খেলাঘরখেলাঘর

শীতের গপ্পো

আবার তো জাঁকিয়ে পড়লো শীত । কেমন মজা করছো ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুরা ? ছোটবেলায় শীতই ছিল আমার ফেভারিট ঋতু । নভেম্বর আসতেই হাড় কাঁপানো উত্তুরে হাওয়া, ছুটির দিনে দুপুরবেলায় জম্পেশ ভুরিভোজের পর জানলার ধারে একচিলতে রোদ্দুরে পা ছড়িয়ে দিয়ে সুর্যিমামার গরম ওম নেওয়া এর মজাই আলাদা! রবিবার আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্স-এর চত্বরে সকাল থেকেই আসে একে একে ফেরিওয়ালা ।শীতের রবিবার তার সঙ্গে যোগ দেয় জয়নগরের মোয়া, নলেনগুড়ের পাটালি - ও:, ভাবতেই জিভে জল! আর শুরু হত ক্রিকেটের মরশুম । তখনো এমন বারোমেসে ক্রিকেটের রমরমা হয়নি কিনা! তাই শীতে টিভিতে ক্রিকেট দেখা আর গলিতে ইঁটের উইকেট পেতে রবারের বল পেটানো ছিল শীতের স্পেশালিটি! আর ব্যাডমিন্টন তো ছিলই ।বড় দাদারা আবার নেট, লাইট লাগিয়ে হিম পড়া রাত্তিরে খেলত ।যতদূর মনে পড়ছে- ক্লাস থ্রী কি ফোর অবধি আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা হত ডিসেম্বরে।জানুয়ারি থেকে নতুন ক্লাস । তাই বড়দিনের ছুটির আট-দশদিন ছিল আমাদের কাছে বছরের সেরা ছুটি ।গরমের বা পুজোর ছুটি লম্বা হলে কি হবে, হোমটাস্ক, পড়া, স্কুল খুললেই পরীক্ষা ইত্যাদি নানান ভীতি ! আর বড়দিনের ছুটি মানে নিখাদ মজা ।

অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হলেই কু-ঝিকঝিক রেলের গাড়ি চেপে (সত্যিকারের কয়লার স্টীম ইঞ্জিন!) গ্রামের বাড়ি যাওয়া । আর গ্রামেগঞ্জের শীত মানে জানো তো - কলকাতার দুদিনের সৌখীন শীত তার কাছে নস্যি । সুর্যিমামা ডুব দেওয়ার সাথে সাথেই যেন কালো চাদর মুড়ি দিয়ে চুপিচুপি নেমে আসতো শীতবুড়ি । সন্ধে হতেই মা, কাকিমা, ঠাকুমা, খুড়তুতো - জ্যাঠতুতো ভাইবোনেদের নিয়ে রান্নাঘর হাউসফুল ।গরম গরম চা, মাটির উনুনে কয়লার আঁচে সেঁকা ফুলকো রুটি কিংবা খাঁটি সর্ষের তেল মাখা বাটিভর্তি ঘরে ভাজা মুড়ির সাথে চলতো জমাটি গপ্পো । তোমরা কি কেউ কয়লার বা কাঠের আঁচের উনুন দেখেছ ? হযতো সত্যিই কিছুদিন পর মিউজিয়ামে গিয়ে দেখা মিলবে এ সবের ।অথচ মাত্র দশ-বিশ বছর আগের কথা! যাইহোক, সেই উনুনের কাছাকাছি বসে আগুন পোহানোর মজা কম ছিল না । গ্রামেগঞ্জে লোডশেডিং-এর কোনো সমস্যা ছিল না তখন - কারণ বিজলিবাতিই আসে নি সেখানে । কেরোসিনের লম্ফ আর হ্যারিকেনের আলোয় চলতো সান্ধ্য আড্ডা ।আর দেয়ালে নিজেদেরই লম্বা লম্বা ছায়া দেখে ভয়ে ছোটোরা কেউ অন্ধকারে উঠে একা বাইরে যেতে চাইতাম না ।

নলেন গুড়ের সন্দেশ নিশ্চয় খেয়েছ তোমরা ? কিন্তু খেজুর গাছের রস জমানোর জন্য যে হাঁড়ি বাঁধা হয়, তা থেকে রস চুরি করে খাওয়ার মজা তো পাও নি! এক বিচ্ছু খুড়তুতো ভাই-এর সঙ্গে সন্ধে নাগাদ গিয়ে   সেই অ্যাডভেঞ্চারও করেছি একবার । ধরা পড়লে অবশ্য মজাটা আর কেউ পেত! তবে সারা রাত রস জমার পর সকালে যখন জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর জন্য হাঁড়ি নামানো হয়, গেলাস ভর্তি সেই টাটকা রসে পাটকাঠির স্ট্র ডুবিয়ে খাওযার আনন্দ কোল্ড ড্রিংকে পাবে না ।

ছোটবেলার আর একটা মজার স্মৃতি মনে আছে এই শীতকালের ।গ্রামের বাড়িতে চড়ুইভাতি । বাড়ির সকলে মিলে হৈ হৈ করে আমাদের আমবাগানে যাওয়া হয়েছিল বনভোজন করতে । মাটি কেটে উনুন তৈরি হল ।ঘর থেকে সবাই চাল, ডাল, মশলাপাতি,আলু এসব নিয়ে যাওয়া হল । আমবাগানের পাশেই আমাদের বেগুনের ক্ষেত থেকে পটাপট বেগুন তোলা হল - বেগুনি ভাজা খাওয়ার জন্য । সারা দুপুর চলল খুব হৈ হল্লা । ঘরে ফেরার পথে কেমন যেন বেশি করে শীত শীত করতে লাগল । তারপর এল কাঁপুনি দিয়ে জ্বর - আর সাথে সাথে মোটা মোটা লেপের তলায় চাপা পড়লাম! এর পর বিচ্ছিরি সব ওষুধ আর ইঞ্জেকসনের ছূঁচ - স্মৃতি তেমন আর মধুর নয় !!

জ্যোতির্ময় দালালের জন্ম ও পড়াশোনা কলকাতায়। ২০০৯ সাল থেকে আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশে কলেজ ষ্টেশন শহরে 'টেক্সাস এ এন্ড এম' বিশ্ববিদ্যালয়ে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডক্টরেট-এর ছাত্র। এর আগে আই আই টি খড়্গপুর থেকে এম টেক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি ই ডিগ্রী লাভ। আই টি ইণ্ডাস্ট্রিতে বছর চারেক কোডিং করে করে তিতিবিরক্ত হয়ে সেক্টর ফাইভকে দুচ্ছাই বলে পি এইচ ডি করতে পলায়ন। লেখালিখি ছাড়া শখ ভ্রমণ ও ফোটোগ্রাফি চর্চা ।