সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

ক্রিসমাস আইল্যান্ড-এর ক্র্যাব ব্রিজ

অনেকদিন পর তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্য ফিরে এলাম। কেমন আছ ? পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে আমরা যারা আছি, তাদের বেশিরভাগই এখন গরমকাল বা গরমের ছুটির মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। এর আগের বেশ কয়েক বছরের মতই, এই বছরেও আমরা আরও একবার, যেন আরও বেশি করে বুঝতে পারছি আমরা প্রকৃতির কতটা ক্ষতি করে ফেলেছি। প্রচন্ড গরমে মানুষ -গাছপালা-পশুপাখি সবার অবস্থা শোচনীয়। একদিকে মাসের পর মাস বৃষ্টি নয়, অন্যদিকে 'রেমাল' এর মত ভয়াবহ সাইক্লোন আবারও একবার বঙ্গোপসাগরের উপকূলের কাছে বসবাসকারী মানুষদের জীবনে বিপদ ডেকে এনেছে। এত সব কিছু জানা বা বোঝার পরেও, আমরা কি সত্যি বদলেছি? গাছ কাটা, বন কেটে রাস্তা তৈরি করা, পাহাড়ের উপর বহুতল বানানো... কিছুই তো থামিয়ে রাখছি না। পৃথিবীর যতটা ক্ষতি আমরা করে ফেলেছি, তা পূরণ করা সহজ কাজ নয়। তবুও, আমাদের আশা বা ভরসা হারালে চলবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, অনেক মানুষ, নিজেদের মত , অল্প অল্প করে, এমন অনেক কাজ করে যাচ্ছেন। তেমনই একটা জায়গা আর সেখানকার মানুষ আর প্রাণীদের গল্প লিখলাম আজ তোমার জন্য।

ভারত মহাসাগরের কোলে, জাভা ও সুমাত্রার দক্ষিণে, অষ্ট্রেলিয়ার অধীনস্থ এক ছোট্ট দ্বীপ 'ক্রিসমাস', ইংরেজিতে Christmas Island। এই দ্বীপের বেশিরভাগ জায়গা জুড়িয়ে ছড়িয়ে রয়েছে এক জাতীয় উদ্যান - ক্রিসমাস আইল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক। এই দ্বীপের মোট জনসংখ্যা ২০০০-এর ও কম। এই ছোট্ট দ্বীপটি বিশ্বের পরিবেশবিদদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যেহেতু এখানে মানবসভ্যতার প্রভাব কম --- কল-কারখানা-কংক্রিটের বহুতলের আধিপত্য অনেক কম, তাই এই দ্বীপের জীববৈচিত্র অনন্য। এখানে এমন বহু গাছপালা, পাখি এবং প্রাণী দেখা যায়, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও --- এমনকি মূল অস্ট্রেলীয় ভূখন্ডেও দেখতে পাওয়া যায় না।

প্রতি বছর এই দ্বীপে এক অসাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে, যা দেখতে সারা পৃথিবীর থেকে পর্যটকেরা এখান ভীড় জমান। পরিবেশবিদ এবং উৎসাহীদের কাছে ঘটনাটি 'লাল কাঁকড়াদের পরিযান' (Red Crab Migration) নামে পরিচিত।

এই বার্ষিক ঘটনাটির বিষয়ে আলোচনা করার আগে ক্রিসমাস দ্বীপের লাল কাঁকড়াদের বিষয়ে কিছু জেনে নেওয়া যাক। ক্রিসমাস দ্বীপের ঘন রেইনফরেস্ট বা অতিবৃষ্টি অরণ্যে বসবাস করে ১০ কোটির থেকেও বেশি সংখ্যক লাল কাঁকড়া। বুঝতেই পারছ, শুধু ঘন বন নয়, উপকূলের পাথুরে খাঁজগুলি থেকে শুধু করে মানুষের বাড়ির বাগানেও এদের দেখা মেলে। এই কাঁকড়ারা মাটিতে গভীর গর্ত খুঁড়ে বা পাথরের গভীর ফাটলের ভিতর বসবাস করে। শুকনো আবহাওয়া একেবারেই পছন্দ নয় বলে, গ্রীষ্মকালটা এরা প্রায় বাইরে বেরোয় না, আর নিজেদের বাসার মুখে গাছের পাতা চাপা দিয়ে রাখে। শুকনো পাতা, ফল, ফুল বা বীজ ছাড়াও, এরা মাঝেমধ্যে আমিষ খাবারও খায়, যেমন মৃত কাঁকড়া, ছোটো পাখি বা শামুক।


সমুদ্রের দিকে লাল কাঁকড়াদের বার্ষিক যাত্রা

ক্রিসমাস দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় এই কাঁকড়াদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরা ঝরাপাতা খেয়ে বনভূমি পরিচ্ছন্ন করে, গর্ত খুঁড়ে মাটি উল্টেপাল্টে দেয় আর নিজেদের শরীরের বর্জ্য মারফত মাটিতে উর্বর করে তোলে। এই কারণগুলির কথা মাথায় রেখেই, এই দ্বীপের মানুষ এবং জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষ এই সমস্ত কাঁকড়াদের যতটা সম্ভব যত্ন নিয়ে দেখভাল করেন।

প্রতি বছর বর্ষাকালে, অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে, ( মনে রাখতে হবে দ্বীপটি দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত, তাই সেখানে ঋতু পরিবর্তনের হিসেব উত্তর গোলার্ধের বিপরীত), সারা দ্বীপের লাল কাঁকড়ারা সমুদ্রের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। লক্ষ্য একটাই, সেখানে গিয়ে ডিম পেড়ে নতুন প্রজন্মের জন্ম দেওয়া। প্রথমে ঘর ছাড়ে পুরুষ কাঁকড়ারা। তাদের পেছন পেছন একই পথ ধরে স্ত্রী কাঁকড়ারা।

মজার কথা হল, এই পরিযান ঠিক কখন শুরু হবে আর কত দ্রুতগতিতে এগোবে, তা চাঁদের কলার উপর নির্ভর করে । এই কাঁকড়ারা কীভাবে এমন হসেব করতে পারে , সেই রহস্য আজও অজানা, কিন্তু সবসময়েই কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে জোয়ারের জম কমতে শুরু করলে, ভোরের দিকে এই লাল রঙের স্ত্রী-কাঁকড়ারা ডিম পাড়ে। কিন্তু বৃষ্টি না পড়লে তো তারা সমুদ্রের দিকে হাঁটা দেয় না। তাই বৃষ্টি যদি দেরিতে আসে তাহলে সঠিক সময়ে সমুদ্রে পৌঁছানোর জন্য তাড়াহুড়ো লেগে যায়। আর যদি বৃষ্টি আগেই এসে পড়ে, তাহলে কাঁকড়ারা ধীরে-সুস্থে, বিশ্রাম নিয়ে এগোয়।

পুরুষ কাঁকড়ারা আগে সমুদ্রে পৌঁছায়। সেখানে জলে এক ডুব দিয়ে, তারা স্থলভাগের গভীর ফাঁকফোকরে বাসা তৈরি করে। এই সময়ে তারা নিজেদের মধ্যে এলাকা দখন নিয়ে লড়াই ও করে। এর পরে স্ত্রী কাঁকড়ারা এসে পৌঁছায়। স্ত্রী ও পুরুষ কাঁকড়ারা মিলিত হওয়ার পরে, স্ত্রীরা প্রায় সপ্তাহ দুয়েক সেই বাসায় থেকে যায়। পুরুষরা আবার স্থলভাগের ভেতরে ফেরার যাত্রা শুরু করে।

একেকটি স্ত্রী কাঁকড়া প্রায় ১,০০০,০০০টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলি একটা থলির মধ্যে থাকে। কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে তারা নিজেদের বাসা থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের তীরে জড়ো হয়। যখন জোয়ারের জল কমতে থাকে, তখন তারা ধীরে জলে নেমে ডিম পাড়ে। এমন পরপর কয়েক রাত চলতে পারে।

লাল কাঁকড়াদের ডিল জলের ছোঁঁয়া পেলেই ফোটে এবং লার্ভা বেরিয়ে আসে। জমাট বাধা লার্ভাগুলি সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে বেড়ায়। এর পরে বেশ কিছুদিন ধরে সেগুলির শারীরিক পরিবর্তন হয় এবং মাসখানেল পরে, সেই অতি ছোট্ট শিশু কাঁকড়াগুলি ডাঙায় ফেরা শুরু করে। প্রায় নয় দিন লেগে যায় একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে।


সদ্য জন্মানো শিশু কাঁকড়া

তবে, সত্যি কথা এই যে, প্রতিবছর এই লাখ লাখ নতুন কাঁকড়াদের মধ্যে মাত্র কিছু অংশই বেঁচে ডাঙায় ফিরতে পারে। বেশ্রিভাগ সময়ে তারা বড় মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীদের শিকার হয়। তবুও, কয়েকবছর পর পর এক সঙ্গে বেশি সংখ্যায় বেঁচে যায় এবং ক্রিসমাস দ্বীপের মোট কাঁকড়ার সংখ্যার গড় বজায় থাকে।

এই পুরো সময়টা জুড়ে, এই দ্বীপের মানুষ এবং বিশেষ করে জাতীয় উদ্যানের কর্মীরা রেড ক্র্যাব বা লাল কাঁকড়াদের এই বিশেষ যাত্রার সুবিধা করে দিতে কী করেন? --- এই সময়ে এই দ্বীপের অনেক রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পর্যটকেরা ইচ্ছে হলে গাড়ি থেকে নেমে সাবধানে কাঁকড়াদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে পারেন। এছাড়া অনেক রাস্তার উপর 'ক্র্যাব ব্রিজ' তৈরি করে রাখা আছে। শক্ত জাল দিয়ে তৈরি এই ব্রিজ বা সেতুগুলির উপর দিয়ে কাঁকড়া নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে। এছাড়া এই পরিযানের সময়ে স্থানীয় রেডিওতে এবং বিভিন্ন নোটিসবোর্ডে সতর্কতা জারি করা হয়ে থাকে, যাতে মানুষ বা লাল কাঁকড়া, কারোরই যাতায়াতে অসুবিধা না হয়।

ক্রিসমাস দ্বীপ একটা ছোট্ট, প্রায় বিচ্ছিন্ন এলাকা এবং এখানে মানুষের সংখ্যা সীমিত বলে কাঁকড়াদের জন্য এমন সুব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে। ভারতের মত ভীড়ে ঠাসাঠাসি দেশে হয়ত এমন কিছু করা বেশ অসুবিধা জনক। তবুও, চাইলে আমরাও আমাদের দেশের বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের জন্য এমন কিছু করতে পারি --- যেমন ধরা যাক, উত্তরবঙ্গে হাতিদের যাতায়াতের জন্য আলাদা পথ, যাতে তারা বিনা কারণে রেলে কাটা না পড়ে। বিশ্বের অনেক দেশেই এমন সব সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

আজকের গল্প এইটুকুই। আবার ফিরবে আসব, নতুন গল্প নিয়ে, শিগগির। ভালো থেকো।

৫ জুন, ২০২৪
২২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
বুধবার, বিশ্ব পরিবেশ দিবস।

তথ্যসূত্র: https://parksaustralia.gov.au
ছবি: এই পার্কের ফেসবুক পেজ

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা