চেনা দেশ - অচেনা উৎসব : থ্যাঙ্কস্-গিভিং
আমরা এখন আমেরিকার টেক্সাসে কলেজ স্টেশন নামে একটা ছোট্ট শহরে থাকি ।দু-বছর আগে গরমের সময় এখানে এসে পৌঁছাই ।প্রথম কিছু মাস ভালোই কাটল ।কিন্তু পুজোর সময়টা কাটাতে বেশ কষ্ট হয়েছিল । সেই সময় আমেরিকার কিছু উৎসবের ব্যাপারে জানা গেল যেগুলো আমাদের কাছে একেবারে নতুন ।
এখানে ২১শে নভেম্বর থ্যাঙ্কস্-গিভিং নামে একটা উৎসব হয় । প্রত্যেক ঘরে ঘরে আর গীর্জায় এই উৎসব পালন করা হয় ।
আমাদের বাড়ির আশেপাশে বেশ কয়েকটা গীর্জা আছে ।এমনই এক গীর্জার নেমন্তন্নে গিয়ে দেখি অনেক লোকের ভিড় - সবাই আমাদের মত থ্যাঙ্কস্-গিভিং-এর ডিনারে এসেছে ।
প্রথম থ্যাঙ্কসগিভিং
ডিনারের আগে ছোট একটা নাটিকা অভিনীত হল যার মাধ্যমে আমরা এই উৎসবের ইতিকথা জানতে পারলাম ।এই উৎসবের মূল ভাবনা হল আমাদের সকলকে আহারের সংস্থান করে দেবার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো ।এই উৎসবের সূচনা হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে । English Separatist Church - এর ১০২ জন সদস্য ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কঠোরতা থেকে মুক্ত এক স্বাধীন পৃথিবীর স্বপ্ন চোখে আমেরিকা পাড়ি দেন ।তাঁরা প্রথমে কিছুদিন হল্যাণ্ডে কাটান, তারপর ফের পাড়ি জমান আটলান্টিকের অপর পারের উদ্দেশ্যে । কিন্তু ১৬২০ সালে প্লাইমাউথ পৌঁছে তাঁদের অত্যন্ত প্রতিকূল আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে হয় । এক বছরের মধ্যেই প্রাণ হারান ৪৬ জন । তারপর স্থানীয় আদি বাসিন্দারা, যাদের আমরা রেড ইণ্ডিয়ান নামে চিনি, তাদের সাহায্য নিয়ে এঁরা চাষবাস শুরু করেন । পরের বছর ভাগ্য তাঁদের সহায় হয় । প্রচুর ফসল ফলে - সকলের প্রাণধারণের ব্যবস্থাও সুগম হয় । তখন সেই জীবিত সদস্যরা তাদের নতুন রেড ইণ্ডিয়ান বন্ধুদের আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য শুরু করেন থ্যাঙ্কস্-গিভিং উৎসব ।
চার্চের অনুষ্ঠান
এবারে জানা যাক ডিনারের মেনুটা কেমন হয়! প্রধান হল টার্কির রোস্ট ।আর আছে ম্যাশড্ পটেটো বা আমাদের চেনা আলুভাতে !! আছে কুমড়ো দিয়ে তৈরী মিষ্টি - পাম্পকিন পাই ,ক্র্যানবেরি স্যস্ আর বিভিন্ন রকমের মরশুমী শাকসব্জী ।
টার্কির রোস্ট
পাম্পকিন পাই
সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া
কলকাতার দুর্গাপুজো মিস করার দু:খ কিছুটা হলেও কম করেছে এই অচেনা উৎসব ।
আমাদের দৈনিক ব্যস্ত জীবনে আমরা কোথাও যেন ঈশ্বরকে ভুলে যেতে চলেছি । তাই থ্যাঙ্কস্-গিভিং-এর মাধ্যমে ঈশ্বরকে জানাই আমাদের কোটি কোটি ধন্যবাদ!
লেখা ও ফটোগ্রাফঃ
রূপসী দালাল
টেক্সাস, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
অন্যান্য ছবিঃ
বিভিন্ন ওয়েবসাইট
- বিস্তারিত
- লিখেছেন রূপসী দালাল
- ক্যাটfগরি: প্রচ্ছদকাহিনীঃ উতসব
মজার উৎসব হ্যালোউইন
কি খবর ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধু?
আজ তোমাকে একটা মজার উৎসবের খবর দিই । তুমি যখন কলকাতায় দুর্গাপুজো, দীপাবলীর আনন্দ করছ, তার কিছুদিন পরেই ৩১শে অক্টোবর আমেরিকায় খুদে-দের ভারি মজার উৎসব হ্যালোউইন পালন করা হয় । শুধু আমেরিকা নয়, আয়ারল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড-সহ বেশ কিছু দেশে এই উৎসবের চল আছে ।তার প্রস্তুতি চলে মাসকয়েক আগে থেকে ।
হ্যালোউইন এক কথায় ভূত উৎসব ! ছোটরা ৩১শে অক্টোবরের রাতে নানারকম বিচিত্র ভূতের পোশাক পরে ঘরে ঘরে চড়াও হয়ে বলে, "Trick or treat?" অর্থাৎ, যদি ভালোয় ভালোয় ভূতবাবাজীকে treat হিসেবে চকোলেট, ক্যাণ্ডি ইত্যাদি উপহার হিসেবে
না দেওয়া হয়, তবে তিনি রেগে গিয়ে নানারকম trick বা তুকতাক করে গৃহস্থের ক্ষতি করবেন । গোটা ব্যাপারটাই অবশ্য স্রেফ ছোটদের মজা ।
এই হ্যালোউইন বেশ প্রাচীন প্রথা । ষোড়শ শতাব্দীতে শেক্সপীয়ারের এক নাটকেও এর উল্লেখ আছে ।প্রথমদিকে নাকি ভিক্ষুকেরা এই দিনটিতে ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবারের মৃত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করত , আর বিনিময়ে পেত খাবার বা কিছু উপহার ।
এই উৎসবকে এখন রীতিমত বাণিজ্যের মোড়কে ঢেকে ফেলা হয়েছে । আগষ্ট মাস থেকেই দোকানে দোকানে এসে যায় বিচিত্র সব হ্যালোউইন কস্টিউম, প্রায় আমাদের পুজোর বাজারের মত । ভূত পেত্নী, ডাইনীবুড়ি, কঙ্কাল ছাড়াও যোগ হয়েছে নানান কার্টুন চরিত্রের পোশাক ।সেই গুপী-বাঘার গানের মতই রোগা-ভূত, মোটা-ভূত, বেঁটে-ভূত, ঢ্যাঙা-ভূত সবারই রংবাহারী মুখোশের মেলা । cছোটদের উৎসাহ দেখার মত ।
হ্যালোউইনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে Pumpkin Carving বা বিরাট বিরাট কুমড়োকে কায়দা করে কেটে তার গায়ে ভূতের চোখ-মুখ আঁকা ।ভেতরটা থাকবে ফাঁকা । সেখানে মোমবাতি জ্বেলে ঘরের বাইরে রাত্রে বসাতে হবে ।দূর থেকেও দেখা যাবে অন্ধকারে জ্বলছে ভূতের চোখ ! সমস্ত সুপার মার্কেট আর আনাজপাতির দোকানে মাসখানেক আগে থেকেই থরে থরে সাজানো হয় বিশেষ ধরনের কুমড়ো ।
দোকানে সাজানো কুমড়ো
এগুলো ফলানোই হয় হ্যালোউইনের জন্য ।এই জাতের কুমড়ো লোকে খায় না । কী বিচিত্র তাদের আকার ! হাতের তালুতে বসানো যাবে এমন মিনিয়েচার থেকে বারোশ পাউণ্ডের দৈত্যাকার কুমড়ো - সবই মিলবে এ বাজারে !
দৈত্যাকার কুমড়ো
ক্ষুদে কুমড়ো
আমেরিকা প্রবাসের প্রথম বছরে সস্ত্রীক অংশ নিয়েছিলাম এই রকম এক কুমড়ো-শিল্পের ওয়ার্কশপে ।সৌজন্যে - আমাদের ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত একটি চার্চ ।তারা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সারা বছর ধরেই সামাজিক মেলামেশা ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানমূলক অনুষ্ঠান করে থাকে ।হ্যালোউইন উপলক্ষেও এমন এক কর্মসূচী নিয়েছিল তারা । গিয়ে দেখি প্রচুর ছোটরা আর তাদের মা-বাবাদের ভিড় ।
কুমড়ো খোদাই করছে ছোটরা
অধিকাংশই চীন আর কোরিয়ার বাসিন্দা । দস্তুরমত বিশেষ বিশেষ যন্ত্রপাতিও আছে Pumkin Carving-এর জন্য । প্রথমে বেশ হৃষ্টপুষ্ট একটা কুমড়ো বাছাইএর পর হাতে এল ক্ষুদে করাত । তা দিয়ে কুমড়োর বোঁটার কাছ থেকে বেশ খানিকটা গোল করে কেটে হাত ঢোকানোর জায়গা করা হল ।আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্র ছিল - ভেতর থেকে শাঁস বের করা আর শেষ অবধি কুমড়োর গায়ে খোদাই করে ভূতের নাক-মুখ-চোখ আঁকার জন্য ।
ঘন্টাদুয়েক ধরে গলদঘর্ম হয়ে ভূতের চক্ষুদান-পর্ব মিটলো । নানা দেশের একগাদা আনাড়ী লোকজন মিলে এই ওয়ার্কশপের হুড়োহুড়িতে বেশ মজা হয়েছিল।অবশ্য ঐ কেজি-পাঁচেক বস্তুটিকে হাতে করে ঘর অবধি আনার অভিজ্ঞতাটা বিশেষ সুখকর হয় নি ।
খোদাই শেষ হওয়ার পরে
কুমড়ো-ভূত ছাড়াও হ্যালোউইনের অন্যান্য আকর্ষণ হল scare crow বা আমাদের পরিচিত কাকতাড়ুয়া । খড় দিয়ে মানুষের সাইজের পুতুল বানিয়ে তাকে রীতিমত বাহারী জামা, ডেনিম, টুপি পরিয়ে সাজানো হয় । আর ঝাঁটায় চড়া ডাইনি বুড়িরও ভালোই জনপ্রিয়তা !
কাকতাড়ুয়া
ডাইনি-বুড়ি
তোমার জন্য এই মজার উৎসবের প্রস্তুতিপর্বের কিছু ছবি পাঠালাম দুর্গাপুজোর সাথে সাথে ভিনদেশের আরেক মজাদার উৎসবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে ।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জ্যোতির্ময় দালাল
- ক্যাটfগরি: প্রচ্ছদকাহিনীঃ উতসব
খুশির ঈদ
কিছু আনন্দ কেবল অনুভবের। সে আনন্দ যতটা মনে অনুভব করা যায় ততটা লিখে ঠিক প্রকাশ করা যায় না। ঈদ তেমনই একটা আনন্দ। মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় এই মহাউৎসব শুধু যেন উৎসব নয়, এ এক মহামিলনের দিন। আমরা জানি সব ধর্মেই নানারকম ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়। ইসলাম ধর্মেও ঠিক সেরকম উৎসব হল ঈদ। ঈদ এলে সকল দুঃখকষ্ট ভুলে ঈদের আনন্দে সমাজের সকলের সাথে আমরা মিলিত হই। এ আনন্দের উৎস কোথায়? উৎস মনে, উৎস হৃদয়ে। এই বিশেষ দিনটিতে সকলরকম ভেদাভেদ ভুলে ছোট-বড় সকলে মেতে ওঠে আনন্দে। ঈদের সকালে ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়ে একে অন্যকে কোলাকুলি করে ঈদ মুবারক বলে শুভেচ্ছা জানানো হয়। ঘরে ঘরে তৈরী হয় সেমাই, পায়েস, ফিরনী, পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানীর মত সুস্বাদু সব খাবার। একে অপরের বাড়ি গিয়ে কুশল বিনিময় করে। মোট কথা নতুন জামাকাপড়ে, সুস্বাদু খাবারে, হাসিআনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে সমাজের ধনী-গরীব একত্রিত হয়ে আমরা ঈদের বিশেষ দিনটি পালন করি।
ঈদ শব্দটি আরবী ভাষা থেকে এসেছে। এর অর্থ খুশি, আনন্দ, আনন্দোৎসব ইত্যাদি।
ইসলাম ধর্মে এই ঈদ দুটো। ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। ইসলাম ধর্মে চাঁদের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে চান্দ্রমাস নির্ধারণ করা হয়। প্রতিবছর চাঁদের হিসেবে দেখা যায় এই ঈদ পনের দিন করে এগিয়ে আসে। যে কারণে প্রতিবছর একই দিনে ঈদ হয় না। বাংলা বা ইংরেজী বছরে আমরা বার মাসের নাম নিশ্চয়ই জানি! আরবী বছরেও ঠিক তেমন বার মাস রয়েছে। আমরা প্রথমে জেনে নিই আরবী মাসের নামগুলো।
আরবী বারো মাসের নাম
১) মহররম ২) সফর ৩) রবিউল আউয়াল ৪) রবিউস সানি ৫) জমাদিউল আউয়াল ৬) জমাদিউস সানি ৭) রজব ৮) শাবান ৯) রমজান ১০) শাওয়াল ১১) জিলক্বদ ১২) জিলহজ্ব
এই যে আরবী মাসের নবম মাসটির নাম রমজান, এই রমজান মাসটি রোজা রাখার মধ্য দিয়ে পালিত হয়।
তাহলে রোজা কি?
রোজা
সূর্য ওঠা থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত পানাহার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগবিলাস থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। রোজা রেখে সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কোনো কিছুই খাওয়া যাবে না। সন্ধ্যায় সরবত, খেজুর, ছোলা নানারকম ফল খেয়ে রোজা ভাঙা হয়। এর নাম ইফতার। আবার ঠিক ভোরের আগে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে খাবারটি খেয়ে আবার পরদিনের জন্য রোজা রাখা হয় তার নাম সেহরী।
মসজিদে ইফতারের আয়োজন হচ্ছে
তবে না খেয়ে শুধু উপোস করলে কিন্তু রোজা হবে না। রোজা রেখে কোনোরকম খারাপ কাজ করা বারণ। কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ বা মিথ্যে কথা বলা, রাগ করা এসব কিছুই করা যাবে না। যারা ছোটো তারা রোজা রাখতে পারে না কিন্তু বেশী বেশী ভালো কাজ এসময় করার চেষ্টা করবে। বড়দের কথা মেনে চলবে এবং নামাজ (প্রার্থনা) পড়া এবং পবিত্র কোরান (ধর্মগ্রন্থ) পড়বে।
আমাদের দেশে বহু লোক দরিদ্র। রোজা রাখলে সেসব লোকের দুঃখ কষ্টগুলো বোঝা যায়। এই রমজান মাসে দরিদ্রদের বেশী বেশী সাহায্য করতে পারলে মহান আল্লাহতালা (সৃষ্টিকর্তা) অত্যন্ত খুশি হন। একটা মজার হিসেব কিন্তু এমাসে আছে। যাদের অর্থসম্পদ আছে এবং সোনা-রূপার গয়না আছে তার ওপর একটা হিসেব ধরে সেই হিসেবের ভিত্তিতে টাকা, কাপড় ইত্যাদি এ মাসে গরীবদের মাঝে দান করতে হয় এর নাম যাকাত।
ঈদুল ফিতর
অনেক কাল আগের কথা। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হুয়াসাল্লাম) মদীনাতে এসে দেখেন মদীনাবাসীর দুটি জাতীয় উৎসব কিন্তু এ উৎসব দুটির রীতি-নীতি, আচার-আচারণ ছিল শ্রেণী-বৈষম্য, ধনী ও দরিদ্রের মাঝে পার্থক্যের, ঐশ্বর্য-অহমিকা ও অশালীনতায় পূর্ণ। ইসলামের দৃষ্টিতে রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব সাদা কালোতে কোন ভেদাভেদ নেই। তাই মহানবী (সাঃ) তাদের ঘোষণা দিলেন আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য দিয়েছেন এ দুটো দিবস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দুটো দিবস আর সে পূণ্যময় দিবস হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। সুতরাং তোমরা পূর্বের অনুষ্ঠান বর্জন করে এ দু-দিবসের অনুষ্ঠানাদি পালন কর। এভাবেই জন্ম নিল একটি প্রীতিঘন মিলন উৎসব। সাদা কালো, ধনী দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিক, নারী-পুরুষ সকলের ভোগ ও মহা মিলনের দিন হতে পারে এ পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিবসটি।
এবার আমরা জেনে নিই ঈদুল ফিতরের অর্থ। ফিতর অর্থ রোজা ভাঙা, খাওয়া ইত্যাদি। ঈদুল ফিতর এর রোজা শেষ হওয়ার আনন্দ। সেই আনন্দকে আমরা পালন করি ঈদুল ফিতর হিসেবে। পুরো একমাস রোজা রাখবার পর ঈদের আনন্দ তাই অপরিসীম।
ঈদের আলোক সজ্জা
আরবী শাওয়াল মাসের ১ তারিখ ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়। আরবী মাস যেহেতু চান্দ্র মাস, তাই চাঁদ দেখার ওপর ঈদ কবে হবে তা নির্ভর করে। ২৯তম রমজানে সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদের দিন ঘোষণা করা হয়। আর সে রাতে চাঁদ দেখা না গেলে রমজান ৩০টি হয় এবং এর পরের দিন নিশ্চিতভাবেই ঈদুল ফিতর বা ঈদের দিন হয়। কেননা আরবী মাস কোনো ভাবেই ৩০ দিনের বেশি হয় না। অর্থাৎ চাঁদ দেখা গেলেই সে রাতটিকে বলে চাঁদরাত আর তার পরদিন হলো ঈদ। ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই চারদিকে আতশ পুড়িয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে সবাই। মেয়েরা হাতে মেহেদির নকশা আঁকে। ছোটোরা উল্লাসে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। বড়রা ঈদের বিশেষ রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
চাঁদরাত পেরিয়ে যে সকালটি এসে উপস্থিত হয় তা ঈদের সকাল। মজাদার সব খাবারের সুবাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ঈদগাহতে সকালেই ঈদের নামাজটি পড়া হয়। কাজেই গোসল (স্নান) সেরে, পরিষ্কার নতুন জামাকাপড় ও টুপি পরে, আতর (সুগন্ধী) লাগিয়ে নামাজ পড়তে বেরিয়ে পড়ে ছোট বড় সবাই। নামাজ শেষে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানায় কোলাকুলি করে। তারপর বাড়ি ফিরে পরিবারের সকলের সাথে আনন্দে মেতে ওঠে। পরিচিত,বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন একে অন্যের বাড়ি বেড়াতে যান।
মনে রাখতে হবে ঈদ শব্দের সাথে আরো একটি শব্দ রয়েছে তাহলো ফিতর, আর ফিতর শব্দের অর্থ হলো উপবাস ভঙ্গ করা, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা, আজকের ঈদ তাদের জন্যে যারা রমজান মাসে রোজা রেখে প্রয়াস করেছেন আত্ম সংযম করার, সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করেছেন, ক্রোধ দমন করেছেন, অন্যের কষ্ট লাঘব করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন, প্রতিবেশির ব্যথাবেদনা দূর করার চেষ্টা করেছেন, নিঃস্বের ক্ষুধা যন্ত্রণা নিজে রোজা রেখে উপলব্ধি করার, উঁচু নীচুর ভেদাভেদ ভুলে যাবার চেষ্টা করেছেন। ঈদ শুধু নিজেদের মধ্যে আনন্দ বা খুশির উৎসব নয় বরং ঈদ মানে ধনী-গরীব সকলের জন্যই বিশেষ আনন্দের দিন। শুধু নিজের জন্য নয়, শুধু ভোগে নয়, বরং সবাইকে নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠার দিন হলো ঈদ।
মেঘ অদিতি
ঢাকা, বাংলাদেশ
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মেঘ অদিতি
- ক্যাটfগরি: প্রচ্ছদকাহিনীঃ উতসব
দুর্গাপুজো
দুর্গাপুজো। বাঙালিদের সব থেকে বড় আনন্দ উতসব। হ্যাঁ, আনন্দ উতসবই লিখলাম, কারণ আজকের দিনে, দুর্গাপুজো আর শুধুমাত্র ধর্মীয় উতসব নয়। আর দুর্গাপুজোতে শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুরাই অংশগ্রহণ করেন না বা আনন্দ উপভোগ করেন না। আলো-মন্ডপ-প্রতিমা দেখা-বেড়ানো-খাওয়াদাওয়া-গান বাজনা- সব মিলে দুর্গাপুজো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কাছে হাসি-আনন্দে ভরা পাঁচটা দিন।
এই শরতকালে দুর্গাপুজো কেন হয় সেই নিয়ে সবথেকে প্রচলিত গল্পটা বোধ হয় সবার জানা। রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রামের প্রয়োজন ছিল দেবী দুর্গার আশীর্বাদের। কিন্তু দুর্গাপুজো আদতে হত বসন্তকালে ( সে পুজো পরিচিত বাসন্তী পুজো নামে)। তাই রামচন্দ্র শরতকালে দেবীর অকালবোধন করতে বসলেন। তাঁর আরাধনায় খুশি হয় দেবী দেখা দিলেন। মূল রামায়ণে কিন্তু এই গল্পটা ছিল না। এই গল্পটা জানা যায় প্রধাণতঃ কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে।
শরতকালে দুর্গার আরাধনার আরেকটাও প্রচলিত গল্প আছে। হিমালয় কন্যা পার্বতী/ উমা তো শিবঠাকুরকে বিয়ে করে কৈলাশ পর্বতে চলে গেলেন। কিন্তু তিনি বাপের বাড়ি না এলে কি হয়? তাই বছরে একবার, বর্ষার শেষে গোলাভরা ধান উঠলে , নতুন ফসল উঠলে, উমা তাঁর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে চার দিনের জন্য বাপের বাড়ি আসেন। কৃষিপ্রধান পূর্ব ভারতে যেভাবে ঘরে ভাল ফসল উঠলে বিবাহিতা মেয়েরা বছরে একবার বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন, ঠিক সেইভাবে।
কিন্তু যে দুর্গাঠাকুরের মূর্তি আমরা সাধারণতঃ মন্ডপে মন্ডপে দেখতে পাই, সেখানে তো বাড়ির মেয়ে উমা অথবা রামের আরাধনায় তুষ্ট দুর্গা দেবীকে দেখি না। আমরা দেখি দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপ। দেবীর এই রূপের খোঁজ পাওয়া যায় পুরাণের আরেক গল্পে। সেই গল্প এইরকমঃ
এক খুব ভয়ানক অসুর ছিল। সে মহিষ সেজে ঘুরে বেড়াত, তাই সে পরিচিত ছিল মহিষাসুর নামে। মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতাদের দুঃখ দুর্দশার শেষ ছিল না। তাঁরা একশো বছর ধরে তার সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহিষাসুর দেবতাদের হটিয়ে দিয়ে নিজেই স্বর্গে ইন্দ্রের স্থান গ্রহণ করল। দেবতারা তখন নিরুপায় হয়ে ব্রহ্মাকে সাথে নিয়ে শিব ও বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তাঁদের মুখে মহিষাসুরের অত্যাচারের কথা শুনে শিব আর বিষ্ণু প্রচন্ড রেগে গেলেন। রাগের চোটে ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বরের শরীর থেকে এক অদ্ভূত তেজ নির্গত হতে থাকল। আগুণের পাহাড়ের মত সেই পুঞ্জিভূত তেজ ক্রমশঃ একত্রিত হয়ে এক বিশাল দেবীর সৃষ্টি হল। সেই দেবী অপরূপ সুন্দরী;অমিত শক্তির অধিকারিনী। সেই দেবীকে দেখে দেবতাদের আনন্দের সীমা রইল না। তাঁরা কেউ তাঁকে দিলেন অস্ত্র, কেউ বর্ম, কেউ অলঙ্কার। স্বয়ং হিমালয় এক বিশাল সিংহকে এনে তাঁকে বাহন রূপে উপহার দিলেন।
এই দেবী হলেন দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। তাঁর হাজার হাজার হাত, তাঁর যুদ্ধহুঙ্কারে দশদিক কম্পিত হল। অসুরেরা সেই হুঙ্কারের শব্দে ছুটে এল। তারপরে শুরু হল এক ভয়ানক যুদ্ধ। মহিষাসুর এসে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করল। সে ছিল এক দক্ষ মায়াবী। সে কখনও মহিষ, কখনও সিংহ, কখনও হাতি সেজে দেবীর সাথে লড়াই করতে লাগল। শেষ অবধি দেবী সেই মহিষরূপী অসুরকে ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করে সেই মহিষের মুন্ডচ্ছেদ করলেন। তখন সেই অসুর আধখানা মহিষের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করা শুরু করল। শেষ পর্যন্ত দেবী তার মাথা খড়্গ দিয়ে কেটে ফেললেন। দেবতারা দেবীর জয়ধ্বনি দিলেন। স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল। দেবী দুর্গা দেবতাদের কথা দিলেন আবার বিপদে পড়লে তিনি তাঁদের রক্ষা করতে আসবেন। এই বলে আকাশে মিলিয়ে গেলেন।
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমরা যে দেবী দুর্গার প্রতিমা দেখে অভ্যস্ত, সেখানে আধাখানা মহিষের দেহ থেকে বেরিয়ে আসা অসুরকে কেন দেখা যায় দেবী দুর্গার পায়ের তলায়। দেবী দুর্গার সাথে মহিষাসুরের এই যুদ্ধের অসাধারণ এক বিবরণ শুনতে পাওয়া যায় মহালয়ার ভোরবেলায় রেডিওতে ভেসে আসা "মহিষাসুরমর্দিনী " অনুষ্ঠানে। শুনেছ নিশ্চয় মহালয়ার ভোরে?
একচালা প্রতিমা
এই সমস্ত গল্পই মিলে মিশে আছে আশ্বিনমাসের দেবীপক্ষে (বা শুক্লপক্ষে) পাঁচদিন ধরে দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্যে। তাই প্রচলিত বিভিন্ন গল্পগুলি মিলে মিশে গিয়ে, আমরা এই মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার দুইপাশে দেখতে পাই তাঁর চার ছেলে মেয়েকেও।
শরতকালে দেবী দুর্গার আরাধনা বাঙালিদের মধ্যে চলে আসছে কয়েক হাজার বছর ধরে। এগুলি বেশিরভাগই ছিল পারিবারিক পুজো বা একা কোন মানুষের চেষ্টায় পুজো। দুর্গাপুজোকে আমরা এখন যেভাবে দেখি, অর্থাৎ অনেক মানুষ মিলে একত্র হয়ে একটা পুজোর আয়োজন করা, উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সেটা প্রথম শুরু করেন গুপ্তিপাড়ার বারো জন ব্রাহ্মণ মিলে। বারো জন বন্ধু বা 'ইয়ার' মিলে এই পুজো শুরু করেন বলে এই ধরণের পুজো পরিচিত হয় 'বারোয়ারি' পুজো নামে। 'বারোয়ারি' শব্দটি এখন আর তত ব্যবহার হয়না। তার বদলে ব্যবহার করা হয় 'সার্বজনীন শব্দটি। 'সার্বজনীন' অর্থাৎ সবাইকে নিয়ে যে পুজো।
হ্যাঁ, তাই এই লেখার শুরুতে বলেছিলাম, দুর্গাপুজো শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুদের এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এ হল সব মানুষের এক আনন্দ উতসব। আর আজকাল তো এই পুজো শুধু পুজোতেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশেষ করে বড় শহরগুলিতে, অঞ্জলি, সন্ধিপুজো, ধুনুচি নাচ, ঢাকের বাদ্যি, এ সবের পাশেপাশে রয়েছে প্রতিমা , মন্ডপ , আলোকসজ্জার অসাধারণ সব উদাহরণ দেখতে পাওয়ার সুযোগ। কয়েক মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দূর দূরান্ত থেকে আসা শিল্পীরা সৃষ্টি করেন অসাধারণ সব মন্ডপ আর প্রতিমা। সেইসব নিয়ে বিভিন্ন পুজো উদ্যোক্তাদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে। আর সুন্দর শিল্পকীর্তি দেখতে কার না ভাল লাগে? তাই এইসব শিল্পকীর্তি দেখতে ভিড় জমান সমাজের সব স্তরের মানুষ। এই ভাবে ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে এই উতসব হয়ে উঠেছে এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উতসব।
আর তোমার মত ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের কাছে দুর্গাপুজো মানে তো লম্বা ছুটি, পড়াশোনা বন্ধ, নতুন জামা, দেদার মজা, যত ইচ্ছা ভালমন্দ খাওয়া। বাবা-মায়েদের শাসন ও অনেক কম এই কয়টা দিনে। অনেকদিন দেখা না হওয়া আত্মীয়দের সাথে দেখা হয়ে আড্ডা-গল্পে মেতে ওঠেন তাঁরা। ষষ্ঠী থেকে নবমী অবধি চারদিন ধরে চলে অফুরন্ত আনন্দ। আজকাল অবশ্য এত এত ঠাকুর দেখার সুযোগ, যে ভিড় শুরু হয়ে যায় চতুর্থী -পঞ্চমী থেকেই।
সন্ধিপুজোর ১০৮ বাতি
নবমী নিশি পোহালেই কিন্তু মায়ের ফিরে যাওয়ার সময় চলে আসে। দশমী দুপুরে মা দুর্গাকে সিঁদুর পরিয়ে, মিষ্টিমুখ করিয়ে বিদায় জানানো হয়। ঢাকে বেজে ওঠে বিদায়ের সুর-
ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ-
ঠাকুর যাবে বিসর্জন।
কিন্তু বিসর্জন দিলেই বা কি? সেই যে, মা দুর্গা দেবতাদের কথা দিয়েছিলেন, ডাক দিলেই তিনি ফিরে আসবেন, সে আশাতেই বুক বেঁধে কিন্তু মা'কে নদীর জলে ভাসান দিতে দিতে সবাই হেঁকে ওঠে - 'আসছে বছর আবার হবে' ।শুরু হয় আবার এক বছরের অপেক্ষা।
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা
দুর্গার ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
গণেশজননীর ছবিঃ
সাবেরী সেনগুপ্ত
ফটোগ্রাফঃ
কল্লোল লাহিড়ি
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: প্রচ্ছদকাহিনীঃ উতসব
শরত এল
বর্ষা সবে শেষ হল। এবার মেঘরাজ্যে ভারী খাটুনি গেছে আগের বারের তুলনায়।
আগের আগের বার মেঘেদের খুব মজা ছিল। কাগজে কলমে বর্ষাকাল এসে গিয়েছিল কিন্তু বড়কর্তার প্ল্যান ছিল খালি ভয় দেখাতে হবে, জল ঢালা নয়। কিঞ্চিৎ গণ্ডগোল অবশ্য পাকিয়েছিল মেঘেদের কালো-কোলো ছানাগুলো; তারা তো এত মতলবের কথা জানেনা – কাজের সময় এসে গেছে, তাই তারা কোন এক জায়গার আকাশে গিয়ে ভীড় জমাল। ছোট তো, তাই উৎসাহ বেশি। সবাই ভাবল, “বাবা, আকাশ এতো কালো হয়ে গেল। এইবার নামবে জব্বর বৃষ্টি।” কড়-কড়-কড়াৎ- মেঘের ছানাগুলি বেজায় মারামারি শুরু করল, এক্কেবারে বজ্র নিয়ে লাঠালাঠি। তাই দেখে চাষীরা হাল-বলদ নিয়ে মহা আনন্দে মাঠে নেমে পড়ল চাষ করতে। কিন্তু ওমা! বড়কর্তার প্ল্যান-এ জল ঢালা, মানে আদেশ অমান্য করেই জল ঢালা, কি এতই সহজ? ঊনপঞ্চাশ পবনের বাহিনী এসে এমন ফুঁ লাগাল যে মেঘেরা পালিয়ে যাবার পথ পায় না। কোথায় বৃষ্টি, কোথায় কি, আকাশ ফর্সা।
এদিকে এইরকম কিছু ঘটলেই রাজা মিহিরকিরণের হয় বেজায় রাগ। মেঘলা দিনে তাঁর মনে একটু আশা জাগে, প্রতিদিন সারাদিন একটানা কাজ করতে হয়, সেই দিনগুলো একটু বিশ্রাম করা যাবে। হা হতোস্মি! সেদিন যেমন, মোটে রথ ঘুরিয়ে দু’মাইল গেছেন কি যাননি, আকাশ ফর্সা দেখে তাঁকে আবার রথ নিয়ে ছুটতে হল। বিধাতাপুরুষ বলে দিয়েছেন আকাশ খালি রাখা যাবে না। সে কথা তো আর অমান্য করা চলে না! রেগে মেগে তিনি ভীষণ তেজে জ্বলতে লাগলেন। রোজই প্রায় এক গল্প। পৃথিবীর মানুষ হতাশ হয়ে পড়ল। মাটি ফেটে চৌচির, সব ফসলের বীজ শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেল। চাষীরা হায় হায় করে মাথায় হাত দিয়ে বসল। এই ভাবেই কেটেছে গত বছর দু’য়েক।
কিন্তু এবার? বছরের প্রথমেই মেঘদের হাতে বড়কর্তা, যার নাম শ্রী বাসব, একটা তালিকা ধরিয়ে দিয়েছেন। সেটা দেখে সব মেঘেদের ভুরু গেল কুঁচকে। এবার এত আগে থেকে কাজ শুরু করতে হবে! ব্যাপার কি? একজন বলল, “আরে জাননা, গত পূজার সময় দুগ্গা মা তো হাতিতে চড়ে গিয়েছেন। পঞ্জিকাতে লেখা আছে না, গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা? বোধহয় সেই জন্যই।” আরেকজন বলল, “ছাই, এসব আবার কেউ মানে নাকি? এগুলো ফালতু কথা। আসলে কি হয়েছে জানো? পরপর কয়েক বছর এতো খরা গেছে যে মানুষ এখন আর বিরক্তও হচ্ছেনা। বরং বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন যাতে নকল জলভরা মেঘ তৈরী করে ইচ্ছামত বৃষ্টি ঝরানো যায়। কেমন মজা হবে বলতো? যখন দরকার হবে তখনই বৃষ্টি পাওয়া যাবে। এসব শুনে বড়কর্তা শ্রী বাসবের ভয় ধরেছে না?”
কথাটা খুব একটা ভুল বলেনি। শ্রী বাসব-এর বেজায় ভয় ধরেছে বটে। এত বছর ধরে তাঁর হাতে বৃষ্টি ঝরানোর ভার; এজন্য তাঁর কি প্রতাপ! সবাই তাঁকে বেশ সমীহ করে। আজ যদি এইসব ক্ষমতা চলে যায় তো লোকে কি তাঁকে আর মানবে? তাই এবছর প্রথম থেকেই তিনি বেশ সক্রিয় হয়েছেন। রীতিমত আটঘাট বেঁধে কাজ শুরু করিয়েছেন। মেঘদের তো আর এত চিন্তাভাবনা করার অভ্যেস নেই; তাদের বলা হয়েছে, আর তারাও জল ঢালতে শুরু করল। ফলে, এবার এতো বৃষ্টি হল যে চারদিক ভেসে গেল, রীতিমত বন্যা শুরু হয়ে গেল। তার ওপর অতিবৃষ্টিতে বাঁধ ভেসে যাচ্ছে দেখে সেখান থেকে জল ছাড়া হতে লাগল। ফলে মানুষের ত্রাহি মাং অবস্থা। আর কেউ বৃষ্টি চায় না। সকলের জীবন পচে গেল একেবারে।
তারপর একদিন এই লাগাতার বৃষ্টি থামল। মিঃ বাসব খুশমেজাজে গোঁফে তা দিয়ে নিজের মনেই হাসলেন, ভাবলেন, “কেন, এইবার ব্যাটারা বোঝ, কত ধানে কত চাল! আমার নামে অভিযোগ করা? আমি নাকি কাজে ফাঁকি দেই!” তিনি মনের খুশীতে পেল্লাই এক ডিনারের অর্ডার দিলেন। তাই দেখে মেঘেরা গেল বেজায় চটে। “ই---স, আমাদের নাওয়া খাওয়ার সময় ছিল না, সারা দেশ জুড়ে দৌড়ে দৌড়ে ঘড়া ঘড়া জল ঢালতে ঢালতে হাত পায়ের খিল খুলে গেল। একদিনও তো দেখতেও যাননি, আমরা কিভাবে কেমন কাজ করছি। আজ এখন সেলিব্রেট করতে ডিনার খেতে বসেছেন। যত্তোসব!” তারা গজগজ করতে লাগল। তাই আকাশ একটু হাল্কা হলেও মেঘের গুরু গুরু বন্ধ হলনা।
ভারী বর্ষাটা কেটে গেছে। তা বলে সমস্ত মেঘের কাজ কিন্তু একেবারে শেষ হয়ে যায় নি। মাঝে মাঝে এখানে সেখানে জল অল্প-স্বল্প জল ঢালার কাজ চলতেই থাকবে – বড়কর্তার হুকুম জারি হয়ে গেছে। এখন এই কাজটা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবার পালা। ছোট দলের লীডাররা এই কাজের ভার ফেলল দলের পুঁচকিগুলোর ঘাড়ে। তারা হৈ হৈ করে আজ এখানে কাল সেখানে জল ছড়িয়ে বেড়াতে লাগল। পৃথিবীর মানুষ হয়তো রোদ দেখে মহা আনন্দে পুজোর বাজার করতে বেড়িয়েছে, বা ছোটরা কলকল করতে করতে এ দোকান ও দোকানে রঙবেরঙ-এর জামা জুতো খুঁজছে। হঠাৎ আকাশ থেকে ফুলঝুরির মত বৃষ্টি ঝরে পড়ল। ছোট্, ছোট্, মূহুর্তে রাস্তা ফাঁকা। তাই দেখে উপর থেকে বালখিল্য মেঘের দল হেসেই কুটিপাটি, আর মানুষেরা ভুরু কুঁচকে ওপর দিকে তাকাবার আগেই ভ্যানিস। কোথায় মেঘ, কোথায় বৃষ্টি, নীল আকাশ ঝকঝক করছে।
আর গাছপালারা? তাদের মন যে কী খারাপ হয়েছিল এতো বৃষ্টি দেখে। এখন ফাঁকা মাঠে যেখানে সেখানে কাশবন গজিয়ে উঠল। পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্না গায়ে মেখে বাতাসের ছোঁওয়া পেয়ে আনন্দে একে অন্যের গায়ে হেসে ঢলে পড়তে লাগল। বাতাস সেই আনন্দ বয়ে নিয়ে গেল মানুষের বাড়ি। সবাই খুশি হয়ে উঠল। এদিকে কুমোরপাড়ায় কি ব্যস্ততা! বৃষ্টিতে প্রতিমা যে শুকায় নি। এখন দ্রুতহাতে প্রতিমা শুকিয়ে তারা রঙ লাগাতে ব্যস্ত। দুগ্গা ঠাকুর যে আজকাল বিদেশেও পাড়ি দেন। আর দু’দিন বাদেই ঢাকে কাঠি পড়বে। ঢ্যাম কুড়কুড়, ঢ্যাম কুড়কুড়, দুগ্গা ঠাকুর আর কত দূর। বর্ষার সমস্ত ঘ্যানঘ্যানে কষ্ট কাটিয়ে আকাশে বাতাসে আজ একটাই সুর বাজছে শরৎ এলো, শরৎ এলো।
শুক্তি দত্ত
বৈষ্ণবঘাটা, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন শুক্তি দত্ত
- ক্যাটfগরি: প্রচ্ছদকাহিনীঃ উতসব