সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

(মালয়েশিয়ার উপকথা)

সে অনেকদিন আগে কথা। পৃথিবীর বয়স তখন অনেক কম, আর স্বর্গরাজ্য কায়ান্‌গান থেকে দেব-দেবীরা ইচ্ছেমত পৃথিবীতে যাওয়া-আসা করতেন। সেই সময়ে চারিদিকে সমুদ্র ঘেরা বোর্নিও দ্বীপের অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল সারাওয়াক বা সেরাক দেশ। সেই দেশের আরেক নাম "ধনেশপাখির রাজত্ব"- সেখানে অনেক অনেক ধণেশ পাখি ছিল কিনা !

সেই ধনেশ পাখির রাজত্বে দুটি গ্রাম ছিল - পীত বালুর গ্রাম আর শ্বেত বালুর গ্রাম। এই দুই গ্রামের মানুষ সবসময়ে নিজেদের মধ্যে নানা কারণে যুদ্ধ করতেই ব্যস্ত থাকত। তাদের নিয়ে দেবতাদের তো হিমশিম অবস্থা। শেষে এই দুই গ্রামের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁরা দুই বোন, দুই দেবকন্যা - রাজকন্যা সান্তুবং আর রাজকন্যা সেইজিংজানকে পৃথিবীতে পাঠালেন। কিন্তু তাঁদের একটা শর্ত মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হল- তাঁরা কেউ কোনদিন একে অপরের সাথে ঝগড়া করতে পারবেন না। যদি করেন, তাহলে ঘোর অঘটন ঘটতে পারে।

রাজকন্যা সান্তুবং আর রাজকন্যা সেইজিংজান পৃথিবীতে নেমে এলেন। তাঁরা দুজনেই অপূর্ব সুন্দরী। তাঁদের দুজনের রূপ দেখে তো পীত বালু আর শ্বেত বালু- দুই গ্রামের যত মানুষ একেবারে হাঁ হয়ে গেল, আর লড়াই -ঝগড়া করতে ভুলে গেল।

রাজকন্যা সান্তুবং আর রাজকন্যা সেইজিংজান- দুজনেরই দুটো বিশেষ গুণ ছিল। সান্তুবং খুব ভাল কাপড় বুনতে পারতেন। তাঁর হাতে বোনা কাপড়ের রঙ আর নকশার খ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওদিকে সেইজিংজান খুব ভাল ধান চাষ করতে পারতেন। তাঁর চাষ করা ধান থেকে তৈরি চালের ভাত যে একবার খেয়েছে, সে আর সেই স্বাদ আর সুগন্ধ কোনদিন ভুলতে পারত না।

দুই রাজকন্যা নিজেদের এই দুই ভাল গুণের সাহায্যে পীত বালু আর শ্বেত বালু গ্রামের মানুষদের দুঃখ দুর্দশা দূর করলেন। পাশাপাশি দুই গ্রাম। পীত বালু গ্রামের দায়িত্ব নিলেন রাজকন্যা সান্তুবং। শ্বেত বালু রইল সেইজিংজানের নজরদারিতে। তারা একে অপরকে খাদ্য আর বস্ত্রের যোগান দিতে থাকল। দুই গ্রামের মানুষের অন্ন-বস্ত্রের অভাব মিটে যাওয়াতে সেখানে শান্তি ফিরে এল। গ্রামের মানুষ নানা কাজে মন দিল, আর কিছুদিনের মধ্যেই সবদিক থেকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। দুই গ্রামের মানুষ দুই রাজকন্যাকে অনুরোধ করল, তাদের ছেড়ে চলে না গিয়ে গ্রামেই তাদের সাথে থেকে যেতে। দুই বোন আনন্দের সাথেই রাজি হলেন। গ্রামের পাশাপাশি আশেপাশের সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলের দেখাশোনাও করতে লাগলেন দুই রাজকন্যা।

ক্রমশঃ এই দুই গ্রামের কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। সেরাকের বিভিন্ন অন্য শহর থেকে দলে দলে মানুষ আসতে থাকল, এই দুই সাজানো গোছানো গ্রাম দেখার জন্য। সান্তুবং-এর বোনা কাপড় আর সেইজিংজানের চাষ করা ধান কেনার জন্য ভীড় জমাতে থাকল দেশ -বিদেশের বণিকেরা।

এইভাবেই একদিন সেই দুই গ্রামের কাছে এসে পড়লেন পড়শী রাজ্য মাতং এর রাজপুত্র সেরাপি। সেরাপি ছিলেন যেমন বীর, তেমনি সুন্দর দেখতে। তিনি তো পীত বালু আর শ্বেত বালু- দুই গ্রাম দেখে মুগ্ধ। তাঁর সাথে দেখা হল দুই রাজকন্যারও। রাজকন্যা সান্তুবংকে খুব পছন্দ হল রাজপুত্র সেরাপির। তিনি তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। রাজকন্যা সান্তুবং রাজি হয়ে গেলেন।

