আঁকিবুকি
সম্পূর্ণা ঘোষ, ৮ বছর, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
দুই বেড়ালের গপ্পো
তুমি কি গারফিল্ডকে চেনো? কিম্বা হিথক্লিফকে? ধরে নিলাম চেনো। হয়তো ভালোও বাসো মনে মনে। আমিও খুব ভালোবাসি ওদের। ওদের সব কিছু দৌরাত্মি ধরা পড়ে কমিকসে। আর সেইসব কান্ড আমরা সবাই খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি টক-মিষ্টি আচার খাবার মতো করে। তাই না? জানো তো গারফিল্ডের নাম গিনেস বুকেও পাওয়া যায়। পৃথিবীর হেন কাগজ নেই যেখানে নাকি গারফিল্ডকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুনে তো নিশ্চই গারফিল্ডের ল্যাজ মোটা হচ্ছে। তা একটু হোক...ওয়ার্ল্ডে পপুলার বলে কথা। খবরের কাগজে জনপ্রিয়তা লাভের পর গারফিল্ডকে আমরা দেখতে পেলাম টেলিভশনের পর্দায়। সেই সিরিজও তো খুব জনপ্রিয়তা পেলো। ভাবছো হিথক্লিফকে নিয়ে বলছি না কেনো? আরে বাপু দাঁড়াও...একটু সবু্র করো দেখি। বলবো তো তার কথাও। দেখছো না গারফিল্ড কেমন মিটমিট করে তাকিয়ে আছে। আগে তার আবদার মেটাই।
গারফিল্ড
গারফিল্ডের আগে জিম পোকামাকড়দের নিয়ে কমিক স্ট্রিপ আঁকতেন এবং লিখতেন। কিন্তু সেই কমিকস খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি আর তেমন প্রশংসাও পায়নি। মনে মনে একটু কষ্ট পাচ্ছিলেন জিম। তখন একদিন এক সম্পাদকের সাথে দেখা হল জিমের তিনি তাঁকে বললেন, "জিম, তুমি আঁকতে ভালোই পারো...গল্পটাও ভালোই বলো...এবার তোমার এমন কিছু নিয়ে কাজ করা উচিত যা পাঠকেরা সহজেই বুঝতে পারবে।" সম্পাদকের পরামর্শ অনুযায়ী সৃষ্টি হলো গারফিল্ডের জীবন বৃত্তান্ত। সবচেয়ে মজার তথ্য হল এই যে গারফিল্ডের নাম থেকে শুরু করে তার চরিত্রের খুঁটিনাটি জিম তৈরী করলেন তাঁর দাদু এ গারফিল্ড ডেভিসের অনুকরণে। আসলে জিমের দাদু বড়ই বদমেজাজি আর অলস। শুরুর দিকে গল্প গুলোতে লেম্যান বলে একটি চরিত্রকে দেখতে পাওয়া যেতো। কারণ ডেভিস ভেবেছিলেন আরবাকলের তো একটা কথা বলার লোকের দরকার। কিন্তু পরে তিনি ভেবে দেখলেন এর জন্য গারফিল্ডই যথেষ্ট। আর সেই থেকে গল্পে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়। মানুষ আর বেড়ালের কথোপকথন আর তার সাথে নানান মজার কান্ড কারখানা। গল্প থেকে লেম্যান চলে গেলেও আরবাকলের বাড়িতে থেকে যায় তার পোষা কুকুর ওডি । গারফিল্ড আবার মাঝে মাঝে টিভি দেখে। শুধু তাই নয় জন যা খাবার আনে গারফিল্ড সব খেয়ে ফেলে। সে এমন লোভী আর পেটুক বেড়াল যাকে ইঁদুরেরা পর্যন্ত খাবারের লোভ দেখিয়ে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়। গারফিল্ডকে সারাদিন ঘুমোতে দেখে জন নিজের মোবাইল চার্জার দিয়ে তাকে চার্জ করতে চায়!! কিন্তু তাতেও কিছু হয় না পেটুক আলসেমিতে ভরা গারফিল্ডের। সে শুয়েই চোখ মিট মিট করে। দেখো এখানেও কেমন মিটমিট করে তাকিয়ে আছে। কুঁড়ের বাদশা নামে আজও গারফিল্ড জগত বিখ্যাত।
