মার্চ মাসের মাঝামাঝি ২০১৯ সালের শান্তির নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন সুইডেনের ১৫ বছরের মেয়ে গ্রেটা থানবার্গ। জলবায়ু সংকটের মোকাবিলার দাবীতে ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে স্কুলে না গিয়ে দিয়ে টানা তিন সপ্তাহ সুইডেনের পার্লামেন্টের সামনে বসে থাকেন গ্রেটা। সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু সংকটের মোকাবীলা করার বিষয়ে ইন্সটাগ্রাম ও ট্যুইটারের সাহায্যে সারা পৃথিবীকে জানাতে থাকেন। ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে সুইডেনের নির্বাচনের আগে গ্রেটা নিজের সাইকেলের গায়ে জলবায়ু সংকটের সমাধান চেয়ে বার্তা লিখেছেন।
সুইডেনে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে তিনি প্রতি শুক্রবার স্কুলে যাওয়ার বদলে পার্লামেন্টের সামনে গিয়ে বসেন এবং বলেছেন ততদিন অবধি যেতে থাকবেন, যতদিন না তাঁর দেশের সরকার এমন কোনো নীতি প্রয়োগ করে যাতে সে দেশের গড় তাপমাত্রা বছরে দুই ডিগ্রির বেশি না বাড়ে। গ্রেটা সারা বিশ্বের অগুন্তি কিশোর-কিশোরীকে জলবায়ু সংকট সম্পর্কে সচেতন করেছেন।
নভেম্বর ২০১৮ থেকে, গ্রেটার কর্মকান্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা জলবায়ু সংকটের মোকাবিলায় স্কুল স্ট্রাইক করা শুরু করে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই আন্দোলন ক্রমশঃ আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে।গত ১৫ই মার্চ, ২০১৯, সারা বিশ্বের প্রায় ১.৪ মিলিয়ন ছাত্রছাত্রী স্কুল স্ট্রাইক করে পরিবেশ এবং জলবায়ু সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান বিশ্বের নেতা-নেত্রীদের কাছে পরিষ্কার করে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, পোল্যান্ডের কাতোভিচ শহরে আয়োজিত রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কনফারেন্স { 24th Conference of the Parties to the United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCCC)/ সংক্ষিপ্ত নাম COP24} চলাকালীন সেখানে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্যদের সামনে নিজের বক্তব্য পেশ করেন গ্রেটা ।
এই বক্তব্যটির পরে , ২০১৯ এর শুরুতে , গ্রেটা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সমাবেশে , বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক নেতা এবং শিল্পপতিদের সামনে নিজের বক্তব্য পেশ করেছেন। ।
COP24-এ রাখা গ্রেটার বক্তব্যের অনুবাদ রইল নিচে। আর সম্পূর্ণ মূল ভাষণের ভিডিওটি রইল এই লেখার শেষে।
আমার নাম গ্রেটা থানবার্গ। আমার বয়স ১৫। আমি সুইডেন থেকে আসছি।
আমি ক্লাইমেট জাস্টিস নাও- এর তরফ থেকে কথা বলছি।
অনেকে বলে যে সুইডেন একটা ছোট্ট দেশ, আর তাই আমরা কী করছি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কিন্তু আমি শিখেছি যে বদল আনার জন্য বিরাট কিছু হওয়ার দরকার নেই।
আর যদি কয়েকটা ছেলেমেয়ে শুধুমাত্র স্কুলে না গিয়ে সারা পৃথিবীর খবরের শিরোনামে চলে আসতে পারে,তাহলে ভাবুন আমরা সবাই মিলে কী করতে পারি, যদি আমরা সত্যিই কিছু করতে চাই। কিন্তু সেটা করতে গেলে, আমাদের পরিষ্কারভাবে কথা বলতে হবে, সেটা যতই অস্বস্তিকর হোক না কেন।
আপনারা শুধুমাত্র বহনীয় অর্থনৈতিক উন্নতির(green eternal economic growth) কথা বলেন, কারণ আপনারা জনপ্রিয়তা হারাতে চান না।আপনারা সেই সমস্ত ভুল ভাবনাগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চান যেগুলি আমাদের এই বিপর্যয়ের মধ্যে এনে ফেলেছে, যখন কিনা এমারজেন্সি ব্রেকটা টানাই হবে একমাত্র বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ।
আপনারা স্পষ্ট কথা বলার মত পরিপক্বও হন নি। সেই দায়িত্বটাও আমাদের ছোটদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি জনপ্রিয়তার পরোয়া করিনা। আমি ক্লাইমেট জাস্টিস এবং এই সজীব গ্রহটাকে নিয়ে চিন্তিত।
খুব অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ যাতে বিপুল পরিমাণে অর্থ জমাতে পারে তার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমাদের সভ্যতাকে বলি দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের জীবমন্ডল (Biosphere) নষ্ট করা হচ্ছে যাতে আমার দেশের মত দেশগুলিতে ধনী মানুষেররা আরও বিলাসের মধ্যে থাকতে পারে। কয়েকজনের বিলাসের জন্য বহুজনকে কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।
২০৭৮ সালে, আমি আমার ৭৫ বছরের জন্মদিন পালন করব। আমার যদি ছেলেমেয়ে হয়, তারা হয়ত আমার সঙ্গে দিনটা কাটাবে। হয়ত তারা আমাকে আপনাদের কথা জিজ্ঞাসা করবে। হয়ত তারা জানতে চাইবে, কিছু বদলে ফেলার সময় থাকা সত্বেও আপনারা কিছুই করেননি কেন।
আপনারা বলেন আপনারা নিজেদের সন্তানদের সবথেকে বেশি ভালোবাসেন, তবুও আপনারা তাদের চোখের সামনে তাদের ভবিষ্যৎ চুরি করছেন।
আপনারা যতক্ষণ না রাজনীতিকে বাইরে রেখে যা করা দরকার সে বিষয়ে লক্ষ্য স্থির করবেন, ততক্ষণ কোনো আশা নেই। আমরা একটা বিপর্যয়কে হাল্কা ভাবে নিয়ে সেটার সমাধান করতে পারব না।
আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানীকে মাটির নিচেই রাখতে হবে, এবং সবার সমান অধিকারের দিকে লক্ষ্য স্থির করতে হবে। আর যদি সিস্টেমের মধ্যে থেকে সমাধান বার করা এতটাই কঠিন হয়, তাহলে হয়ত সিস্টেমটাই আমাদের বদলে ফেলতে হবে।
আমরা এখানে বিশ্বের নেতৃবৃন্দের কাছে এ বিষয়ে দয়া ভিক্ষা করতে আসিনি।আপনারা আমাদের অতীতেও উপেক্ষা করেছেন, এবং আবার উপেক্ষা করবেন।
আমাদের কাছে আর কোনো ছুতো নেই, আর সময়ও নেই।
আমরা আপনাদের জানাতে এসেছি যে বদল আছে, সেটা আপনাদের পছন্দ হোক বা না হোক। আসল ক্ষমতা আছে সাধারণ মানুষের কাছে।
ধন্যবাদ।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া