কিন্তু এই ঘটনায় রাজকন্যা সেইজিংজানের খুব মন খারাপ হল - তিনি নিজেও আসলে রাজপুত্রকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন কিনা ! তিনি কি সান্তুবং-এর থেকে কম সুন্দরী? তাহলে রাজপুত্র কেন তাঁকে বিয়ে করতে চাইলেন না? সান্তুবং-এর সাথে সেরাপির বিয়ে হবে বলে সবাই কত আনন্দ করছে। সেইজিংজান কিন্তু একটুও আনন্দিত হলেন না। তাঁর দুঃখ ক্রমে রাগ এবং হিংসায় পরিণত হল। তিনি সান্তুবং এর বাড়ি গেলেন ।সেখানে দুই বোনে কথা-কাটাকাটি শুরু করলেন। তাঁদের সেই কথার পিঠে কথা পরিণত হল ভয়ানক ঝগড়ায়। তাদের দুই গ্রামের দুই রক্ষককে এইরকম ঝগড়া করতে দেখে পীত বালু আর শ্বেত বালু- দুই গ্রামের মানুষ আবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে দিল।

দিন কেটে রাত হয়ে গেল; সান্তুবং আর সেইজিংজানের ঝগড়া আর থামল না। দুজনে শেষ পর্যন্ত একে অপরকে আঘাত করার জন্য হাতের কাছে যন্ত্রপাতি যা পেলেন , হাতে তুলে নিলেন। হঠাৎ এক সময়ে সেইজিংজান নিজের ধান মাড়াই করার যন্ত্রটি দিয়ে সান্তুবং এর মুখে আঘাত করলেন। রাজকন্যা সান্তুবং এর গাল আঘাতে ফেটে গেল, তিনি আঘাতের যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে গেলেন। পড়ে যাওয়ার আগে তিনি নিজের কাপড় বোনার যন্ত্রটি ছুঁড়ে মারলেন সেইজিংজানের দিকে। সেই অস্ত্রের আঘাতে সেইজিংজানের দেহের খানিকটা অংশ টুকরো টুকরো হয়ে গেল। দুই দেবকন্যার দেহ থেকে সাদা রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিল জমি, মিশে গেল সাগরের জলে।

হায় !দুই বোন তাঁদের কথা রাখতে পারলেন না ! হঠাৎ আকাশে গর্জে উঠল ভয়াবহ বজ্র, বিদ্যুতের তীব্র আলোর ঝলকানি চিরে দিল আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। নিজেদের কথা রাখতে না পারার জন্য সান্তুবং এবং সেইজিংজান, দেবতাদের রাজার অভিশাপে পরিণত হলেন পর্বতে। সেইজিংজানের ভাঙা মাথার অংশগুলি পরিণত হল ছোট ছোট দ্বীপে।

আর পীত বালু আর শ্বেত বালু গ্রামের বাসিন্দাদের কি হল? তারা তো দুই বোনের লড়াই থামানোর চেষ্টা করেনি। বরং নিজেরাও লড়াই শুরু করে দিয়েছিল। লড়াই চলাকালীন দুই বোনেই অপরদিকে মানুষদের নানা অভিশাপ দিচ্ছিলেন। তাই যুদ্ধের শেষে সেই দুই গ্রামের মানুষেরা দুই দেবকন্যার অভিশাপে বিভিন্ন বন্য প্রাণীতে পরিণত হয়ে গেল। আজও তারা সেইভাবে পর্বতে- জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।

এই গল্পের থেকে আমরা কি শিখলাম? - কে বেশি সুন্দর দেখতে, বা কে বেশি আনন্দে আছে- এইরকম তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কখনই মনে হিংসার ভাব আনতে নেই। কখনই কোন ঝগড়া হলে কোন এক জনের হয়ে লড়াই না করে বরং সেই ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করা উচিত। অস্ত্র নিয়ে একে অপরকে আক্রমণ করা কখনই উচিত নয়। এই সব কাজই সামগ্রিকভাবে ধ্বংস ও ক্ষতি করে, আর শেষে কিন্তু কেউই জেতে না।


সান্তুবং পর্বত, মালয়শিয়া


আজকের মালয়েশিয়ার দক্ষিণ চীন সাগরের তীরবর্তী কুচিং অঞ্চলে এক জনপ্রিয় পর্যটন স্থান হল সান্তুবং পর্বত। সেই পর্বতের একটি খাঁজকাটা জায়গাকে চিহ্নিত করা হয় সান্তুবং এর ভেঙে যাওয়া গাল রূপে ! সান্তুবং পর্বতএর থেকে একটু দূরেই রয়েছে সেইজিংজান পর্বত। বলা হয়, ওই অঞ্চলের ছোট ছোট দ্বীপ- কেরা, তালাং-তালাং, সাতাং - এগুলি হল সেইজিংজানের দেহের টুকরোগুলি।




ছবিঃত্রিপর্ণা মাইতি, উইকিপিডিয়া

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা