“এরকম ছবি কারা তোলে?... কি রকম ক্যামেরা দিয়ে এইসিব ছবি তোলে?... কোন দেশে এরকম দেখা যায়?...” এক কালে, গ্রীষ্মের দুপুরগুলো এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই কেটে যেত। যদিও তার বহু আগে ছাত্রজীবনকে বিদায় জানানো হয়ে গেছে, তবু তখন আমার গ্রীষ্মের ছুটি। খড়গপুরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় অযাচিত ভাবেই জীবনে গ্রীষ্মের ছুটি আবার ফিরে এসেছিল। বিদ্যালয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লে ছাত্রদের সাথে শিক্ষকদেরও এক মাসের অব্যাহতি। আমার বাসস্থান ওই স্কুলের কাছেই ছিল। আর ওই ছোট একতলা বাড়ির বারান্দা থেকেই একটা প্রকাণ্ড মাঠ দেখা যেত। গ্রীষ্মের সকালে বা বিকেলে বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখতে পেতাম আমার কোনও না কোনও ছাত্র সেখানে হুটো-পাটি করে খেলছে। তাদের খেলার মধ্যে কৈশোরের উল্লাস দূর থেকে উপভোগ করতে বেশ লাগত। শিক্ষকের অনাহুত উপস্থিতি তাদের পাছে বিব্রত করে, তাই সামনে গিয়ে তাদের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাতাম না। তবে সেই খেলার মাঠে যে ছেলেটিকে একেবারেই দেখা যেত না, সে হ’ল বিমল। যে স্কুলে পড়াতাম, সেই স্কুলেরই ছাত্র ছিল বিমল পাত্র। কোনও বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা অসাধারণ মেধার জন্য এত বছর পরও তার নাম স্মরণে আছে, এমন ভাবলে ভুল হবে। বিমল ছিল পেছনের সারিতে বসা অতি সাধারণ মানের ছাত্র। তার চেহারা, বাচনভঙ্গি বা পড়াশুনোয় অমনোযোগিতা দেখে বোঝা যেত যে সে স্কুলের গণ্ডি পার হলেই তার পরিবার উদ্ধার হয়ে যাবে।
সেই ছেলেটি প্রায়ই কামাই করত। প্রায় তিন-চার দিন পর ক্লাসে এসে বলত “জ্বর হয়েছে”। প্রথম প্রথম এরকম হ’তে দেখে বেশ বিরক্ত লাগত। সেই সময়, গ্রাম বাংলায় বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষালাভ করার সামর্থ্য সকলের থাকত না। আর যারা স্কুলে যেত তারা মনোযোগ দিয়েই স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার চেষ্টা করত। বিমলের মধ্যে বিদ্যা-শিক্ষার প্রতি এহেন অবহেলা বড়ই অসন্তোষজনক ছিল। সহকর্মীদের বলতে তাঁরা বললেন “সব বাঁদর ছেলেপিলে... স্কুলের বদনাম... ঘার ধরে বেড় করে দেবে... ঠেঙ্গিয়ে ঠিক করে দেওয়া উচিৎ।” আপাত ভাবে প্রথম ভাগের রাখালের সাথে বিমলের সাদৃশ্য দেখা যেত। কিন্তু বিমল ক্লাসে বিশেষ চপলতা করত না। এমন কি খেলার মাঠেও তার দেখা মিলত না। আর পাঁচজন অভিজ্ঞ সহকর্মীর পরামর্শ মত তার সাথে কঠিন হওয়ার চেষ্টা করলাম। লঘুদণ্ড, কিঞ্চিৎ প্রহার বা স্কুল থেকে বেড় করে দেওয়ার আস্ফালনেও তার মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করলাম না। যত দিন যেতে লাগল সেই অতি সাধারণ বালকের প্রগলভতা যেন হঠকারিতার রূপ নিয়ে মাথায় শেলের মত বিঁধতে লাগত। কেবলই মনে হ’তে লাগল এই ছেলেটির অদ্ভুত ব্যবহারের পেছনে কোনও নির্দিষ্ট কারণ আছে। সেই কারণ জানার কৌতূহল এযাবৎ কেউ দেখায়নি। সেই কৌতূহল প্রকাশের ধৃষ্টতা আমিই দেখালাম।
যে সব ছেলেরা বিকেলে মাঠে খেলত, তাদেরই ক’জন কে ধরে আলাদা ভাবে জানতে পারলাম বিমলের খবর। বিমলের বাড়ি ঠিক কোথায় কেউই বলতে পারল না। তবে সেই খেলার মাঠ থেকে দু’মাইল দক্ষিণে সবেদাবাগান বলে এক অঞ্চলে বিমল থাকে। আরও জানলাম, বিমলের বাবার একটা চায়ের দোকান আছে, বিমলকে সেখানে পাওয়া যেতে পারে। এর বেশি খবর কেউ দিতে পারল না। এর পরের রবিবারই সবেদাবাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। পথের ধারে কোনও চায়ের দোকান, বা গুমটি চোখে পড়তেই খেয়াল করছিলাম বিমলকে পাওয়া যায় কি না। কিন্তু তাকে দেখা গেল না। গোটা সবেদাবাগান অঞ্চলের চক্কর দিয়েও বিমলের দর্শন পেলাম না। এরপর আরও দু’দিন সাইকেল করে গেলাম ওই দিকে। দু-তিন দিন এভাবে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন বিমলকে দেখা গেল। তখন সকাল সাড়ে সাতটা হ’বে, সেদিনও আমি সাইকেল করেই গেছি। দেখি আমার সামনে রাস্তা দিয়ে একটি ছেলে কাঁধে বাঁশের লাঠি বয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সেই লাঠির দু’ধারে দু’টো টিনের পাত্র ঝুলছে। সেই ওজনের ভারে ছেলেটি সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু সেই ভাবেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। সাইকেলের গতি বাড়িয়ে সেই ছেলেটির সামনে যেতেই দেখলাম সে বিমল। আমাকে হঠাৎ সম্মুখে দেখা সে থমকে দাঁড়াল। কাঁধ থেকে বাঁশটা ফেলে দিল। টিনের পাত্র দু’টো ধাতব শব্দ করে রাস্তার ওপর পড়ল। ছলকে পড়া জলের ধারা, মেঠো পথ সিক্ত করে রাস্তার পাশের ডোবার দিকে এগিয়ে চলল। আমরা দু’জনে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলাম, কিন্তু কেউ কিছু বললাম না। অবশেষে আমার মুখে হাসির রেখা দেখে সেও সামান্য হেসে পুনরায় তার গুরুভার বহন করে এগিয়ে চলল। আমি ধীর গতিতে সাইকেল চালিয়ে তার সাথে তাল রেখে এগিয়ে চললাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম – “তুই কি রোজই সকালে জল দিতে যাস?”। সে কেবল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
--- “আর তাই বুঝি স্কুলে যেতে দেরি হয়?” এই প্রশ্নের আর কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
--- “তোদের বাড়ি কোথায়?”
--- “সামনেই”
--- “কে কে আছেন?”
--- “মা আর আমি”
--- “বাবা?”
--- “নেই... গত বছর, মারা গেছেন।”
--- “তাহলে চায়ের দোকান?”
চায়ের দোকানের কথা শুনে সে থমকে দাঁড়াল, আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার চলতে শুরু করল। আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করতে বলল “মা বসে... আমিও থাকি... যতক্ষণ পারি।” তারপর আমাকে প্রশ্ন করল “আপনি এ পাড়ায় হঠাৎ?” আমি সরাসরি বললাম “তোর খোঁজ নিতে।” বিমল হা হা করে হেসে ফেলল। টিন থেকে জল ছলকে পড়ল আবার। বিমলকে আবার জিজ্ঞেস করলাম “তোদের বাড়ি কত দূর?”। সে এড়িয়ে গিয়ে বলল “এখন আমি ঘরে যাচ্ছি না... জল দিতে যাচ্ছি।” তারপর আর আমার কোনও বক্তব্যের অপেক্ষা না করে রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে গেল। আমার আর ওর পেছন পেছন যেতে ইচ্ছে করল না। ততক্ষণে বিমলের দেরিতে স্কুলে আসা, পড়াশুনোয় অমনোযোগ, প্রভৃতি রাখালবৎ আচরণের কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। কারণ না জেনে ছেলেটিকে তিরস্কার করার জন্য একটা আত্মগ্লানি মনকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল। ঘরে ফিরে স্নান করার পরেও সেই গ্লানি দূর হ’ল না। বিমল সেদিন আর স্কুলে এলো না।
এর দু’দিন পর বিমল আবার স্কুলে এলো। সেদিনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমি আর ওকে বিব্রত করলাম না। স্কুল ছুটি হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই সাইকেল নিয়ে মাঠের পাশে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম বিমল আপন মনে চলতে চলতে সবেদাবাগানের দিকে যাচ্ছে। সন্তর্পণে তার পিছু নিলাম। বেশ খানিকটা দূর থেকে তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলাম। মিনিট কুড়ি হাঁটার পরে সে পথে ধারে একটি গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। সেই গলিরই একটা ছোট্ট টিনের চালওলা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে সে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাস্তার ধারে সাইকেল দাঁড় করিয়ে সেই হতশ্রী গলির ভেতর প্রবেশ করলাম। সেই দরজার কাছে এসে দেখলাম, তার পাশে একটা জানালা, সেই জানালার একটা পাল্লা খোলা। আর সেই গলির বাকি গার্হস্থ চিত্রটাও একই রকম। পাশাপাশি টিনের চাল, আর দরজা। রাস্তা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে তিন নম্বর দরজাটা বিমলদের, এই সনাক্তকরণ নিশ্চিত করে সেদিন প্রত্যাবর্তন করলাম।
এরপর এক শনিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই বিমলদের ঘরের সামনে গিয়ে হাজির হ’লাম। দরজায় প্রথমবার টোকা দিতে কেউ খুলল না, দ্বিতীয়বার টোকা দিতে দরজা অল্প ফাঁক হ’ল। ভেতরে ঘনীভূত অন্ধকার থেকে কেবল একটা চোখের আভাস পেলাম। কাঁসার বাসনের মত খনখনে স্বর ভেসে এলো – “কাকে চাই?” আমি ইতস্তত করে বললাম “বিমল আছে?” প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ দরজার একটা পাল্লা খুলল। ফুরিয়ে যাওয়া দিনের পরে থাকা আলোয় এক মহিলাকে দেখতে পেলাম। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মলিন বস্ত্র দিয়ে কোন মতে মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। কপালে কোনও টিপ নেই, সিঁথি খালি। কপালে দারিদ্রের বলিরেখা আর চোখে করুন অভিব্যক্তি নিয়ে তিনি আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি নিজে থেকেই বললাম “আমি বিমলদের স্কুলে পড়াই... আপনি বোধহয় বিমলের মা...”। আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সলজ্জ-ব্যস্ততার সাথে তিনি দরজার দু’টো পাল্লা খুলে আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। একটি মাত্র ঘর, তার এক পাশে স্টোভ আর রান্নার অন্য সরঞ্জাম পড়ে আছে, আর এক পাশে মেঝেতে শতরঞ্চির ওপর কিছু বই পড়ে আছে। আর দেওয়ালের ধারে পড়ে আছে দু’জোড়া ক্ষয়িষ্ণু হাওয়াই চটি। এক কোনে একটা ছোট খাট, মলিন চাদর দিয়ে তোশক নিজের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছে। সেই খাটের ওপর পড়ে থাকা একটা হাত পাখা দিয়ে বিমলের মা আমাকে বাতাস করতে লাগলেন। ঘরের মধ্যে জ্বলা একটিমাত্র হারিকেনের আলোয় তখনও তাঁর চোখে অপ্রস্তুত হওয়ার আভাস। তিনি বললেন “বিমল একুন ঘরে নেই, সন্ধেবেলা দোকানে বসে... ওই দোকানটাই একুন শেষ সম্বল কিনা... আমি একুনি গিয়ে ডেকে আনচি... দু’মিনিট বসুন। চা করে দি, খান।” আমি বাঁধা দিয়ে বললাম “আপনাকে অত ব্যস্ত হ’তে হবে না। আমি আপনার সাথেই কথা বলতে এসেছিলাম। বিমলকে নিয়ে কিছু কথা ছিল।” উনি কেবল “ও” বলে থেমে গেলেন। আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম “বিমলের কি সত্যিই লেখাপড়ায় আগ্রহ আছে? নাকি আপনারা জোর করেন বলে স্কুলে যায়?” আমরা প্রশ্নের উত্তরে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন “ওর বাপের সাধ ছিল লেখাপড়া শিকে ছেলে বড় কিচু হবে। তাই অভাবের মধ্যেও ছেলেকে ইস্কুলে ভর্তি করল। বাপকে মান্যি করত, কোনও ঝামেলা ছিল না। গেল বছর ওর বাবা চোখ বুঁজলেন, আর এই ছেলেও কেমন হয়ে গেল। সকাল হলেই কাজে যাচ্চি বলে বেড়িয়ে যায়। কোনোদিন ইস্কুল যায়, কোনোদিন যায় না। আমার কোনও কথাই গেরাজ্জি করে না।” বক্তব্য শেষ করে তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। ওনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম “আহা, বিমলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নিয়ে আমি আসিনি। কেবল জানতে চাইছিলাম ছেলেটার পড়াশুনোর প্রতি কতটা আগ্রহ।” তিনি কান্না থামিয়ে বললেন “আগে পড়ত, এখন পড়তে চায় না। আপনি দেকুন যদি বুজিয়ে-ধমকিয়ে কিচু করতে পারেন। আমি আর পারচি না।”
অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ অনেক সময়ই কিশোর মনে গভীর ছাপ ফেলে। সংসারে অবশিষ্ট একমাত্র পুরুষ হওয়ার জন্য বিধাতা তার ঘারেই জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছেন। মা কে অধিক পরিশ্রম করতে না দিয়ে কৈশোরেই সংসারের ভার বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিমল। এমন সংকল্পের কাছে শিক্ষালাভের ব্রতও ম্লান হয়ে যায়। লেখাপড়া শিখে বিশেষ উপকার হবে, সেই আস্থা আর থাকা না।
বিমলের মায়ের করুন দৃষ্টি, আর অব্যক্ত মিনতি সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম। ফেরার পথে দেখলাম একটা চায়ের দোকানে বিমল বসে আছে। দু-একজন দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। দোকানের সামনে সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়েছিল, তাই বিমল আমাকে দেখতে পেল না।
... ... ... ... ...
সোমবার বিমল স্কুলে এলো এবং ক্লাস চলাকালীন কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে পাঠ্যর প্রতি কোন মনোযোগ নেই, কৌতূহলের বিষয় কেবল আমি। এরপর একদিন আবার বিমলের চায়ের দোকানে গেলাম। আমাকে দোকানের সামনে সাইকেল থেকে নামতে দেখে ওর হাতের কেটলি থেকে খানিকটা চা বাইরে পড়ে গেল। আর পাঁচজনের মত আমিও দোকানের সামনে বেঞ্চের ওপর বসলাম। সে উপস্থিত গ্রাহকদের হাতে চায়ের ভাঁড় তুলে দিয়ে আমার দিকে তাকাল। কোনরকম সৌজন্য না দেখিয়ে বলল “আপনার কি লাগবে?” হারিকেনের আলোয় সদ্য-প্রকাশিত গোঁফ-দাড়ির রেখায় ডাকা মুখটা বেশ কঠিন মনে হ’ল। কোন উত্তর না পেয়ে আবার সে বলল “আপনাকে কি চা দেব? সঙ্গে বিস্কুট না মামলেট?” আমি বললাম “শুধু চা।” একটা মাটির ভাঁড়ে চা ঢেলে সে আমার দিকে এগিয়ে দিল। সেটা হাতে নিয়ে পাশে রাখলাম, তারপর ওকে প্রশ্ন করলাম “তুই বাড়ি থাকিস কখন?”
