বইটা কিনেছিলাম বেশ কিছুদিন আগেই। কিন্তু পড়া হয়ে উঠছিল না। যবে থেকে শুনলাম 'লাইফ অফ পাই' সিনেমাহলে মুক্তি পাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি, তবে থেকে তড়িঘড়ি পড়তে শুরু করলাম সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা ইয়ান মার্টেল এর এই বিখ্যাত বই। তবে আধাআধি পড়ে ওঠার আগেই বাড়ির কাছের মাল্টিপ্লেক্সে চলে এল থ্রি-ডি ভার্সনে 'লাইফ অফ পাই'। তাই বাকি গল্পটা পর্দায় দেখতে চলে গেলাম একদিন।
'লাইফ অফ পাই' ত্রিমাত্রিক বা থ্রি-ডাইমেনশান্ল্ ছায়াছবি। অর্থাৎ এই ছবির বেশ কিছু অংশ ত্রিমাত্রিক ভাবে দেখা যাবে। পর্দায় উড়তে থাকা পাখিটা হটাৎ তোমার চোখের একদম সামনে এসে ডানা ঝাপ্টাবে, বৃষ্টি পড়লে মনে হবে এই বুঝি আমি ভিজে গেলাম। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে গেলে চোখে পড়তে হয় এক বিশেষ ধরনের চশমা, যেটা কিনা সিনেমাহল থেকেই ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। আমি এক আগে কোনদিন থ্রি-ডি ফিল্ম দেখিনি, তাই প্রবল আগ্রহে চশমা চোখে পড়লাম।
আর তারপরেই সেই চমক! গল্পের পটভূমির চিড়িয়াখানার পশু-পাখিরা সব যেন হাতের নাগালে চলে এল - মনে হল হাত বাড়ালেই হয়ত বা ছুঁতে পারব হেলে-দুলে চলতে থাকা পেলিক্যান পাখিগুলিকে; গাছের মগডালের বাঁদরটা এই না লাফিয়ে এসে পড়ে আমার ঘাড়ে...মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলাম উন্নত প্রযুক্তির কম্প্যুটার অ্যানিমেশনের সাথে টানটান গল্প আর অনবদ্য অভিনয়ের যুগলবন্দী।
গল্পের শুরু পন্ডিচেরীতে। সেখানকার চিড়িয়াখানার মালিকের ছোট ছেলের এক সাঁতার-পাগল মামা তার নাম রাখলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত সুইমিং পুল পিসিন্ মলিটর্ (Piscine Molitor )এর নামে! যেহেতু তার বন্ধুরা সবাই তার নাম নিয়ে খ্যাপাত, তাই সে নিজের নামকে ছোট করে রাখল গণিতের চিহ্ন 'পাই' এর নামে। তার নতুন নাম হল পাই প্যাটেল। পাই যদিও হিন্দু ছিল, কিন্তু ইসলাম ও খ্রীষ্ট ধর্ম সম্পর্কে জানার তার সমান উৎসাহ ছিল। চিড়িয়াখানার পশু-পাখীদের মধ্যে তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল রিচার্ড পার্কার নামে এক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
পাই এর ষোল বছর বয়সে তার বাবা ঠিক করেন চিড়িয়াখানার পশুপাখীদের অন্যান্য চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দিয়ে তাঁর পরিবারকে নিয়ে কানাডাতে বসবাস করতে চলে যাবেন। পাই, তার দাদা এবং তার মায়ের অনিচ্ছা সত্বেও তিনি সব ব্যবস্থা হরে ফেলেন। তারপর একদিন জাপানি মালবাহী জাহাজ 'সিমসুম' এ চেপে বেশ কিছু পশু-পাখী সহ পাই- এর পরিবার চিরদিনের মত ভারত ছেড়ে কানাডার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে এক ভয়ানক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে ওই জাহাজ। পুরো জাহাজটাই তলিয়ে যায়। ঘটনাচক্রে প্রাণে বেঁচে যায় পাই। দুরন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে, পাহাড়সমান ঢেউয়ের সাথে লড়াই করতে একটা লাইফবোটে তার সংগী হয় একটা পা ভাঙা জেব্রা, একটা স্পটেড হায়না, অরেঞ্জ জ্যুস নামের এক বয়স্কা ওরাংউটাং আর হ্যাঁ - রিচার্ড পার্কার নামের সেই ভয়ানক সোঁদরবনের বাঘ। কয়েকদিনের মধ্যেই অবশ্য পশুরাজ্যের নিয়ম মেনে পাই ছাড়া লাইফবোটে রয়ে যায় একমাত্র রিচার্ড পার্কার।
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দিশাহীন অবস্থায় রিচার্ড পার্কারকে সঙ্গী করে ২২৭ দিন ভেসে বেড়ায় পাই প্যাটেল।
কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? উদ্দাম প্রকৃতির ভয়াল রূপের সামনে কি রিচার্ড পার্কার মেনে নিল পাই এর সাথে এই দীর্ঘ যাত্রা? গড়ে উঠল তাদের মধ্যে কোন নতুন সম্পর্ক? না, সেই গল্প আমি বলব না। যদি জানতে চাও গল্পের শেষে কেমন হল পাই আর রিচার্ড পার্কারের সম্পর্ক, তাহলে কিন্তু দেখতে হবে পরিচালক অ্যাং লি এর ছবি 'লাইফ অফ পাই'।
ফক্স ২০০০ পিকচার্স প্রযোজিত, ২০১২ সালে নির্মিত এই ছবিতে অভিনয় করেছেন ভারতের ইরফান খান, টাবু আর আদিল হুসেন। পাই এর ভূমিকায় জীবনে প্রথমবার অভিনয় করেছে দিল্লির ছাত্র সূরজ শর্মা। এক বিশেষ চরিত্রে আছে ফ্রান্সের বিখ্যাত অভিনেতা জেরার্দ দেপারদ্যু। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের ১১ টি বিভাগে মনোনয়ন পায় এই ছবি। জিতে নেয় আরো বেশ কিছু পুরষ্কার।
তাহলে কি ভাবছ, ভাব জমাতে যাবে নাকি রিচার্ড পার্কার আর পাই প্যাটেলের সাথে?
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
লাইফ অফ পাই অফিশিয়াল ওয়েবসাইট