আগের পর্বঃঊদেয়ার রাজাদের দেশ - মহিশূর-পর্ব ২
শ্রীরঙ্গপটনার সেই ‘গেটওয়ে’ পার করে খানিকটা এগোতেই রাস্তের দু’দিকের কিছু সাইনবোর্ড বুঝিয়ে দিলো সেই ঐতিহাসিক শহরে ঢুকে পড়েছি। মাইসোর সেখান থেকে আরও খানিকটা দূর। একটা জায়গা দেখলুম হাইওয়ে থেকে একটা রাস্তা বাঁদিকে ঢুকে গেছে... আর তার ঠিক উলটো দিকে... এরকমই একটা রাস্তা হাইওয়ে থেকে ভেতরে চলে গেছে। মানে, ঠিক এই জায়গা থেকে শ্রীরঙ্গপাটনা ঘুরে দেখার শুরু। পর্যটকদের সুবিধের জন্য সেই বাঁকের কাছে হলুদ সাইনবোর্ডে এক এক করে সব জায়গার নাম, যা যা আকর্ষণ করতে পারে। এবং একটা ম্যাপ, যা দেখে বোঝা যায় ঠিক কোথায় কি আছে। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলুম, কোনদিকটা আগে দেখলে সুবিধে হয় – রাস্তার এইদিক না ওইদিক? সে রীতিমত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে দিলো “লেফ্ট সে হি দেখনা সাব... রাইট সে মাইসোর শর্টকাট... যা না জলদি হোতা।” আমারও হাতে চিরকুট ছিল একটা, কি কি দেখব সব লিখে রেখেছিলাম, সেটা ব্যাগ থেকে বার করে হাতে নিয়ে হলুদ সাইনবোর্ডে লেখা নামগুলোর সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করলুম, কিছু নাম মিললো বটে... বাকি যা কিছু, হয় উলটো দিকের রাস্তায়, না হ’লে খুঁজে দেখতে হবে, ঠিক যে কারণে গাড়ি নিয়ে বেরোনো। মহেশকে বললুম, একদম শেষ যে দেখার জায়গা, মানে এই রাস্তা ধরে সব থেকে ভেতরে, সেখানে আগে যেতে... ভেতর থেকে একটা একটা করে দেখতে দেখতে বাইরের দিকে আসব। সে এক কথায় স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বাঁদিকের রাস্তায় নিয়ে নিলো, হাসতে হাসতে বলল – “সব দেখনা সাব...” আমিও চিরকুটের দিকে তাকিয়ে বললুম... যা দেখতে এসেছি, তা না দেখে তোমাকে ছাড়ছিও না।
শনিবার বলেই হয়ত রাস্তায় একটু ভিড় বেশি ছিল... এদিক ওদিক ট্যুরিস্ট বাস চোখে পড়ছিল, তার মানে সামনে সত্যিই দেখার মত নিদর্শন রয়েছে, যেখানে পর্যটকদের সময় কাটবে... আর তার সঙ্গে টাটা সুমো বা টেম্পো ট্র্যাভেলারের মত গাড়িও চোখে পড়ল কিছু। তাদের কাটিয়ে কাটিয়ে আমাদের গাড়ি ওই রাস্তা ধরে ভেতর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল... রাস্তার দু’ধারে চোখ রেখে দেখলাম দু’টো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পার করে গেলাম – টিপুর গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, আর স্মৃতিসৌধ। সেই সব পেরিয়ে এক জায়গায় এসে রাস্তা বেশ এবড়োখেবড়ো হয়ে উঠল, পিচ নেই শুধু খোয়া। তারপর সেই রাস্তাও এক জায়গায় গিয়ে দু ভাগ হয়েছে... হলুদ সাইনবোর্ড বলছে এক রাস্তায় সঙ্গম আর অপর রাস্তায় গঞ্জম।
সঙ্গম হ’ল সেই জায়গা, যেখানে স্থানীয় তিন নদী – কাবেরী, কাবিনী এবং হেমাবতী মিলিত হয়েছে। আর সেই নদীর পারেই গঞ্জম বলে একটা ছোট্ট গ্রামে নিমিশাম্বা নামে এক দেবীর মন্দির। সেই মন্দির খুব একটা দেখার মত কিছু নয়, ভাস্কর্য নেই বা কোনও প্রাচীন গল্পও তার সাথে জুড়ে আছে কি না তা স্থানীয় কারও কাছ থেকে জানতে পারলাম না।
শুধু এক মস্ত গোপুরাম (দক্ষিণভারতীয় মন্দিরের প্রবেশ দ্বার) যার অনেকটাই সোনালী রঙ করা, দেখে মনে হয়ে সোনা দিয়ে মোড়া। এক সময় দক্ষিণ ভারতে মন্দিরের এতটাই প্রাচুর্য ছিল, যে সত্যিই সব মন্দিরের তোরণ আর মন্দিরের চূড়ো সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হ’ত। তবে সেসব কিছুই অস্তমিত সূর্য, এখন কেবল এই সোনালী রঙ আর নাহলে সোনালী পাত... আসল সোনা নয়... অন্ততঃ এইসব ছোটখাটো মন্দিরে তো কোনও মতেই নয়! মহেশ আমাকে বলেছিল, খুব জাগ্রত দেবী (আমাদের পরিচিত মা দূর্গার মত), ভেতরে গিয়ে পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে আসতে। শনিবারের সকালে মন্দিরে ওই শরনাগতদের ভিড় আর পুজোর লম্বা লাইন দেখেই টের পাচ্ছিলাম জাগ্রত কতটা... তবে একই সঙ্গে সেই লম্বা লাইনই আমার কাছে জুজু হয়ে গেল... বেড়াতে বেরিয়ে সকাল সকাল ওই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পুণ্যি অর্জন করার মত ধৈর্য আর ভক্তি কোনওটাই আমার নেই। মন্দিরের সামনে একটা ঘাট, সেখান স্নান করে সব কাবেরী নদীর জলে পুর্ণপাত্র করে মন্দিরে যাচ্ছিল ভিজে কাপড়েই। আর পাঁচটা মন্দিরের মত সেখানেও নদীর পারে ক্ষৌরকর্ম করার জন্য কিছু নাপিত চোখে পড়ল, লাল-কমলা সুতো, ধূপ আর ফুল বিক্রি করছিল স্থানীয় মহিলারা... সবার কপালে আড়াআড়ি চন্দনের তিলক বেশ মোটা করে আঁকা। রীতিমত তীর্থক্ষেত্র! নদীর ঘাটে একে একে লোক আসছে, কেউ একা কেউ সপরিবার। ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কাবেরীর জলে ডুব দিচ্ছে আর ভিজে কাপড়ে সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ হাতজোর করে চোখ বন্ধ করে প্রণাম করে নিচ্ছে, কেউ নাক-কান মলে ওঠ-বোস করে নিচ্ছে। এই নাক-কান মলে ওঠ-বোস করা অথবা একজায়গায় দাঁড়িয়ে আট-দশটা পাক খেয়ে নেওয়াটাও দক্ষিণ ভারতের এক প্রচলিত প্রথা, মন্দিরে আরাধ্য দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে লোকজনকে এমন করতে প্রায়েই দেখা যায়। তোমাদের যদি এই প্রথার কথা শুনে হাসিও পায়, হেসো না। এ মানুষের সরল বিশ্বাস, যার সুযোগ কতভাবে কত জায়গা যে নেওয়া হয় তার ঠিক নেই।
সেই নদীর ঘাটেই একটা আলাদা করে অল্পভিড়ের সিঁড়ি খুঁজে জলে পা ডুবিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলুম। মন্দিরটা বাদ দিলেও জায়গাটা বেশ সুন্দর... ছোট ছোট পাথুরে টিলা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে... এমনকি নদীর মাঝেও ছোট ছোট দ্বীপের মত পাথর মাথা উঁচিয়ে রেখেছে। আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে, কিংবা নীল আকাশে ভাসা ভাসা হালকা মেঘ থাকলে সেই নদীর জল আরও চমৎকার লাগে। স্বচ্ছ জলে কাছাকাছি একদম স্পষ্ট জলের তলায় পাথুরে জমি আর ঘুরে বেড়ানো ছোট ছোট মাছ চোখে পড়ে। সেদিন যখন ওই ঘাটে বসেছিলাম, জলে পা ডুবিয়ে – মেঘ ভাঙা রোদ্দুর ঝলমল করছিলো নদীর জলে। আকাশের নীল মেখে নদীর জলও অদ্ভুত নীল হয়ে থাকে, বোঝা যায় দূষণ এখনও ছোঁয়েনি এইসব অঞ্চলকে সেই ভাবে।
গোল গোল নৌকা করে লোকে নদী পার হয়ে প্রয়োজন হ’লে। এই গোল নৌকা আমাদের দেশে দক্ষিণ ভারতে এলেই দেখা যায়। কেরালা, কর্ণাটক আর তামিলনাড়ুতে খুব দেখা যায়। কাঠ আর বেত দিয়ে তৈরী এই ছোট আর মাঝারি মাপের গোল নৌকাগুলো। ইংরেজীতে এদের বলে কোরাক্ল (Coracle); আর এই কর্ণাটকের স্থানীয় ভাষায় কোথাও বলা হয় হারিগোলু, আবার কোথাও বলা হয় টেপ্পা... অন্য কোনও অঞ্চলে আরও কত নামে একে ডাকা হয়... তার ঠিক আছে? তবে এই মন্দিরের সামনে জল দেখলে মনে হয় হেঁটেই নদী পার হয়ে যাওয়া যায়, স্রোত আছে তবে অল্পই। কিন্তু পাথুরে জায়গা, পাথরের ওপর দিয়েই নদী বয়ে চল দ্রুত। তাই পার হতে গিয়ে কেউ পড়ে গেলে সেই পাথরে জোরালো চোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। তাই খুব অভ্যস্থ না হ’লে কেউ হেঁটে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করবে না। জলের তলায় কোথায় কি আছে, তা কি বলা যায়!
ওই ঘাটের সিঁড়িতে ঠিক কতক্ষণ বসেছিলাম খেয়াল নেই... তবে উঠে যখন ফিরছি, ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা বাজে। আর আসার সময় মন্দিরের সামনেটা যে কাঠের তক্তাগুলো ফাঁকা ফাঁকা দেখেছিলাম, এখন সেখানে একেবারে মেলা বসে গেছে। ফুল ফল মালা, পুজোর যাবতীয় সামগ্রী, প্লাস্টিকের খেলনা, দেবদেবীর ছবি, কাঠের তৈরী রান্নার সরঞ্জাম... কি নেই! অবিশ্যি লোকজনের যে সে সব পসরা কেনার খুব আগ্রহ তাও দেখলাম না। পুজোর সামগ্রী আর নারকেল কেনার ভিড় বেশি। এ ছাড়া দু-তিনজন মহিলা কোনও কোনও দোকানের সামনে রঙচঙে পাথরের মালাগুলো দেখছিল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। যারা কাঠের বা পাথরের জিনিসপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল, তাদের দেখেই বোঝা যায়, আমার মতই পর্যটক এবং তাদের কাছে এইসব জিনিস ‘লোকাল মার্চেন্ডাইজ’।
সেইসব কাটিয়ে রাস্তার সামনে এসে দেখলাম মহেশ একধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অন্য এক ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করছে। আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে কানাডা ভাষায় তাকে কিছু বলে মাথা নাড়তে নাড়তে গাড়িতে বসে পড়ল। গাড়িতে বসতে আমাকে জিজ্ঞেস করল “ক্যায়া সাব, সব কিছু আচ্ছা?” মন্দিরের ভেতরে ভিড় ছিল কি না, দর্শন হ’ল কি না এইসব এক এক করে জানতে চাইল। ওকে স্পষ্ট বললুম, মন্দিরে পুজোর এত লম্বা লাইন, আমার দ্বারা ঐ লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে যাওয়া কষ্টকর, নদীর ঘাটে বসেছিলাম... দিব্যি লাগল সেখানে বসে থাকতে। মন্দিরে ঢুকিনি শুনে চুপ করে গেল, আমিও আর কথা বাড়ালাম না এই নিয়ে। ফেরার পথেও আবার সেই মোড় এলো, যার একদিকে গঞ্জম আর একদিক সঙ্গম। সঙ্গম দেখতে যাওয়ার কথা বলতে মহেশ বলল, “আভি ওয়াটার কম সার... যানা আনা টাইম ওয়েস্ট... আধা ঘণ্টা আপ ডাউন।” ওই মোড়ের কাছেই ব্রেক কষে অপেক্ষা করল, আমি কি বলি শোনার জন্য। বাস্তবিক, জল কম থাকলে অতটা ভেতরে গিয়ে বিশেষ কিছুই দেখার থাকে না, আর এর জন্য অন্য কোনও জায়গা দেখতে না পারলেও আফসোস হবে। আমি বললুম এগিয়ে যেতে... তিন নদীর সঙ্গম ওই যাত্রায় আর দেখা হ’ল না। সামনে অপেক্ষা করছিল দু’টো খুব গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন... টিপু সুলতান আর হায়দার আলির সমাধি (যাকে স্থানীয় লোকে বলে গুম্বাজ); আর দরিয়া দৌলতাবাগ (টিপু’র গ্রীষ্মকালীন বিলাসভবন)।
(ক্রমশ)
ছবিঃ জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়