ওরে বাবা ওদিকে তো আবার হিথক্লিফ ডাকতে শুরু করেছে বেজায়। চলো তো দেখি কি বলছে? আচ্ছা বুঝেছি তার গোঁসা হয়েছে। বলছি বাবা...বলছি তোমার কথা। ইচ্ছামতীর বন্ধু একটু মন দিয়ে শোনো হিথক্লিফের কথা। কারণ না শুনলে যা পাড়া বেড়ানো স্বভাব তার, কোনদিন তোমার বাড়ি চলে যাবে।
হিথক্লিফ
হিথক্লিফকে গারফিল্ডের দাদা বলতে পারো। কারণ হিথক্লিফ গারফিল্ডের থেকে পাঁচ বছরের বড়। আসল কথাটা হলো জর্জ গেটলি হিথক্লিফের গল্প শুরু করেন ১৯৭৩ সালে। জর্জ গেটলি ছোটবেলা থেকেই দেখতেন তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে আছে নানান কমিকসের বই আর চরিত্রেরা। আর থাকবে নাই বা কেনো তাঁর বাবা আর দাদা তো এই সব নিয়েই চর্চা করতেন। জর্জের দাদা জন একজন নাম করা কার্টুনিস্ট। দাদা এবং বাবার দেখাদেখি জর্জেরও ঝোঁক গেলো আঁকাআঁকির দিকে। ক্যুইনস ভিলেজ ছেড়ে চলে এলেন নিউইয়র্ক শহরে। ভর্তি হলেন বিখ্যাত কলেজ প্র্যাট ইন্সটিটিউটে। পাশ করার পর এক বিজ্ঞাপনের অফিসে কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুতেই জর্জের মন বসছিলো না। ইচ্ছে হতো দাদার মতো কাজ করতে। ১৯৫৭ সালে জর্জের প্রথম কমিকস বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু তুমি মনে মনে হয়তো ভাবছো এই এতো সবের মধ্যে বেড়াল কই? আরে আছে, হিথক্লিফকে দেখতে প্রায় গারফিল্ডের মতো। কিন্তু দেখতে এক হলে হবে কি দুজনের মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আগেই বলেছি গারফিল্ডের মতো অলস বেড়াল আর দুটি নেই। আর হিথক্লিফ? সে হলো পাড়া বেড়ানো...মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ভরা এক বেড়াল। পাড়ার কুকুররাও তার ভয়ে তটস্থ। মাছওয়ালা কিম্বা দুধওয়ালার দুরবস্থার কথা না বলাই ভালো।
হিথক্লিফ বাড়ির পোষা বেড়াল। সেই বাড়ির দিদিমা তাকে খুব ভালোবাসে। আর এই হিথক্লিফকে নিয়ে টেলিভিশন সিরিজ শুরু হয় ১৯৮০ সালে। মনে রাখার মতো কথা হলো যে কমিক স্ট্রিপে হিথক্লিফ কোনো কথা বলতো না। টেলিভিশনের পর্দায় সে কিন্তু কথা বললো। বিখ্যাত কমেডিয়ান অভিনেতা মেল ব্লাঁ [Mel Blanc] হিথক্লিফের কন্ঠে অভিনয় করতেন। ১৯৮৪ সালে আবার শুরু হয় হিথক্লিফের টেলিভিশন সিরিজ। এই সময় থেকে হিথক্লিফের গল্পের সাথে জুড়ে দেওয়া হয় ক্যাটিল্যাক ক্যাটস [Catillac Cats] নামের এক মজাদার সিরিজ। এই সিরিজে দেখতে পাওয়া যায় নানা রকমের বেড়ালদের যারা সাধারণত পাড়া চষে বেড়ায়। এরা সবাই থাকে হিথক্লিফের পাড়াতে। রিফ-র্যাফ হলো দলের নেতা বেড়াল। ক্লিও এক সুন্দরী বেড়াল আর রিফ-র্যাফএর বান্ধবী।
এতো গেলো কমিক স্ট্রিপের বেড়ালদের গল্প। তোমার বাড়িতে বেড়াল আছে নাকি? কিম্বা তোমার বন্ধুর বাড়িতে? নিশ্চই তাদের অনেক মজার গল্প আছে। সব লিখে পাঠাও ইচ্ছামতীকে...আর ও হ্যাঁ বলতে তো ভুলেই যাচ্ছি ছবি পাঠিও তার সঙ্গে। মনে থাকবে তো? আমার এক বন্ধুর বাড়িতে পনেরোটা বেড়াল আর দু-তিনটে কুকুর আছে। বুঝতেই পারছো কেমন সব রকমারি গল্প। সে সব না হয় অন্য কোনোদিন বলবো। ভালো থেকো তুমি।