--- “কেন?”
--- “তোর সঙ্গে জরুরি দরকার ছিল। এখানে হবে না।”
--- “আমি কখন থাকি, কখন থাকি না... কোনও ঠিক নেই।”
--- “আমি চাইলে তোর মার সাথে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু তোকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল... তোর হাতেই দেবো।”
---“তাহলে এখানেই দিন...”
--- “না”
--- “তাহলে রবিবার বিকেলে আসুন, ঘরেই থাকব।”
চা শেষ করে বিস্কুটের বয়ামের ওপর এক টাকার কয়েন রাখলাম। বিমল ঘাড় নেড়ে সেই টাকা নিতে অসম্মতি জানিয়ে বলল “মা বলল আপনি সেদিন কিছু না মুখে দিয়েই উঠে গেছেন... ” আমি ওর পিঠে একটা হালকা চাপর মেরে বললাম “বেশ গুরুজন হয়েছিস! চা তোদের বাড়ি গিয়েই খাব আবার। এখন এই টাকাটা রাখ।” টাকাটা ওই বয়ামের ওপর রেখেই বেড়িয়ে এলাম, পেছন ফিরে আর দেখলাম না। কেউ পেছন থেকে কিছু বলল বলেও মনে হ’ল না। সাইকেল করে খানিকটা দূরে এসে পেছন ফিরে দেখলাম বিমলের দৃষ্টি আমার গতিপথের দিকে।
রবিবারের বদলে শনিবার বিকেলেই ওদের ঘরে গিয়ে হাজির হ’লাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম বিমল খাটের ওপর বসে চোখ কচলাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরে ঘুমচ্ছিল, আমার জন্য ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। বিমলের মা বিমল কে বললেন “মাস্টারমশাই এসেচেন, দেকেচিস?” বিমলের চোখের মধ্যে ঘুমের ঘোর কেটে এক অযাচিত সচেতনতা চলে এলো। নিতান্ত অপ্রস্তুতের মত চারপাশ হাঁতরে একটা শার্ট গলায় গলিয়ে নিলো। তারপর ব্যস্ত ভাবে খাট পরিষ্কার করতে লাগল। ওর মা বললেন “আপনি সেদিন কিছু মুখে না দিয়েই চলে গেলেন। আজ চা খেয়ে যেতেই হবে... জল চাপিয়েচি।” বিমল বসা গলায় বলল “আপনি তো বলেছিলেন রবিবার আসবেন।” একথা শুনে আমার মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেল “হ্যাঁ, আমি রবিবার আসি, আর তুমি তাল বুঝে সরে পড়!” বিমলের মুখে ভদ্রতার হাসি ম্লান হয়ে গেল, কান লাল হয়ে উঠল। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল খাটের পাশে। বিমলের মা চুপ করে স্টোভে বসানো কেটলির দিকে চেয়ে রইলেন। বিমলের হাত ধরে কাছে টেনে বললাম “তোকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে বলেছিলাম? এই নে... ” প্লাস্টিকের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আসতে আসতে প্যাকেট থেকে জিনিসটা বার করে দেখল... একটা নতুন বই। যে বই না নিয়ে যাওয়ার জন্য ক’দিন আগেও ক্লাসে শাস্তি পেয়েছে। বইটা হাতে নিয়ে সে প্রথমে হাসল, তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
কেটলির ভেতর জমে থাকা বাষ্প তার মুখ থেকে উষ্ণ প্রবাহে নির্গত হয়। কিন্তু মনুষ্য-হৃদয়ে জমে থাকা বাষ্প নির্গত হয় অশ্রু রূপে। পৌরুষ-সম্ভ্রম নিয়ে উদ্বিগ্ন পুরুষ তাকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করে। সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত বালকের সেই কৌশল অবগত নয়। আর স্ত্রী জাতি সেই চেষ্টা করে শক্তির অপচয় করে না। বিমলের মায়ের মুখে হাসি থাকলেও, স্টোভের শিখার আভায় তাঁর চোখের কোন চিক চিক করছিল।
... ... ... ... ...
