স্যারের থেকে খাতা নিয়ে চুপচাপ অভির দুটো বেঞ্চ পেছনে গিয়ে বসল। তারপর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে নিজের মত লেখার চেষ্টা করল। অভির পাশে বসে অনির্বাণ তখনো মুচকি মুচকি হাসছে। সমর বাবু কাউকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করলে অনির্বাণের খুব আমোদ হয়। অন্য কোনো স্যার কাউকে বকলে বা তাকে নিয়ে হাশাসি করলেও এমনই আমোদ পায় অনির্বাণ। আরো কেউ কেউ মুচকি হেসে তাকাচ্ছিল সুজনের দিকে। দেরিতে এসেছে, আরো দেরিতে পরীক্ষার খাতা পেল। আজকের পরীক্ষাটা তো গেলই, সঙ্গে স্যারের টোন কাটা। ঠিক তখনই একটা কাগজ উড়ে গিয়ে পেছন দিকের বেঞ্চে পড়ল। আর কে কী দেখেছিল জানে না অভি, কিন্তু ও স্পষ্টই দেখল — হঠাৎ জানলা দিয়ে আসা এক ঝলক হাওয়ায় যেন কারো হাত থেকে অসাবধানেই উড়ে গেল পেছন দিকে। আর কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ সমরবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন — ও বাবা! ক্লাস এইটের ইউনিট টেস্ট থেকেই খেপ খেলা শুরু করে দিলে বাবা?

সবাই একসাথে তখন সুজনের দিকে তাকিয়ে। স্যারের দৃষ্টি অনুসরণ করেই চোখে পড়ল — ওর খাতার ঠিক পাশে একটা চিরকুট। বাঁ হাতের কবজির তলায় চাপা পড়ে আছে। বাকিটা আর কাউকে বুঝিয়ে দিতে হয় না। সাধারণ ক্লাস টেস্টের পরীক্ষা। তাতে কেউ টুকে লেখার চেষ্টা করে? সুজন তো অত খারাপও নয় ভূগোলে। দেখার হলে, পাশের ছেলের থেকেও চটজলদি কিছুটা দেখে নেওয়া যায়। কিন্তু তখন, সেই মুহূর্তে আর এত কিছু ভাবার ছিল না। খুব দ্রুতই ব্যাপারটা ঘটে গেল। সমর বাবু এসে সুজনের খাতাটা টেনে নিয়ে নিলেন। তারপর ওই ছোটো চিরকুটটা নিয়ে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। কী লেখাছিল বোঝা গেল না, কিন্তু স্যারের মুখের কৌতুকটা কেটে গিয়ে কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। সত্যি বলতে, সমর বাবুকে ক্লাসে কখনো কেউ এমন রেগে যেতে দেখেনি আগে। রাগটা যেন কয়েক মুহূর্তের চেষ্টায় কিছুটা সংযত করে নিয়েই শান্ত ভাবে জানালেন — অন্যদের পরীক্ষা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা, তারপর সুজনকে হেড স্যারের ঘরে নিয়ে যাবেন।

সুজন এবারও কোনো কথা বলল না। ক্ষমাও চাইল না। চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দেবু পাশ থেকে বলে উঠল, 'স্যার... ওটা সুজনের নয়। উড়ে এসে পড়ল ওখানে।' একথা শুনে সমর বাবুর আর রাগটা চেপে রাখতে পারলেন না। চেঁচিয়ে বললেন, 'একটি চড়ে মুখ বন্ধ করে দেব তোমার। ওকালুতি করা হচ্ছে! জানিস কী লেখা আছে এখানে?... এরা নাকি লেখাপড়া শিখবে! এদের জন্য এত সব ব্যবস্থা!' শেষের দিকের কথাগুলো চেঁচিয়ে বললেন না। বললেন চাপ স্বরে। গজগজ করতে করতে। কিন্তু দেবু দমল না, একই ভাবে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, 'সত্যিই স্যার! উড়ে এসেছে... আমরা দেখেছি। আপনি জিজ্ঞেস করুন। কীরে অভি... বল? ওদিক থেকেই তো উড়ে এলো!'

