ফেলুদা, তোপসে, জটায়ু, প্রোফেসর শঙ্কু, তারিনী খুড়ো, মুকুল,ক্যাপ্টেন স্পার্ক, বাতিকবাবু, অসমঞ্জবাবু, নকুড়বাবু, মগনলাল মেঘরাজ, ফটিকচাঁদ, মোল্লা নাসিরুদ্দিন...এদের কাউকে কাউকে তুমি বেশ ভালো করেই চেনো, কাউকে বা একটু কম চেনো। বলতো এদের সবার নাম গুলো এক সাথে বলছি কেনো? বুঝতেই পেরে গেছো এতক্ষনে- গত সংখ্যায় আমরা যাঁর ছোটবেলার কথা একটুখানি পড়েছিলাম, এখন আমরা তাঁকে নিয়ে গল্প করবো। তিনি সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কে তুমি নিশ্চয় কিছু কিছু, বা অনেক কিছু খবর রাখো। এসো, আরেকবার একটু তাঁর কাজকর্ম নিয়ে কথা বলি।
তিনি ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ুর সৃষ্টিকর্তা। ফেলুদা কে জানোতো? ফেলুদা হল আসলে একজন বিখ্যাত গোয়েন্দা, তোপসে হল তার খুড়তুতো ভাই আর সাকরেদ, আর জটায়ু হলেন তাদের বন্ধু। এই তিনজনে মিলে গোয়েন্দাগিরি করে সাঙ্ঘাতিক সব অপরাধের সমাধান করে ফেলে। ফেলুদার একটা সত্যিকারের রিভলভার আছে যদিও, কিন্তু ফেলুদার আসল অস্ত্র হল তার বুদ্ধি- যাকে সে বলে"মগজাস্ত্র"। এইখানে জটায়ুকে নিয়ে না বললে অন্যায় হবে। জটায়ুর আসল নাম হল লালমোহন গাঙ্গুলি। তিনি একজন জনপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনির লেখক, আর তাঁর একটা সবুজ রঙের গাড়ি আছে। তাঁর হিরোর নাম হল প্রখর রুদ্র!! সেই প্রখর রুদ্র আবার সাড়ে-ছয়ফুট লম্বা!! আর তাঁর লেখা দুই একটা বই এর নাম শুনবে নাকি? -'সাহারায় শিহরণ', 'হন্ডুরাসে হাহাকার', 'ভ্যাঙ্কুভারের ভ্যাম্পায়ার' !! -কি, নাম শুনেই মনে হচ্ছে তো বেশ গা-ছমছমে জমজমাট ব্যাপার-স্যাপার?
ফেলুদা আর তোপসে
ওদিকে আবার আছেন প্রোফেসর শঙ্কু। তাঁর পুরো নাম ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। তিনি গিরিডি তে থাকেন, তাঁর একমুখ সাদা দাড়ি আর চোখে গোল চশমা; তাঁর বাড়ির কাজের লোকের নাম প্রহ্লাদ, তাঁর পোষা বেড়ালের নাম নিউটন, আর তাঁর তৈরি করা রোবটের নাম বিধুশেখর। সে আবার "ধন-ধান্যে-পুষ্পে-ভরা" গাইতে পারে! তিনি নানারকম দারুণ দারুণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন। তাঁর তৈরি 'মিরাকিউরল' বড়ি , একমাত্র সর্দি ছাড়া সব অসুখ সারাতে পারে। তাঁর 'বটিকা ইন্ডিকা' যদি একটা মাত্র খাও, ব্যস, পেট এমন ভরে যাবে যে আর খিদেই পাবে না। আর আছে 'অ্যানাইহিলিন' -সেটাকে শত্রুর দিকে তাক করলেই শত্রু বিনা রক্তপাতে ভ্যানিশ হয়ে যায়। এইরকম আরো সব দুর্ধর্ষ আবিষ্কার করেছেন তিনি। মাঝে মাঝেই তিনি দেশে -বিদেশে নানারকম অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর প্রিয় দুই বৈজ্ঞানিক বন্ধু হলেন সন্ডার্স আর ক্রোল।
নিউটন কে কোলে নিয়ে প্রোফেসর শঙ্কু
সত্যজিতের আরেকজন বিখ্যাত চরিত্র হলেন তারিনী খুড়ো। তিনি বেনেটোলা লেনে থাকেন। সারাজীবন নানারকমের কাজকর্ম করেছেন ভারতবর্ষের বিভিন্নপ্তান্তে। তারিনী খুড়ো তাঁর সেইসব অদ্ভূত মজাদার, মাঝে মাঝে ভয়াবহ সব অ্যাডভেঞ্চারের কথায় শোনান তাঁর স্কুল পড়ুয়া শ্রোতাদের।
নিজের লেখা এই সমস্ত গল্পগুলির জন্য ছবি আঁকতেন সত্যজিৎ নিজেই। শুধুমাত্র ফেলুদা বা প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়েই নয়, আরো নানারকমের ছোট ছোট অনেক গল্প লিখেছেন তিনি। সব গল্প, আর গল্পের বই গুলির প্রচ্ছদ, সব নিজে আঁকতেন তিনি। 'সন্দেশ' পত্রিকা আর অন্য অনেকের বইয়ের জন্য ও ছবি এঁকে দিয়েছেন তিনি। তোমার কাছে যদি সত্যজিৎ রায়ের কোন গল্পের বই থাকে, বা অন্য বই যেখানে ওনার গল্প আছে, সেইখানে ছবিগুলিকে দেখো মন দিয়ে, দেখবে ওনার সই আছে ছবির নীচে। জানো কি, সত্যজিৎ তৈরি করেছিলেন অনেকগুল বাংলা এবং ইংরাজি টাইপফেস। টাইপফেস মানে হল বর্নমালার অক্ষরগুলিকে একটা বিশেষ স্টাইলে দেখানো। তাঁর তৈরি করা 'রে রোমান' আর ' রে বিজার' নামে টাইপফেস দুটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিলো। আর 'সন্দেশ' পত্রিকার জন্যেও তিনি তৈরি করেন অনেকগুলি টাইপফেস।একেকবার একেক রকমভাবে 'সন্দেশ' এর লোগো ছাপা হত।
রে-রোমান
রে বিজার
সন্দেশ এর জন্য নানারকম লোগো
সত্যজিৎ তো প্রথমে কাজ করতেন ডি যে কীমার নামের বিজ্ঞাপনের অফিসে। সেখানে কাজ করতে করতেই ১৯৫৫ সালে তৈরি করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে তাঁর প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালি'। তারপর তো আরো অনেক ছবি তৈরি করেছেন। তার মধ্যে ছোটদের জন্য আছে 'গুপি গাইন বাঘা বাইন', 'হীরক রাজার দেশে', 'গুপি বাঘা ফিরে এল'। তুমি কি এই ছবিগুলি দেখেছো? না দেখে থাকলে শিগগির দেখে ফেলো। ভূতের রাজার দেওয়া তিন বরের সাহায্যে গুপি আর বাঘা, দুজনে মিলে কিভাবে দুষ্টু লোকেদের শায়েস্তা করে ফেলে, তারি টানটান গল্প বলা আছে এই ছবিগুলিতে। গু -গা-বা-বা ছবিগুলিকে শুধুমাত্র পরিচালনা করেন নি তিনি, সেই ছবিগুলির সব অসাধারন গানগুলি লিখেছিলেন এবং সুর ও দিয়েছিলেন তিনি। আছে ফেলুদার গল্প নিয়ে 'সোনার কেল্লা' আর 'জয় বাবা ফেলুনাথ'।
সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কে আরো অনেক অনেক কথা বলার আছে। সব কথা তো এখানে বলার জায়গা নেই। তবে একটা বিষয়ে বলে শেষ করি। এই যে এত এত কাজ করতেন- গল্প লেখা, ছবি আঁকা, সিনেমা তৈরি করা, গান লেখা, সুর দেওয়া - কি করে এতসব এত সুন্দর ভাবে করতেন বল তো? - এর রহস্যটা কোথায় জানো? - ছোট্টবেলা থেকেই কাজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব খুব মনোযোগী। বড় হয়েও তাঁর সঙ্গে সবসময় থাকতো একটা লাল মলাটের খেরোর খাতা। এই খাতায় তিনি সব হোমওয়ার্ক করে রাখতেন। ভাবছো হোমওয়ার্ক তো স্কুলে করতে হয়, বড়দের আবার হোমওয়ার্ক কি? -আসলে কি জানো, বড়দের ও খুব ভালো কাজ করতে গেলে আগে থেকে হোমওয়ার্ক করতে হয়। ওই যে বলছিলাম খেরোর খাতা, সেই খাতাতে কি লেখা থাকতো জানো?- তাঁর সব ছবিগুলির চরিত্র, তাদের চেহারা কেমন হবে, কি পোশাক পড়বে, চারিপাশে কি থাকবে, কিভাবে ছবি তোলা হবে - সব কিছু আগে থেকেই লিখে, এঁকে রাখতেন তিনি। এইরকম আরো অনেক খুঁটিনাটি তথ্যে ভরা ছিলো সেই খাতা। এতো ভালো করে হোমওয়ার্ক করতেন বলেই এতো নিখুঁতভাবে তৈরি করতেন পারতেন তাঁর ছবিগুলিকে।
বিখ্যাত সেই লাল মলাটের খাতা [বাঁ দিকে] আর তাঁর লেখা চিত্রনাট্যের পাতা
একেই বলে হোমওয়ার্ক!
আমাদের সবার প্রিয় এই মানুষটির জন্মদিন ২রা মে। আর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল। বিশ্ববিখ্যাত এই ছয় ফুট চার ইঞ্চি লম্বা মানুষটিকে তাঁর বন্ধুরা মজা করে কি নামে ডাকতেন জানো? -'ওরিএন্ট লংম্যান' - মানে পূর্বদিকের লম্বা মানুষ!!