লেখা ও ছবি
পূর্বাশা
নিউ আলিপুর, কলকাতা
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
রান্না ঘরে গোলমাল
চলো আবার যাই রান্না ঘরে। দেখি সুলুক সন্ধান করে কিছু পাওয়া যায় কিনা। তোমাকে তো যেতেই হচ্ছে। মা ডাকছেন দুধ খেতে।
আরে ওকি? মা 'গেলো গেলো' বলে চিতকার করছেন কেনো? চলতো দেখি। ও, দুধ উথলে পড়ে গেছে আর তাতে গ্যাসও নিভে গেছে।এর পর মা যেটা করলেন সেটা বড়ই গোলমেলে একটা কাজ। গরম দুধটা তাড়াতাড়িতে একটা কাচের গ্লাসে ঢেলে ফেললেন। ব্যস সঙ্গে সঙ্গে চড়াত করে একটা শব্দ,গ্লাস ফেটে চৌচির।
কি গেরোরে বাবা!!
তবে এর পর মা যেটা করলেন সেটা কিন্তু একদম সঠিক কাজ। অন্য একটা গ্লাসে দুধ ঢালার আগে একটা চামচ রাখলেন তাতে। এবার কিন্তু গরম দুধ ঢাললেও গ্লাসটা ফাটলো না।
তিন তিনটা কান্ড হল পর পর। কি মনে হচ্ছে, কি কারন থাকতে পারে এর পেছনে ? দেখা যাক এক এক করে।
দুধটা উথলে উঠে পড়ে গেল কেনো ?অথচ জল টগবগ করে ফোটালেও উথলে ওঠেনা বা পড়ে যায় না। দুধ আর জল ফোটে এক রকম করেই, তবে সামান্য একটু তফাত আছে এক জায়গায়। দুধে ফ্যাট বা 'স্নেহপদার্থ' আছে , জলে নেই। দুধ যখন গরম করা হয় তখন নিচের অংশ গরম হলেও ওপরের স্তরটা কিন্তু তুলনায় কিছুটা ঠান্ডা থাকে। আর যার জন্য ওপরের ফ্যাটটা জমে গিয়ে অপেক্ষাকৃত শক্ত একটা সর পড়ে। সরটা দুধটাকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে। তুমি কি সর খেতে ভালোবাসো? আমি তো খুব ভালোবাসি। কি বললে? একদম পছন্দ নয়? তাহলে আর কি করা যাবে...একবার খেয়ে দেখতে পারো চিনি দিয়ে।
যাকগে, যা বলছিলাম - নীচে দুধের বুদ বুদ গুলি ওপরের দিকে উঠে বেরিয়ে যেতে চায় কিন্তু সরের ঢাকনাতে আটকা পড়ে যায়। তখন সবগুলো বুদ বুদ মিলে একত্রে নিচ থেকে ঠেলা মারে। সরটা ঠেলা খেয়ে ক্রমশঃ ওপরের দিকে ওঠে আর দুধ শেষ পর্যন্ত পাত্রের কানা উপচে বাইরে পড়ে যায়।
একটা চামচ দিয়ে যদি ওপরের সরটা ভেঙে দেওয়া যায় তাহলে কিন্তু দুধটা পড়বে না। সেই জন্যই গরম করার সময় চামচ দিয়ে দুধকে অনবরত নাড়া হয়।
তা তো হলো । কিন্তু কাচের গ্লাসটা ফাটলো কেন বলতো ?
তোমরা কি জান যে সব জিনিষকেই গরম করলে লম্বায় চওড়ায় আয়তনে বেড়ে যায়? কাচের গ্লাসে গরম দুধ বা জল ঢাললে তার ভেতরের তলটা আয়তনে বেড়ে যায়। অথচ কাচ ভেদ করে তাপ গ্লাসের বাইরের স্তর পর্যন্ত দ্রুত পৌছতে পারে না। কাচ তাপের কুপরিবাহি কিনা । তাই বাইরের দিকটা বাড়তে পারে না। ভেতরটা বাড়লো অথচ বাইরেটা যেমনকার তেমনি রয়ে গেলো। সে জন্য দুই স্তরে কাচের প্রসারনের তফাতের কারনে চাপের তারতম্য হলো। আর সেটা হতেই কাচের গ্লাসে চড়াত করে চিড় ধরে গেলো !
মা একটা চামচ গ্লাসের মধ্যে দিয়ে যে কাজটা করলেন সেটা একেবারে সঠিক। এতে কি হল বলতো ? ধাতব চামচ তাপের সুপরিবাহী হওয়ায় গরম দুধের তাপটা তাড়াতাড়ি শুষে নিলো। আর তার কিছুটা বাইরে পাঠিয়ে দিলো। ফলে দুধের তাপ যতটা থাকলে কাচের গ্লাস ফেটে যেত ততটা আর থাকছে না। তাই গ্লাসটাও আর ফাটল না।
কুপরিবাহি কথাটার মানেটা কি জান ? একটু বুঝিয়ে বলি । যে সব পদার্থের মধ্য দিয়ে তাপ চলাচল করতে পারে না সেগুলি কুপরিবাহি। যেমন,কাচ কাঠ কাগজ - এই সব আর কি। আর যারা তাপকে বহন করে বা বয়ে এক জায়গা থেকে আর এক যায়গায় নিয়ে যেতে পারে তারা হল সুপরিবাহি। যেমন, কোন ধাতব পদার্থ। স্টিলের চামচ একটা ধাতব পদার্থ। এটা তাপকে সহজেই অন্যত্র চালান করে দিতে পারে।
চাপের তারতম্য কথাটার মানেটাও তো বলে দিলে ভালো হয়,তাই না ?কাচের গ্লাসের ভেতরটা বেড়ে গিয়ে বড় হতে চাইছে অথচ বাইরেটা যেমনকার তেমনি রইল। একটা টানা- পোড়েনের মতো ব্যাপার হল না ? এটাই চাপের তারতম্য।
মোটা কাচের গ্লাসগুলোই সাধারনত ফেটে যায়। কেননা গ্লাসের দেওয়াল পাতলা হলে কাচ কুপরিবাহী হলেও ভেতরের তাপ একটু তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে পারে। ফলে প্রসারনটা মোটামুটি সমান হয়। গ্লাসও ফাটে না।
সন্তোষ কুমার রায়
রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ
ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ
গ্রিফিথ কে নিয়ে আজও আমাদের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। গল্প বলা ছবির স্রষ্টা হিসাবে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরন করি। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, তিনি ছিলেন ঘোরতর বর্ণবিদ্বেষী। তিনি পৃথিবীর যেকোন সমস্যাকেই সাদা-কালো মানুষের দ্বন্দ্বের ভিতর দেখতেন। তাঁর সাদারা সবসময়ই ভাল, কালোরা সবসময়ই খারাপ। এর একটা কারন হয়ত এই যে, গ্রিফিথ বড় হয়ে উঠেছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলে, যেখানে সে সময়ে, আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে, এই ধরনের ভাবনা চিন্তা গুলি খুব গুরুত্ব পেত। এখোনো কিন্তু অনেকে সেই ভাবনার শিকার। তুমি কিন্তু খবরদার এই ভাবনা চিন্তাকে গুরুত্ত্ব দিও না। মাথাতেও এনো না। আর কেউ ভাবলে তাকে বোঝাতে চেষ্টা কোরো যে গায়ের রঙ দিয়ে সত্যি মানুষকে বিচার করা যায় না...করা উচিত নয়...আমরা কোনো দিন তা করবো না।
যাইহোক যে কথা বলছিলাম...গ্রিফিথ জন্মেছিলেন খুব সাধারণ এক পরিবারে, তাই বড় হয়ে তাঁকে নানাধরনের কাজ করতে হয়েছিল। এমনকি তাঁর বিশ্বাস ছিল যে তিনি লিখতেও পারবেন, কিন্ত তাঁর লেখকজীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সবথেকে মজার ব্যাপার হল যে সিনেমা বিষয়ে তাঁর তেমন কোন উতসাহ ছিলনা, বরং বেশ একটু নাক উঁচু মনোভাব ছিল । তিনি ছবিতে গল্প বেচে চটজলদি কিছু পয়সা আয় করতে চেয়েছিলেন। পোর্টার সাহেব, মানে এডউইন পোর্টার, যাঁর কথা আমরা আগের সংখ্যায় পড়েছি, গ্রিফিথের সুন্দর চেহারায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দৈনিক পাঁচ ডলারের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নায়কের কাজ দেন। সে কাজ বেশিদিন থাকে নি। কিন্তু ভাগ্যের জোর...আর বলতে পারো খানিকটা নিজের ইচ্ছায় গ্রিফিথ একদিন পরিচালক হয়ে গেলেন। তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করতেন তারা টাকার অভাবে নতুন পরিচালক জোগাড় করতে পারছিল না। ফলে গ্রিফিথ কে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হল। তিনি তৈরি করলেন তাঁর প্রথম ছবি 'অ্যাডভেঞ্চারস অফ ডলি'।
এই ছবিটা তৈরি করার সময়েই কিভাবে ভাল গল্প বলবো এই কথা ভাবতে ভাবতে আবিষ্কার হয়ে গেল বিখ্যাত ১৮০ডিগ্রী ব্যবস্থা। ভাবছ সেটা আবার কি? নিচের ছবিটা দেখ।
১৮০ ডিগ্রী ব্যবস্থা
একজন নীল জামা পরা লোক,আরেকজন কমলা জামা পর লোকের সঙ্গে কথা বলছে। যতক্ষণ তাদের মধ্যে কথা চলবে, ততক্ষণ ক্যামেরা ছবির ডান দিকের সবুজ লাইন বরাবর যেখানে ইচ্ছা বসানো যেতে পারে। এইভাবে সবসময়ই কমলা জামা পরা লোকটি বাঁ দিকে থাকবে আর নীল জামা থাকবে ডান দিকে। ক্যামেরা যদি উল্টোদিকে বসে, তাহলে তো নীল জামা চলে যাবে বাঁ দিকে আর কমলা জামা যাবে ডান দিকে !! এবার যদি ক্যামেরা একবার এদিকে, একবার ওদিকে বসানো হয়, তাহলে দর্শকের চোখে বড় বেশি ঝাঁকুনি লাগবে যে। কিন্তু ক্যামেরা যদি এই ১৮০ডিগ্রী ব্যবস্থা মেনে এক শট থেকে অন্য শটে যায়, তাহলে আমরা আর গল্পটা দেখতে দেখতে চমকে উঠব না। আমাদের মনে হবে আমরা সিনেমা নয়, যেন সত্যি ঘটনা দেখছি -চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দুইজন মানুষ কথা বললে যে অনুভূতি হয়, সেইরকম লাগবে।
এইভাবেই, আমরা দেখতে পাই যে, ১৯০৮-০৯ সাল নাগাদ, গ্রিফিথ ক্যামেরা থেকে বিষয়বস্তুর দূরত্ব অনুযায়ী নানারকম শট, যেমন ফুল শট বা ক্লোজ-আপ তৈরি করেছেন। ফুল শট মানে জানো তো? যখন একজন চরিত্রের মাথা থেকে পা অবধি পর্দায় দেখা যায়, তাকে বলে ফুল শট। আর যখন সেই চরিত্রের শুধুমাত্র মুখটাকে আমরা পর্দায় দেখতে পাই তখন তাকে বলা হয় ক্লোজ-আপ। বোঝানোর খাতিরে আমি এই সহজ উদাহরণ দিলাম। তাই বলে ভেবো না এটাই একমাত্র উদাহরণ। ক্লোজ-আপেরও নানা রকম ফের আছে আর ফুল শটেরও। সে না হয় অন্য কোনো দিন বলবো। কিন্তু এখন মনে হতেই পারে এই দুই রকম শটের দরকার কি? দরকার আছে, গল্প বলার খাতিরেই দরকার আছে। ফুল শট ব্যবহার করে একজন চরিত্রের অবস্থান বোঝানো যায়, যেমন, লোকটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে - রাস্তার ধারে, না বাগানে, সাথে কেউ আছে কিনা, আশেপাশে কে আছে; আর ক্লোজ-আপে দেখানো যায় সেই চরিত্রের মুখের ভাব - সে খুশি, না তার মন খারাপ।
গ্রিফিথের এইসব নিয়মগুলি দিয়েই শুরু হল হলিউডের এক নতুন যুগ...ছবির এক নতুন ভাষা। শুরু হল ধ্রুপদী বা ক্ল্যাসিকাল সিনেমার পথচলা। ধ্রুপদী কথাটার মানে হল যা কিনা চিরায়ত, এমন কিছু যা বহু বছর ধরে একইরকম ভাবে চলে আসছে, যার একটা নিজস্ব উতকর্ষ আছে যেটাকে মেনে চলা যেতে পারে। যেমন ধর, ভারতবর্ষের রাগপ্রধান সঙ্গীতের ধারা, যাকে বলা হয় ধ্রুপদী সঙ্গীত, যে গানের ধারা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। সেইরকমই হল সেই সময়ের সিনেমা তৈরির নিয়ম - সেই একশো বছর আগেও যা মেনে চলা হত, আর যা এখনও মোটামুটি ভাবে সবাই মেনে চলে।
গ্রিফিথের এই সমস্ত নিয়মগুলির কিন্তু দেশে-বিদেশে কদর বাড়তে থাকলো। এমন কি, সেই সময়ে আমেরিকার সঙ্গে যে দেশের মোটেও বন্ধুত্ব ছিল না, সেই সোভিয়েত রাশিয়াতেও তাঁর নিয়মগুলি নিজের ছাত্রদের শেখাতেন আরেক বিখ্যাত পরিচালক লেভ কুলেশভ।
গ্রিফিথের আরেকটি অবদান হল যে তখনও পর্যন্ত যে টু-রিলার [দুই রিলের] ছোট ছবি বানানো হত, সেই রেওয়াজ তিনি ভেঙ্গে ফেললেন, এবং ১৯১৪ সালে তৈরি করলেন বিখ্যাত ছবি 'বার্থ অফ আ নেশন'। অনেকেই এই ছবিকে পৃথিবীর প্রথম পূর্ন দৈর্ঘ্যের আখ্যানচিত্র, বা গল্প বলা ছবি বলে মান্য করে থাকেন। এই ছবির নির্মাণে খরচ হয়েছিল সেই যুগের এক লক্ষ দশ হাজার ডলার। এই ছবিতে আছে ১৫৪৪ টি শট, সেযুগের পক্ষে যা অতিরিক্ত বেশি। সেগুলিকে নানারকম ভাবে মাত্র তিন মাসের মধ্যে জুড়ে জুড়ে, গ্রিফিথ তৈরি করেছিলেন এক অসাধারণ সিনেমা এবং দেখিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে বিরতি না নিয়ে একটি গল্প বলতে পারা যায় এবং দর্শককে প্রায় বই পড়ার অনুভূতি দেওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কি, আজও গল্প বলা সিনেমা যেসব উপায়ে জমজমাট গল্প বলে, তার মধ্যে প্রায় সবকটিই প্রথম ব্যবহার হয়েছিল 'বার্থ অফ আ নেশন' ছবিতে। এর ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি আমরা অনেকেই ভাবি ছবি দেখা তো একটা সহজ ব্যাপার। এই তো যা দেখছি...যেমন ভাবে দেখছি সেটাই তো একটা ছবি। এর জন্য আলাদা করে ভাবার...পড়াশুনো করার কি কোনো দরকার আছে? অনেকে বলেছিলেন নেই অনেকে বলেছিলেন আছে কেউ কেউ ছবি দেখা...বানানোর পাশাপাশি লেখালেখিও শুরু করেছিলেন। আর সেটা শুরু হয়েছিলো ছবি জন্মানোর প্রায় সেই সময় থেকেই। ওদিকে এখন যাবো না কারণ সে তো আর এক ইতিহাসের গল্প। বরং আমরা 'বার্থ অফ আ নেশনের' দিকে মনোযোগ দিই।