দেবুর মুখে নিজের নামটা শুনেই বুকের ভেতর ধক করে উঠল অভির। সমর বাবু সরাসরি ওর দিকে তাকালেন। 'এদিক থেকে উড়ে গেছে? দেখেছিস?... সত্যি কথা বলবি!' অভি কেমন চুপ করে গেল প্রশ্নটা শুনে। তখন ক্লাসের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে। কাগজটায় এমনই সাংঘাতিক কিছু আছে, যা সমর বাবুর মত মানুষকে এমন ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। এটা ভেবেই অভির বুক শুকিয়ে গেল। ঠিক কোথা থেকে উড়ে গেছে ও খেয়াল করেনি। আচমকাই একটা কাগজ মনে হল উড়ে পেছন দিকে চলে গেল। কয়েক সেকন্ডের ব্যাপার। অথচ হ্যাঁ বলা মানে ও দেখেছে, এবং ওকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করা হবে। অভি বলে ফেলল, 'ঠিক খেয়াল করি নি স্যার। হতে পারে।' এতটা মেপে উত্তর দিতে পারে... ওর নিজেরই ধারণা ছিল না। নিজেরই কানে কেমন লাগল উত্তরটা। একটা সরল স্পষ্ট হ্যাঁ-এর বদলে কেমন অদ্ভুত একটা উত্তর। আর সঙ্গে সঙ্গে সেকন্ড বেঞ্চে বসে থাকা অর্পণ চেঁচিয়ে বলে উঠল, 'না স্যার, কিছুই উড়ে যায়নি।' অভি এবারেও বলতে পারল না কিছু। সমর বাবু তখনও ওর দিকে তাকিয়ে। ও মাথা নিচু করে রইল, সুজনেরই মত।

সুজনের সঙ্গে হেড স্যারের ঘরে কী কথা হল ওরা জানে না। কাগজে কী লেখা ছিল সেই নিয়েও সমর বাবু কিছু জানালেন না। সুজনও কাউকে কিচ্ছু বলল না পরে। অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিল, অনেকবার। কিন্তু উত্তর পায়নি। শুধু জানল। সুজনকে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখে আনতে হবে বাড়ি থেকে সই করিয়ে। এক সপ্তাহর জন্য ক্লাস করতে পারবে না, ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন। চিরকুট নিয়ে ক্লাস টেস্টে বসার জন্য এমন শাস্তি হতে পারে কখনো?

স্যার চলে যাওয়ার পরেই একটা কথা কাটাকাটি শুরু হল দেবুর সঙ্গে, অভির সত্যি গোপন করা নিয়ে। কিন্তু ব্যাপারটা বেশি দূর এগলো না, বাংলার স্যার অমিয় বাবু ক্লাসে চলে এলেন বলে। এরপর টিফিন ব্রেকে আবার কথা উঠল, ছুটির পর আবার। দেবু একা নয়, সুজনের পাশে বসে অনেকেই একসাথে অভিকে মিথ্যেবাদী বলল, বিভিন্ন ভাবে। দু-চারটে খারাপ কথাও বলল। অভিও নিজের হয়ে অনেক কিছুই বলল, হাতাহাতিও হতে পারত... সুজনের জন্যই হল না। সুজন নিজেই ঝামেলা চাইছে না দেখে, অন্যরা একটু দমে গেল। আসলে, সকালের পর থেকে যে স্যারই আসছে, মাঝে মাঝে সুজনকে লক্ষ করছিলেন, অথবা জিজ্ঞেস করেছেন — 'কী রে? এইসব শিখছিস?' , তাই সুজন এরপর যে ঘটনাতেই জড়াত, ফল খারাপই হত।

অভি জানে, ওদের সঙ্গে কিছু ঝামেলা হলে ওরা ঠিক কী ভাবে কোন ভাষায় কথা বলতে পারে। কখনো বিরোধীতা হয়নি বলেই এসব আগে শুনতে হয়নি। অথচ ওরা সুজনের জন্য একসাথেই যা বলার বলল। অভির হয়ে ওর পাশে বসা ছেলেরা কেউই কিছু বলল না। যে যার মত চলে গেছে। মনে হচ্ছিল, এই সব কিছুই আসলে অভির প্রাপ্য। সুজন যদি শাস্তি পায়, তাহলে এটুকু অভিকেও সয়ে যেতে হবে।

অভি বুঝতে পারছিল না, মিথ্যেটা বলল কেন... শুধুই নিজেকে বাঁচাতে?

এর পরের দিন থেকেই সুজন সাসপেন্ডেড হয়ে গেল। আর দেবু, মানস, ওদের সঙ্গে বিকেলে নদীর চরে অভির খেলতে যাওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেল। চার দিন হয়ে গেছে, সুজন স্কুলে যায়নি আর। আর অভিও নদীর চরে যায়নি। আজ হঠাৎই এলো টোটো করে, সাইকেল করে নিয়ে আসার কেউ নেই। এসে দেখল অন্যরা যে যার মত খেলছে। সুজনও এসেছে খেলতে। এদের একটা বড়ো গুণ, এরা এক-দুদিন আগের সব কিছু পেছনে ফেলে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। এক বেলা মারপিট করে, পরের বেলা একসাথে সাইকেল করে চলে যেতে পারে পুকুরে মাছ ধরতে। অভি পারে না, মাঝে মাঝে বুঝতে পারে — অভি এদের মতও না, অনির্বাণদের মতও না। কারো দলেই ওকে নিজেদের মত করে না কেউ।

অভির ওদের সঙ্গে গিয়ে খেলতে ইচ্ছে হল না। একটু দূরেই বসল। চেষ্টা করল ওদের দিকে না তাকাতে, অন্যদিকে তাকিয়ে বসল। তাও ওরা দেখল। কিছুক্ষণ পরে ছুটে এসে খেলতে ডাকল। অভি না বলতেও হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। বেশ জোরেই টানল। হাতে লেগে গেল। অভি মেনে নিলেও, খেলায় মন বসল না। খেললে মনটা হালকা হয়, কিন্তু সুজনের চোখের দিকে তাকালেই অস্বস্তি হচ্ছিল। 'সরি'টা কার কাকে বলা উচিৎ — এসব চিন্তা মাথায় চলে আসছিল।

খেলার পরে অন্যরা একে একে চলে গেলেও অভি একটু বসে রইল। ওকে বসে থাকতে দেখে সুজনও ফিরে এলো আবার চরে। দুজনে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর অভিই নিজের মত করে চেষ্টা করছিল কথা বলার। কিন্তু মূল প্রসঙ্গে আসতে পারল না। সুজনের সাসপেন্ড হওয়ার জন্য পুরো দোষটাই ওর নিজের। কিন্তু কী জিজ্ঞেস করবে ওকে... কাগজে কী লেখা ছিল জানতে চাইবে? জিজ্ঞেস করবে হেড স্যার ওর বাবাকে ডেকেছিল কি না? সান্ত্বনাই বা কেমন করে দেবে? অপেক্ষা করছিল সুজন প্রসঙ্গ তুলুক, রাগে ফেটে পড়ুক... কিন্তু সুজন একটা কথাও বলল না। নদীর দু'পাড়ে অন্ধকার নেমে আসতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল, 'আজ তোদের পাড়া অবধি যেতে পারব না। গাজনতলা হয়ে ঘুরে যাব। কাজ আছে।'

সারা রাস্তা সাহস করতে করতে গাজনতলার মাঠে সাইকেল থেকে নেমে অভি পিছু ডাকল, 'শোন'।
সুজন ওর দিকে তাকাল প্যাডেল থেকে পা নামিয়ে।
'আমি দেখেছিলাম, কাগজটা হাওয়ায় উড়ে গেছিল তোর দিকে। আমি বলব স্যারকে।'
ওর দিকে তাকিয়ে হাসল সুজন। তারপর অদ্ভুৎ একটা কথা বলল — 'মানুষ যা দেখতে চায়, তা-ই দেখে। বুঝলি?'
সুজন চলে গেলে অন্ধকার রাস্তার দিকে। ওদিকে সরু রাস্তা... শুধু টোটো চলে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে অন্যদিকে চলে গেছে অন্ধকার পথ। পঞ্চায়েৎ ভোটের আগে আলোগুলো সারাতে আসবে আবার।

বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দরজার কাছে বাবার মোটরবাইকটা দেখতে পেল অভি। 'বাবা আজ বাড়িতে এসেছে!'... মনে মনে যেন এটাই চাইছিল অভি।
ওর বাবা দুর্গাপুরে কাজ করেন। শুক্রবার রাতে আসেন, সোমবার সকালে চলে যান। কিন্তু মাঝে মাঝে কোনো কারণে সপ্তাহের মাঝে চলে আসেন হঠাৎই।
এ কদিন বাড়িতে একটু চুপচাপই কাটিয়ে দিয়েছে, মায়ের সঙ্গে স্কুলের বিষয়ে কোনো কথাই বলেনি। কিন্তু আজ, সুজনকে দেখে আরো বেশি করে কষ্টটা ফিরে এলো। কদিন পর সাসপেনশন শেষ হবে, কিন্তু সুজনকে যে চোখে সমর বাবু দেখেন, যে চোখে হেড স্যার দেখেলেন... সেই চেনাটা বদলাবে না।

মা-কে আড়াল করে বাবার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করল। বাবা-ই পারে হেল্প করতে। মা পছন্দ করে না ওদের। ছোটোবেলা থেকেই মা শেখাত, ভালো কিছু করতে হবে, অনেক বড়ো হতে হবে। বড়ো হয়ে কী হবে, কথায় কথায় জিজ্ঞেস করত বড়োরা... এখনো করে। মা শিখিয়ে দিয়েছিল — বলবে ডাক্তার হব, গরীব মানুষের চিকিৎসা করব, আর্তের সেবা করব। স্বামীজীর কথা স্মরণ করবে। মায়ের শেখানো কথা এত গুছিয়ে বলতে পারত না। সবাই শুনতেও চায় না। ডাক্তার হবে শুনেই 'ও আচ্ছা' বলে হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। কেউ কেউ বলে 'বাহ!'। কিন্তু এখন অভি স্পষ্টই বুঝতে পারে, ও ডাক্তার হতে চায় না। ও ঠিক কী করলে ওর মা খুশি হবে, বুঝতে পারে না। জিজ্ঞেসও করে না। মনে হয়, ও যা করত্তে ভালোবাসে... তার কিছুই খুব বড়ো কিছু না। সেসব করে মায়ের ইচ্ছে মত অনেক বড়ো হওয়া যাবে না। নাটকে অভিনয় করা, অথবা জায়গায় জায়গায় ঘোরা... এসব ইচ্ছের কথা বলার সাহসই নেই অভির। মা'র কথাগুলো মনে পড়ে, 'বাবা অনেক কষ্ট করে সব কিছু করেছে... ভুলে যেও না।'

অভির বাবার কাছে মাঝে মাঝেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওর মা, 'এইসব ছেলেদের সঙ্গে মিশছে... কী শিখছে, কী করবে কে জানে। এদের আর কী, এই তো সব ফ্যামিলির অবস্থা! তুমিও থাকো না, আমিও একা সবসময়ে পাহারা দিতে পারছি না... ছেলেটার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে।'

অভি বুঝতে পারে না, মায়ের এত অপছন্দ কেন। মা কেন 'সঙ্গ দোষ' কথাটা বার বার বলে। মায়ের কথা শোনে, ক্লাসে তাদের সঙ্গেই বসে, মেশার চেষ্টা করে... যারা নিয়মিত ক্লাসে পড়া করে আসে, পরীক্ষায় বেশি নম্বর পায়। অথচ ওরা কেবল নিজের পড়া আর নিজের ভালো নিয়েই থাকে। সবার সঙ্গে মেশে না। নদীর চরে আসে না। আরো অনেক কিছু করে না, করতে চায় না... যা অভির ভালো লাগে। কেমন যেন স্বার্থপর। ওদের ঠিক বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি অভি। আর এই অসিত, দেবু, সুজন... এরা সব ক্লাসে পেছন দিকে বসে। ক্লাসের ভালো ছেলে নয় ওরা। এই কারণেই মা ওদের পছন্দ করে না। অভি বুঝতে পারে না কী করবে। ওর ক্লাসের ভালো ছেলেদের মত হতে ওর ইচ্ছেও করে না।

বাবা, কিছু হতে বলে না। মাঝে মাঝে চুপ করে কথা শোনে। বাবা অত সময়ও দিতে পারে না। কিন্ত তাও পাশে এসে বসে। ছুটি পেলে নদীর চরে, ব্রিজের ওপারের ঝিলে নিয়ে যায়। বাবার সঙ্গে তখন যেসব কথা হয়, মায়ের সঙ্গে হয় না। হবেও না কোনোদিন। বাবা কোনো কিছু হতে বলে না। কিছু করতেও বলে না। জিজ্ঞেস করে কিছু কথা, যেগুলো অভির শুধু বাবাকেই বলতে ইচ্ছে করে। তারপর বাবা শোনে, চুপচাপ অনেক কথা শোনে। কিছু কথা বলে... তারপর আবার শোনে।

মানুষ যা দেখতে চায়

কারেন্ট চলেযেতে যখন ছাদে গিয়ে বসেছিল বাবা, তখন অভির মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। রুটি সেঁকছেন। সেই ফাঁকেই ছাদে চলে এলো অভি। অন্ধকার ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আসতে আসতে বাবার দিকে এসে দাঁড়াল, ছাদের পাঁচিল ধরে... গাজনতলার মাঠের দিক থেকে তখন ডিজে গানের সুর ভেসে আসছে। কোনো বিয়ে বাড়ি আছে। ওকে এভাবে ছাদে আসতে দেখে সিগারেটটা হাতের আড়ালে নিয়ে ওর বাবা জিজ্ঞেস করলেন — কিছু বলবি? পরীক্ষা কেমন হল?

বাবাকেই সাহস করে বলে ফেলল সেদিনের কথাগুলো অভি। একদিন বাড়িতে কাউকে বলেনি, আজ বলে ফেলল। বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। অভির বাবা একবার আসতে নিজের হাতটা ওর কাঁধে রাখলেন, কান্না থামাতে বললেন না। কিছুক্ষণ পর বললেন, 'সমর বাবুর বাড়ি গির্জা পাড়ার ওদিকে... না?'
আর তখনই দূরে আকাশে আতসবাজির আলো ছড়িয়ে গেল। বরযাত্রী পৌঁছে গেছে বিয়েবাড়িতে।

পরদিন কাক ভোরে দুজনে মর্নিং ওয়াক করতে বেরলো অনেকদিন পর।
সমর বাবু এত ভোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে একটু বিরক্ত হয়েই চোখে-মুখে অসন্তোষ নিয়ে দরজা খুললেন। চোখে চশমা নেই। ভুরু কুঁচকে ঠাওর করে দেখলেন একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে, সৌজন্যের হাসি। আর তার হাত ধরে তাঁর স্কুলের ছাত্র অভি।
একই রকম হাসি। একই রকম মুখের আদল।

সমরবাবু ঘুম ভাঙা কণ্ঠস্বর নিয়ে বললেন, 'এত সকালে?'
অভির সঙ্গে থাকা ভদ্রলোককে দেখে আন্দাজ করেছিলেন, কে হতে পারেন। ওঁর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন উত্তরের প্রত্যাশায়। কোনো অভিভাবকের এত সাতসকালে বাড়িতে আসা, আর যাই হোক, স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
অভির বাবা হাত জোর করে সুপ্রভাত জানালানে, তারপর বিনয়ের হাসি নিয়ে বললেন —
'আপনার দু মিনিট সময় নিতাম স্যার। অভি একটা কথা আপনাকে জানাতে পারেনি... কিন্তু জানানো খুব প্রয়োজন।'
সমরবাবু কিছু বুঝতে না পেরে অভির দিকে তাকালেন। অভি এক বাবার দিকে তাকিয়ে দেখল, বাবার চোখে আশ্বস্ত করা দৃঢ়তা। তারপর সমরবাবুর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল — 'ওই কাগজটা সুজনের ছিল না স্যার।'

পুরোপুরি কলকাতার মানুষ হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস এখন ব্যাঙ্গালোর বা ব্যাঙ্গালুরু। কলকাতারই কলেজ থেকে বি টেক পাশ করে এখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মী। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই মাঝে মধ্যে একটু লেখা আর সময় সুযোগ হ'লে ব্যাগ গুছিয়ে কাছে-দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়া, এই নিয়েই জয়দীপ। সেই সব বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম অভিজ্ঞতা ছোটদের কাছে বলার ইচ্ছে বহুদিন। সেই ইচ্ছাপূরণ করতেই ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কলম ধরা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা