সে ছিল এক অপ্সরাদের দেশ। অপ্সরা মানে শাপভ্রষ্ট দেবী। যারা মর্ত্যে নেমে আসে কোনও কারণে। দেবতাদের অভিশাপে। ভালো কাজ করে, দুষ্টের দমন করে আবারও যথাসময়ে তারা ফিরে যায় স্বর্গে। দেবতাদের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে।
সে দেশ কে বলা হয় "ল্যান্ড অফ খমের (Khmer)" বা কাম্বোডিয়া। মহাভারতে যে কম্বোজ উপজাতির কথা আছে তারা নাকি গান্ধারের আশেপাশেই থাকত। তাই কম্বোজ> কাম্পুচিয়া> কাম্বোডিয়া। এভাবেই হয়েছে সে দেশের নামের বিবর্তন। স্বর্গের অপ্সরারা নাকি নেমে আসতেন এখানে। সেখানকার মানুষের এমনি বিশ্বাস।
পাহাড় কে খমের (Khmer) ভাষায় বলে Phnom । কথায় বলে নম-কুলেন (Phnom Kulen) পাহাড়ের মাথা থেকে বয়ে আনা স্যান্ড স্টোন আর লাভা স্টোন দিয়ে সারা কাম্বোডিয়ার আনাচকানাচ ভরে উঠেছিল এক অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তিতে। একের পর মন্দির তৈরী করেছিলেন রাজারা। লিচুগাছের প্রাচুর্য্যে ভরা এই নম কুলেন পাহাড়ের খমের (Khmer) ভাষায় অর্থ "Mountain of Lychees"।
নম-কুলেনের এক পাহাড়ি এলাকায় থাকতেন এক সাধু। সাধুর নাম ছিল প্রাম মনি। পাহাড়ের মাথায় ছিল তাঁর আশ্রম। সেখানে তাঁর দুই প্রিয় শিষ্য ছিল। এক অপ্সরা এবং এক দৈত্য।
অতীব বিচক্ষণ এবং শক্তিশালী সেই সন্ন্যেসীর আশ্রমে সহজে কেউ প্রবেশ করতে পারত না। একে তো পাহাড়ের মাথায় তায় আবার সেখানে উঠতে গহীন এক জঙ্গল পেরুতে হত। সেই সাধু প্রাম মণির কাছে ছিল এক ম্যাজিক বল বা পরশ পাথরের অনুরূপ কিছু একটা অলৌকিক জিনিষ। তিনি তা আগলে রেখেছিলেন এতদিন যাবত নিজের কাছে। খুব সাবধানে। সবার থেকে আড়ালে আবডালে। তিনিও আবার তা পেয়েছিলেন তাঁর গুরুদেবের কাছ থেকে। ভেবেছিলেন নিজের শেষ জীবনে সবচাইতে সুযোগ্য ও বুদ্ধিমান শিষ্যের কাছে তা দিয়ে যাবেন। তবেই হবে তাঁর শান্তি। শিষ্য অপ্সরার নাম ছিল মণিমেখলা আর দৈত্যের নাম ছিল রিয়েম। গুরুগৃহে তাদের দুজনের শিক্ষালাভ প্রায় শেষের পথে।
সেবার প্রচণ্ড গরমে অস্থির কাম্বোডিয়ার জন জীবন। পাখি পশু, সবুজ উদ্ভিদ সবাই যেন ত্রাহি ত্রাহি রব তোলে। সেখানকার মাটি যেন সে গ্রীষ্মে ফুটিফাটা হয়েছিল। চাষাবাদ নেই। কাঠফাটা গরমে মানুষের প্রাণ যায় যেন। হা বৃষ্টি, জো বৃষ্টি করতে থাকে লোকে।
গুরুদেব প্রাম মণি ভাবলেন এভাবে দিনের পরদিন চললে সেখানকার জনজীবন মারা যাবে। চাষাবাদ যাদের জীবিকা তারা বৃষ্টি ছাড়া বাঁচবে কেমন করে?
চিন্তায় দিনাতিপাত গুরুদেবের। তিনি এই পৃথিবী থেকে চলে যাবার আগেই এই বৃষ্টির উপায় তাকে বের করতেই হবে। মণিমেখলা আর রিয়েম দুজনেই তাঁর সুযোগ্য শিষ্য। কিন্তু কার হাতে তবে দিয়ে যাবেন সেই আশ্চর্য পরশ গোলক? অতঃপর তাঁর মাথায় এক বুদ্ধি খেলল। দুজনকেই উদ্দেশ্য করে তিনি একটি জিনিষ চাইলেন। কী সেই জিনিষ? ভোরবেলায় ঘাসের ডগায় পড়ে থাকা এক পেয়ালা তাজা শিশির চাই তাঁর। দুজনের মধ্যে যে সর্বাগ্রে এনে দিতে পারবে তার ওপরেই বর্তাবে সেই আশ্চর্য গোলকের অধিকার।
রিয়েম ছিল অতি চতুর প্রকৃতির। সে ভাবল এক কায়দা করবে। চুপিচুপি ভোরবেলায় উঠে আগেভাগে সে আশ্রমের বাগানের সবুজ ঘাসে টুপটাপ ঝরে পড়া এলোমেলো সব পাতাগুলিকে কুড়িয়ে আনলো। একটার পর একটা পাতার আগা থেকে যত্ন সহকারে ফোঁটা ফোঁটা শিশিরের কণা গুলো কে পাথরের পেয়ালার ধার দিয়ে ভেতরে চেঁছে নিয়ে শিশির সংগ্রহ করতে থাকলো। জলে যেন আর ভর্তি হয়েও হয়না সেই গেলাস। এদিকে সময় এগিয়ে আসে। ভোরের সূর্যের তেজ বাড়তেই থাকে। ভয় হয় তার সংগ্রহের শিশির না উবে যায় পেয়ালা ছেড়ে।
অন্যদিকে মণিমেখলার আরও বুদ্ধি। সে মধ্যরাত থেকেই আশ্রমের বাগানের সবুজ ঘাসের ওপর বিছিয়ে রেখেছিল একটি নরম রুমাল। ভোরের সব শিশির সেখানে ঝরে পড়ল। মণিমেখলা ধীর পায়ে গিয়ে শিশিরভেজা সেই রুমালটি এনে তা চিপে সব জলটুকুনি ভরে রেখে দিল একটি পাথরের গেলাসে। বলাই বাহুল্য তার হাতযশে ছোট্ট সেই শিশির সুদ্ধ গেলাসটি তখন উপচে পড়ছিল জলে।
দৈত্য রিয়েমের আগেভাগেই গেলাসটি গুরু প্রাম মণির কাছে নিবেদন করল মণিমেখলা। গুরুদেব মহানন্দে শিষ্য কে আশীর্বাদ করে সেই আশ্চর্য গোলকটি সুযোগ্যা মণিমেখলার হাতে দিলেন ও যারপরনাই স্বস্তি পেলেন। অন্যদিকে পাছে অন্য শিষ্য রিয়েমের মনখারাপ হয় তাই তার হাতে সান্ত্বনা পুরষ্কার স্বরূপ তুলে দিলেন একটি যাদু কুঠার।
এই পুরষ্কার প্রাপ্তির পরেই কিন্তু গুরুর কাছে আশ্রমিক শিক্ষালাভ পর্বের সমাপ্তিতে মণিমেখলা এবং রিয়েম দুজনেরই জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হবার কথা। কিন্তু ফল হল আরেক।
আগে বন্ধুত্ব থাকলেও সেই আশ্চর্য গোলক পাওয়ার পরে প্রবল হিংসার শিকার হতে থাকলো মণিমেখলা। গল্পটির মোড় তখন ঘুরে যায় অন্যদিকে। মণিমেখলা যেন বিশাল শৌর্য আর ক্ষমতা হাতে পেয়েই গেছে সেই ভয়ে দুষ্টু রিয়েম যেন তেন প্রকারেণ মণিমেখলার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে গোলকটি ছিনিয়ে নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো।
মণিমেখলার প্রতি তার লক্ষ্য রইল সর্বদা। কিছুতেই তার পিছু ছাড়েনা রিয়েম। ক্রমশ তাকে ভয় দেখাতে লাগল সে। সবসময়ই উঁকিঝুঁকি দেয় সে। মণিমেখলা কোথায় যায়, কী করে, কোথায় সেই জিনিসটি রাখে সেদিকেই তার কেবল লক্ষ্য। তবে মণিমেখলার সে বিষয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তার মতোই থাকে। তবে সে দিব্য বুঝতে পারে যে দুষ্ট রিয়েমের দুরভিসন্ধি। একদিন কিছুতেই সেই দুর্লভ গোলকটি না লাভ করতে পারায় অধৈর্য রিয়েম তার গুরুর দেওয়া সেই যাদু কুঠার টি মণিমেখলার দিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়েই দিল। একটুর জন্য তা অপ্সরার গায়ে লেগেও লাগলো না যেন। অপ্সরা মণিমেখলা তখন তার সেই আশ্চর্য পরশ গোলকটি শূন্যে ছুঁড়ে দিতেই ভয়ানক এক বজ্র বিদ্যুৎ সহ গগনভেদী শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠল। চারিদক নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢেকে গেল । দৈত্য রিয়েমের চোখে সজোরে গোলকটি লাগায় সে অন্ধ হয়ে গেল। উঠতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল সে। ক্ষণিকের মধ্যেই সম্বিত ফিরতে সে তার কপালের ঘাম মুছে নিজের বলে উঠে দাঁড়াল। এ কী! বৃষ্টি? হ্যাঁ। বজ্র গর্ভ মেঘ আর বৃষ্টির ধারাজলে প্রকৃতি ততক্ষণে শান্ত হয়েছে। রিয়েম ভাবল তার শত্রু বুঝি পালিয়েছে।
কাম্বোডিয়ার মানুষের বিশ্বাস, এভাবেই নাকি বজ্র আর বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়েছে। দেবী এবং দানবের এই স্বঘোষিত যুদ্ধ নাকি সত্যিই হয়েছিল সেখানে। প্রচণ্ড এক খর গ্রীষ্মে।
রিয়েম রূপী অসুর দানবের সেই যাদু কুঠার আর মণিমেখলা রূপী দেবীর সেই পরশ গোলকের সমন্বয়ে যুদ্ধ হয়েছে দু'জনার। দু' প্রান্তে। তবেই শান্ত হয়েছে ধরিত্রী। কাম্বোডিয়া নাকি এভাবেই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হয়ে উঠেছে কালে কালে।
বহু বছর ধরে এই কিংবদন্তি কে মান্যতা দিতে অন্ততঃ বছরে একবার কাম্বোডিয়ায় একটি অনুষ্ঠান হয় ঘটা করে। "বুওং সুওং" নামে পরিচিত এই পবিত্র অনুষ্ঠান। প্রতিবছরে এখানে আইন মেনে পালিত হয় রাজকীয়ভাবে। নানারকমের ফল, মাংস এবং অন্যান্য খাবার, ধূপ, ফুল নিবেদনের মাধ্যমে নাচ গান করে দেবতাদের কাছে বৃষ্টি কামনা করে আশীর্বাদ চাওয়ার একটি উপায় যেন এই অনুষ্ঠান।
এমন যুদ্ধ প্রতিবছরেই হয়ে থাকে কাম্বোডিয়ান নিউ ইয়ার অর্থাৎ আমাদের দেশের এপ্রিলের মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে। মানে বাঙ্গালির তখন পয়লা বৈশাখ। ফুটিফাটা মাঠঘাটের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে হতাশ চাষি। আকাশের দিকে তাকিয়ে এক টুকরো কালো মেঘ দেখলেই তারা ভাবে ওই বুঝি রিয়েম আর মণিমেখলার যুদ্ধ শুরু হবে। সেখানে নেমে আসবে বৃষ্টির আশীর্বাদ। তবেই হবে ফসল। বাঁচবে মানুষ চাষাবাদ করে।
কাম্বোডিয়া বেড়াতে গেছিল ছোট্ট টুপুর। তার বাবা মায়ের সঙ্গে। অপ্সরার দেশ কাম্বোডিয়া এক প্রাচীন মন্দিরময় দেশ। সেখানে আজও অলিগলিতে, মন্দিরের স্থাপত্যে, লাইট অ্যান্ড শোয়ের গল্পে রামায়ণ, মহাভারত ফুটে ওঠে প্রতিনয়ত। টুপুর ভারি খুশি সেই কারণে।
বাবা টিকিট কেটেছেন — সেখানকার জনপ্রিয় শো 'স্মাইল অফ অ্যাঙ্কর'। সিয়েম রিয়েপ শহরের প্রাণকেন্দ্রে 'স্মাইল অফ অ্যাঙ্কর' গ্র্যান্ড থিয়েটারে ইভিনিং শো দেখবে টুপুর। রামায়ণের গল্প আরও রঙিন হয়ে উঠবে তার চোখের সামনে। আলো ঝলমলে মঞ্চে।
সারাদিন সাইট সিইং ট্যুরে বিধ্বস্ত ছোট্ট টুপুর। সেখানে ডিসেম্বরেও প্রচণ্ড গরম। শরীর ঠাণ্ডা রাখতে ডাব আর রকমারি ফল বিক্রি হয় পথে ঘাটে। গরমের দাবদাহে পথ চলা দায়। টুপুর বলে, বাবা, শীতের ছুটিতে গরমের দেশে যেতে হয়?
বাবা বলেন এসময়টাই এখানে মনোরম। আমাদের গরমকালে এখানে আরও কষ্টকর। সবকিছু ঘুরে দেখতে নাজেহাল হতে হয়।
কিন্তু বৃষ্টি কী আজও হবেনা বাবা? উফফ!
গুমোট গরম নয় তবে রোদে হেঁটে হেঁটে বড় বড় সব মন্দির ঘুরে ঘুরে দেখতে বড় পরিশ্রান্ত লাগে। তার জন্য অবিশ্যি কথায় কথায় ফ্রোজেন ডাব পাওয়া যায় সেখানে। গোটা একটা ডাব তারা রেফ্রিজারেট করে বিক্রি করে পথচারীদের জন্য। অতবড় ডাব জীবনে চোখে দেখেনি তারা। শুধু টুপুর কেন? তার বাবা মাও। একটা ডাবের জলে পেট ভরে যায় দুজনের।
অন্ধকার হয় 'স্মাইল অফ অ্যাঙ্কর'-এর ঝলমলে মঞ্চ। অপ্সরা সেজে সব নৃত্যশিল্পীরা অবতীর্ণ হবে সেখানে। ছোট্ট টুপুর অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। কী ভাগ্যিস সেখানে এয়ারকন্ডিশানার আছে। নয়ত অত লোকের গরমে কী কষ্টই না হত। ভ্রাম্যমান মন্দিরময়তায় হঠাত আলোর ঝলকানিতে জ্বলে উঠল মঞ্চের আনাচকানাচ। আলোয় অন্ধকারে ভাষ্যপাঠ, গান, মিউজিকের আবহে আঙ্কোরভাটের মন্দিরময় ইতিহাস রমরমিয়ে বর্ণিত হল। মন্দিরের সামনে এমন অপ্সরার নাচ অন্যরকম স্বর্গীয় আনন্দে আপ্লুত করল টুপুরদের।
বাবা এ কেমনতর স্টেজ? মঞ্চ ঘোরে? এক আকাশের নীচে এত কারিগরী দেখে টুপুর একের পর এক প্রশ্ন করে।
বাবা বললেন, সব লেজার আলোর কারসাজি বুঝলি? দেখ দেখ, সে যুগে কাম্বোডিয়ার রাজ্যপাট কেমন ছিল। শুরু হল সে রাজকাহিনী। অনবদ্য অ্যাক্রোবেটিকস।
বাবা এ কী তবে আমাদের সার্কাসের মত ট্র্যাপিজের খেলা?
একবার বেরিয়ে আসে কেউ সার্কাসের তাঁবু থেকে। পরিবেশন করে জীবন্ত উত্সব। গান, নাচ সম্বলিত অপূর্ব সিম্ফনি।
এর নাম কাম্বোডিয়ান সোনাটা। বাবা বললেন।
ভাবতে ভাবতেই ঘোড়া ছুটিয়ে রাজারাজড়ার যুদ্ধ...টগবগিয়ে সেনাবাহিনী মঞ্চ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ায়। একটুও অতিনাটকীয়তা নেই, নেই মেলোড্রামাটিক অভিনয়। সঙ্গে সারে সারে রুচিসম্মত পোশাকে অপ্সরাদের সম্মিলিত নৃত্য।
হঠাত শুরু হল বৃষ্টি। টুপুর চমকিত মঞ্চের ওপরে বৃষ্টি দেখে।
বাবা বললেন এ হল কৃত্রিম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে নাচল সবাই।
এমন বৃষ্টি বাইরে যদি সত্যিই হত এখানে মানুষ তবে বাঁচত। তাই না বাবা?
হ্যাঁ। রে। সবুজ আর সজীব হত ধানক্ষেত। চাষিরা বাঁচত। বাবা সায় দেন মেয়ের কথায়।
ঐ দেখ রেইন ডান্স বাবা? কী সুন্দর নাচছে ওরা! ইস! আমি যদি একটু বৃষ্টি তে এমন নাচতে পারতাম! তাকিয়ে দেখে, মঞ্চের সামনেই এক টুকরো পুকুরে খলখল করে ফোয়ারা। জ্বলে উঠছে আলো। নাচছে অপ্সরারা। কত ভঙ্গিমা তাদের! কি অপূর্ব যুগপত শুরু ও শেষ। সমুদ্রমন্থন করে অমৃতের ভান্ড নিয়ে লক্ষ্মী উঠে এলেন। সেই অমৃত পান করে দেবতাদের অমরত্ব লাভ হল। মা বুঝিয়ে দেন টুপুর কে সব। সবকিছুই সঙ্গীতের মূর্চ্ছণায় আর নৃত্যনাট্যের ভঙ্গিমায়।
এবার রামায়ণের শো হবে। টুপুর নড়েচড়ে বসে। বড় প্রিয় এসব গল্প তার।
বানর সেনাপতি হনুমান রামচন্দ্রের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সীতাকে অপহরণ করে বন্দী করা হলে হনুমান তাকে উদ্ধার করতে সাহায্য করলেন। টুপুর সব জানে।
হনুমান বানরসেনা কে ডেকে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। প্রথমে তারা সমুদ্রের উপর একটি সেতু নির্মাণ করবে। তারপরে তারা জল পেরিয়ে সেই দেশে চলে যাবে যেখানে সীতা কে বন্দী করা হয়েছিল। তার অপহরণকারী রাবণের সঙ্গে লড়াই করে তাকে নিরাপদে বাড়িতে নিয়ে আসবে।
নাচের মাধ্যমে সব দেখাতে থাকল তারা। বানরের পোশাকে মানুষই ভারী পাথর তুলে সমুদ্রের উপর ফেলতে লাগল।
কিন্তু কিছুতেই যেন সেই সেতু তৈরীর কাজ আর শেষ হয় না। বানর সেনা পাথর তুলেই চলে। তুলতেই থাকে। সেতু বাঁধা আর কিছুতেই হয় না।
সমুদ্রের মধ্যে জলকন্যারা নীচ থেকে পাথর তুলে ওপরে দিচ্ছিল বানরদের। পাথর তুলতে তুলতে বানর সেনারাই দেখতে পেয়েছিল সেইসব পরীর মত মারমেইডদের। সাহায্য করছিল তারা সেতুবন্ধনে।
বানরগুলো মারমেইডদের এদিক ওদিক সাঁতার কেটে সমুদ্রের মধ্যেই ধরার চেষ্টা করে। জলকন্যাদের নেত্রী সোভান মাচা।
দেখেছিস আমাদের রামায়ণে এই মারমেইডদের গল্প নেই। টুপুর মায়ের কথায় মাথা নাড়ে।
রামায়ণ কী খমের ভাষাতেও আছে নাকি মা? টুপুর বলে।
এমন সুন্দর নৃত্যনাট্য দেখতে দেখতে টুপুরের যখন খুব ঘুম পাচ্ছে তখনই স্টেজে মঞ্চস্থ হবে মণিমেখলা এবং রিয়েম দানবের যুদ্ধ। মা জাগিয়ে রাখলেন টুপুর কে। ওই দ্যাখ এই শো কেন হচ্ছে জানিস? এবার এখানে বৃষ্টি নেই। বারেবারে এই শো কন্ডাক্ট করেই যেন বৃষ্টি আনবে এখানকার লোকজন। মন দিয়ে দেখ।
তুমুল যুদ্ধ হল মণিমেখলার সঙ্গে রিয়েমের।
শো দেখে ফেরার সময় টুপুরের হাতে একজন অপ্সরা মঞ্চ থেকে নেমে এসে একটি ফুল দিল। ওর নাম জিগেস করল। টুপুর তো মহা খুশি। বাবা ছবি নিলেন মেয়ের সঙ্গে সেই অপ্সরা বেশী নৃত্যশিল্পীর।
কী আশ্চর্য ! সেদিন স্মাইল অফ আংকোর দেখে হলের বাইরে আসতেই প্রচণ্ড তর্জন গর্জন করে মেঘ ডেকে উঠল। বৃষ্টির ছিটে ফোঁটা গায় লাগল টুপুরের। কিন্তু অত গর্জালেও তেমন করে বৃষ্টি হলনা। মায়ের হাত শক্ত করে ধরল টুপুর। সেই অপ্সরার দেওয়া ফুলটি অন্য হাতে যত্ন করে ধরে রেখেছিল সে পরম বিশ্বাসে। প্রার্থনা করছিল বৃষ্টির। হোটেলের ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল ছোটো মেয়েটা। মায়ের ব্যাগে মনে করে ঢুকিয়ে রেখেছিল সেই ফুল।
পরের দিন ভোরে উঠে ওদের সিয়েমরিয়েপ শহর থেকে কাম্বোডিয়ার বিখ্যাত টোনলে স্যাপ লেক দেখতে যাবার কথা। সেখানে মোটোরাইজড বোটে চেপে নৌকাবিহার হবে। জায়গাটা খুব নীচু। লেকটি টোনলে স্যাপ নদী ও সবশেষে ভিয়েতনামের মেকং বদ্বীপের সঙ্গে যুক্ত।
বর্ষায় মেকং নদী ফুলে ফেঁপে উঠলে এই লেকের দুকুল ছাপিয়ে বন্যা হয়ে যায়। বন্যার জল সরে গেলেই আশপাশের ধানজমি পলি পড়ে উর্বর হয়ে ওঠে আর ধানচাষ করে মাছেভাতে বেঁচে থাকে এই অঞ্চলের মানুষ। শয়ে শয়ে মত্স্যজীবিদের বাস এইখানে। তারা মাছ ধরে, মাছ শুকিয়ে বিক্রি করে, শহরে তাজা মাছের যোগান দেয়। কিন্তু সেবছর খরার কারণে সেখানকার মানুষজন হাহুতাশ করছে।
সাগরের মত তাবড় সেই লেকের দুপাশে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ঠিক যেন সুন্দরবন। শুধু তফাত একটাই । সুন্দরবনে নোনাজল। সেখানে ফ্রেশ ওয়াটার। বাঘ ছাড়া পাখী, কুমীর, মাছ, সবকিছুই আছে সেখানে।
অঝোরে বৃষ্টি নেমেছিল অবশেষে। টুপুর সেই স্পীড বোটে ভাসমান হয়ে আগের রাতে অপ্সরার দেওয়া ফুলটি ছুঁড়েছিল লেকের জলে। ঠিক তারপরেই কিন্তু বৃষ্টি নেমেছিল। খুব প্রার্থনা করেছিল সে। ছোটো মেয়ের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তবে অপ্সরা মণিমেখলা। সেদিন মণিমেখলা এবং রিয়েমের যুদ্ধটা সচক্ষে দেখে ভরসা হয়েছিল টুপুরের। রেইন ডান্সও হল টুপুরের।
টুপুর টোনলে স্যাপ লেক থেকে ফেরার পথে বলল, বাবা কাম্বোডিয়ার ফোকলোর তবে কেবল মিথ নয়, কী বল?
(কাম্বোডিয়ার পুরাণকথায় বোনা গল্পটি লেখকের মৌলিক ভাবনায়)
গ্রাফিকঃ পিক্সাবে