এই ছবিটি আমেরিকার গৃহযুদ্ধের বিষয়ে গল্প বলে। আগেই বলেছি, গ্রিফিথ ছিলেন আদতে বর্নবিদ্বেষী। তাঁর এই ছবিটিও এইরকম ভাবনা চিন্তায় ভরা। 'বার্থ অফ আ নেশন' একদিকে যেমন প্রচুর জনপ্রিয় হয়, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উডরো উইলসন একে বলেন 'আলোয় লেখা ইতিহাস'; অন্যদিকে, জাতিবিদ্বেষের জন্য এই ছবিটিকে প্রচুর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়।
হয়ত সমালোচনার ফলেই, দুইবছর পরে তৈরি 'ইনটলারেন্স' [১৯১৬] ছবিতে গ্রিফিথ অনেক বেশি উদারতার পরিচয় দেন। এই ছবিটি আজও অবধি হলিউডের এক অন্যতম জমজমাট ছবি। এই ছবিতে গ্রিফিথ, তাঁর অন্যান্য নিয়মগুলির সাথে, প্রথম ব্যবহার করেন 'মন্তাজ' নীতি। যে নীতিতে কয়েকটি ছবি পরপর বসিয়ে একটি ঘটনা বা অবস্থা বোঝানো যায়।
বলা যেতে পারে, ডেভিড ওয়র্ক গ্রিফিথই প্রথম প্রমান করেন যে আধুনিক শিল্প হিসাবে সিনেমা কতটা সম্ভাবনাময়। আবার বলি তাঁর হাত ধরেই আমাদের সামনে আসে সিনেমায় গল্প বলার কতগুলি দুর্দান্ত নিয়ম, যা আজও ব্যবহার হচ্ছে। এরপর থেকেই সিনেমার চেহারা আমূল পালটে গেল, শুধু আমেরিকাতেই নয়,সারা পৃথিবীতেই। ছবি আর তার ভাষা নিয়ে পৃথিবী জুড়ে সবাই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে লাগলেন। শুরু হল শিল্পের আর এক নয়া মাধ্যম চলচ্চিত্রের জয়যাত্রা। সেই গল্প আমরা পরের বার বলবো। সেই গল্প শুরু হবে বিখ্যাত নির্বাক মার্কিনী হাসির ছবিগুলি নিয়ে- চ্যাপলিন, কীটন, লয়েড, সেনেট - এইসব মজাদার মানুষদের নিয়ে।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপক, চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
দ্য ব্লু আমব্রেলা
হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রামে থাকে বীণা। পড়ার সাথে সাথে সে বাড়ির অনেক কাজ করে দেয়,বন্ধুদের সাথে খেলে আবার রাগ হলে ঝগড়া করতেও ছাড়ে না।
বীনা
তাদের গ্রামটা খুব সুন্দর তাই মাঝে মাঝেই ট্যুরিস্টরা সেখানে ঘুরতে আসে, সবার ছবি তোলে...গ্রামের বাইরের মাঠে তখন যেন এক জমজমাট আসর বসে। আর সেই সময় নন্দকিশোরের ফূর্তি দেখে কে। ও নন্দ কিশোরকে তুমি চেনো না বুঝি? নন্দকিশোর হল এক মুদি। যার দোকান থেকে গ্রামের মানুষরা সারা বছর কেনাকাটা করে আর নন্দকিশোর মাঝে মাঝেই সেই গ্রামের লোকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে,পয়সার গরম দেখায়। বিদেশীদের ডেকে ডেকে গরম কোকাকোলা খাওয়ায় আর বলে যে তার তো ফ্রিজ নেই তাই ঠান্ডা করবে কোথা থেকে?
নন্দকিশোর
নন্দকিশোর বীণার কাছ থেকে ছাতাটা কিনতে চায়। কিন্তু বীণা দেবে কেনো? ছাতাটা যেন তার প্রাণ...তেপান্তরের মাঠ...রাজকন্যের জীয়ন কাঠি। বীণা ছাতা দেয় না,বরং ডাকাবুকো মেয়েটা বলে আসে খবরদার নন্দকিশোর তার ছাতার দিকে যেনো ফিরেও না তাকায়। কিন্তু তাই কি হয়? নন্দকিশোর তার দোকানের পুঁচকে বদমাশ ছেলেটাকে দিয়ে ছাতাটা চুরি করে। বীণা তন্নতন্ন করে খোঁজে,ছাতা পায় না। সে পুলিশ কাকুদের বলে নন্দকিশোরের ঘরে তল্লাশি চালায় কিন্তু কিছুই পাওয়া যায় না। হঠাত একদিন সবাই দেখে নন্দকিশোর একটা লাল রঙের জাপানী ছাতা মাথায় দিয়ে ঘুরছে। গ্রামে তার প্রতিপত্তি আবার বাড়তে থাকলো আর সবাই বীণা আর তার বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিলো। মনমরা হয়ে থাকলো বীণা। একদিন তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো সে পিছু নিলো নন্দকিশোরের। আর সেখান থেকেই জানতে পারলো নন্দকিশোর আসলে তার ছাতাটা চুরি করে রঙ করে ফেলেছে।
এদিকে গ্রামে খুব ঘটা করে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। সভাপতির আসন অলংকৃত করছেন নন্দকিশোর। তার তো অহংকারে আর মাটিতে পা পড়ছে না। এই রকম এক সময় হয়েছে কি বৃষ্টি নেমেছে। আর পাহাড়ের বৃষ্টি জানোই তো কেমন তেড়ে হয়। সেই বৃষ্টির পরোয়া না করেই নন্দকিশোর তার ছাতা নিয়ে খেলা দেখতে থাকলো আর ছাতার সব লাল রঙ গলে গলে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকলো। লাল ছাতাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই বীণার সেই নীল ছাতা হয়ে গেল। গ্রামবাসীরা সবাই ছি ছি করতে থাকলো। একটা ছোট্ট মেয়ের ছাতা চুরির অপরাধে নন্দকিশোরকে সবাই বয়কট করলো। কেউ তার দোকান থেকে কোনো জিনিস কেনে না...কথা বলে না...বিয়েতে, নানা অনুষ্ঠানে কেউ আর তাকে ডাকে না। এইভাবে সময় বয়ে চলে,গুটি গুটি পায়ে শীত চলে আসে... গাছের পাতা ঝরতে শুরু করে বরফে ঢেকে যায় গোটা গ্রাম...নন্দকিশোর একা।
এরকমই এক শীতের সকালে গ্রামের বাইরে নন্দকিশোরের দোকানের সামনে হঠাত একদিন কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। নন্দকিশোর তখন সেই সকালবেলা নিজের মনে বকবক করছিলো আর চা খাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। খুট করে আওয়াজ শুনে নন্দকিশোর দেখে তার দোকানের সামনে বীণা দাঁড়িয়ে। তার হাতে নীল রঙের সেই ছাতা। বীণা একটা বিস্কুট কেনে। কতদিন পর নন্দকিশোরের দোকান থেকে কেউ কিছু কিনলো। বীণা চলে যাওয়ার পর নন্দকিশোর দেখলো তার দোকানের দরজার গায়ে হেলান দেওয়া সেই নীল রঙের ছাতা। বীণা ভুলে ফেলে গেছে। নন্দকিশোর সারাদিন ছাতাটাকে বুকে আগলে নিয়ে বসে থাকলো...কাঁদলো...রাতে ঘুমলো না...এক সময় রাগে ছাতাটাকে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু পারলো না...সে যে বড় ভালোবাসে ছাতাটাকে। আবার সকাল হলো...আবার ঝিরঝিরে বরফের বৃষ্টির মধ্যে বীণাকে হাঁটতে দেখে নন্দকিশোর তাকে ডাকলো। ছাতাটা বীণার হাতে তুলে দিল। এবার কিন্তু অবাক করে দিয়ে বীণা ছাতাটা আর নিলো না। সে বললো এটা তার ছাতা নয়,নন্দকিশোর ইচ্ছে করলে নিতে পারে। ভেউভেউ করে কেঁদে ফেললো নন্দকিশোর কারণ সে ততদিনে জেনে গেছে চুরি করা, মিথ্যে কথা বলা অন্যায়...জীবনের বড় পাপ। ছোট্ট মেয়েটার কাছে সেদিন তার থেকেও বড় একটা মানুষ অনেক কিছু শিখলো।
আমিও সিনেমার হল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ফাঁকা লন দিয়ে হাঁটার সময় মনে মনে ভাবলাম বীণার ভূমিকায় অভিনয় করা শ্রেয়া শর্মার কথা। এইটুকু সময়ের মধ্যে সে আমাদের সবার মন জুড়ে বসে আছে। ভারতে পাহাড়ে ঘেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত অসংখ্য গ্রামের ছোট্ট বীণাদের প্রতিনিধি আজ সে। রাস্কিন বন্ডের গল্পের অনুপ্রেরণায় এমন এক মিষ্টি ছবি উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ।
কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া, হুগলী
ছবি
স্ম্যাশহিটস
- বিস্তারিত
- লিখেছেন কল্লোল লাহিড়ী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত