
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা /ISRO- তে কর্মরত বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী শ্রী অরিন্দম চক্রবর্তী-র সঙ্গে কথোপকথন।
নমস্কার শ্রী চক্রবর্তী। সম্প্রতি চন্দ্রযান উৎক্ষেপনের সাফল্যে ইসরোর নাম সবার মুখে মুখে ঘুরছে ঠিকই, কিন্তু আপনার সঙ্গে আমাদের এই কথোপকথনের ভাবনা অনেকদিন আগে থেকেই ছিল; শুধু সময় বা সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এই কথোপকথনের মূল উদ্দেশ্য ইচ্ছামতীর পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে ইসরোর মত দেশের এক প্রথম সারির সংস্থার পরিচয় এবং সেখানে আপনার কাজকর্মের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া। আশা রাখছি, এই কথোপকথন ভবিষ্যতে মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চাওয়া এবং/ অথবা মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহী পাঠকদের কিছু কৌতূহল মেটাবে।
১। একেবারে শুরু থেকে শুরু করি। আপনার ছোটবেলার কথা, বড় হয়ে ওঠার দিনগুলির কথা কিছু বলুন।
— আমি বড় হয়েছি পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খন্ডের সীমান্তে অবস্থিত, রূপনারায়ণপুর নামের এক ছোট শিল্পাঞ্চলে। সেখানে আমার বাবা হিন্দুস্থান কেবলস্ লিমিটেড নামের এক সংস্থায় কাজ করতেন। আমি সেই সংস্থার স্কুলেই একেবারে ছোটবেলা থেকে উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়াশোনা করেছি । যদিও সেখানে সুযোগ সুবিধা অনেক কম ছিল, কিন্তু আমরা স্কুলে খুব ভালো কিছু শিক্ষকদের পেয়েছিলাম, যাঁরা আমাদের সবরকম ভাবে সাহায্য করতেন। জগৎ সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের প্রাথমিক রসদ ছিল বই, মূলত পাঠ্যবইগুলি। পরে ক্রমে ক্রমে যত বড় হলাম, নানা রকমের রেফারেন্স বই, সাধারণ জ্ঞানের বই, এনসাইক্লোপিডিয়া — এমন সব বইয়ের সঙ্গেও পরিচয় হল।
আমাদের ছোটবেলায় একটা বড় আকর্ষণ ছিল পাশের রেল শহর চিত্তরঞ্জনের বাৎসরিক বইমেলা। সেখানে অবশ্য নতুন ভূতের গল্প আর গোয়েন্দা গল্পের বইগুলির জন্যই যেতাম।
আশির দশকের শুরুর দিকে আমাদের অঞ্চলে টেলেভিশন সম্প্রচার শুরু হয়। এর ফলে আমাদের সবার জীবনে প্রিন্ট মিডিয়া বা ছাপা বই/কাগজের বদলে জায়গা নেয় এই নতুন অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যম। সেই সময়ে দূরদর্শনের একটাই চ্যানেল ছিল। কিন্তু সেই একটাই চ্যানেল আমাদের সারা বিশ্বের নানা ধরনের বিষয়ে জানাতো— বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ক্রিকেট, ফুটবল, ক্যুইজ শো, সাক্ষাৎকার, আন্তর্জাতিক খেলার প্রতিযোগিতা যেমন উইম্বল্ডন বা অলিম্পিক্স... আমাদের চোখের সামনে যেন একটা নতুন জানালা খুলে গেছিল যেখান দিয়ে আমরা সারা দুনিয়ার খোঁজ রাখতে পারতাম।
২। আমাদের সমাজে ছোটদের একেবারেই ছোট্টবেলা থেকে বলা হয় – ডাক্তার হতে হবে বা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। আপনাকেও কি সেভাবে বলা হয়েছিল ইসরোর বিজ্ঞানী হতে হবে? না কি এটা বড় হয়ে আপনার নিজস্ব সিদ্ধান্ত ছিল?
— আমি কোনোদিন ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি। আমার মা-বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন ডাক্তার হই এবং দেশের-দশের উপকারে লাগি। তাই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে, নিয়মমাফিক আমি ডাক্তারি পড়ায় সুযোগ পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসি। কিন্তু আমার পরীক্ষার ফলাফল ততটা ভালো না হওয়ায় আমি এম বি বি এস পড়ার সুযোগ পাই না।
তখন আমার হাতে পড়ে রইল একটাই উপায় — কোনো একটা বিভাগে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া আর পরের বছরের জয়েন্ট এর জন্য আবার প্রস্তুতি নেওয়া। আমি দুটি জায়গায় সুযোগ পেলাম — যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অংকে অনার্স ; আর আসানসোলের বানওয়ারিলাল ভালোটিয়া কলেজে ( বি বি কলেজ) ফিজিক্স অনার্স। এইবার আমি ধন্ধে পড়ে গেলাম, কোন পথে যাব?
এই সময়ে আমি নিজের দুই প্রিয় এবং সম্মানীয় মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। স্বর্গত শ্রী সন্তোষ কুমার রায় আমাদের ফিজিক্সের শিক্ষক ছিলেন। আর স্বর্গত শ্রী শান্তিময় চ্যাটার্জি ছিলেন কেমিস্ট্রির শিক্ষক। তাঁরা দুজনেই আমাকে বলেন আমার ফিজিক্স নিয়ে পড়া উচিত, কারণ এই বিষয়ে পড়াশোনা করলে ভবিষ্যতে নানা ধরনের কাজের পথ খোলা থাকবে। তাঁদের মতামতের ওপর আস্থা রেখে আমি আসানসোলে বি বি কলেজে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। বলা যায়, এই সিদ্ধান্ত আমার ভবিষ্যতের পথ নির্দিষ্ট করে দেয়।
পরের বছরের জয়েন্ট এন্ট্রাস পরীক্ষাতেও আমি মেডিক্যালে সুযোগ পেলাম না। আমি ফিজিক্স অনার্স নিয়ে স্নাতক হওয়ার পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে মাস্টার্স করলাম। তারপরে সেখান থেকেই মাইক্রোয়েভস্ বিষয়ে এম টেক করি। শেষ অবধি, ইচ্ছে না থাকলেও আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলাম। আমি তখনও জানতাম না আমার জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে।
৩। ইসরো- তে আপনি কীভাবে, কবে যোগ দিলেন?
— এম টেক সম্পূর্ণ করে, আমি রাজস্থানের পিলানিতে অবস্থিত সেন্ট্রাল ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইন্স্টিট্যুট-এ (CEERI) প্রোজেক্ট সায়েন্টিস্ট পদে যোগ দিই। তবে আমি থেমে থাকি নি। আমি দেশে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় কাজের খোঁজে থাকি। মাস ছয়েক পরে, আমার কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের দুটো আকর্ষণীয় কাজের সুযোগ আসে — প্রথমটা ছিল ব্যাঙ্গালোরের ইসরো আর দ্বিতীয়টা ছিল কলকাতার ভ্যারিয়েবল্ এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার। আমার মা খুব চেয়েছিলেন যে আমি কলকাতায় ফিরে আসি। বাবা অবশ্য সিদ্ধান্তটা আমার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
এই সময়ে পিলানিতে আমার প্রোজেক্ট গাইড, ডঃ এ কে সিন্হা আমাকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন। তিনি আমাকে বলেন ইসরোর কাজে যোগ দিতে। তাঁর এই পরামর্শ যে কতটা লাভজনক ছিল সেটা আমি আজ বুঝি।
১৯৯৯ সালের দিওয়ালির দিনটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয়। সেইদিন আমি পিলানি ছেড়ে জীবনের নতুন অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে ইসরো স্যাটেলাইট সেন্টারের ( এখন ইউ আর রাও স্যাটেলাইট সেন্টার /URSC) উদ্দেশ্যে পাড়ি দিই। সেখানে আমি স্যাটেলাইট/ উপগ্রহ পরিচালন এবং নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা মিশন গ্রুপে যোগ দিই। আমার এক নতুন, উত্তেজনায় ভরপুর কেরিয়ারের শুরু হয়।
৪। ইসরোর একজন বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে, আপনার সারাটাদিন কেমনভাবে কাটে? দিনে কতক্ষণ কাজ করতে হয়?
— খাতায় কলমে ইসরোতে আমাদের কাজের সময় সপ্তাহে পাঁচদিন, সকাল ৮-৩০ থেকে বিকেল ৫-০০ অবধি। কিন্তু অনেক সময়েই বিকেল পাঁচটায় আমাদের কাজ শেষ হয় না। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সব সময়ে, যেমন জরুরী টেস্টিং বা লঞ্চ অপারেশন্স্ চলাকালীন, আমরা দিন-রাত ভুলে কাজ করি; সেই সময়ে কোনো উৎসবের জন্য বা সপ্তাহশেষের ছুটি পাওয়ার প্রশ্নই নেই। এখানে জানিয়ে রাখি, অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য ইসরোর বিজ্ঞানীরা কোনো ওভারটাইম অ্যালাওয়্যান্স পান না। এর থেকেই আমাদের পুরো দলের সদস্যদের নিজেদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দায়বদ্ধতা বোঝা যায়। আর ইসরোর নানা সাফল্যের পেছনে আমাদের সমস্ত সদস্যদের এমন পরিশ্রমের অবদান রয়েছে।
একজন সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে, আমি নিজে একাধিক দায়িত্ব পালন করে থাকি, যেমন স্পেসক্রাফট অপারেশন্স্ প্ল্যানিং, মিশন অ্যানালিসিস, মিশন অ্যাশিওর্যান্স, প্রয়োজনে সফট্ও্যায়ার ডেভেলপ করা — এমন অনেক কাজ। বিভিন্ন স্পেসক্রাফট প্রোজেক্টে এক সঙ্গে অনেকগুলি দল কাজ করে; আমাদের কাজ হল এই সংস্থার নিয়মকানুন মেনে সবকিছু তৈরি করা। প্রতিটা কাজ বারে বারে রিভিউ করা হয় আর প্রতিটা দলের করা কাজটিকে অনেকগুলি রিভিউ বোর্ড থেকে ছাড়পত্র পেতে হয়। এইরকম নিখুঁতভাবে কাজ করা আমাদের অভ্যাসের মধ্যে পড়ে। আর এইভাবে কাজ করে আমরা ইসরোর বিভিন্ন মিশনগুলিকে সাফল্য দিতে পেরেছি।
আমি নিজে একটা কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট আর দুটো ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের মিশন ডিরেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি। এইগুলি অবশ্যই আমার কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য। এত বড় দায়িত্বের নেতৃত্ব দেওয়াটা খুবই কঠিন এক অভিজ্ঞতা ছিল। আর এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সফল ভাবে সম্পন্ন করতে পারার আনন্দ একেবারেই আলাদা।
৫। আপনাকে কি মূলত কম্পিউটারে বা খাতায় অংক কষে গবেষণার কাজ করতে হয়? না কি প্রফেসর শঙ্কুর মত হাতে কলমে যন্ত্রপাতিও তৈরি করতে হয়?
— না, আমি হার্ডওয়্যার নিয়ে কাজ করিনা; আমার কাজ মূলত স্পেসক্রাফট অপারেশন এবং সফটওয়্যার নিয়ে। আমার কাজের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, যেখানে একটা মহাকাশযানের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সফটওয়্যার তৈরি করা হয়। C, C++, JAVA এবং Python, এই ল্যাঙ্গোয়েজগুলি ব্যবহার করে আমাদের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট টিম কোনো নির্দিষ্ট মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার তৈরি করে।
৬। আপনি প্রায় ২৫ বছর ইসরোতে কাজ করছেন, ভালো এবং মন্দ – দুই রকমের অভিজ্ঞতাই হয়েছে। সাফল্য এবং অসাফল্য- দু'য়ের মুখই দেখেছেন। সেইরকম কয়েকটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে পারি কি?
— হ্যাঁ, ইসরোতে আমি প্রায় ২৫ বছর কাটিয়ে ফেললাম। এই দীর্ঘ সময়ে আমার দারুণ সাফল্য আর দুঃখজনক অসাফল্য, দু'ইয়েরই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমাদের এই কাজে সহজাতভাবেই ঝুঁকি বেশি। খুব ছোট্ট ভুলও বিরাট সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
আমার অভিজ্ঞতায় মার্স অরবিটার মিশন, অ্যাস্ট্রোস্যাট এবং চন্দ্রযান-৩ অবশ্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল মিশন। এগুলি ছাড়াও, ইসরো একাধিক কম্যুনিকেশন, রিমোট সেন্সিং এবং ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট তৈরি এবং সফল উৎক্ষেপন করেছে। এই উপগ্রহগুলি আমাদের দেশকে নানা ক্ষেত্রে সাহায্য করে — আর্থিক পরিষেবা, কৃষি, কার্টোগ্রাফি বা মানচিত্রনির্মানবিদ্যা, ওশেনোগ্রাফি বা সমুদ্রবিদ্যা, টেলি-মেডিসিন, টেলি-এডুকেশন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, স্থানীয় যান চলাচল, অসামরিক বিমান চলাচল ইত্যাদি। আমাদের দেশের নানা উন্নতিতে এই উপগ্রহগুলির সক্রিয় ভূমিকা ইসরোর সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষকে গর্বিত করে, কারণ এই কাজগুলির মাধ্যমে আমরা দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছি।
তবে হ্যাঁ, এটাও ভোলা যায় না যে এমন সব সাফল্যের পাশাপাশি আমরা অসাফল্যও দেখেছি। অনেকসময়েই নির্মাণপর্বেই মিশন অসফল হয়েছে। চন্দ্রযান-২ এর সফ্ট ল্যান্ডিং এ অসাফল্য আমাদের সবার কাছে দুঃখজনক ছিল। তবে হতাশ হলেও, এই সমস্ত অসাফল্য থেকে আমরা নিজেদের ভুল ত্রুটিগুলো বুঝতে শিখেছি, যে শিক্ষা পরের কাজগুলির ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করেছে। মহাকাশ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আরও উন্নতি করার লক্ষ্যে, এই অসাফল্যগুলিও একেকটি ধাপ।
৭। চন্দ্রযান-৩ মিশনে মোট কতজন বিজ্ঞানী / প্রযুক্তিবিদ/ অন্যান্য কর্মী সরাসরি যুক্ত ছিলেন? এই মিশনে আপনার ভূমিকা কী ছিল?
— চন্দ্রযান-৩ মিশনকে বলা যায় টিমওয়ার্ক বা সদলবলে সফলভাবে কাজ করার জ্বলন্ত উদাহরণ। আমার পক্ষে সত্যিই সঠিকভাবে বলা মুশকিল ঠিক কতজন এই মিশনে যুক্ত ছিলেন। এই সুবিশাল প্রোজেক্টে কয়েক হাজার প্রযুক্তিবিদ এবং ইঞ্জিনিয়ার ইসরোর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে যুক্ত ছিলেন। প্রাথমিক নকশা তৈরি থেকে শুরু করে ক্রমশ নির্মাণের বিভিন্ন ধাপে, এবং পরীক্ষা-নিরিক্ষার কাজে এঁরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
চন্দ্রযান-৩ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৮-১০ বছর আগে। সঙ্গে চন্দ্রযান-২ এর কাজ ও চলছিল। চন্দ্রযান-৩ এর জন্য আমরা ক্রমে আরও উন্নতি এবং পরিবর্ধন করি। এই কাজে বহুসংখ্যক মানুষের অবদান রয়েছে।
এই মিশনে আমাদের হাতে হাত মিলিয়েছে একাধিক সরকার অধীনস্থ সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারী সংস্থাও। এই সমস্ত সংস্থাগুলি চন্দ্রযান নির্মাণে ব্যবহার করা নানা অংশের যোগান দিয়েছে। তাই চন্দ্রযান-৩ এর সাফল্যের পেছনে এই সমস্ত সংস্থার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদেরও অবদান রয়েছে।
চন্দ্রযান-৩ মিশনে আমার ভূমিকা ছিল এই মিশনের মান নিশ্চিত করা (ensuring mission quality assurance)। এই কাজে আমি একটা দলের অংশ ছিলাম যারা চন্দ্রযান-৩ মিশনের সমস্ত ধাপ আলাদা করে খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিত করত যে সব ঠিক আছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক দায়িত্ব, মিশনের সাফল্যের অনেকটাই আমাদের কাজের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আমি এর আগে চন্দ্রযান-২ মিশনের সময়েও একই ধরনের দায়িত্ব পালিন করেছি।
৮। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ইসরো নানারকমের প্রোজেক্ট এবং অ্যাকটিভিটির ব্যবস্থা করে। এইগুলিতে অংশ গ্রহণ করলে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে উপকৃত হতে পারে? আপনি কি এই সমস্ত অ্যাকটিভিটিতে প্রশিক্ষণ দেন?
— আমাদের কেন্দ্রতে প্রতিবছর জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পালন করা হয়। ব্যাঙ্গালোরের বিভিন্ন হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহ বাড়ানোর জন্য নানারকমের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিজ্ঞানসম্মত মডেল তৈরি, মহাকাশ নিয়ে ক্যুইজ, ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা — এমন সব অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়েরা উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেয়।
এছাড়াও, স্কুল এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীরা চাইলে আমাদের কেন্দ্র ঘুরে দেখতে আসতে পারে। স্কুল বা কলেজের পক্ষ থেকে এমন 'স্টুডেন্ট ভিজিট'-এর জন্য আমরা আবেদন নিয়ে থাকি। এইরকম ব্যবস্থায়, আমাদের কাজকর্ম বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরা সরাসরি দেখার এবং জানার সুযোগ পায়। এই সমস্ত কাজের মধ্যে দিয়ে ইসরো ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবকদের মনে নতুন কিছু করার স্বপ্নের বীজ বুনে দেয়।
স্কুলের ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য, ইসরো এক বিশেষ প্রোগ্রাম তৈরি করেছে, যার নাম YUVIKA ( YUva VIgyani Karyakram) / নতুন বিজ্ঞানীদের জন্য কার্যক্রম। এই কার্যক্রমে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মহাকাশ প্রযুক্তি, মহাকাশ বিজ্ঞান এবং স্পেস অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে ছোটদের মধ্যে নিত্য নতুন বদলে যাওয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা হয়। এমনও মনে করা হচ্ছে যে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের 'স্টেম' (Science, Technology, Engineering and Mathematics /STEM) নির্ভর গবেষণা বা কেরিয়ারের বিষয়ে উৎসাহিত করা যাবে।
যারা বড় ছাত্রছাত্রী, তাদের জন্য ডিপার্টমেন্ট অফ স্পেস- এর অধীনস্থ ইন্ডিয়ান ইন্স্টট্যুট অফ স্পেস টেকনোলজি (IIST) এবং ইন্ডিয়ান ইন্স্টিট্যুট অফ রিমোট সেন্সিং (IIRS) এ মহাকাশবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরাল স্তর অবধি পড়াশোনা করার ব্যবস্থা আছে। ইসরোর ওয়েবসাইটে এই সমস্ত বিষয়ে বিশদে লেখা রয়েছে।
৯। ইসরোর মত সংস্থায় কাজ করার ইচ্ছে থাকলে কীভাবে নিজেকে তৈরি করা উচিত? এ বিষয়ে আপনি ইচ্ছামতীর বন্ধুদের কী পরামর্শ দেবেন?
— মহাকাশ নিয়ে কাজকর্ম এখন একটা বড়সড় শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রির পর্যায়ে পড়ে। এক কথায় আমাদের সমস্ত কাজকর্মকে 'স্পেস ইন্ডাস্ট্রি' বলে অভিহিত করা হয়। মহাকাশ চর্চায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির নানা শাখা মিলেমিশে কাজ করে। এখানে মেকানিকাল, ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিকাল এবং কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারদের সবসময়েই কদর বেশি। এছাড়াও, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ দেওয়া হয়। ইসরো নতুনদের খোঁজে প্রয়োজনমত বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।
সাধারণভাবে একটা লেখা পরীক্ষার পরে মৌখিক পরীক্ষা/ সাক্ষাৎকার হয়। আমি বলব যারা ইসরোর সঙ্গে যুক্ত হতে চাও, তারা খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করো, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করো এবং ইসরোর চাকরির পরীক্ষাগুলি দাও। ইসরো সর্বদাই তরুণ, উৎসাহী, উদ্যমী ছেলেমেয়েদের সুযোগ দিতে আগ্রহী।
তবে এটা শুধু ইসরোতে চাকরি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা এবং পরবর্তীকালে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মিত পরিশ্রম আর ধৈর্য্যের প্রয়োজন। নিজের কাজটুকু নিজে একাগ্রতা দিয়ে করলে জীবনে সাফল্য আসবেই।
১০। একদিকে ভারতের বিজ্ঞানীরা চাঁদ ছাড়িয়ে সূর্যের দিকেও এগিয়ে যাচ্ছেন; অন্যদিকে এখনও ভারতে প্রচুর কুসংস্কার সযত্নে লালিত হয়। এই প্রসঙ্গে আপনার কী মতামত? ভারতের বিজ্ঞানচর্চা কি কোনোদিন পারবে এই দেশে প্রচলিত নানা কুসংস্কারকে একেবারে নির্মূল করতে?
— আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের দেশে এখনও নানারকমের কুসংস্কার প্রবলভাবে প্রচলিত। শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য, অনুন্নয়ন — এই সবের মিশেলে এই ধরনের কুসংস্কারের উৎপত্তি হয়ে থাকে। এই ধরনের ভুল ধারণাগুলিকে চিহ্নিত করে, সেগুলিকে সমূলে সরানো এক কঠিন কাজ।
এটা ঠিক যে চাঁদে অবতরণের সাফল্য আমাদের দেশে ছোটদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে পড়ার উৎসাহ বাড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু শুধুমাত্র এমন কিছু অভিযনের সাফল্য এই দেশে বহুদিন ধরে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কারকে মুছে ফেলতে পারবে না। তার জন্য শিক্ষিত এবং আলোকপ্রাপ্ত মানুষদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এবং এই কাজে একেবারে গোড়া থেকে লাগতে হবে, ওপর ওপর করলে হবে না।
শিক্ষার মাধ্যমে কুসংস্কার এবং সত্যতার ফারাক বোঝানো সম্ভব। আজকাল অনেক জায়গাতেই পুতুল নাচ, পথ নাটক, ম্যাজিক শো এর মাধ্যমে মানুষকে বোঝানো সম্ভব হয়েছে কীভাবে তারা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যেতে পারেন। কথাবার্তা এবং আলোচনার মধ্যে দিয়ে মানুষের মধ্যে ভাবনা চিন্তার অভ্যাস আনা অবশ্যই সম্ভব।
কুসংস্কার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সবার জন্য শিক্ষার সুযোগও জরুরী। মেয়েদের পড়াশোনা ও স্বাধীনতা এই ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে।
১১। জানেন তো, ইচ্ছামতীর দেখভাল করেন চাঁদের বুড়ি। আপনি কি ছোটবেলায় 'চাঁদের বুড়ি'-র কথা বিশ্বাস করতেন? বিক্রম চাঁদের ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে — এই অবস্থায় আজকের দিনের ছোটরা কি চাঁদের বুড়ির গল্পে আর বিশ্বাস করবে বলে আপনার মনে হয়?
— আমাদের ছোটবেলা কেটেছিল 'চাঁদমামা', 'ঠাকুমার ঝুলি', 'বেতাল পঞ্চ বিংশতি'-র মত বই পড়ে। সেই সব বইয়ের ছবি বা রঙ আজকের দিনের বইয়ের মত না হলেও, আমাদের কল্পনা বিস্তারে তাদের অবদান কম ছিল না। তাই 'চাঁদের বুড়ি' বা 'ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী'কে আমরা সত্যি চরিত্র বলেই মনে করতাম।
আজকের ছোটরা সত্যিই আলাদা এক জগতে বড় হচ্ছে। ইন্টারনেটের দৌলতে সারা দুনিয়ার সমস্ত তথ্য আর বিনোদন তাদের হাতের মুঠোয়। কম্পিউটার আর ভিডিও গেমস তাদের নিয়মিত সঙ্গী। দেশীয় সাহিত্যের পাশাপাশি, 'হ্যারি পটার' আর জাপানি অ্যানিমের দুনিয়া আজ তাদের পছন্দের তালিকায়।
প্রযুক্তি আমাদের গল্প বলার আর গল্প শোনার ধরন বদলে দিয়েছে। কিন্তু ছোটদের এবং বড়দের মধ্যে ভালো গল্পের চাহিদা সবসময়েই থেকে যাবে, বিভিন্ন প্রজন্ম সংযোগকারী সেতু হয়ে। তাই 'চাঁদের বুড়ি'র গল্পও টিঁকে থাকতে পারে, যদি সঠিক কল্পনার মিশেলে হাজির করা হয়।
যুবিকা বিষয়ে বিশদে জানা যাবে এইখানেঃ https://www.isro.gov.in/YUVIKA.html
মহাকাশবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা বিষয়ে জানা যাবে এইখানেঃ https://www.isro.gov.in/AcademicCourses.html
সাক্ষাৎকার এবং মূল ইংরেজি থেকে ভাষান্তরঃ মহাশ্বেতা রায়