পশ্চিম মেদিনীপুরের এক গ্রামের মধ্যে দিয়ে বছর শুরুর দিনে যেতে যেতে বর্ষবরণ দেখে এলাম । খড়গপুর থেকে হিজলী ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে সালুয়া পেরিয়ে নাক বরাবর কেশিয়াড়ির পথে । সোজা গেলে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ভসরাঘাট না গিয়ে তার আগেই ডান দিকে মোরামের পথ, মাটীর পথ ধরে বহু পুরোণো দুর্গা মন্দির । সর্বমঙ্গলা মন্দির আর কাশীশ্বর জিউ ।
বেলা গড়িয়ে, দুপুর পেরিয়ে, বিকেলের সময় চলেছিলাম পয়লা জানুয়ারির দিন ।
শহরে তখন কত হিড়িক ধুম করে নিউইয়ার পার্টির । কত তোড়জোড় রেস্তোরাঁয়া, ক্লাবে, মাঠে ময়দানে। সার্কাসের তাঁবুতে, চিড়িয়াখানায়, শীতের মেলাপ্রাঙ্গনে তখন মানুষে মানুষে ছয়লাপ । গ্রামের মানুষের মনে সেই নিয়ে কোনো হেলদোল নেই ।
নতুন বছরের প্রথম সূর্যাস্ত তখন রঙ ছড়িয়ে চলেছে আপনমনে । ঠান্ডার দাপটও ছিল বেশ । আর রাস্তায় যেতে যেতে চড়ুইভাতির গন্ধ । তখন বনভোজনের রসুইখানার ঝাঁপ ফেলা হচ্ছে । তারই মধ্যে জোরে মাইকে বেজে চলছে" পরাণ যায় জ্বলিয়ারে "... বড়রাস্তার একপাশে সেন্ট পলস গীর্জায় বর্ষবরণের পার্টির শেষ ঝলক । মাদল বাজছে আর সাথে ট্রাইবাল ডান্স । বিলিভার্স চার্চে নিউইয়ারের ফেস্টুন ।
সর্বমঙ্গলা মন্দির
খড়গপুর আইআইটি ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার গেলে পড়বে ইন্দা বাজারের মোড় । সেখান থেকে পূবদিকে আরো খানিকটা গেলে পড়বে ইন্দা দুর্গা মন্দির আর তারপরই বাঁদিকে খড়গেশ্বরের শিব মন্দির । এই মন্দিরের নামেই এই জায়গার নাম খড়্গপুর । কারো মতে, রাজা খড়্গসিংহ তৈরী করেছিলেন এই মন্দির । আবার কারো মতে বিষ্ণুপুরের রাজা খড়্গমল্ল ২০০ বছর আগে এই মন্দির তৈরী করেছিলেন ।মন্দিরের অভ্যন্তরে গর্ভগৃহে প্রোথিত খড়্গেশ্বর শিবলিঙ্গ । শিবরাত্রি, আর গাজনের সময উতসব হয় এখানে ।
মন্দির চত্বরে বহু প্রাচীন একটি অশ্বত্থ গাছের বেদীমূলে রয়েছে আদিবাসীদের আরাধ্যা কোনো দেবতার প্রস্তর মূর্ত্তি । দক্ষিণবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এই অঞ্চলগুলি প্রধানত:আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা ছিল । তবে এখন সূর্য দেব রূপে ইনি পূজিত হন ।
খড়্গেশ্বর
মন্দিরের নাট মন্দিরে এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে । স্থানীয় মানুষ জন আর মন্দিরের পুরোহিত বিদ্যালয়টি চালনা করেন । মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণও তাঁরাই করেন আর মন্দিরের মধ্যে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই স্কুলটি করেছেন তাঁরা ।জটাজুটো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বহু পুরোণো অশ্বত্থ বৃক্ষ আর বহন করছে সময়ের সাক্ষ্য ।পুরো মন্দিরটী তৈরী পাথর দিয়ে । কোনো ইঁট নেই এর গায়ে । এখন সাদা রঙ করা হয়েছে ।
খড়্গেশ্বর মন্দির
খড়্গেশ্বরের মন্দির থেকে আরো কিছুদূর গ্রামের পথ ধরে স্থানীয় মানুষদের জিগেস করতে করতে পৌঁছনো যায় হিড়িম্বেশ্বরী মন্দিরে ।
হিড়িম্বেশ্বরী মন্দির
বড় বড় দীঘি পরিবেষ্টিত ইন্দার এই গ্রামটির নাম বামুনপাড়া । কথিত আছে মহাভারতে পঞ্চপান্ডবের অজ্ঞাতবাসের সময় ভীম ঘুরতে ঘুরতে এসে স্থানীয় এক অনার্য নারী হিড়িম্বাকে বিবাহ করেন ;এই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলটির নাম ছিল "হিড়িম্বা ডাঙা" এই অঞ্চলে হিড়িম্বার আরাধ্যা একটি অত্যন্ত জাগ্রত কালীমূর্ত্তি ছিল যা কালাপাহাড়ের অত্যাচারে,কালের স্রোতে ভেসে যাওয়া এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল ।এখনো গাছের নীচে সেই অতি প্রাচীন পাথরের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় আর সেইখানেই বাংলার ১৩৭৫ সালে নতুন করে মন্দির স্থাপন করেন বামুনপাড়ার স্থানীয় মানুষ জন । মন্দিরের মধ্যে ধাতব কালীমূর্ত্তির পাশে শীতলারও ধাতব মূর্ত্তি পূজো হয় ।
হিড়িম্বেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস
মহাভারতের ভীম নাকি দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলেন । পঞ্চপান্ডব অধুনা মেদিনীপুর ও সংলগ্ন জেলার গহিন অরণ্যের মধ্য দিয়ে বনবাসে চলেছিলেন, সে কথার উল্লেখ কাশীরাম দাস অনুদিত মহাভারতে পাওয়া যায় । কুন্তী পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলেন সেই জঙ্গলেই । আর সেখানেই উপজাতি পরিবারের রাক্ষস হিড়িম্ব আর তার বোন হিড়িম্বা এসে উপস্থিত হল । মহা উল্লাসে নরখাদক হিড়িম্ব তার কাজ সারতে পঞ্চপান্ডব সহ মাতা কুন্তীকে সংহার করতে উদ্যত হল আর মহাবলী ভীমসেন তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন । হিড়িম্বকে বধ করে ভীমসেন তার দেহ রেখে এলেন খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরের সামনে আর হিড়িম্বা রাক্ষসীর সাথে তার পর ভীমের প্রণয় ও গান্ধর্ব মতে তাকে বিয়ে ( এবং অবশ্যই সেই সময় বিয়ে না করে উপায়ও ছিলনা ভীমের, কারণ অরণ্যে শয্যা পেতে উপজাতিদের সাথে শান্তিপূর্ণ বসবাস না করে কি উপায় থাকে! ) স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন প্রাচীনকালে "মেদ" উপজাতির বাসভূমি হিসেবে মেদিনীপুর ভূখন্ডর নাম এই ঘটনার সাক্ষী বহন করছে। অতএব উপজাতির আবাসস্থল হিসেবে মেদিনীপুরের এই তথ্যটি ফেলে দেবার নয় । ভীম হলেন মেদিনীপুরের এক পরাক্রমশালী দেবতা । তাই মহা সমারোহে ভীমের পুজো করার জন্যই ঐ অঞ্চলের গ্রামবাসীরা ভীম-একাদশীর ব্রত পালন করেন ।
অতএব ঘটা করে ভীমের পুজো, খড়গেশ্বর ও হিড়িম্বেশ্বরী কালী মন্দির অনেক পুরোনো সময়ের দলিলের সাক্ষ্য এখনো বহন করে চলেছে ।
এবার গাড়ি নিয়ে খড়গপুর থেকে তমলুক । গুগ্ল ম্যাপে মোটামুটি ঠাহর করে নিয়ে বেরিয়ে পড়া আরকি । আর স্মার্টফোন বাকী দিশা দেখানোর জন্য তো আছেই । তমলুক পূর্ব মেদিনীপুরের ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার্স । এককালে যার নাম ছিল তাম্রলিপ্ত । পূর্বে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এই তাম্রলিপ্ত ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান বন্দর । বঙ্গোপসাগর এর খুব কাছে ।
তমলুক-পাঁশকুড়া বাসষ্ট্যান্ড পৌঁছে হরিরবাজার, জেলখানা মোড়, চক্রেশ্বর পেরিয়ে বর্গভীমা মন্দির । কাছেই একটি মাঠে গাড়ি রাখা হল । সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মায়ের মন্দিরে ।
বর্গভীমা মন্দির
দেবী বর্গভীমা হলেন তমলুক শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী । দেবীকে ঘিরে দুটি কিংবদন্তী আছে । প্রাচীন যুগের কিংবদন্তী অনুযায়ী জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবীর মাহাত্ম্যের উল্লেখ পাওয়া যায় । মহাভারতের যুগে যখন তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশীয় রাজা তাম্রধ্বজের রাজবাড়িতে এক জেলে বৌ নিয়মিত মাছ সরবরাহ করত । একদিন সে পথে আসার সময় তার ঝুড়ির মাছে, রাস্তার একটি জলভরা গর্ত থেকে জল নিয়ে ছেটানো মাত্রই মরা মাছগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে । রাজবাড়িতে গিয়ে এই ঘটনা জানানোর পর জেলেবৌ সহ রাজা ঐ স্থানে পৌঁছে জলেভরা গর্তের বদলে সেখানে দেবীমূর্তি আসীন একটি বেদী দেখতে পান সেইখানেই রাজা ঐ দেবীর পূজা শুরু করেন ও সেই দেবীই বর্গভীমা নামে পরিচিত ।
প্রাচীনযুগের আরো একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দেবী বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । প্রাচীন যুগের তৃতীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর বাম গুল্ফ(গোড়ালি) তমলুকের এই অংশে পতিত হয়েছিল তাই এটি একটি শক্তিপিঠের অন্যতম ।
কিংবদন্তীর কড়চা দূরে সরিয়ে রাখলেও বিশ্বাস করতে হয় যে দেবী বর্গভীমা হলেন দক্ষিণবঙ্গের অগণিত দেবদেবীর অন্যতম স্থানীয় লৌকিক দেবী । মূল মন্দিরের গঠনরীতিও চমত্কার এবং এখানে বর্গভীমার সাথে অন্যান্য দেবদেবীর পাথরের মূর্তি আছে । সপ্তরথ রীতিতে নির্মিত এর নাম বড় দেউল । যেখানে দাঁড়িয়ে ভক্তরা দেবীকে দর্শন করেন তার নাম জগমোহন । এছাড়াও রয়েছে যজ্ঞমন্দির এবং নাটমন্দির । উত্তরদিকে মন্দির সংলগ্ন একটি কুন্ড আছে ।
বর্গভীমা মন্দিরের কুন্ড
মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দেবদেবীর ২৬টি টেরাকোটার নিপুণ চিত্র আছে ।
বর্গভীমা মন্দিরের টেরাকোটা মূর্তি
ছোটবেলায় নিয়ম করে প্রতিবছর দক্ষিণেশরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কল্পতরু উত্সবে সামিল হতাম । ভীড় ঠেলে দর্শন করাতেও কত তৃপ্তি মানুষের! এখন সেটাও খুব মিস করি । মিস করি গঙ্গার ধার, ঠাকুরের মন্দিরের নিরিবিলি নিস্তব্ধতা আর সেই একরাশ অনাবিল শান্তি নিয়ে কল্পতরুর কাছে প্রার্থনা করা । কি যে চাইতাম জানিনা । কিন্তু যেতাম ও সারাবছরের রেসোলিউশান নিয়ে চোখ বুঁজে অনেক ভাবতাম । "এই বছরে, এটা করবনা, সেটা করতে হবে"...আরো কত কিছু !
নতুন বছরে সর্বমঙ্গলা, খড়গেশ্বর, হিড়িম্বেশ্বরী আর বর্গভীমাই আমার কল্পতরু উত্সবে সামিল হলেন ।
লেখা ও ছবিঃ
ইন্দিরা মুখার্জি
খড়গপুর