সারা পৃথিবীতে ২০১১ এর এগারোই নভেম্বর দিনটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন অনেক মানুষ – কারনটা সহজ,এমন তারিখ তো আর বারবার আসে না, প্রত্যেকেই তার জীবনের কিছু স্মরনীয় মুহুর্ত পালন করতে চাইছিলেন এই দিনটাতে । মজার ব্যাপারটা হচ্ছে দুনিয়ার কচি কাঁচারাও এই দিনটার দিকে তাকিয়ে ছিল বিশেষ কারনে – টিনটিন আসছে যে বড় পর্দায়, তাও আবার ত্রিমাত্রিক ছবিতে অর্থাৎ টিনটিন কেবল সিনেমার পর্দায় ঘুরে বেড়াবে না, তাকে চলতে ফিরতে দেখা যাবে একেবারে সামনে থেকে – যেন জলজ্যান্ত টিনটিন গপ্পের বই থেকে এসে গেছে নাকের ডগায়। আবার টিনটিন যে শুধু খুদে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় এমন তো নয়, আজকের দিনে বৃদ্ধরাও তাঁদের শৈশবে টিনটিনকে নিয়ে মাতামাতি করেছেন। তার ওপরে এই সিনেমা তৈরী করেছেন স্টিভেন স্পিলবার্গের মত বিশ্বপ্রসিদ্ধ পরিচালক। কাজেই তিনি যখন টিনটিনের মত ঐতিহাসিক কার্টুন চরিত্র নিয়ে সিনেমা করছেন আর সে সিনেমা যখন মোশন ক্যাপচার টেকনোলজি দিয়ে তৈরী (অর্থাৎ অভিনেতাদের দিয়ে ছবির শুটিং করে তা ডিজিটাল মডেলের মধ্যে রূপান্তরিত করা), তখন সে সিনেমার ওপর প্রত্যাশা যে আর পাঁচটা অ্যানিমেশন ফিল্মের চেয়ে অনেক বেড়ে আকাশছোঁয়া হয়ে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ ছিল না।
গল্পটা একটু দেখা যাক। টিনটিন একদিন বাজারে ঘুরতে ঘুরতে কিনে ফেলে সপ্তদশ শতাব্দীর একটি জাহাজের মডেল, যার নাম ছিল ইউনিকর্ন। শাখারিন নামের এক ভদ্রলোক টিনটিনের কাছ থেকে জাহাজটি কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু টিনটিন রাজী না হওয়ার পর আকস্মিকভাবে সেটি চুরি যায়। এদিকে শহরে এক পকেটমারের উপদ্রবে সকলে অস্থির হয়ে উঠলে যমজ গোয়েন্দা জনসন আর রনসন তদন্তে নামে। এর মধ্যে টিনটিন বন্দী হয় কারাবুজান নামের একটি জাহাজে – যেখানে জাহাজের ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড হ্যাডককে নেশাগ্রস্ত করে রেখে শাখারিন ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা এক গভীর ষড়যন্ত্র করছেন। টিনটিনের আলাপ হয় ক্যাপ্টেন হ্যাডকের সাথে এবং সে পালায়। এরপর আস্তে আস্তে রহস্যের জাল একটু একটু করে পরিষ্কার হতে থাকে। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের পূর্বপুরুষ স্যার ফ্রান্সিস হ্যাডক ইউনিকর্ন নামের একটি জাহাজে করে অতুল বৈভব নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করার সময় রেড র্যাকহ্যাম নামের এক কুখ্যাত জলদস্যুর দ্বারা আক্রান্ত হন। জলদস্যুরা প্রতারনা করে জাহাজের সম্পদ দখল করার চেষ্টা করলে তিনি জাহাজে বিস্ফোরন ঘটিয়ে সেটিকে ডুবিয়ে দেন, তলোয়ারের লড়াইয়ে মেরে ফেলেন রেড র্যাকহ্যামকে। তিনি সেই অভাবনীয় সম্পদের কিছু অংশ সামলাতে পেরেছিলেন, এবং সেটাই গুপ্তধনের আকারে রেখে গেছেন আর সেই গুপ্তধনের সঙ্কেত লুকিয়ে রেখে গেছেন তিনটি ইউনিকর্ন জাহাজের মডেলের মাস্তুলে। অবশেষে টিনটিনের সাহস আর উপস্থিত বুদ্ধির কাছে হার মানে শাখারিন, আর ক্যাপ্টেন হ্যাডক পেয়ে যান তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গুপ্তধন।
গল্পটা ঠিক অক্ষরে অক্ষরে সিক্রেটস অফ ইউনিকর্ন বইয়ের মত নয় তবে অনেকেরই জানা – কারন তিনটি আলাদা গল্পের কিছু কিছু অংশ জুড়ে তৈরী হয়েছে সিনেমার গল্প। বই না পড়ে সিনেমা দেখলে ক্ষতি নেই, কিন্তু যারা কিনা টিনটিনের বইয়ের পোকা তারা তো মেলাতে যাবেই প্রতিটি চরিত্র, তাদের খুঁটিনাটি, তাদের মুখের বুলি, পোষাক সবকিছু - আর সেখানেই স্পিলবার্গের টিনটিন কোথাও যেন হার্জের টিনটিনের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। ক্যাপ্টেন হ্যাডক যেন সেই ক্যাপ্টেন হ্যাডক নন যিনি চেঁচিয়ে উঠবেন বস্তাপচা গেঁড়ি গুগলির ঝাঁক বলে। যে জনসন রনসনকে আমরা চিনি, সিনেমার পর্দায় তাঁরা একটু অন্যরকম। টিনটিন অনেকটা নিখুঁত হলেও, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে টিনটিনের গল্পের মূল আকর্ষন কিন্তু কেবল সে নিজে নয় - অনেকটাই দাঁড় করিয়েছেন পার্শ্বচরিত্ররা। আর সেখানেই যেন একটু অতৃপ্তির স্বাদ থেকে গেল। তবে সিনেমাটি নিজের জায়গায় স্বতন্ত্র। আর সত্যজিত রায়ও গুপি বাঘার সিনেমা গল্প মেনে করেননি। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে তাকে বদলেছেন নিজের মত। কাজের কথা এইটাই যে স্পিলবার্গ আরো দুটি টিনটিনের সিনেমা নিয়ে চুক্তিবদ্ধ, বইয়ের পাতায় যে টিনটিনকে দেখেছি তাকে পর্দায় আরো বেশি করে পাওয়া যাবে এটা কে না চাইবে। তাই না?
অভ্র পাল
কলকাতা
ছবিঃ উইকিপিডিয়া