২০১১ ভারতের খেলাধূলার জগতে এক নতুন অধ্যায় রচনা করল । তথাকথিত স্পোর্টসের পাশাপাশি এবছর উত্তরপ্রদেশের নয়ডায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ফর্মুলা ওয়ান গাড়ির রেস । মনে হয় ভারতের মাটিতে যে স্পোর্টসের সূচনা হল এবার আগামী বছরগুলিতে এর উন্মাদনা অব্যাহত থাকতে বাধ্য । এখন নাকি ফুটবলের মাঠে ভীড় হয়না মোটে, ক্রিকেটের প্রচুর অবিক্রীত টিকিট পড়ে থাকে । কিন্তু ঐ তিনদিন অর্থাত ২৮শে অক্টোবর থেকে ৩০শে অক্টোবর নয়ডায় জেকে গ্রীণ স্পোর্টস সিটিতে একলাখেরো বেশি উপচে পড়া মানুষের ভীড় দেখে সে কথা মনে হল না।
"বুক মাই শো" তে অনলাইন টিকিট কাটার পর টানটান উত্তেজনায় ছিলাম ক'টা মাস । অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান হল । সারাদেশ জুড়ে একদিকে জ্বলছে দীপাণ্বিতার আলোকমালা আর নয়ডার 'জেপি গ্রীণ স্পোর্টস সিটি' তে তখন সাজোসাজো রব, ইনঅগুরাল ফর্মুলা ওয়ান গ্রাঁ প্রি' র। বাতাসে হিমের ছোঁয়া নিয়ে ঊণতিরিশ এবং তিরিশে অক্টোবর হাজির হয়েছিলাম আমরা সেই বুদ্ধ ইন্টারন্যাশানাল সার্কিটে । কিছুদূর গাড়ি করে যাবার পর শাটলবাস আমাদের নিয়ে গেল স্টেডিয়ামে । নিজেদের টিকিট অনুযায়ী নির্ধারিত জায়গায় বসে পড়লাম । প্রথমে ছিল বেশ কিছু প্র্যাকটিস সেশন এবং ফর্মুলা ওয়ান গাড়ি ছাড়া অন্যান্য গাড়ির প্রথাগত রেস। ৩০ তারিখে ফাইনাল রেসের ঠিক আগে হেলিকপ্টার আকাশ থেকে বারবার এসে ট্র্যাক পরিদর্শন এবং ছবি তুলতে লাগল । তারপর শুরু হল একে একে ড্রাইভারস প্যারেড । একটি করে ভিন্টেজ কারে এক একজন ড্রাইভার একে একে হাত নেড়ে রাজকীয় কায়দায় ট্র্যাক পরিক্রমা করে চলে গেলেন । তারপর সেফটি কার এসে বারে বারে ট্র্যাকের নিরাপত্তা পরিদর্শন করে গেল । তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ।
অবশেষে 'দিন আগত ঐ, ভারত তবু কই?' হ্যাঁ, ছিলেন আমাদের শিবরাত্তিরের সলতে নারায়ণ কার্তিকেয়ণ আর ফোর্স ইন্ডিয়া টিমে ছিলেন চালক সুটিল ।
খেলার মাঠে কারো লক্ষ্য বলের গতিতে কারো কবজির জোর টেনিস র্যাকেট এ, কারো আনন্দ পায়ে বল মারাতে । কেউ চলে জলের স্রোতে সাঁতারাতে , কেউ ঘোড়ায় চড়ে পোলো খেলায়, কেউ দাবার চালে, কেউ ধনুর্বিদ্যায়। কারো আবার আনন্দ এবং লক্ষ্য দুইই গতিতে এবং গতির আনন্দে । এবার আলোচনা করা যাক ফর্মুলা ওয়ান কি এবং কেন এই সম্বন্ধে ।
ফ্রান্সের সংস্থা "ফেডারেশান ইন্টারন্যাশানাল ডি লা অটোমোবাইল" (FIA) এই বিশেষ রেসের জন্য গাড়িগুলির জন্য যে আকার, আকৃতি এবং গঠনের ফর্মুলা নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই অনুসারে "ফর্মুলা ওয়ান" গাড়ি তৈরী হয় । এই ফর্মুলাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
-গাড়ির মাঝখানে ইঞ্জিন থাকতে হবে,
-উন্মুক্ত ককপিট থাকবে,
-একটিমাত্র সিট থাকবে,
-উইং থাকবে সামনে ও পেছনে ,
-গাড়ির চালক সহ গাড়ির ওজন হতে হবে মাত্র ৬৫০কেজি
-গাড়িটি যেন ঘন্টায় শূন্য থেকে ১৬০কিমি যেতে পারে ও ৫ সেকেন্ডের কম সময় যেন ঐ স্পীড কমে আবার যেন নেমে আসতে পারে
এই স্পেসিফিক ফর্মুলায় তৈরী গাড়িকেই বলে ফর্মুলা ওয়ান গাড়ি । GP Motor Sports অর্থাত Glitz & Glory, Power & Precision, Man & Machine, Speed & Style এই চারটির সমন্বয়ে তৈরী হয় ফর্মুলা ওয়ান । এখানে গাড়ী এবং তার চালক হল প্রধান । গাড়ী শুধু জোরেই যায় না কিন্তু অসাধারণ কায়দা এবং কৌশলের বৈচিত্র্যে ভরা এই স্পোর্টস । বারটি টিমের চব্বিশটি ড্রাইভার সহ চব্বিশটি গাড়ি যেন প্রত্যেকটি এক একটি আইকনিক অবতার। গতিশীলতা যাদের শিরায় শিরায়, হৃত্স্পন্দনে সুস্থিরতা । গাড়ীর ইঞ্জিনের গর্জন যত বেশি গাড়ির চালকদের হৃত্স্পন্দন বা পাল্স রেট ততই ক্ষীণ । গাড়ির গতির ওঠানামায় ড্রাইভারদের উত্তেজনার পারদকে কঠিন নিয়ন্ত্রণে রেখে অসাধারণ নৈপুণ্যে বিদ্যুত্গতির গাড়িগুলিকে অত্যন্ত জটিল পথ এবং পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে প্রতিঘন্টায় সর্বোচ্চ ৩০০ কিমি বেগে সবশুদ্ধ ৩০০কিমি পথ অতিক্রম করতে হয় । গাড়ি যে থামে না এমন নয় । এক অবিশ্বাস্য আট সেকেন্ডের মধ্যে গাড়িকে থামিয়ে চারটি চাকা বদল করে এবং ট্যাঙ্কে জ্বালানী ভরে নিয়ে ধনুক থেকে তীরের মত ছিটকে বেরিয়ে পড়ে সেই গাড়ি আবার ট্র্যাকে গতিপ্রাপ্ত হয়ে । এ ওকে অতিক্রম করতে গিয়ে ঠোকাঠুকি লাগে এবং অনেক সময় গাড়ি ট্র্যাক থেকে বেরিয়ে যায় । দুর্ভাগ্যবশত কখনো কখনো দুর্ঘটনার মুখে পড়ে গাড়ি ও তার চালক । হতাহত হয় চালক । দর্শক আহত হবার নজির ও আছে এই রেসে যখন গাড়ি লাফিয়ে এসে দর্শকাসনে পড়েছে । তাই বিশাল ফেন্সিংয়ের ব্যব্স্থা থাকে এখন । কিন্তু এ সবকে তুচ্ছজ্ঞান করে ড্রাইভার্, মেকানিক ও দর্শকরা এই অসাধারণ উন্মাদনায় মেতে ওঠেন কারণ ফর্মুলা ওয়ান একটি ক্রীড়া নয় এটি একটি জীবনধারার প্রতীক । যারা এই উন্মাদনায় মাতেন তারা অনেকেই ভাবেন যে তাদের ধমনীতে রক্ত নয় যেন পেট্রোলের তরঙ্গ বয়ে চলেছে এবং হৃত্পিণ্ডের বদলে ৬ সিলিন্ডার ও ৩ লিটারের V-6ইঞ্জিন তাদের বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে । আর চব্বিশটি গাড়ি যেন উচ্চৈঃস্বরে ছুটতে ছুটতে গিয়ে বলে আমাকে বাঁচতে দাও; তারস্বরে গগনভেদী চিত্কারে বলে ওঠে আমাকে আগে যেতে হবে, আমাকে শিখরে পৌঁছতে হবে কিম্বা হাম হোঙ্গে কামৈয়াব ।
গতির ছন্দে মেতে উঠে গতির দুনিয়ায় পা রেখেছেন ভারতের নারায়ণ কার্তিকেয়ণ; ফর্মুলা ওয়ান রেস করেছেন ভারতের বাইরে । ভারতীয় মালিকানায় ফর্মুলা ওয়ান টিম ফোর্স ওয়ান আগে ছিল বিজয় মাল্যর । অধুনা সেটি যৌথ ভাবে বিজয় মাল্য এবং সাহারার মালিকানায় । কিন্তু ভারতের মাটিতে ফর্মুলা ওয়ান টিম পা রাখল এই বছর অর্থাত ২০১১ র অক্টোবরে । ২০১১ সালের ১৭তম রেসটি হল ভারতের মাটিতে, উত্তরপ্রদেশের গ্রেটার নয়ডায়। নয়ডার বুদ্ধ ইন্টার ন্যাশানাল সার্কিটে ২৮, ২৯ ও ৩০ শে অক্টোবর ফর্মুলা ওয়ান রেস হল । এবছর এই টিমে সবশুদ্ধ বারোটি দলের চব্বিশটি গাড়ির চব্বিশজন ড্রাইভার যথার্থই কাঁপিয়েছেন ভারতবর্ষের মাটি । প্রত্যেক টিমে দু'জন ড্রাইভার থাকেন ।
এবার ছিলেন
- রেডবুল টিমের সেবেষ্টিয়ান ভেটেল এবং ওয়েভার,
- ভোডাফোন ম্যাকল্যারেন মার্সিডিজের হ্যামিল্টন ও জেনসন বাটন্,
- মার্সিডিজ জিপির মাইকেল স্যুমাকার ও নিকো রসবার্গ,
- স্কুডেরিয়া ফেরারির ফেলিপ মাসা ও ফার্ণান্ডো এলোনসো
- ফোরস ইন্ডিয়ার পল ডিরেষ্টা ও এড্রিয়ান সুটিল,
- রেনোর নিক হাইডফেল্ড ও ভিটালি পেট্রোভ,
- লোটাস রেনোর হাইকি কোভালাইনন ও ইয়ারনো ট্রুলি
- উইলিয়াম কসওয়ার্থ টিমের রুবেন্স ব্যারিচেলো ও প্যাষ্টার মালডোনাডো
- এইচ আরটি কসওয়ার্থ টিমের নারায়ণ কার্তিকেয়ণ ও ভিট্যান্টোনিও ল্যুইজি
- ভার্জিন কসওয়ার্থ এর টিমো গ্লক ও জেরোম ডি এমব্রোজিও ,
- সবার ফেরারি টিমের কামুই কোবায়াশি ও সার্জিও পেরেজ এবং
- দ্বাদশ ও শেষ টিম টোরো রোসো ফেরারির সেব্যাস্টিয়ান বুয়েমি ও জেইম এলগ্যুয়ার সুয়ারি ।
পৃথিবীতে ১৯৫০ থেকে ফর্মালি সব নিয়ম কানন মেনে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফর্মুলা ওয়ান রেস হচ্ছে । সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ও সফিষ্টিকেটেড স্পোর্টস হল ফর্মুলা ওয়ান । ব্যয়সাপেক্ষও বটে। উন্নতমানের প্রযুক্তি এবংবিশেষ কৌশলে তৈরী হয় এই ফর্মুলা ওয়ান গাড়িগুলি । বর্তমান যুগের গাড়িগুলি ৮সিলিন্ডারের ইঞ্জিন এবং ৩০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন । সবমিলিয়ে টিম ফর্মুলাওয়ানের কোঅর্ডিনেশন দেখবার মত । গাড়ির সাথে ড্রাইভারের , তার সাথে পিটক্রুদের সহযোগিতা, সেফটি কারের পথ প্রদর্শন বা ইয়ালো ফ্ল্যাগ দেখেই গাড়ি থামিয়ে রেস বন্ধ করে দেওয়া এও দেখার । এই ফর্ম্যুলা কারের চাকা এবং ইঞ্জিনই হল গাড়ির আসল জিনিস । চাকার লজিষ্টিকস এর অবদান এই রেসে অন্যতম । ভিজে মাটির জন্য একরকম চাকা এবং শুকনো মাটির জন্য আরেকরকম চাকা বরাদ্দ থাকে । আবার কোন চাকা কতক্ষণ রেস করার পর কত দ্রুত তাকে বদলাতে হবে তাও ভাবতে হয় । আর অবিশ্বাস্য হল গাড়ির চালকরা ।
- এদের রক্তচাপ খুব কম হয় ।
- নাড়ির বেগ বা পালস রেট হতে হবে অত্যন্ত কম ।
- শরীরের ওজন হতে হবে অনূর্দ্ধ ৭০ কেজি ।
- আর চশমা থাকলে নৈব নৈব চ ।
দুর্দান্ত রেসিং ট্র্যাকটি তৈরী হয়েছিল । পুরো ট্র্যাকটি হল একটি ল্যাপ যার দৈর্ঘ্য হল ৫.১৪ কিমি । এবার ফাইনাল রেসের দিন অর্থাত ৩০শে অক্টোবর দুঘন্টায় বারোটি টিমের চব্বিশটি গাড়ি ৬০বার ঐ ট্র্যাক প্রদক্ষিণ করল । তার আগে ২৮ ও ২৯ তারিখে প্র্যাকটিস রেস বা কোয়ালিফাইং হল ।
পর পর গগনভেদী চিত্কারে গাড়ীগুলি পিট থেকে বেরিয়ে মেইন ট্র্যাক ধরে চলতে শুরু করল । এভাবে ৬০ বার পরিক্রমা চলতে লাগল ঘন্টা দুই ধরে । কি চরম উত্তেজনার সামিল আমরা তখন ! কখনো দুটি গাড়ি একে অপরকে ছুঁই ছুঁই, কখনো অবলীলায় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই হুস করে সামনে দিয়ে চলে গেল । বুদ্ধ সার্কিটে ফর্মুলার ওয়ানের আসরে আকাশ বাতাস তখন গাড়ির শব্দে মুখর । কানে ইয়ার প্লাগ তবুও কাজ হলনা । পাশের লোকের কথাও শোনা যায় না সেই আওয়াজে । গতির লড়াইয়ে ২৪জন চালক তখন একে অপরকে টেক্কা দিতে ব্যস্ত । আমরাও গতির রোমাঞ্চে রোমাঞ্চিত । কি হয় কি হয় ! আমাদের ট্র্যাকের সামনে দুবার অঘটন ঘটেছিল যা অবিশ্যি কিছুই নয় । কিন্তু চোখের সামনে দেখে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম আমরা । ফিলিপ মাসা এবং লুইস হ্যামিলটন একে অপরকে ওভারটেক করতে গিয়ে চাকায় চাকায় স্পর্শ করে; স্পিন খেয়ে মাসার গাড়ি ট্র্যাকের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে আবার সে সাবলীল গতিতে ঢুকে এসেছিল ঠিকমত, যেন কিছুই হয়নি এই ভাবে । দুঘন্টা পর দেখা গেল সেবেস্টিয়ান ভেটেলই এগিয়ে রয়েছে সকলের চেয়ে । ৬০ ল্যাপের পর সেবেষ্টিয়ান ভেটেলকেই চাম্পিয়ান ঘোষণা করা হল । সামনে বিশাল টিভির স্ক্রিনে শচীন তেন্ডুলকারের চেকার্ড ফ্ল্যাগ নাড়া দেখে বুঝলাম খেলা শেষ ।
লেখা ও ছবিঃ
ইন্দিরা মুখার্জি
ভবানীপুর, কলকাতা