খেলাঘরখেলাঘর

ম্যাজিক
 ১

রবিবারের সকাল। আজ ইস্কুল নেই। পড়া নেই। তবু রবিবারের সকালটাই তাতানের সবচেয়ে অপছন্দ। ঠিক নটা থেকে তার আঁকার ক্লাস। আঁকার মাস্টারমশাই জগদীশ খুব গম্ভীর আর রাগী মানুষ। একটুও হাসেন না। সবাইকে আঁকার ক্লাসে গিয়ে রোজ একটা কিছু দেওয়া হয়। আঁকতে তাতানের একটুও যে ইচ্ছে করে না এমন নয়। কিন্তু আজ অবধি তার একটা ছবিও ভাল হয়নি। একটা লাইনও সে সোজা করে টানতে পারেনি। একটা গোল জিনিসও গোল হয়নি, তা সেটা পেঁপেই হোক আর কুমড়োই হোক। রোজ সে কোন একটা গোলমাল করেই, আর শেষমেষ মাস্টারমশাই একটু ঠিকঠাক করে দেন। ওখানে সবাই ওর চেয়ে ভাল আঁকে। বড়রা তো বটেই, এমনকি ওর সমবয়সী বা ছোটরাও। তাই এই ইস্কুলে যেতে তার একেবারেই ভাল লাগে না। তবু যেতেই হবে। রবিবারে শরীরও খারাপ হয় না একদিন।

সকালে আটটার সময় তাতান শুনতে পেল যে মা তাকে ডাকছে। তখনও সে ইচ্ছে করেই সাড়া দিল না। শুয়ে শুয়েই কালো রঙের বড় দেওয়াল ঘড়িটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আঁকার ক্লাস তো বলতে গেলে পাশের বাড়িতেই । ওদের পাড়াতেই গুবলুদের বাড়িতে মাস্টারমশাই আসেন। একদল ছেলেমেয়ে চারদিকে সতরঞ্চি বিছিয়ে বসে। মাস্টারমশাই দুকাপ চা খান। বড়রা কেউ না কেউ এসে গল্প করে। তারপর সবার আঁকার খাতা দেখে নেন এক এক করে। দু আড়াই ঘন্টা এইভাবেই কেটে যায়। বিছানার পাশের জানালাটা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল তাতান। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন। পিঠে রোদ্দুর। ঝকঝক করছে একটা সকাল। তাতান বিছানার ওপরে সোজা উঠেও লেপটা জড়িয়ে বসে রইল। রোজ সকালে পাঁচটার সময় উঠতে হয় ইস্কুলে যাওয়ার জন্য। এমনকি শনিবারেও। পিন্টুদের তো কি সুন্দর শনিবারে হাফছুটি হয়। ওদের হয়না। সপ্তাহে রোজ ইস্কুল করে রবিবারে যে একটু ছুটি পাবে তা হওয়ার জো নেই।
বাবার গম্ভীর গলা শোনা গেল, ‘তাতান উঠে পড়ো এবার। মা আর কতক্ষন ধরে ডাকবে তোমায়।’
এবার না উঠে উপায় নেই। তাও সে একটু করুন সুরে আবদার করল, ‘বাবা, আজকে আঁকার ইস্কুলে না গেলে হবে? একদম ইচ্ছে করছে না।’
‘কেন? সে তো তোমার প্রত্যেক সপ্তাহেই ইচ্ছে করে না।’
‘মাস্টারমশাইকে খুব রাগী মনে হয় যে’
‘তোমার মাস্টারমশাইকে আমি চিনি। খুব ভাল লোক আর মোটেও রাগী নয়।’
আসল কারনটা যে বাবাকে বলা যাবে না। তার ওপর সকাল সাড়ে নটা থেকে টিভিতে মিকি মাউস আছে। কালেভদ্রে একবার ঐ কার্টুনটা দেখা হয়। মামার বাড়ী গেলে বা আঁকার ইস্কুল ছুটি থাকলে। প্রত্যেক রবিবার সকালে আঁকার ক্লাসে বসে ঐ কথাটাই বারবার মনে পড়ে তাতানের। আজও সেই দুঃখের কথা ভেবেই পা দিল মাটিতে। লাল রঙের মেঝেটাও বেশ কনকনে ঠান্ডা। সেই ঠান্ডা তাতানের হাফপ্যান্টের বাইরের পা দুটোকে কাঁপিয়ে দিল। 

     

কদিন আগে বায়না করে একটা টিয়াপাখি কিনেছে তাতান। সেটা রাখা থাকে বারান্দায়। বাড়ির বাইরের বারান্দা নয়, ভেতরেই। তাতান পায়ে পায়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘কিরে কিছু শিখেছিস?’
পাখিটা বড় দুষ্টু। সবাই বলত টিয়াপাখি নাকি মানুষের মত কথা বলতে পারে। কিন্তু কোথায় কি? সে কত চেষ্টাই না করেছে। কিন্তু টিয়ার মুখে কোন কথা নেই। সপ্তাহ দুয়েক পরে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল সে। আজকাল রোজ সকালে উঠে সে শুধু জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে টিয়া কিছু শিখেছিস?’ টিয়া কিছুই বলে না। অথচ আজ ওকে অবাক করে দিয়ে  টিয়া বলে উঠল, ‘হয় হয়, হবে হবে হবে।’ মানুষের মত সে আওয়াজ নয়, বরং একটু খনখনে। তবে পরিষ্কার শুনতে পেল তাতান। কোন ভুল নেই তাতে।  
‘হয় হয় আবার কি রে? হবে মানে কি হবে?’ জিজ্ঞেস করার পরেই তাতানের মনে হল এটা একটু বোকা বোকা হয়ে যাচ্ছে। পাখি তো শুনে শুনে শেখে। সে কি আর মানুষের মত কথা বুঝতে পারে? এর পরেও তাকে অবাক করে দিয়ে টিয়া বলল, ‘তোমার হবে’। তাতান হাতে ব্রাশটা নিয়ে একটু সন্দেহের সঙ্গে পাখির দিকে তাকাল।
পাখিটাও মিটিমিটি ওকে দেখছে। তীক্ষ সে চাহনি। তাতান ভয়ে ভয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কি হবে?’ পাখিটা এবার আর জবাব দিল না। নাহ, কিছু একটা ভুল হয়ে থাকবে। আর বোঝার চেষ্টা না করে কোনরকমে চোখে মুখ একটু জল দিয়ে ধুয়ে সে রান্নাঘরে ছুট দিল মার কাছে। লুচিভাজা হচ্ছে আজ। গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
‘কি রে কি করে মুখ ধুয়েছিস তুই? তোর চোখের কোনে যে পিচুটি লেগে রয়েছে এখনো। রোজ এতবার করে বলি, তাও শুনিস না?’
‘মা, জানো পাখিটা না আজকে কথা বলছিল মনে হল...’
‘কোথায় আমরা তো কিছু বলতে শুনি না। তুই খামখা বায়না করে পাখিটা কিনলি।’ বলতে বলতে তিনি তাতানের চোখের কোনদুটো পরিষ্কার করে দিলেন। ‘নে খেয়ে নে, আর দেরী করিস নি। আঁকার ইস্কুলে চলে যা। আজকে থেকে তো আবার তোদের নতুন মাস্টারমশাই আসবেন।’
তাতানের আরেকটু তর্ক করার ইচ্ছে ছিল যে পাখিটা সত্যিই কথা বলেছে কিন্তু মাস্টারমশাই বদলে গেছেন এই খবরটা তো একেবারেই নতুন। সে রীতিমত চমকে গিয়ে বলল, ‘তুমি কি করে জানলে?’  



গুবলুদের বাড়ি পৌঁছে একটু অবাকই হল তাতান। আজ প্রায় অনেকেই আসেনি। আর অনেকটা তার দাদার মত একটা অল্পবয়সী ছেলেকে ঘিয়ে সবাই বসে আছে আর হেসে হেসে গল্প করছে। তাতান ওর মত একটা জায়গায় একটু আলাদা হয়ে বসে কাঁধে ঝোলান ব্যাগ থেকে বোর্ড, রঙ, তুলি, প্যালেট এইসব বের করে রাখল। কে জানে আজকের নতুন মাস্টারমশাই কখন আসবে। আবার কি আঁকতে দেবে। প্রথম দিনেই প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে না তো?
‘তুমি এরকম দূরে দূরে বসে আছো কেন?’ ছেলেটা ওকে ডাকল। তাতান কিছু বলল না। চুপ করে বসে রইল। সবার সামনে বলবেই বা কি করে যে ও ভাল আঁকতে পারে না। কিন্তু ছেলেটাও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সে বলল, ‘আরে, এসই না এখানে। আমরা কি সুন্দর গল্প করছি।’
‘মাস্টারমশাই কখন আসবেন?’ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল তাতান। জগদীশ স্যার তো কোনদিন হেসে কথাই বলতেন না। কেউ হাসাহাসি করলেও রাগ করতেন। আর এ কে যে সব্বার সঙ্গে বসে গল্প করছে?
‘মাস্টারমশাই? ও না, মাস্টারমশাই তো আসবেন না আজকে।’  
‘তাহলে আঁকা শেখাবে কে?’
‘ও তুমি এমনিই শিখে যাবে। কোথাও ভুলটুল হলে আমি না হয় দেখিয়ে দেব এখন।’
তাতান আরো অবাক, ‘ও তুমিই বুঝি আমাদের নতুন মাস্টারমশাই?’ মা বার বার বলে দিয়েছে মাস্টারমশাইকে তুমি করে না বলতে, কিন্তু ছেলেটাকে কিছুতেই আপনি পারছে না সে।
‘না না, আমাকে কিন্তু তোমাদের মাস্টারমশাই বলার দরকার নেই। আমাকে ভুলুদা বলেই ডেকো। এখন থেকে আমরা এখানে রবিবার রবিবার করে সবাই মিলে আঁকব, তোমরাও আঁকবে, আমিও আঁকব। তা তোমার নাম কি?’  
‘আমার ভাল নাম অর্কপ্রভ, আর ডাকনাম তাতান।’
‘বাহ, বেশ সুন্দর নাম। ঠিক আছে। দেখি আজকে কি আঁকা যায়।’ এই বলে সে তার ঝোলা থেকে একটা মোটা খাতা বের করে আনল। সঙ্গে কিছু পেনসিল, আর কয়লার টুকরোর মত কিছু। কিন্তু কোন রঙ নেই। এমনকি একটা প্যাস্টেলও। অবাক হয়েই তাতান জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি রঙ কর না বুঝি?’
‘রঙ, হ্যাঁ করি তো। কিন্তু এটা খালি স্কেচের খাতা। কোথাও গেলে নিয়ে যেতে সুবিধে হয়। আর রঙ লাগলে না হয় তোমাদের কাছ থেকে কিছু নিয়ে নেব, কি দেবে তো?’  হেসে ফেলল সবাই। তাতান বলল, ‘আর আমরা কি আঁকব আজকে?’
‘তোমরা যা খুশি তাই আঁকবে। তুমিই বল না তোমার কি আঁকতে ইচ্ছে করছে?’
সবাই কিছু না কিছু বলল। কেউ বটগাছ, কেউ কলাগাছ, কেউ পাহাড় আঁকতে বসে গেল। বাকী রয়ে গেল শুধু তাতান।  
‘কি তাতান, তুমি কি আঁকবে ঠিক করলে?’
তাতান আমতা আমতা করে বলল, ‘আমাকে বলে না দিলে যে আমি কিছুই আঁকতে পারি না। আর যাই আঁকতে যাই ভুল হয়ে যায়। শেষে মাষ্টারমশাই একটু ঠিক করে দেন।’
‘হুঁ, তোমার তো দেখছি গভীর সমস্যা’। ভুলু গালে হাত দিয়ে খানিক ভাবল। ‘আচ্ছা, তোমার কি মন থেকে কিছুই আঁকতে ইচ্ছে করছে না?’
মাথা নাড়ল তাতান।
ভুলু আরও খানিকক্ষন কি সব ভেবে তাকে বলল, ‘বেশ। তোমাকে কিছু আঁকতে হবে না। আজকে বরং আমার আঁকা দেখ, কেমন? তোমাকে একটা ধাঁধা দিচ্ছি। কোন তাড়া নেই। এক সপ্তাহ ভেবে পরের দিন আমাকে জানিও। একটা জিনিস তুমি জোর করে ধরে বেঁধে রেখেছ। তাই আঁকতে পারছ না। কেমন? যেই সেটা ছেড়ে দেবে, অমনি দেখবে তরতর করে আঁকতে পারছ।’

ম্যাজিক


রবিবার সন্ধ্যায় আড্ডায় বেরোনর সময় প্রনবেশ লক্ষ্য করলেন তাতান ছবি আঁকছে। দৃশ্যটা একটু অদ্ভুত; কারন তিনি কোনদিনই ছেলেকে আগে ছবি আঁকতে দেখেননি। তাঁর ধারনা ছিল তাতান আঁকতে ঠিক পারেনা। ভয় পায়। অথচ আজ সে অবলীলাক্রমে এঁকে চলেছে। একসময় সে ঘাড় ঘুরিয়ে বায়নার সুরে বলল, ‘আসার সময় একটা আঁকার খাতা আনবে বাবা?’


প্রনবেশ হকচকিয়ে বললেন বললেন, ‘হ্যাঁ, আনব। কেন আনব না।’ যে ছেলে আঁকার ইস্কুলে যাওয়ার নামে ভয় পেত তাকে প্রান খুলে আঁকতে দেখে বড় তৃপ্তি পেলেন তিনি।
তাতানের মনে আজ ফূর্তির সীমা নেই। অন্যান্য রবিবারগুলোয় ঘন্টা দুয়েক ক্লাস হলেই উঠি উঠি করত মনটা। আজকে বাড়ি ঢুকে দেওয়াল ঘড়িটায় দেখল সাড়ে বারটা বেজে গেছে। ভুলুদা যেন ম্যাজিক জানে। ওরা সবাই যা বলছে তাই এঁকে দিচ্ছিল। নাহ, আঁকাটা শিখতেই হবে। এই ভেবে মহানন্দে তাতান স্নান করতে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে মাথায় খেলছিল ধাঁধাটাও।  

বারান্দায় টিয়াপাখিটা বসে বসে ছোলা খাচ্ছিল। অন্য সময় হলে হয়তো তাতান ওকে কিছু বলত। আজকে আর সেদিকে হুঁশ নেই। কিন্তু মাথায় একমগ ঠান্ডা জল ঢালার সাথে সাথেই যেন পট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আরে, তাই তো। হ্যাঁ, এটাই তো। নিশ্চয়ই। হতেই হবে। কোন রকমে গায়ের জল মুছে ছুটতে ছুটতে হাজির হল পাখির খাঁচার কাছে। আর চুপিচুপি একটা টুলে উঠে খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, ‘পালা।’ ব্যস আর পায় কে, পাখিও ফুড়ুত হাওয়া। তারপর থেকে পরপর আটখানা ছবি এঁকে ফেলেছে তাতান। আজ আর তাকে পায় কে।  


    
 
অভ্র পাল
কারডিফ, ওয়েলস, যুক্ত্ররাষ্ট্র