এরপর থেকে মাসে দু-তিনবার বিমলের বাড়িতে বা চায়ের দোকানে যেতাম। সেই সাধারণ শ্রীহীন কিশোরের মধ্যে অদ্ভুত এক সারল্য ছিল যা আমার ভালো লেগে গেল। সেই ভাল লাগার মধ্যে দয়া বা করুণার লেশ মাত্র ছিল না। ছেলেটির এক অদ্ভুত চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল। মেধাবী না হলেও, লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা ছাই চাপা আগুনের মত ধিক্ ধিক্ করে তার ভেতরে জ্বলত। কখনও ছুটির দিনে ওকে সঙ্গে নিয়ে অল্প দূরে কোন ঝিল বা দিঘির পারে যেতাম। পরিষ্কার জল দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত, আমি পারে দাঁড়িয়ে শত চিৎকার করলেও উঠে আসত না। পথে কোনও ফল গাছে দেখলে তরতরিয়ে গাছে উঠে তিন-চারটে ফল পেরে আনত। নীতি শিক্ষা দিতে গেলে বলত “ওই ফল গাছের পাখি আর হনুমানেও নষ্ট করে। আমিও না হয় একটা হনুমান।” বিমলের মধ্যে তীব্র নাস্তিকতা ছিল লক্ষণীয়। সাধারনতঃ গ্রামের মানুষদের মধ্যে এইরূপ নাস্তিক দেখা যায় না। বিমল কে কোনদিনও স্কুলের সরস্বতী পুজোয় আসতে দেখিনি। গ্রামের দূর্গাপুজোর সময় মণ্ডপের ধারেকাছে সে আসত না। পথ চলতে চলতে কোন মন্দিরের সামনে কাউকে প্রণাম করতে দেখলে, অদ্ভুত অবজ্ঞার হাসি নিয়ে তাকে দেখত। ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে জনসাধারণের এহেন ভক্তি দর্শনের মধ্যে যেন ভারী কৌতুকপূর্ণ কিছু লুকিয়ে আছে। সেই কৌতুক যেন সেই কেবল দেখতে পায়। হয়ত বিধাতাপুরুষ বাল্যকালে যাদের জাগতিক ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেন, তারা এইভাবেই তাঁর কর্মের মধ্যে কৌতুকের উৎস খুঁজে নেয়।
এক প্রতিবেশীর সহায়তায় বিমলের মায়ের জন্য একটা জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। ওনাকে মাসিমা বলে ডাকতাম। ছেলে স্কুলে যাওয়ার পর উনি সেলাইয়ের দোকানে কাজ করতে যেতেন। সন্ধ্যের পর ছেলের সাথে আবার চায়ের দোকানে বসতেন। বিমল ওই দোকানেই বই নিয়ে বসত। কেবল পরীক্ষার সময় দোকানে বসত না। তবে শত চেষ্টা করেও বিমলের সকালে জল বাড়ি বাড়ি জল দেওয়ার কাজ বন্ধ করতে পারিনি। বহুকালের পরিচিত প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজন যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন দৈব-রূপে সাক্ষাত শয়তান এলেও বোধ করি আর্তের মধ্যে এমন বিহ্বলতা প্রকাশ পায়। বিমলের বাবা অবর্তমানে সে ও তার মা হয়ত আমার মধ্যে এক আকাঙ্ক্ষিত অভিভাবক কে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাদের প্রতি সামান্য সহানুভূতি বা ভদ্রতাও তাদের কৃতজ্ঞতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিত।
গ্রীষ্মের ছুটিতে দুপুরবেলা বিমল মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে আসত। আমার ঘরে নানারকম রঙিন ছবিওয়ালা বিদেশি বই থাকত। আমি বসে কোনও একটা বই পড়তাম বা রেডিও শুনতাম, আর বিমল সেই সব বই আর পত্রিকার পাতা উলটে পালটে দেখত। পাশ্চাত্যের শহরের গগনচুম্বী বহুতল অট্টালিকা, ঝর্ণা, গাছের পাতার ওপর বসে থাকা উজ্জ্বল কীট-পতঙ্গ, এই সব ছবি বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখত। সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত, তুষার মণ্ডিত গিরি-শৃঙ্গর ছবি দেখে বলত “এরকম ছবি কারা তোলে? কি করে তোলে? কোথায় এরকম দেখা যায়?...” সেই ছবিগুলো আরও একবার দেখার আকর্ষণেই সেই বার বার আমার বাড়িতে আসত। আমার একটা ক্যামেরা ছিল, তাতে সাদা-কালো ছবি তোলা যেত। মাঝে মাঝে সেই ক্যামেরা নিয়ে বেরোতাম, আর ছবি তুলতাম। বিমল সেই ক্যামেরার লেন্স-এ চোখ রেখে চারিদিক দেখত আর ছবি তোলার ভান করত। ক্যামেরা হাতে পেয়ে গ্রাম্য কিশোরের সেই বালকোচিত আচরণ বড়ই অদ্ভুত দর্শন ছিল।
বিমল মেধাবী ছিল না, ঠিক ভাবে লেখাপড়া করার মত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু প্রবল মানসিক দৃঢ়তাকে সম্বল করে সে দু’বার মাধ্যমিকে ফেল করেও তৃতীয়বার পরীক্ষা দিল, এবং ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল। পাশ করার খবর পেয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল “তিন বছর একই জিনিস পড়া তো, তাই তিন বারের বার ঠিকঠাক শেখা হয়েছে... এক বারে পাশ করে গেলে শেখা হ’ত না।” ছেলে মাধ্যমিক পাশ করেছে বলে মাসিমা মৌরলা মাছের বাটি চচ্চড়ি খাইয়েছিলেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্যে ঋণ পরিশোধের প্রবল আকুতি মুহুর্মুহু প্রকাশ পেত। সেই আকুতি নিয়েই প্রতিবার তিনি বলতেন “আবার এসো বাবা...”।
জেলা হাইস্কুলে বিমল একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হ’ল। ঠিক সেই সময়, অপ্রত্যাশিত ভাবে আমি কলকাতায় একটি চাকরি পেয়ে গেলাম। খড়গপুরের বাসা ত্যাগ করার সময় ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগল। কলকাতা ফেরার ক’দিন আগে বিমলদের বাড়িতে গেলাম ওদের সাথে শেষবার দেখা করে নিতে। আমার কলকাতা ফেরার খবর শোনার পরেও বিমলের ভাবলেশহীন চোখে অভিব্যক্তির কোনও পরিবর্তন হ’ল না। তবে সেদিন ওদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় মাসিমার চোখের অবলম্বনহীন অসহায়তা সারা জীবন হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।
কলকাতায় ফিরে আসার মাস ছয়েক পর একবার খড়গপুরে গেছিলাম। কিন্তু বিমলদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম দরজায় তালা ঝুলছে। পাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানলাম বিমল ও তার মা খড়গপুর ছেড়ে চলে গেছে। কোনও এক পরিচিত আত্মীয় বিমলের জন্য শহরে কাজের ব্যবস্থা করেছে, তারা তার সাথেই চলে গেছে। বিমল এইভাবে ছ’মাসের মধ্যে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কর্মসন্ধানে আত্মীয়র শরণাপন্ন হ’বে, একথা ভাবতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বিমল বা তার মায়ের সাথে খড়গপুর অথবা কলকাতায় আর দেখা হয়নি। মাসিমার চোখে সেই সজন হারানোর শূন্যতাই শেষ স্মৃতি হয়ে থেকে গেল।
... ... ... ... ...
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেলো। সেই সময় আমি কলকাতায় থাকি। আমার এক বন্ধুর সাথে ছুটির দিনে নাটক, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্র প্রদর্শনী অথবা আলোচনা সভায় যেতাম। বেশ লাগত সৃষ্টিশীল সমাজের কেউকেটাদের নানারকম মতামত শুনতে। শহরের বিদ্বজ্জনের কথোপকথনের একটা-দুটো টুকরো হঠাৎ ভেসে এলে মাঝে মাঝে কৌতুকও বোধ করতাম। সেইরকম একদিন ‘অপ্রতিম’ নামক এক এক শিল্পীর আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখতে গেলাম। তার নাম আগে কখনও শুনিনি, তবে “ওয়াইল্ড লাইফ”-এর ওপর কিছু ছবি অনবদ্য। শুনলাম তিনি বেশ কিছু বছর বেলজিয়ামেই কাটিয়েছেন... তারপর আফ্রিকা মহাদেশে এবং ব্রাজিলে। শিল্পী সেই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু আলোকচিত্রের নিপুণতা দেখে তাঁর সাথে দেখা করার ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার সেই বন্ধুর চেষ্টায় কিছুদিন পরেই শিল্পীর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির হ’লাম।
দোতলা বাড়ির সদর দরজায় নেম প্লেট, তাতে স্পষ্ট লেখা ‘অপ্রতিম’। বেল বাজাতে একজন বেয়াড়া এসে দরজা খুলে দিল। সেই পথ দেখিয়ে আমাদের দোতলায় নিয়ে চলল। বাড়ির প্রতিটা দেওয়াল জুরে অসাধারণ সব আলোকচিত্র। বর্ণ, আকৃতি, আলো-ছায়া চারিদিকে খেলা করছে। বেয়ারা আমাদের প্রশস্ত ড্রইং-রুমে বসিয়ে তার দাদাবাবু কে ডাকতে গেল। ড্রইং-রুমের চারিদিকে চোখ বোলাতে গিয়ে একটা দেওয়ালে কেবল মাত্র একটি ছবি চোখে পড়ল। এক প্রৌঢ়া স্ত্রীলোক নির্মল হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই মুখ অতি পরিচিত। তবে সেই মুখে কোনও মলিনতা নেই, দৃষ্টিতে করুণ আকুতি নেই, সহানুভূতির প্রতিদানে অসহায় কৃতজ্ঞতাবোধের চিহ্ন নেই। নিশ্চিন্ত, প্রশান্ত দৃষ্টি। সেই ছবিতে মোটা রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে। আর তার ঠিক নীচে একটা ছোট পিঁড়ির ওপর একটা মালা রাখা, আর তার চার পাশে ফুল ছড়ানো। সোফা থেকে উঠে এক পা এক পা করে সেই ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম জলচৌকির ওপর একজোড়া পুরনো হাওয়াই চটি। তারই ওপর মালা রাখা, আর চারপাশে ফুল ছড়ানো। বুঝতে অসুবিধে হ’ল না এ চটি কার। সেদিনের গ্রাম্য, হতশ্রী, নাস্তিক বিমল আজকের প্রতিষ্ঠিত অপ্রতিম হয়েছে। তবে তার মা কে যথার্থ ভাবে দেবীর সম্মান দিতে ভোলেনি। মাসিমার স্মিতহাস্য মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেড়িয়ে গেলাম। বন্ধুর পিছু-ডাক গ্রাহ্য করতে ইচ্ছে হ’ল না। বিমল বা অপ্রতিম কারও সাথেই আর দেখা হয়নি।
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা