দুর্গাপুজো। বাঙালিদের সব থেকে বড় আনন্দ উতসব। হ্যাঁ, আনন্দ উতসবই লিখলাম, কারণ আজকের দিনে, দুর্গাপুজো আর শুধুমাত্র ধর্মীয় উতসব নয়। আর দুর্গাপুজোতে শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুরাই অংশগ্রহণ করেন না বা আনন্দ উপভোগ করেন না। আলো-মন্ডপ-প্রতিমা দেখা-বেড়ানো-খাওয়াদাওয়া-গান বাজনা- সব মিলে দুর্গাপুজো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কাছে হাসি-আনন্দে ভরা পাঁচটা দিন।
এই শরতকালে দুর্গাপুজো কেন হয় সেই নিয়ে সবথেকে প্রচলিত গল্পটা বোধ হয় সবার জানা। রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রামের প্রয়োজন ছিল দেবী দুর্গার আশীর্বাদের। কিন্তু দুর্গাপুজো আদতে হত বসন্তকালে ( সে পুজো পরিচিত বাসন্তী পুজো নামে)। তাই রামচন্দ্র শরতকালে দেবীর অকালবোধন করতে বসলেন। তাঁর আরাধনায় খুশি হয় দেবী দেখা দিলেন। মূল রামায়ণে কিন্তু এই গল্পটা ছিল না। এই গল্পটা জানা যায় প্রধাণতঃ কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে।
শরতকালে দুর্গার আরাধনার আরেকটাও প্রচলিত গল্প আছে। হিমালয় কন্যা পার্বতী/ উমা তো শিবঠাকুরকে বিয়ে করে কৈলাশ পর্বতে চলে গেলেন। কিন্তু তিনি বাপের বাড়ি না এলে কি হয়? তাই বছরে একবার, বর্ষার শেষে গোলাভরা ধান উঠলে , নতুন ফসল উঠলে, উমা তাঁর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে চার দিনের জন্য বাপের বাড়ি আসেন। কৃষিপ্রধান পূর্ব ভারতে যেভাবে ঘরে ভাল ফসল উঠলে বিবাহিতা মেয়েরা বছরে একবার বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন, ঠিক সেইভাবে।
কিন্তু যে দুর্গাঠাকুরের মূর্তি আমরা সাধারণতঃ মন্ডপে মন্ডপে দেখতে পাই, সেখানে তো বাড়ির মেয়ে উমা অথবা রামের আরাধনায় তুষ্ট দুর্গা দেবীকে দেখি না। আমরা দেখি দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপ। দেবীর এই রূপের খোঁজ পাওয়া যায় পুরাণের আরেক গল্পে। সেই গল্প এইরকমঃ
এক খুব ভয়ানক অসুর ছিল। সে মহিষ সেজে ঘুরে বেড়াত, তাই সে পরিচিত ছিল মহিষাসুর নামে। মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতাদের দুঃখ দুর্দশার শেষ ছিল না। তাঁরা একশো বছর ধরে তার সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহিষাসুর দেবতাদের হটিয়ে দিয়ে নিজেই স্বর্গে ইন্দ্রের স্থান গ্রহণ করল। দেবতারা তখন নিরুপায় হয়ে ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে শিব ও বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তাঁদের মুখে মহিষাসুরের অত্যাচারের কথা শুনে শিব আর বিষ্ণু প্রচন্ড রেগে গেলেন। রাগের চোটে ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বরের শরীর থেকে এক অদ্ভূত তেজ নির্গত হতে থাকল। আগুণের পাহাড়ের মত সেই পুঞ্জিভূত তেজ ক্রমশঃ একত্রিত হয়ে এক বিশাল দেবীর সৃষ্টি হল। সেই দেবী অপরূপ সুন্দরী;অমিত শক্তির অধিকারিনী। সেই দেবীকে দেখে দেবতাদের আনন্দের সীমা রইল না। তাঁরা কেউ তাঁকে দিলেন অস্ত্র, কেউ বর্ম, কেউ অলঙ্কার। স্বয়ং হিমালয় এক বিশাল সিংহকে এনে তাঁকে বাহন রূপে উপহার দিলেন।
এই দেবী হলেন দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। তাঁর হাজার হাজার হাত, তাঁর যুদ্ধহুঙ্কারে দশদিক কম্পিত হল। অসুরেরা সেই হুঙ্কারের শব্দে ছুটে এল। তারপরে শুরু হল এক ভয়ানক যুদ্ধ। মহিষাসুর এসে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করল। সে ছিল এক দক্ষ মায়াবী। সে কখনও মহিষ, কখনও সিংহ, কখনও হাতি সেজে দেবীর সাথে লড়াই করতে লাগল। শেষ অবধি দেবী সেই মহিষরূপী অসুরকে ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করে সেই মহিষের মুন্ডচ্ছেদ করলেন। তখন সেই অসুর আধখানা মহিষের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করা শুরু করল। শেষ পর্যন্ত দেবী তার মাথা খড়্গ দিয়ে কেটে ফেললেন। দেবতারা দেবীর জয়ধ্বনি দিলেন। স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল। দেবী দুর্গা দেবতাদের কথা দিলেন আবার বিপদে পড়লে তিনি তাঁদের রক্ষা করতে আসবেন। এই বলে আকাশে মিলিয়ে গেলেন।
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমরা যে দেবী দুর্গার প্রতিমা দেখে অভ্যস্ত, সেখানে আধাখানা মহিষের দেহ থেকে বেরিয়ে আসা অসুরকে কেন দেখা যায় দেবী দুর্গার পায়ের তলায়। দেবী দুর্গার সাথে মহিষাসুরের এই যুদ্ধের অসাধারণ এক বিবরণ শুনতে পাওয়া যায় মহালয়ার ভোরবেলায় রেডিওতে ভেসে আসা "মহিষাসুরমর্দিনী " অনুষ্ঠানে। শুনেছ নিশ্চয় মহালয়ার ভোরে?
একচালা প্রতিমা
এই সমস্ত গল্পই মিলে মিশে আছে আশ্বিনমাসের দেবীপক্ষে (বা শুক্লপক্ষে) পাঁচদিন ধরে দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্যে। তাই প্রচলিত বিভিন্ন গল্পগুলি মিলে মিশে গিয়ে, আমরা এই মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার দুইপাশে দেখতে পাই তাঁর চার ছেলে মেয়েকেও।
শরতকালে দেবী দুর্গার আরাধনা বাঙালিদের মধ্যে চলে আসছে কয়েক হাজার বছর ধরে। এগুলি বেশিরভাগই ছিল পারিবারিক পুজো বা একা কোন মানুষের চেষ্টায় পুজো। দুর্গাপুজোকে আমরা এখন যেভাবে দেখি, অর্থাৎ অনেক মানুষ মিলে একত্র হয়ে একটা পুজোর আয়োজন করা, উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সেটা প্রথম শুরু করেন গুপ্তিপাড়ার বারো জন ব্রাহ্মণ মিলে। বারো জন বন্ধু বা 'ইয়ার' মিলে এই পুজো শুরু করেন বলে এই ধরণের পুজো পরিচিত হয় 'বারোয়ারি' পুজো নামে। 'বারোয়ারি' শব্দটি এখন আর তত ব্যবহার হয়না। তার বদলে ব্যবহার করা হয় 'সার্বজনীন শব্দটি। 'সার্বজনীন' অর্থাৎ সবাইকে নিয়ে যে পুজো।
হ্যাঁ, তাই এই লেখার শুরুতে বলেছিলাম, দুর্গাপুজো শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুদের এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এ হল সব মানুষের এক আনন্দ উতসব। আর আজকাল তো এই পুজো শুধু পুজোতেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশেষ করে বড় শহরগুলিতে, অঞ্জলি, সন্ধিপুজো, ধুনুচি নাচ, ঢাকের বাদ্যি, এ সবের পাশেপাশে রয়েছে প্রতিমা , মন্ডপ , আলোকসজ্জার অসাধারণ সব উদাহরণ দেখতে পাওয়ার সুযোগ। কয়েক মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দূর দূরান্ত থেকে আসা শিল্পীরা সৃষ্টি করেন অসাধারণ সব মন্ডপ আর প্রতিমা। সেইসব নিয়ে বিভিন্ন পুজো উদ্যোক্তাদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে। আর সুন্দর শিল্পকীর্তি দেখতে কার না ভাল লাগে? তাই এইসব শিল্পকীর্তি দেখতে ভিড় জমান সমাজের সব স্তরের মানুষ। এই ভাবে ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে এই উতসব হয়ে উঠেছে এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উতসব।
আর তোমার মত ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের কাছে দুর্গাপুজো মানে তো লম্বা ছুটি, পড়াশোনা বন্ধ, নতুন জামা, দেদার মজা, যত ইচ্ছা ভালমন্দ খাওয়া। বাবা-মায়েদের শাসন ও অনেক কম এই কয়টা দিনে। অনেকদিন দেখা না হওয়া আত্মীয়দের সাথে দেখা হয়ে আড্ডা-গল্পে মেতে ওঠেন তাঁরা। ষষ্ঠী থেকে নবমী অবধি চারদিন ধরে চলে অফুরন্ত আনন্দ। আজকাল অবশ্য এত এত ঠাকুর দেখার সুযোগ, যে ভিড় শুরু হয়ে যায় চতুর্থী -পঞ্চমী থেকেই।
সন্ধিপুজোর ১০৮ বাতি
নবমী নিশি পোহালেই কিন্তু মায়ের ফিরে যাওয়ার সময় চলে আসে। দশমী দুপুরে মা দুর্গাকে সিঁদুর পরিয়ে, মিষ্টিমুখ করিয়ে বিদায় জানানো হয়। ঢাকে বেজে ওঠে বিদায়ের সুর-
ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ-
ঠাকুর যাবে বিসর্জন।
কিন্তু বিসর্জন দিলেই বা কি? সেই যে, মা দুর্গা দেবতাদের কথা দিয়েছিলেন, ডাক দিলেই তিনি ফিরে আসবেন, সে আশাতেই বুক বেঁধে কিন্তু মা'কে নদীর জলে ভাসান দিতে দিতে সবাই হেঁকে ওঠে - 'আসছে বছর আবার হবে' ।শুরু হয় আবার এক বছরের অপেক্ষা।
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
দুর্গার ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
গণেশজননীর ছবিঃ
সাবেরী সেনগুপ্ত
ফটোগ্রাফঃ
কল্লোল লাহিড়ি