নিনির সংসার
এক দেশে এক সুন্দর ছোট্ট মেয়ে থাকে । ফুলের মতো সুন্দর মেয়ে । মা আদর করে ডাকেন, ‘নিনি’।
মা, বাবা আর নিনি । ছোট্ট সংসার । বাবা সারাদিন কারখানায় কাজ নিয়ে ব্যস্ত, বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় । মাও সারাদিন অফিসে ব্যস্ত । দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে রোজ কান্না পায় নিনির । একা একা খাওয়া, টিভি দেখা, হোমওয়ার্ক করা, ছবি আঁকা, বই পড়া । ভালো লাগে নাকি ? খুব কান্না পায় । একা একা ভয়ও করে । যেদিন ঝড়বৃষ্টি হয়, সেদিনগুলোয় তো খুব ভয় করে নিনির । মা ঠিক বুঝতে পারে । বৃষ্টি পড়লেই মা তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসে তাই ।
এমনি দিনেও বিকেলে বাড়ি ফিরেই মা নিনিকে কোলে করে আদর করবে রোজ, চোখের জল মুছিয়ে দেবে, নিজে হাতে খাইয়ে দেবে, তারপর গল্প শোনাবে, গান শোনাবে, বাগানে গিয়ে ঝারি হাতে গাছে জল দেবে । তখন নিনিকেও জলে ভিজিয়ে দেবে । খুব মজা হয় । তারপর মা আর নিনি হাঁটতে বেরোয় রোজ ।
নিনিদের বাড়িটা একটা পাহাড়ের কাছে । বিকেল হলেই নিনি মায়ের সঙ্গে পাহাড়ের দিকে হাঁটতে যায় । আঁকাবাঁকা রাস্তাটা যে কি সুন্দর । ছায়া ছায়া সবুজ ঝাঁকড়া গাছ দু’পাশে । কোনোটায় থোকা থোকা বেগুনী ফুল, কোনোটায় হলুদ, কোনোটায় গোলাপি । কখনো পলাশে লালে লাল, কখনো সাদা শিমুলে আকাশ ঢাকা পড়ছে এমন । লাল লাল কৃষ্ণচূড়া দেখলেই মা বলবে,‘দ্যাখ নিনি,ঠিক যেন আকাশে আগুন লেগেছে ।‘
মোটেই আগুন মনে হয় না নিনির । আকাশটা এমনিই লাল হয়ে থাকে সর্বক্ষণ, কারখানার লাল ধোঁয়ায় । তবে কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো সেই লাল আকাশে দিব্যি লাগে, মানতেই হবে ।
সব গাছে ফুল নেই, লম্বা লম্বা ছুঁচের মত পাতার সরলগাছ, বড় বড় পাতার শালগাছ, হাল্কা সোনালি সবুজ পাতার সোনাঝুরি গাছ । সেই সঙ্গে কত ফলের গাছ । আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমলকি, ডুমুর । শেষ বিকেলে গাছে গাছে দল বেঁধে বেঁধে পাখি উড়ে আসে । লম্বা ল্যাজঝোলা পাখি, ছোট্ট টোপর মাথায় পাখি, কালো চকচকে কাক, ছোট্ট কালো কোকিল । সবুজ পাতার মতো টিয়া পাখি, সাদা ফুলের মতো দোয়েল পাখি । চড়াই, বুলবুলি, দুর্গাটুনটুনি, মৌটুসি । কত কত যে পাখি । চলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নিনি । পাহাড় পর্যন্ত যাওয়া হয় না, তার আগেই ঝুপ করে সন্ধে নেমে আসে ।
বাবা বলেছে, একটা রবিবার সকাল সকাল পাহাড়ে নিয়ে যাবে । সে আর হচ্ছেই না । রবিবার বাবা মা দুজনেরই বাড়িতে কত কাজ ।
আজকাল নিনি বন্ধুদের সঙ্গে বিকেলে খেলতে যায় । এক একদিন সবাই মিলে দল বেঁধে পাহাড়ের রাস্তায় যায় । এমনিতে বন্ধুদের পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে না । ওরা বলে, পাহাড়ের চেয়ে পার্ক ভালো । কিন্তু নিনিকে যে পাহাড়টা বড্ড টানে ।
মায়ের কাছে অরুণ-বরুণ-কিরণ মালার গল্প শুনেছে নিনি । পাহাড়ে গিয়ে লোভ করলে পাথর হয়ে যেতে হবে । মা বলে, পাহাড়ে গেলেই লোভ না করা শেখা যায় । নিনির খুব ইচ্ছে করে তাই । নিনি একলা একলাই বনের রাস্তায় যায় তখন ।
মাঝে মাঝে বন্ধুরাও বনের কাছে ছুটে আসে । পাহাড়ে যাবার ইচ্ছে না হলেও বনের মধ্যেটায় খুব ভালো খেলা জমে যে । ঝাঁকড়া গাছের জঙ্গলে এলেই লুকোচুরি খেলতে ইচ্ছে হয় । ‘টু উ উ কি’ বলে ডাক দিয়ে পুপলু লুকিয়ে পড়বে মোটা কাঁঠাল গাছটার পেছনে, আর সেই শব্দটা বনের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে কত দূরে চলে যাবে । আওয়াজ শুনে পুপলুকে খুঁজতে গেলেই বোকা হতে হবে ।
খুব মজা ।
সেদিনও বন্ধুদের সঙ্গে পাহাড়ের রাস্তায় যাচ্ছিল নিনি । দুপুরবেলা খুব ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল । রাস্তাটায় জল, এদিক সেদিক ভাঙা গাছের ডাল পড়ে আছে, পাতায় পাতায় ভরে আছে রাস্তা, পাখিগুলো বিকেল বিকেল ফিরে এসে বাসা খুঁজে না পেয়ে কিচির মিচির করে খুব হল্লা জুড়েছে ।
এক জায়গায় একটা গর্তমতো ছিল, সেটায় জল ভরে একটা ছোট্ট পুকুর হয়ে গেছে । পিঙ্কি আর বুবুন সেই দেখে বেজায় খুশি । জলে নেমে সে কি হুল্লোড় । মিলি আর প্রিয়ার আবার এসব পছন্দ না । ‘ইস কি নোংরা তোরা’, বলে মিলিদের বাড়ি খেলতে চলে গেল । বুম্বা আর পুপলু ঘুরে ঘুরে কাঁচা আম কুড়িয়ে পকেট বোঝাই করতে লাগল । কেউ পাহাড়ের দিকে যেতে চাইল না ।
নিনির মনখারাপ করছিল । কোনো দিনই কি পাহাড়ের কাছে যাওয়া হবে না ? আজকের আকাশটা কি সুন্দর । বৃষ্টির পর নীল আকাশের গায়ে পাহাড়টার রঙও নীল নীল । ভারি সুন্দর । একা একাই পাহাড়ের দিকে হাঁটতে লাগল নিনি । কোথা থেকে একটা ছোট্ট কুকুর ছুটে এসে ল্যাজ দোলাতে দোলাতে সঙ্গে চলল । ভালোই হল । আর একা একা যেতে হবে না নিনিকে । এখনও অনেকটা বিকেল আছে । আজ নিনি পাহাড় পর্যন্ত যাবেই ।
একটু এগোতেই দেখল, কত পাখির বাসা ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে । খুব ঝড় হয়েছিল যে । কি করবে পাখিগুলো ! কাঠবেড়ালিরা এদিক সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে, ওদের বাসাগুলো কি হয়েছে কে জানে । যত রাজ্যের ছোট ছোট পোকামাকড় উড়ছে, ছোট ছোট জীবজন্তুরা সবাই ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে । সবাই কেমন গাছের মধ্যে, বনের মধ্যে ঢুকে থাকত, এখন ভয় পেয়ে বেরিয়ে এসেছে ।
আহা রে । সন্ধে হয়ে আসছে, কোথায় থাকবে ওরা? এই জঙ্গলে বাঘ-সিংহ নেই অবশ্য, কিন্তু শিয়াল আছে, বুনো কুকুরের দল আছে, মাঝে মাঝে মহুয়া খেতে ভালুকও আসে ।
সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছিল নিনি ।
আর একটু এগোতেই কুকুরটা জোরে ডাকতে ডাকতে একদিকে ছুটে গেল । কি একটা দেখে খুব জোরে চেঁচাতে লেগেছে, আর জোরে জোরে ল্যাজ নাড়ছে । নিনিও সেদিকেই এগিয়ে গেল ।
ইস্ এক্কেবারে বাচ্চা একটা খরগোশ । সাদা একটা তুলোর বলের মতো, নীল নীল পুঁতির মতো চোখ, লম্বা লম্বা হালকা গোলাপি কান, সে দুটো তিরতির করে কাঁপছে । খুব ভয় পেয়েছে বেচারা । কুকুর আর নিনিকে দেখে ভয় পেয়ে পা টেনে টেনে গাছের আড়ালে লুকোতে চাইছে । পারছে না । আহা রে, নিশ্চয় ওর পা ভেঙে গেছে । খুব কষ্ট হচ্ছে বোধহয়, দু চোখের কোণে জল । নিনি এগোতেই আরো ভয় পেয়ে খরগোশ এমন ছটফট করতে শুরু করল যে নিনিই ভয় পেয়ে গেল । কি বুঝে কুকুরটা নিজে থেকেই দূরে সরে গেল । নিনি খরগোশের মাথায় মুখে হাত বুলোতে লাগল । কি বুঝল কে জানে খরগোশটা, চুপটি করে নিনির হাতের পাতা জিভ দিয়ে চাটতে লাগল ।
এদিক সেদিক দেখে একটা বড় শালপাতা এনে ওকে আস্তে করে তুলে নিল নিনি ।এই জঙ্গলে, এখুনি অন্ধকার নামবে, ওকে একলা রেখে যাওয়া যায় নাকি !
কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু খুব হল্লা জুড়েছে আবার । সাবধানে শালপাতা ধরে এগিয়ে গেল নিনি । নিনিকে দেখে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চুপ করল কুকুর ।
‘আয় রে, আমরা বাড়ি যাব । এই যে একে নিয়ে যেতে হবে ।‘ নিনি চেঁচিয়ে ডাক দিল । শালপাতা তুলে খরগোশকে দেখিয়েও দিল । তবু কুকুর সেখানে দাঁড়িয়েই ল্যাজ নাড়তে লাগল । খুব অস্থির । নিনি এগিয়ে গেল ।
একটা পাখির বাসা ভেঙে পড়ে আছে । তার মধ্যে ছোট্ট একটা একলা শালিখ । ভয় পেয়ে উড়ে পালাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না । ওর ডানা ভেঙে গেছে । শালপাতার মধ্যে খরগোশের সঙ্গেই আস্তে করে ওকেও তুলে নিল নিনি ।
দুজনেই শান্ত লক্ষ্মী হয়ে রইল, একটুও ছটফট না করে । দু’হাতে কত সাবধানে ধরে আছে নিনি, নিশ্চয় বুঝেছে ওরা । কুকুরটাও কি ভালো, চুপটি করে সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল ।
আজও পাহাড়ে যাওয়া হল না নিনির ।
আরো কত পাখির বাসা ভেঙে পড়ে আছে কে জানে । কত পাখি, কত প্রাণী এমন অসহায় অবস্থায় আছে কে জানে । পুপলু প্রিয়া বুবুনরা সবাই মিলে যদি তাদের খুঁজে দেখত, কি ভালোই না হত !
কিন্তু বন্ধুরা কেউ রাজি হল না । বুবুন বলল, ‘আমার মা এই সব নিয়ে ঢুকতেই দেবে না ।‘
পুপলু বলল, ‘তুই নিয়ে গিয়েও কি ওদের বাঁচাতে পারবি? তার চেয়ে ওদের এখানেই ছেড়ে দে । ওদের এসব অভ্যেস আছে ।‘
পিঙ্কি বলল, ‘ওদের নিয়ে যাচ্ছিস, ওদের মা এসে খুঁজবে না ? ঠাকুর তখন তোকেই পাপ দেবে ।‘
বুম্বা তো আম কুড়োনো ফেলে এলই না । খেলা ছেড়ে কেউ নিনির সঙ্গে আসতেও চাইল না । কুকুরটা কিন্তু বাড়ি পর্যন্ত সঙ্গে এল । নিনির সঙ্গে সঙ্গে মাকে ডাকাডাকিও করল । মা এসে ছোট্ট খরগোশ আর শালিখকে সাবধানে ঘরে নিয়ে গেল ।
‘এখন যাও ডাকু, কাল আবার এসো’, কুকুরকে বলল নিনি ।
‘ওর নাম বুঝি ডাকু?’ মা শুনতে পেয়েই বেরিয়ে এসেছে, ‘দাঁড়া, ডাকুকে যেতে বলিস না । ওর খুব খিদে পেয়েছে নিশ্চয় । ওকে খেতে দিই ।‘
মায়ের কথা শুনেই ডাকু জোরে জোরে ল্যাজ নাড়তে লাগল । এইজন্যে মাকে এত ভালো লাগে নিনির । মায়ের সব দিকে খেয়াল থাকে । খাবার সময় ডাকুকে ভালো করে সব বুঝিয়ে বলে দিল নিনি । সত্যি সত্যি খরগোশ আর শালিখের মায়েরা এসে খোঁজ করে যদি ! ল্যাজ নেড়ে নেড়ে সব বুঝে নিল ডাকু ।
তারপর কতদিন ধরে খরগোশ আর শালিখ থাকল নিনির বাড়ি । খরগোশের নাম হল জিনি আর শালিখের নাম চুনী । রোজ সকাল বিকেল আসতে লাগল ডাকুও । একদিন আর ফিরে গেল না । নিনির বাড়ি এখন ডাকুরও বাড়ি ।
খুব মজা এখন ।
ইচ্ছে করে বাবা সুর করে ডাকবে, ‘নিনি নিনি নিনি ... কোথায় গেলি জিনি চুনী ...’
আর অমনি জিনি ছুটে আসবে । ওর পা সেরে গেছে, তবু আর জঙ্গলে যায় নি । চুনীর থাকার জন্যে একটা বেতের ঝুড়ি এনে দিয়েছে বাবা । বেতের ঝুরি উল্টে হাঁটি হাঁটি পায়ে ছুটে আসবে চুনীও । ও এখনও উড়তে পারে না ।
ডাকু সেই সময় চুপটি করে বারান্দার কোনায় বসে থাকবে । ওর রাগ হয়েছে কিনা । বাবা কেন ওকে ডাকে নি ! মা এসে তখন ডাকুকে কোলে নিয়ে আদর করবে । তবু ডাকু গম্ভীর হয়ে থাকবে । তখন বাবা বলবে, ‘ডাকুবাবুর গোঁসা হয়েছে । কড়মড় করে একখানা টোস্ট করে দাও দেখি ।‘ বাবার হাতে টোস্ট খেয়ে তবে ডাকুর মুখে হাসি ফুটবে ।
বাবা বলেছে, ‘নিনি রে, তোর চিড়িয়াখানার একটা নাম দিবি না?‘
চিড়িয়াখানা কথাটা পছন্দ নয় নিনির । চিড়িয়াখানায় তো সবাইকে খাঁচার মধ্যে, লোহার জালের মধ্যে থাকতে হয় । এটা তো নিনির বাড়ি, চিড়িয়াখানা কেন হবে ? বরং মা যে বলে, ‘নিনির সংসার’, সেই কথাটা খুব ভালো লাগে । আজকাল বাবাও ‘নিনির সংসার’ কথাটা বলছে ।
বাড়িতে কেউ এলেই বাবা বলে, ‘নিনি, তোমার সংসারের সবাইকে আলাপ করাও ।‘
জিনিকে দেখলেই সবাই কোলে নিয়ে আদর করে । একটুও দুষ্টুমি না করে শান্ত হয়ে বসে থাকে জিনি । ডাকুও তখন জিনিকে হিংসে না করে চুপ করে বসে থাকে । শুধু ছোট বাচ্চারা কাছে এলে ডাকু ঘাড়ের লোম ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ায় । তখন নিনি চুপিচুপি বলে দেয়, ‘বিহেভ ইওরসেলফ ।‘ অমনি ডাকু আবার লক্ষ্মী ছেলে হয়ে বসে পড়ে ।
চুনীকে দেখলেই সবাই বলে,’এই রে ! এক শালিখ ! জোড়াটা কই ?’ তাই চুনী লোকজনের সামনে যেতে চায় না । আজকাল রোজ সকালে একবার আকাশে উড়তে যায় চুনী । ঠিক সময়মতো ফিরেও আসে ।
আসাম থেকে বেড়াতে এসে ছোটমাসি নিনির সংসারের আর একটা নাম দিয়েছে - ‘হাসিকান্না চুনীপান্না ।‘ এই নামটাও খুব পছন্দ হয়েছে নিনির ।
আজকাল আর একা লাগে না নিনির । ঠিক করেছে, একদিন ডাকু চুনী আর জিনির সঙ্গে পাহাড়ে যাবে । ফুলের বাগান, ফলের বাগান, সবুজ ছোলার ক্ষেত, হলুদ সরষের ক্ষেত । তারপর ঘন সবুজ বন । তারপর পাহাড় । মাথার ওপর মস্ত আকাশে সুজ্জিমামা এসে সোনার আলো ঢেলে দেয় । চূড়ার ওপর মেঘেরা এসে পা দুলিয়ে বসে গল্প করে । চুনীর মতো অনেক পাখি, ডাকুর মতো জিনির মতো অনেক প্রাণী । কাঠবেড়ালীদের সঙ্গে সঙ্গে পিঁপড়েরাও ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘোরাফেরা করে ।
সে এক আশ্চর্য সুন্দর জায়গা । পাহাড়ে উঠতে অনেক হাঁটা, অনেক কষ্ট, পায়ে ব্যথা । কিন্তু একবার উঠে পড়লে আর কষ্ট নেই । খোলা গলায় হাসো, আর অমনি পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে সে হাসি ফিরে আসবে তোমার বুকের মধ্যে । সবাই মিলে ভালোবাসায় হাত ধরে অনেকদিন হাঁটলে সেই হাসিকান্না চুনীপান্নার দেশে পৌঁছনো যায় ।
নিনি ঠিক করেছে, একদিন ডাকু চুনী আর জিনির সঙ্গেই পাহাড়ে যাবে ।
আইভি চট্টোপাধ্যায়
জামশেদপুর,ঝাড়খন্ড
অলঙ্করনঃ
ঋতম ব্যানার্জি
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন আইভি চট্টোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
হাতি শিকার
গরুমারা অভয়ারণ্যে একটা দাঁতাল হাতি হঠাত করেই পাগল হয়ে গেছে। দুলছুট হয়ে সেই হাতি এখন লাটাগুড়িতে তান্ডব চালাচ্ছে। বাড়ি ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সাধারণ গরিব মানুষের। অনেক গুলো দোকানও তছনছ করে দিয়েছে সেই পাগলা হাতিটা। বন দপ্তরের লোকেরা এখন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে হাতিটাকে। টিভির পর্দায় এখন লোকাল চ্যানেলের নিউজ রিডারের মুখ। বহুদিন পর শান্তশিষ্ট শহরে এক জবর খবর পাওয়া গেছে। তাই চোখ মুখ বড় করে হাতির সংবাদটা যতটা পারা যায় চমকে দেবার মতো করে পরিবেশন করছেন ভদ্রলোক।
টিভিতে নিউজ চ্যানেলের সংবাদটা দেখছিল ক্লাস এইটের মিকি। দশটা বেজেছে, বাবা চলে গেছেন অফিসে। মা আর দুখিদাদা রান্না ঘরে, জোর মাংস রান্নার গন্ধ বেরোচ্ছে সেখান থেকে। একটু আগেই একবাটি মাংস চেখে এসেছে মিকি। সামার ভ্যাকেশন চলছে স্কুলে। একগাদা অংক করতে দিয়েছেন প্রাইভেট টিউটর, সেইসব গাদা গুচ্ছের হোম ওয়ার্ক সময়ে শেষ করা নিয়ে বড় ভাবনায় আছে মিকি। এমনিতেই অংকে সে অষ্টরম্ভা। তারমধ্যে টেনশানে থাকলে মিকির ক্ষিদে বেড়ে যায়। একবাটি মাংস এইমাত্র খেয়েও একটু যেন খিদে খিদে পাচ্ছে মিকির।
সিঁড়িঘরে বসে আরও একবাটি মাংস তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতেই মাথায় আইডিয়াটা এসেছে মিকির। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছে কিকুকে। মিকির ক্লাসমেট কিকু আবার অংকে জিনিয়াস। কিকু হাসতে হাসতে বললো, কী রে অংক পারছিস না বুঝি?
ফিসফিস করে মিকি বললো, রাখ তোর অংক। একটা জোর খবর শুনলাম এইমাত্র। লাটাগুড়িতে একটা পাগলা হাতি বেরিয়েছে। ঋজুদা আর রুদ্রর শিকারের গপপো পড়ে খুব এডভেঞ্চার এডভেঞ্চার করছিলো না কদিন ধরে? ভগবান সুযোগ করে দিয়েছেন এবার। বল যাবি হাতিশিকারে?
আকাশ থেকে পড়েছে কিকু, বলিস কি? কোথায়?
মিকি নিচু গলায় বললো, কেন লাটাগুড়ি।
কিকু ভোম্বলের মতো থমকে থেকে বলেই ফেললো, কী দিয়ে শিকার করবি হাতি?
মিকি চাপা গলায় বললো, কেন? জন্মদিনে বাবার দেওয়া এয়ার গানটা দিয়ে।
এয়ার গান দিয়ে হাতি শিকার? কিকু অবাক হয়ে বললো খেপেছিস নাকি? ওই অতবড় হাতির কাছে তোর এয়ারগানের গুলি তো নস্যি।
ভ্যাট বোকা, মিকি আশ্বাস দিলো কিকুকে, তুই ভুলে যাচ্ছিস যে হাতির সব চাইতে দুর্বল জায়গা হল ওর ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ জোড়া।
তো? কিকু এখনো ধাঁধায় রয়েছে যেন।
মিকি একটু বিজ্ঞের মতো হাসলো। আমার হাতের টিপতো তুই জানিসই। মেলায় যে বন্দুকের দোকান গুলো থাকে, সেখানে বেলুন ফাটাই দেখিস না। একটাও মিস হয় বল?
কিকু নিরুত্তর। মিকি অভয় দেওয়ার মতো করে বললো ভাবিস না। রেঞ্জের মধ্যে যাওয়াটারই শুধু অপেক্ষা। একবার পেলেই ঢ্যা ঢ্যা করে গুলির বৃষ্টি ব্যস। চোখ দিয়ে মগজে ঢুকে যাবে গুলি আর সঙ্গে সঙ্গে মরে যাবে হাতিটা, সিম্পল।
কিকু চুপ। মিকি বললো, হাতি-শিকার পর্বটা ঠিকঠাক নামিয়ে দিতে পারলে লাটাগুড়ির গরিব লোকজনদের যেমন উপকার হবে, আমরাও কি মাইলেজ পাবো একবার ভাব কিকু। চাই কি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা পুরষ্কারও জুটে যেতে পারে আমাদের।
বাড়িতে বলবি না? কিকু ভয়ে বললো।
ওরে রামছাগল বাড়িতে বললে কি আর বাবা-মা যেতে দেবেন নাকি কখনও! মিকি বললো, সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরোবো। লাটাগুড়ি এখান থেকে জোর এক ঘন্টার মামলা। যাওয়া আসা ধরলে আড়াই তিন ঘন্টা । অপারেশান শেষ করে সন্ধ্যেবেলার মধ্যেই বাড়ি ঢুকে যাবো। নো টেনশান।
কাল দুপুরে করালী স্যারের কাছে অংকের টিউশান, সেটা বলতে যাচ্ছিলো কিকু। কিন্তু বন্ধুকে থামিয়ে দিয়ে মিকি বললো, তাহলে ওই কথাই রইলো। কাল আমরা সকাল ন'টায় বেরোচ্ছি বাড়ি থেকে। আর হ্যাঁ বাড়ি থেকে বেরোবার আগে পেট ভরে ভালো করে খেয়ে নিস, আমিও খেয়ে নেবো। পরে রাস্তায় কিছু জোটে কি না জোটে!
পরদিন বাবাও বেরিয়েছেন অফিসে , কাঁধে এয়ারগান ঝুলিয়ে মিকি সন্তর্পনে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছে। পুজোর সময় কেনা জিন্স্টা পড়েছে মিকি। গায়ে সেনাবাহিনীর মতো একটা জলপাই রঙের শার্ট। পা টিপে টিপে গলির মুখটায় গিয়ে হাঁফ ছেড়েছে সে। বেরোবার সময় মাকে বলেছে কিকুর বাড়ি অংক প্র্যাকটিস করতে যাচ্ছি। কিকুও একই কথা বলেছে বাড়িতে। মাটির একটা ভাঁড়ে টাকা জমাচ্ছিলো মিকি একবছর ধরে। সেটা ভেঙে বেশ কিছু টাকা পাওয়া গেছে। সে টাকা দিয়ে পকেট ভর্তি করে বেরিয়ে পড়েছে দু' বন্ধুতে।
সাধারণ একটা টি শার্ট আর প্যান্টের কিকু দাঁড়িয়ে ছিলো বাস স্ট্যান্ডে। মিকিকে দেখে বললো, তোর ড্রেসটা তো জব্বর হয়েছে।
মিকি বিজ্ঞের মতো বললো, জলপাই রঙের ড্রেস পরার অনেক অ্যাডভান্টেজ আছে। হাতিটাকে আমি দেখবো কিন্তু সবুজ গাছপালার ব্যাকগ্রাউন্ডে সে আমাকে খুঁজে পাবে না।
ঠোঁট কামড়েছে মিকি, ইস, একটা ভুল হয়ে গেলো। তুইও যদি আর্মি টাইপ কোনো ড্রেস পরে আসতিস! যাক গে,ছেড়ে দে। মিকি গম্ভীর গলায় বললো, পরের বার আর এই ভুলটা করিস না।
কিকু তারিফের গলায় বললো, নাঃ মানতেই হবে তোর ঘটে বুদ্ধি আছে কিছু!
বাসে ওঠার সময় মিকি বললো যদিও বাড়ি থেকে ভরপেট খেয়ে বেরিয়েছি, তবুও চল কোথাও কিছু খেয়ে নিই। পথে আবার কি জোটে কে জানে!
বাস স্ট্যান্ডের পাশেই একটা বিরাট মিষ্টির দোকান। সেই দোকানে খান দশেক পুরি দিয়ে সবজি আর বড় বড় চারটে রসোগোল্লা খেয়ে নিলো মিকি আর কিকু। কাঁধে এয়ার গান দেখে অনেকে চোখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছিলো দুজনের দিকে। মুখ টিপে হাসছে সব। অপমানিত কিকু পেটে চিমটি কেটেছে মিকির। বিরক্তির গলায় মিকি বললো, ছাড় তো। বড় বড় কাজে বেরোলে এরকম সিলি ব্যাপারে একদম ধ্যান দিবি না। যখন ফিরবো হাতি মেরে, তখন দেখবি এই লোক গুলোই আমাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করছে।
লাটাগুড়িগামী বাসে উঠেছে দু'জন। কন্ডাক্টর একটু কৌতুহলী চোখে তাকাচ্ছিলো দুজনের দিকে। সেদিকে থোড়াই কেয়ার মিকি আর কিকুর। গম্ভীর মুখে টিকিটের টাকা দিয়ে দিয়েছে লোকটার হাতে। এক চিলতে সাইজের দুটো টিকিট বুক পকেটে গুঁজে মিকি বললো, আমাদের এডভেঞ্চারের কথা কারো কাছে ফাঁস করে বসিস না যেন। প্রেসের লোকজন আজকাল খুব সেয়ানা। টের পেয়ে গেলে আমাদের পেছনে ডাকটিকিটের মতন সেঁটে যাবে ঠিক। কেস পুরো কেঁচে যাবে।
বাসের পিছন দিকে পাশাপাশি বসেছে মিকি আর কিকু। তিস্তা ব্রিজ আসতেই ময়নাগুড়ি আসতেই খিদে পেয়ে গেলো জোর। ভাগ্যিস সঙ্গে করে কিছু কলা এনেছিলো, চারটে করে মালভোগ কলা আর গোটা আষ্টেক লেডিকেনি খেয়ে নিয়ছে দুজন। বাসটা মৌলানী হয়ে লাটাগুড়ি এসে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। কাঁধে এয়ার গান, নেমেছে মিকি। পেছন পেছন কিকু। পথ চলতি লোকেরা ফিরে ফিরে দেখছে দুজনকে।
বাজারের মধ্যেই একটা বিরাট বড় মিষ্টির দোকান। সেখানে কাচের ওপাশে বিরাট বিরাট সব মিষ্টি। কাজু বরফি, প্যাঁড়া, ছানার জিলিপি, কালোজাম থেকে শুরু করে মোতিচূড়ের লাড্ডু পর্যন্ত সাজিয়ে রেখেছে ব্যাটাচ্ছেলে দোকানদার। জিভে জল না আসবার কোনো কারণ নেই। তবে এই দোকানের স্পেশালিটি হলো চমচম। এক একটা চমচম যেন এক একটা থান ইঁট। দোকানদার হেসে বললো এগুলো ফ্যামিলি সাইজ চমচম। বাড়ির সবাই মিলে যেমন একটা বড় কেক খায় , এই মিষ্টিও তেমনি সবাই মিলে শেয়ার করে খেতে হয়।
মিকি বললো, এখন বেরোবো জঙ্গলের দিকে। তারপর হাতি শিকার করে কখন ফিরি না ফিরি। খিদে পেয়ে যেতে পারে। তার চাইতে এখনই একটা একটা করে খেয়ে নিই চমচম। ওদিকটায় রসমালাই বানাচ্ছে, গন্ধ ছেড়েছে জোর। সেটাও একবাটি মেরে দিই চল। ছানার পোলাওটাও মিস করে ঠিক হবে না। আর সব শেষে একটা করে কাজু বরফি।
বুঝলি কিকু, মিকি একটুক্ষণ চিন্তা করে বললো, এখন এর বেশি খাওয়াটা ঠিক হবে না। বেশি খেয়ে ফেললে বিপদের সময় ব্রেন স্লো রেটে কাজ করবে। রিঅ্যাকশন টাইম বেড়ে যাবে। সেই রিস্ক নেওয়াটা ঠিক হবে না।
অত টাকা সঙ্গে আছে তো? কিকু ভয়ে বললো, সব টাকা খেয়েই উড়িয়ে দিবি, ফেরার ভাড়া থাকবে তো রে?
কিকুর মাথায় একটা আলতো করে চাঁটি মেরে মিকি বললো, থাকবে রে বাবা থাকবে, ঘাবড়াসনা। অত না ভেবে এইবেলা খেয়ে নে। তবে একটা কাজ করলে হয় দুটো করে এই মেগা সাইজের চমচম সঙ্গে করে নিয়ে যাই, পরে জঙ্গলের মধ্যে কি জোটে না জোটে!
হাতে চমচমের বিরাট প্যাকেট দুলিয়ে বেরিয়েছে দুই বন্ধু। লাটাগুড়ি বাজার থেকে একটা রিক্সা ধরে কিছুটা গিয়ে নেওড়া মোড়। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সামনেই জঙ্গল। কাঁধে এয়ার গান নিয়ে পথ হাঁটছে মিকি। পেছন পেছন কিকু। পান-সিগারেটের দোকানে আড্ডা মারছিলো কিছু লোক । একজন জিজ্ঞেস করলো এদিকে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
নিরীহ মুখে মিকি বললো, পাখি শিকার করতে।
লোকটা দাঁত বের করে হাসলো, এদিকে তো ঘন জঙ্গল। এদিকটায় যেয়ো না। একটা পাগলা হাতি বেরিয়েছে এদিকে। খুব সাবধান।
কাউকে কিছু না বলে গুটিগুটি দুই বন্ধু এগিয়েছে জঙ্গলের দিকে। একটু বাদেই ঘন জঙ্গল শুরু হয়ে গেলো। যতদূর চোখ যায়, তার পুরোটা জুড়ে মোটাসোটা সব শাল গাছ একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরও কিসব অচেনা গাছ যেন সবুজ রঙের মশারি টাঙিয়ে দিয়েছে জঙ্গলের মধ্যে। গাছ গুলোর এত ঘন পাতা যে ওপর দিকে তাকালে আকাশ দেখা যায় না শত চেষ্টা করলেও। কি একটা অচেনা পাখি ডাকছে ঝুমঝুম শব্দ করে। পিলে যেন চমকে যায়! দিনের বেলাতেই সেই ছমছমে জঙ্গলে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।
নির্ভীক মিকি কিকুকে অভয় দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কিকু ঘাবড়েছে জোর। তার বুকের ভেতর দ্রিদিম দ্রিদিম শব্দ করে ঢাক বাজছে। পেটের মধ্যে একটা কচ্ছপ যেন লাফাচ্ছে থপথপ করে। পিলে-ফিলে যেন বেরিয়ে আসবে পেট ফেটে। কিছুটা পথ গিয়ে কিকু চিতকার করে বললো, মিকি ওই দেখ, ওই বড় শালগাছটার আড়ালে ওটা কি! কালো মতো উঁকি মারছে-ওটাই সেই পাগলা দাঁতাল হাতিটা না!
মিকি কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় গাছপালা নড়িয়ে হুড়মুড় করে সামনে চলে এসেছে একটা বিরাট বড় কালো রঙের হাতি। পাহাড়ের মতো তার আকার। তার শুঁড়টাই যেন দশটা মানুষের সমান লম্বা। ধবধবে সাদা তার দাঁত। পা তো নয় যেন গাব্দা গোব্দা রণ পা। খুদে খুদে চোখ হাতিটার। জুলজুল করে সে এখন তাকিয়ে আছে মিকি আর কিকুর দিকেই।
কিকু ঘাবড়েছে জোর। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। তবুও কোনোমতে চিতকার করলো, মিকি টিপ কর, টিপ কর হাতির চোখে।
কোনো উত্তর আসছে না মিকির দিক থেকে। ঘাড় ঘুরিয়েছে কিকু। মিকি মাটিতে উবু হয়ে বসে চমচম খাচ্ছে দুর্ভিক্ষের দেশের লোকের মতো করে। বেকুবের মতো বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছে কিকু। মিকি অস্ফুটে বললো, খেয়ে নে কিকু, খেয়ে নে। পরে আর জোটে কি না জোটে!
হাতিটা অবাক হয়ে দেখছিলো দুজনকে। সাক্ষাত মৃত্যুকে সামনে দেখেও যারা প্রান বঁচিয়ে পালাবার আগে শেষ খাওয়াটুকু খেয়ে নেবার কথা ভাবে, এমন দুই পেটুককে দেখে তাজ্জব হয়ে গেছে হাতিটা। এমন অসম্ভব কান্ড জীবনে ঘটতে দেখেনি সে। কিছুক্ষণ বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল হাতিটা। তখনও মিকি আর কিকু চমচম খেয়ে চলেছে কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান
১
ছুটি পড়েছে স্কুলে। চার বন্ধু কিংশুক, কেকা, কাবেরী আর কোজাগর রোজ বিকেলে ক্যারাটে শিখতে যায় কাছাকাছি এক ক্লাবে। সেখান থেকে ফিরে জড়ো হয় পার্কে। একটু খেলাধূলো আর অনেকটা আড্ডা মেরে সন্ধ্যের সময় যে যার বাড়ি ফেরে। পার্কটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যে ‘সুচেতনা’ রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স, এদের সবার বাড়ি সেখানেই।
আজ পার্কে ঢুকে সাইকেলটাকে স্ট্যান্ড করে রেখেই কেকা বলল
- একটা মুশকিলে পড়েছি।
- কিরকম মুশকিল?
- সারাদিন গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে না, টিভি দেখতেও ইচ্ছে করে না। পছন্দসই অন্যরকম কিছু একটা কাজ চাই। কী করা যায় বলতো?
কিংশুকও মুখ ব্যাজার করে বলল
- হ্যাঁ আমারও ঐ একই মুশকিল। ভিডিও গেমস খেলতেও ইচ্ছে করে না আজকাল। কিছু ইন্টারেস্টিং কাজ পেলে খুব ভালো হত।
কাবেরী বলল
- আমারও একই দাবী। ভালোলাগে না রোজ এই একঘেঁয়ে ছুটি কাটাতে।
কোজাগর ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে তড়বড়িয়ে বলে উঠল
- কেকিকোকা?
সবাই মিলে জিগ্যেস করল
- কেকিকোকা? এটার মানে কি?
- কেকিকোকা মানে কে কি ধরনের কাজ চাস, কোন সময় কাজ করতে চাস, কোথায় বসে কাজ করবি, কাজের জন্যে কাদেরকে সঙ্গে চাস ইত্যাদি প্রভৃতি আর কি। মানে কোনো বিষয় নিয়ে যা যা প্রশ্ন করা যেতে পারে সেগুলোকে এককথায় প্রকাশ করলে দাঁড়ায় – ‘কেকিকোকা’।
কিংশুক কোজাগরের পিঠে একটা বিশাল চাপ্পড় মেরে বলল
- ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া।
- কেকিকোকা?
- মানে?
- এইতো বললাম মানেটা। আবার বলে দিতে হবে? মানে আইডিয়াটা কেন ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট হল তো কি হল, কোন কাজে লাগতে পারে আইডিয়াটা, কারই বা কাজে লাগবে ইত্যাদি প্রভৃতি ।
- ওহ তাই বল। হ্যাঁ হ্যাঁ কাজে লাগবে। আমাদের সবার কাজে লাগবে।
কেকা, কাবেরীও খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
- বল, বল। শিগ্রী বল। কিভাবে কাজে লাগতে পারে?
- শোন আমরা একটা দল মানে একটা গ্রুপ বানাতে পারি। তার নাম হবে ‘কেকিকোকা’।
- কি করব আমরা সেখানে?
- নাম যা বলছে তাই। মানে কোজাগর যেমন বলেছে সেই রকমই। আমরা যে কোন লোকের নানান কি, কেন, কোথায়, কারা, কিভাবে এই সব প্রশ্নের উত্তর দেব।
- দেব বললেই দেওয়া যাবে নাকি। আমরা কি সব প্রশ্নের উত্তর জানি?
- আরে জানিনা তো কি জেনে নেওয়া যাবে। আমার কম্পিঊটার আছে। ইন্টারনেটে খুঁজলে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই।
কেকা বলল
- তাছাড়া আমরা আমাদের বাড়িতে বড়দেরও জিগ্যেস করে জেনে নিতে পারি। আমার বাড়িতে একটা বিশাল লাইব্রেরী আছে সেখানে এমন কোন বই নেই যা নেই।
কাবেরী বলল
- আমাদের ক্যারাটে ক্লাবের পাশে ‘জ্ঞান পাঠাগার’ নামের যে লাইব্রেরীটা আছে তার আমি মেম্বার। দরকার পড়লে সেখানেও যেতে পারি আমরা।
- গ্রেট। তাহলে আর কি। চল নেমে পড়ি। কি রে কোজাগর তখন থেকে তুই চুপ যে। নতুন আইডিয়াটা কেমন লাগল বললি না তো।
কোজাগর বলল
- আইডিয়াটা যে ব্রিলিয়ান্ট সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ‘কেকিকোকা’ নামের কিন্তু আরও একটা মানে আছে। এই নামটার মধ্যে আমাদের সবার নামের প্রথম অক্ষরটা লুকিয়ে আছে। কেকার ‘কে’, কিংশুকের ‘কি’, কোজাগরের ‘কো’ আর কাবেরীর ‘কা’ মিলিয়ে ‘কেকিকোকা’।
কারো মাথায় এটা আসে নি আগে। সবাই বুঝতে পেরে খুব উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো
- তাই তো! হুররররে...
কোজাগর বলল
- ‘কেকিকোকা’-র সঙ্গে ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’-এর ‘দ্য গ্রেট’-এর মতো ‘দ্য মুশকিল আসান’ জুড়ে দিলে কেমন হয়। আমরা লোকেদের মুশকিল আসান করতে চাই। আর সেই সঙ্গে নিজেদের সময় কাটানোর মুশকিলেরও আসান হবে।
- ‘কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান’। জমাটি নাম।
- দুর্দান্ত ! গ্রুপের নাম তাহলে এটাই ফাইনাল করা হল।
সবাই একবাক্যে মেনে নিল।
২
কিংশুকদের বাড়িতে ওর পড়ার ছোট্ট ঘরটা ‘কেকিকোকা’-র অফিস ঘর হিসেবে চিহ্নিত করা হল। এই ঘরে একটা কম্পিউটার আছে। এটা একটা বিশাল উপরি পাওনা ওদের। বাড়ির লোকেরা কেউ কোন আপত্তি করল না। বরং নিশ্চিন্ত হল যে ছেলেমেয়েগুলো সাইকেল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে না বেড়িয়ে ঘরবন্দী কাটাবে কিছুক্ষন।
কম্পিউটারে ছবি এঁকে ‘কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান’ লিখে পোস্টার বানালো কিংশুক। সঙ্গে জুড়ে দিল তাদের নতুন অফিসের ঠিকানা সহ ম্যাপ। আর কাবেরীর ফোন নাম্বার। ওদের মধ্যে একমাত্র কাবেরীরই নিজস্ব মোবাইল আছে। নতুন একটা ইমেল আইডি বানিয়ে সেটাও জুড়ে দিতে ভুললো না। তারপর লিখল
‘প্রশ্ন আছে কিন্তু উত্তর জানা নেই? যোগাযোগ করুন। ফ্রী সার্ভিস।
‘ফ্রী সার্ভিস’ নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল সবাই। কিন্তু ঠিক করা হল আপাততঃ কিছুদিন বিনা পয়সাতেই কাজ করে অভিজ্ঞতা বাড়ানো হবে। লোকজনের আস্থা অর্জন করতে পারলে নিজেদের মনোবল বাড়বে। তখন কিছু পারিশ্রমিক নেওয়া চলতে পারে। সেই মতো পোস্টারও বদলে দেওয়া হবে তখন।
তারপর ছাপিয়ে বার করল সেই পোস্টার। সাদাকালো প্রিন্টারে ছাপানো বলে দেখতে একটু ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছিল। কাবেরী আর কোজাগর সঙ্গে সঙ্গে রং তুলি নিয়ে বসে গেল। আধঘন্টায় কুড়িটা পোস্টার দেখতে ঝকঝকে আকর্ষনীয় হয়ে উঠলো। তারপর যে যার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে পোস্টার, আঠা, সেলোটেপ, কাঁচি ইত্যাদি যা যা লাগতে পারে। পার্কের সব দিকের গেটে, পার্কের মধ্যে বড় বড় কয়েকটা গাছের গায়ে প্রথম পোস্টার আঁটা হল। তারপর কমপ্লেক্সের বাইরে চৌরাস্তার মোড়ে কয়েকটা আর বিশুদার মুদির দোকানের গায়ে, কাগজ ও ম্যাগাজিনের স্টলের পাশের লাইট পোস্টটায়। টেলিফোন বুথের সামনে। আরো যেখানে যেখানে নজরে পড়ল লাগিয়ে দিল।
আজকের মতো কাজ শেষ। সবার মনেই এখন ‘কেকিকোকা’ টাইপের অনেক প্রশ্ন জমে উঠেছে। পোস্টার তো লাগানো হল। কিন্তু পোস্টারটা কারো কি নজরে পড়বে? কারো কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে? কেউ কি আসবে? কেউ কি ফোন বা ইমেল করবে? করলেও কবে করবে? এসবের উত্তর ওদের জানা নেই। একমাত্র সময়ই বলতে পারে কি হবে। তাই এখন শুধু অপেক্ষা করে থাকা।
চৌরাস্তার মোড়ে সুদীপ কাকুর রোলের দোকানটা চোখে পড়তেই সবার খুব রোল খিদে পেয়ে গেলো। চারটে এগরোল অর্ডার দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ কোজাগর বলল
- দ্যাখ বিশুদার মুদির দোকানের বাইরে একটা লোক আমাদের পোস্টারটা খুব মন দিয়ে দেখছে।
সবাই তাই দেখে খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ল। কিংশুক বলল
- চল চল লোকটির সঙ্গে কথা বলে দেখি। কি ভাবছেন কিছু যদি জানা যায়। কেকা, কাবেরী তোরা রোলটা নিয়ে আয়।
কোজাগর আর কিংশুক রাস্তা পেরিয়ে ভদ্রলোকটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ভদ্রলোকটি এক মনে তাকিয়ে রয়েছে পোস্টারের দিকে। কি যেন ভাবছেন। খুব চিন্তাচ্ছন্ন মুখ।
- কিছু ভাবছেন কাকু?
- আচ্ছা, এই পোস্টারটা আগে তো চোখে পড়েনি কখনো।
- হ্যাঁ আজই মারা হয়েছে। আপনার কি জানার মতো কোন প্রশ্ন আছে?
- আছে। কিন্তু কোন কাজ হবে মনে হয় গেলে? ফ্রীতে সার্ভিস দেবে বলেছে। ভরসা করা যাবে?
- ফ্রীতে যখন সার্ভিস দেবে তখন তো আপনার হারানোর কিছু নেই। টাকা পয়সা তো আর মার যাচ্ছে না। বরং লাভ হলেও হতে পারে। একটু দেখুনই না হয় বিশ্বাস করে।
- তা অবশ্য মন্দ বলোনি। তোমরা জানো কোথায় এদের অফিস?
- আসলে আমরা চারবন্ধু মিলে এই গ্রুপটা ফর্ম করেছি। আপনি যদি আমাদের ভরসা করতে পারেন তাহলে আমরা আমাদের অফিসে গিয়ে বসে কথাবার্তা বলতে পারি।
ভদ্রলোক একথা শুনে ভীষন আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এত বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে দেখে বিশেষ ভরসা করলেন বলে মনে হল না। ততক্ষনে কেকা আর কাবেরীও রোল নিয়ে হাজির হয়েছে। সবাই মিলে চেপে ধরল।
- কাকু, আমাদের ওপর একটু ভরসা করে দেখুন। ক্ষতি হবার তো কিছু নেই।
ভদ্রলোক একটু ইতস্ততঃ করে বললেন
- ঠিক আছে। চলো তোমাদের অফিসে গিয়ে বসে কথাবার্তা বলা যাক।
ভদ্রলোকের বাইক রাখা ছিল সামনেই। বাইকে স্টার্ট দিলেন। ওরা চারজনে সাইকেল চালিয়ে আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।
৩
সবাই মিলে ঢুকলো ওদের অফিস ঘরে। কেকা ভদ্রলোককে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল বসার জন্যে। কিংশুক ভেতর থেকে এক গ্লাস জল এনে দিল।
কোজাগর শুরু করল কথাবার্তা
- কাকু, আপনার নামটা একটু বলুন।
- আমার নাম মিহির মজুমদার।
- আপনার প্রশ্ন কি?
- আমার বাড়ির পোষা কুকুর বাড়ির ভেতর থেকে হঠাৎ ভ্যানিস করে গেল কি করে?
কিংশুক ততক্ষনে তার কম্পিউটার অন করে ফেলেছে। লিখতে শুরু করেছে তাদের ‘কেকিকোকা দ্য মুশকিল আসান’-এর প্রথম প্রজেক্টের সব খুঁটিনাটি।
নাম - মিহির মজুমদার।
প্রশ্ন - বাড়ির ভেতর থেকে পোষা কুকুর হঠাৎ কোথায় ভ্যানিস করে গেল?
কোজাগর জানতে চাইল – কী কুকুর?
- স্পিৎজ। ছোট্ট সাদা কুকুর। নাম জিমি।
- কোন দিন ও কোন সময় ঘটেছে ঘটনাটা?
- তিনদিন আগে। দুপুর বেলা। বাড়িতে আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। কুকুরটাও বাড়িতেই ছিল। ঘুম থেকে উঠে থেকে কুকুরটাকে আমরা আর কেউ দেখতে পাইনি।
- বাড়িতে কে কে ছিলেন সেই সময়?
- সবাই ছিলাম। আমি, আমার স্ত্রী সুমিতা, দুই মেয়ে রিয়া আর দিয়া, আমার বয়স্ক মা আর বাবা।
- কুকুরটাকে কেউ চুরি করতে পারে কি? কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?
- না, সেরকম কখনো মনে হয়নি।
- ঘরের দরজা কি খোলা ছিল? কেউ উঠে আসতে পারে ওই সময়?
- না। নিচের মেন দরজা বন্ধই ছিল।
- আচ্ছা, আমরা কি আপনার বাড়িটা গিয়ে একবার দেখে আসতে পারি।
- নিশ্চয়। এখনই চলো আমার সঙ্গে।
ওনার বাড়ি চৌরাস্তার খুব কাছেই। ওরা সবাই গিয়ে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল সবকিছু। মিহিরবাবুর দোতলা বাড়ি। পাশাপাশি অনেকগুলো একইরকম বাড়ি। নিচে ওনার বয়স্ক মা বাবা থাকেন। ওপরে থাকেন উনি, ওনার স্ত্রী আর দুই মেয়ে। মেয়েরা ছোট। দিয়া হাঁটতে শিখেছে সবে। রিয়া স্কুলে যায়। ক্লাস টু তে পড়ে। ছাদে অনেক ফুলগাছের টব। সব কিছু ভাল করে দেখল ওরা। কিছু মাথায় এলো না কারো। সবার সঙ্গে কথা বলে শুধু একটা নতুন খবর পেল। মিহিরবাবুর মা বললেন ওনার আলমারির চাবিটাও সেদিন থেকে খোওয়া গেছে। উনি বিছানায় শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ঘুম এসে যেতে চাবিটা বিছানাতেই খবরের কাগজের ওপরে রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। উঠে থেকে আর চাবিটা দেখতে পাচ্ছেন না।
মিহির বাবু বললেন
- মা ওরকম প্রায়ই এটা সেটা হারিয়ে ফেলে। আসলে কোথাও নিশ্চয় যত্ন করে তুলে রেখেছে। এখন আর মনে পড়ছে না। এই ব্যাপার নিয়ে তোমাদের ভাবার কিছু নেই। দুদিন পরেই ও চাবি খুঁজে পাওয়া যাবে।
যাইহোক কুকুরের একটা ফটো নিয়ে ওরা বাড়ি ফিরে এলো।
৪
বাড়িতে এই নিয়ে অনেক আলোচনা চলল চার বন্ধুর মধ্যে। চাবি হারানোর সঙ্গে কুকুর হারানোর কোন সংযোগ খুঁজে বার করতে পারল না কেউই। তাই চাবি হারানোর ব্যাপারটা আপাততঃ গুরুত্ব না দিয়ে ককুর রহস্য ভেদ করাই প্রথম লক্ষ্য বলে ঠিক করল ওরা।
কেকা বলল
- আমরা তো আশেপাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি কেউ দেখেছে কিনা কুকুরটাকে।
- আশেপাশে তো অনেক বাড়ি। কটা বাড়িতে যাবি?
- অন্ততঃ ঐ ব্লকটার সব বাড়ি।
সেই মতো ওরা বেশ কয়েকটা বাড়িতে খোঁজ নিল। কেউ তেমন কিছু বলতে পারল না।
মন খারাপ করে সবাই এসে জড়ো হল পার্কে। কি করা যায় বুঝে উঠতে পারছে না। ফটোটা হাতে নিয়ে চারজনে আলোচনা করছে। হঠাৎ একটা মহিলা এসে বললেন,
- এই কুকুরটাকে কি তোমরা খুঁজছ? আমি এরকম একটা সাদা কুকুর দেখেছিলাম।
একটুকরো আশার আলো দেখে সবার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো
- কবে? কোথায়?
- দু-তিন দিন আগে। রাস্তার ধারে চুপ করে বসে ঝিমোচ্ছিল। মনে হল খুব শরীর খারাপ। আমি বাড়ি এনে জল দিলাম, খেতে দিলাম। খেতে চাইল না। ঝিম মেরে বসেছিল। পায়েও চোট ছিল। পা ফেলে হাঁটতে পারছিল না।
- তারপর কি করলেন?
- আমি বাড়িতেই রাখতে চেয়েছিলাম। কুকুরটাকে দেখে খুব মায়া হচ্ছিল। কিন্তু আমি তো আমার নিজের বাড়িতে থাকিনা। একজনদের বাড়িতে কাজ করি। সেখানেই থাকি। ঐ বাড়ির কেউ কুকুর পছন্দ করে না। কুকুরটা বাড়িতে এনেছি দেখে খুব রেগে গেল আমার ওপর। কোথাকার না কোথাকার কুকুর তাও অসুস্থ। কিছুতেই রাখতে দিল না। আমি আর কি করি। কুকুরটাকে আবার রাস্তায় ধারে ছেড়ে দিয়ে এলাম। কুকুরটা নিশ্চয় আর বেঁচে নেই।
মুখটা খুব দুঃখী করে দাঁড়িয়ে রইলেন মহিলাটি। কিংশুক বলল
- আপনি যদি ওকে কুকুরদের রেস্কিউ সেন্টারেও দিয়ে আসতেন।
- রেস্কিউ সেন্টার কি?
- এটা কুকুরদের অনাথ আশ্রমের মতো। যে সব কুকুরদের কোন মালিকানা নেই, হারিয়ে গেছে বা অসুস্থ তাই কেউ নিতে চায় না তাদেরকে আশ্রয় দেয় এরা। থাকতে দেয়, খেতে দেয়, ডাক্তার দেখায়। ওখান থেকে লোকজন বাড়িতে পোষার জন্যেও কুকুর নিয়ে যেতে পারে।
- এরকম আছে নাকি এখানে?
- হ্যাঁ দু-তিনটে আছে। আমি একবার একটা বাচ্চা কুকুরকেকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে দিয়ে এসেছিলাম ‘ডগ লাভারস’ নামের এক রেস্কিউ সেন্টারে।
কোজাগর বলল
- হয়তো তোর মতো কেউ সেভাবে কুকুরটাকে রাস্তা থেকে ধরে ওরকমই কোন এক রেস্কিউ সেন্টারে দিয়ে এসেছে।
- সেটাও হতে পারে অবশ্য।
- চল তাহলে, সেগুলো ঘুরে খোঁজ নিয়ে আসি।
অফিসে ফিরে গিয়ে ওরা চট করে কম্পিউটারে দেখে নিল এই শহরের মধ্যে কটা রেস্কিউ সেন্টার আছে। সব কটার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার টুকে নিল। তারপর একে একে প্রত্যেকটাকে ফোন লাগাল। জিগ্যেস করল দিন তিনেকের মধ্যে কোন সাদা স্পিৎজ কুকুর ওরা উদ্ধার করেছে কিনা বা কেউ দিয়ে গেছে কিনা। ‘লাভ এন্ড কেয়ার ফর এনিম্যালস’ নামে একটা সংস্থা জানাল তারা একটা সাদা কুকুর পেয়েছে। ঐ সংস্থারই এক কর্মী কুকুরটাকে রাস্তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে তুলে এনেছে। মাথায় আর পায়ে চোট ছিল। এখন ওষুধ দেওয়ার পর অনেকটাই ভাল আছে। যদিও এখনও পায়ে ব্যান্ডেজ করা আছে। তক্ষুনি সবাই সাইকেল নিয়ে ছুটলো।
কুকুরটাকে ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে মনে হল এটাই জিমি। ‘জিমি’ বলে ডাকতেই কুকুরটা তাকিয়ে দেখল। লেজও নেড়ে নিল একটু। তখন তারা একদম নিশ্চিত হল। মুখে হাসি ফুটে উঠল সবার। কাবেরী ফোন লাগাল মিহিরবাবুকে। সব কথা শুনে মিহিরবাবু বললেন
- তোমরা ওখানেই থাকো। আমি এক্ষুনি আসছি।
বাইক নিয়ে আধঘন্টার মধ্যেই এসে হাজির হলেন তিনি। ওনাকে দেখেই জিমি তার খোঁড়া পা নিয়েই ছুটতে ছুটতে এসে লাফাঝাঁপি শুরু করে দিল। মিহিরবাবু তাকে কোলে নিয়ে কেঁদেই ফেললেন।
কেকা বলল
- কুকুরদের প্রতি এমন ভালোবাসা পড়ে যায়। যেন ওরা বাড়িরই একজন সদস্য। যাক বাবা শেষ পর্যন্ত জিমিকে খুঁজে পাওয়া গেল।
মিহিরবাবু বললেন
- আমি তোমাদের আন্ডার এস্টিমেট করেছিলাম। তোমরা তো দেখছি খুব কাজের ছেলেমেয়ে। চলো আমার বাড়ি চলো। খাওয়া দাওয়া করে বাড়ি যাবে। তোমরা যে আমার কতো বড় উপকার করলে তা তোমরা জানো না।
৫
সবাই মিলে খুব হৈ হৈ করতে করতে চলল মিহিরবাবুর বাড়ি। কোজাগরের মুখে শুধু হাসি নেই।
- তোর মুখ ব্যাজার কেন রে। আমরা আমাদের ফার্স্ট প্রজেক্ট এত ভালোভাবে কমপ্লিট করলাম। তুই খুশি হলি না?
- কিন্তু কুকুরটার পা ভাঙ্গলো কি করে? সেটা তো বুঝতে পারছি না। আর চাবিটাই বা কোথায় গেল?
কাবেরী বলল
- চাবিটা অত ইম্পর্টেন্ট নয়। মিহিরবাবুর মার অনেক বয়স হয়েছে। নিশ্চয় কোথাও রেখেছেন যত্ন করে। তারপর ভুলে গেছেন। বা খাট থেকে পড়ে গেছে নিচে।
- তাহলে আমরা খাটের তলাটা সার্চ করে দেখলে পারি তো?
- দেখা বেশ অসুবিধেজনক। সেদিন আমি নিচু হয়ে খাটের তলাটা দেখেছিলাম। কতো জিনিস যে জড়ো করা আছে? অত কিছু বার করা বেশ ঝামেলা।
কিংশুক বলল
- ঝামেলা হলেও আজ আমরা একবার চেষ্টা করে দেখতেই পারি। ওখানে থাকব তো অনেকক্ষন। সময়ের অভাব হবে না।
কোজাগর আবার ফিরে এলো সেই পুরনো প্রশ্নে।
- কিন্তু কুকুরটার পা ভাঙ্গলো কি ভাবে? এমন নয় যে ও ছাদে উঠেছিল। ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেছে?
- শুধু শুধু পড়তে যাবে কেন? ছাদে তো পাঁচিল আছে।
মিহিরবাবুর বাড়িতে পৌঁছে কলিং বেল বাজানো হল। ওনার মা খুলে দিলেন। কুকুরকে ফিরে পেয়ে বাড়ির সবার আনন্দ আর ধরে না। মিহিরবাবু বললেন
- সুমিতা। এদেরকেও ধরে আনলাম। এরা না থাকলে জিমিকে আমরা খুঁজে পেতাম না। ‘ডিকিজ কিচেন’-এ ফোন করে আমাদের সবার জন্যে চাউমিন আর চিলি চিকেন অর্ডার করো। এরা খেয়ে তবে বাড়ি যাবে।
জিমি ঐ খোঁড়া ব্যান্ডেজ করা পা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে নামছে। সবার কাছে আদর খাচ্ছে। বাড়ি ফিরে এসে ওরও যে কত আনন্দ হচ্ছিল তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল।
কাবেরী মিহিরবাবুর মাকে বলল
- আচ্ছা দিদা আপনি সেই চাবীটা এখনো খুঁজে পাননি তাই না?
- না ওটা আর পাওয়া গেল না। কিন্তু জানো আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি খবরের কাগজের ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
কিংশুক বলল
- আপনার খাটের তলাটা আমরা একটু খুঁজে দেখতে পারি? যদি পড়ে গিয়ে থাকে।
- দেখো না। কিছু অসুবিধে নেই।
মিহিরবাবুর কাছ থেকে একটা টর্চ চেয়ে নিল ওরা। তারপর খাটের তলা থেকে সব টেনে বার করে টর্চ দিয়ে তন্নতন্ন করে দেখল ভেতরটা। না, চাবি খুঁজে পাওয়া গেলনা।
এমন সময় একটা কাক হঠাৎ জানলায় কার্নিসে বসে বেজায় কা কা করে চীৎকার আরম্ভ করল। আর সঙ্গে সঙ্গে জিমি কোথা থেকে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জানলায়। পারলে কাককে এক্ষুনি আক্রমন করে। আর কাকটা এই দেখে ভয় পেয়ে উড়ে গেল। জিমিও ছুট দিলো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে।
কোজাগর বলে উঠলো
- ঠিক ঠিক। আমি এই বার বুঝতে পেরেছি জিমির পা ভেঙ্গেছিল কি করে।
- কি করে?
সবাই অবাক হয়ে যায় ওর কথা শুনে।
- তোরা চল আমার সঙ্গে ছাদে।
চার বন্ধুতে হুড়মুড়িয়ে ছাদে ওঠে। দেখে ছাদের পাঁচিলের গায়ে সামনের দু’পা তুলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিমি চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কাকটা উল্টোদিকের বাড়ির ছাদে বসে সমানে কা কা চীৎকার করে চলেছে।
কোজাগর ওখানে দাঁড়িয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষন করল। তারপর চেঁচিয়ে উঠলো
- ঐ যে ঐ দেখ ঐ বাড়িটার পাশে যে পেয়ারা গাছটা আছে তার একটা ডালে কেমন চাবিটা ঝুলছে। কাক ব্যাটা সেদিন সবাই ঘুমাচ্ছে দেখে নিশ্চয় জানলা দিয়ে ঢুকে এসে চাবি নিয়ে পালাচ্ছিল। আর ওকে পিছু করতে গিয়ে জিমি ছাদে উঠে এসেছিল। তারপর কাক ধরার জন্যে ঝাঁপ মেরেছিল। তাতেই পড়ে গেছে। তারপর মাথায় চোট লাগায় বাড়িও চিনতে পারে নি বেচারা। রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে থাকবে। পায়ের ব্যাথাতেও কাবু হয়েছিল নিশ্চয়। এপাশে কাকের মুখ থেকেও চাবিটা ফসকে পেয়ারা গাছে পড়েছে। আর সেই ডালেই ঝুলে রয়েছে সেদিন থেকে।
চাবি ও কুকুর দুই-ই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হল। তারপর খাওয়া হল জমিয়ে। মনের আনন্দে ওরা ফিরে গেল যে যার বাড়ি।
একসপ্তাহ পরে ওদের অফিসের ঠিকানায় ‘কেকিকোকা, দ্য মুশকিল আসান’-এর নামে একটা পার্সেল এলো। খুলে দেখা গেল চারজনের জন্যে চারটে হাতঘড়ি পাঠিয়েছেন মিহিরবাবু। পারিশ্রমিক হিসেবে নয়। ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার উপহার হিসেবে। ওদের প্রথম রোজগার।
রুচিরা
বেইজিং, চীন
- বিস্তারিত
- লিখেছেন রুচিরা
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ম্যাজিক
রবিবারের সকাল। আজ ইস্কুল নেই। পড়া নেই। তবু রবিবারের সকালটাই তাতানের সবচেয়ে অপছন্দ। ঠিক নটা থেকে তার আঁকার ক্লাস। আঁকার মাস্টারমশাই জগদীশ খুব গম্ভীর আর রাগী মানুষ। একটুও হাসেন না। সবাইকে আঁকার ক্লাসে গিয়ে রোজ একটা কিছু দেওয়া হয়। আঁকতে তাতানের একটুও যে ইচ্ছে করে না এমন নয়। কিন্তু আজ অবধি তার একটা ছবিও ভাল হয়নি। একটা লাইনও সে সোজা করে টানতে পারেনি। একটা গোল জিনিসও গোল হয়নি, তা সেটা পেঁপেই হোক আর কুমড়োই হোক। রোজ সে কোন একটা গোলমাল করেই, আর শেষমেষ মাস্টারমশাই একটু ঠিকঠাক করে দেন। ওখানে সবাই ওর চেয়ে ভাল আঁকে। বড়রা তো বটেই, এমনকি ওর সমবয়সী বা ছোটরাও। তাই এই ইস্কুলে যেতে তার একেবারেই ভাল লাগে না। তবু যেতেই হবে। রবিবারে শরীরও খারাপ হয় না একদিন।
সকালে আটটার সময় তাতান শুনতে পেল যে মা তাকে ডাকছে। তখনও সে ইচ্ছে করেই সাড়া দিল না। শুয়ে শুয়েই কালো রঙের বড় দেওয়াল ঘড়িটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আঁকার ক্লাস তো বলতে গেলে পাশের বাড়িতেই । ওদের পাড়াতেই গুবলুদের বাড়িতে মাস্টারমশাই আসেন। একদল ছেলেমেয়ে চারদিকে সতরঞ্চি বিছিয়ে বসে। মাস্টারমশাই দুকাপ চা খান। বড়রা কেউ না কেউ এসে গল্প করে। তারপর সবার আঁকার খাতা দেখে নেন এক এক করে। দু আড়াই ঘন্টা এইভাবেই কেটে যায়। বিছানার পাশের জানালাটা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল তাতান। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন। পিঠে রোদ্দুর। ঝকঝক করছে একটা সকাল। তাতান বিছানার ওপরে সোজা উঠেও লেপটা জড়িয়ে বসে রইল। রোজ সকালে পাঁচটার সময় উঠতে হয় ইস্কুলে যাওয়ার জন্য। এমনকি শনিবারেও। পিন্টুদের তো কি সুন্দর শনিবারে হাফছুটি হয়। ওদের হয়না। সপ্তাহে রোজ ইস্কুল করে রবিবারে যে একটু ছুটি পাবে তা হওয়ার জো নেই।
বাবার গম্ভীর গলা শোনা গেল, ‘তাতান উঠে পড়ো এবার। মা আর কতক্ষন ধরে ডাকবে তোমায়।’
এবার না উঠে উপায় নেই। তাও সে একটু করুন সুরে আবদার করল, ‘বাবা, আজকে আঁকার ইস্কুলে না গেলে হবে? একদম ইচ্ছে করছে না।’
‘কেন? সে তো তোমার প্রত্যেক সপ্তাহেই ইচ্ছে করে না।’
‘মাস্টারমশাইকে খুব রাগী মনে হয় যে’
‘তোমার মাস্টারমশাইকে আমি চিনি। খুব ভাল লোক আর মোটেও রাগী নয়।’
আসল কারনটা যে বাবাকে বলা যাবে না। তার ওপর সকাল সাড়ে নটা থেকে টিভিতে মিকি মাউস আছে। কালেভদ্রে একবার ঐ কার্টুনটা দেখা হয়। মামার বাড়ী গেলে বা আঁকার ইস্কুল ছুটি থাকলে। প্রত্যেক রবিবার সকালে আঁকার ক্লাসে বসে ঐ কথাটাই বারবার মনে পড়ে তাতানের। আজও সেই দুঃখের কথা ভেবেই পা দিল মাটিতে। লাল রঙের মেঝেটাও বেশ কনকনে ঠান্ডা। সেই ঠান্ডা তাতানের হাফপ্যান্টের বাইরের পা দুটোকে কাঁপিয়ে দিল।
২
কদিন আগে বায়না করে একটা টিয়াপাখি কিনেছে তাতান। সেটা রাখা থাকে বারান্দায়। বাড়ির বাইরের বারান্দা নয়, ভেতরেই। তাতান পায়ে পায়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘কিরে কিছু শিখেছিস?’
পাখিটা বড় দুষ্টু। সবাই বলত টিয়াপাখি নাকি মানুষের মত কথা বলতে পারে। কিন্তু কোথায় কি? সে কত চেষ্টাই না করেছে। কিন্তু টিয়ার মুখে কোন কথা নেই। সপ্তাহ দুয়েক পরে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল সে। আজকাল রোজ সকালে উঠে সে শুধু জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে টিয়া কিছু শিখেছিস?’ টিয়া কিছুই বলে না। অথচ আজ ওকে অবাক করে দিয়ে টিয়া বলে উঠল, ‘হয় হয়, হবে হবে হবে।’ মানুষের মত সে আওয়াজ নয়, বরং একটু খনখনে। তবে পরিষ্কার শুনতে পেল তাতান। কোন ভুল নেই তাতে।
‘হয় হয় আবার কি রে? হবে মানে কি হবে?’ জিজ্ঞেস করার পরেই তাতানের মনে হল এটা একটু বোকা বোকা হয়ে যাচ্ছে। পাখি তো শুনে শুনে শেখে। সে কি আর মানুষের মত কথা বুঝতে পারে? এর পরেও তাকে অবাক করে দিয়ে টিয়া বলল, ‘তোমার হবে’। তাতান হাতে ব্রাশটা নিয়ে একটু সন্দেহের সঙ্গে পাখির দিকে তাকাল।
পাখিটাও মিটিমিটি ওকে দেখছে। তীক্ষ সে চাহনি। তাতান ভয়ে ভয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কি হবে?’ পাখিটা এবার আর জবাব দিল না। নাহ, কিছু একটা ভুল হয়ে থাকবে। আর বোঝার চেষ্টা না করে কোনরকমে চোখে মুখ একটু জল দিয়ে ধুয়ে সে রান্নাঘরে ছুট দিল মার কাছে। লুচিভাজা হচ্ছে আজ। গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
‘কি রে কি করে মুখ ধুয়েছিস তুই? তোর চোখের কোনে যে পিচুটি লেগে রয়েছে এখনো। রোজ এতবার করে বলি, তাও শুনিস না?’
‘মা, জানো পাখিটা না আজকে কথা বলছিল মনে হল...’
‘কোথায় আমরা তো কিছু বলতে শুনি না। তুই খামখা বায়না করে পাখিটা কিনলি।’ বলতে বলতে তিনি তাতানের চোখের কোনদুটো পরিষ্কার করে দিলেন। ‘নে খেয়ে নে, আর দেরী করিস নি। আঁকার ইস্কুলে চলে যা। আজকে থেকে তো আবার তোদের নতুন মাস্টারমশাই আসবেন।’
তাতানের আরেকটু তর্ক করার ইচ্ছে ছিল যে পাখিটা সত্যিই কথা বলেছে কিন্তু মাস্টারমশাই বদলে গেছেন এই খবরটা তো একেবারেই নতুন। সে রীতিমত চমকে গিয়ে বলল, ‘তুমি কি করে জানলে?’
৩
গুবলুদের বাড়ি পৌঁছে একটু অবাকই হল তাতান। আজ প্রায় অনেকেই আসেনি। আর অনেকটা তার দাদার মত একটা অল্পবয়সী ছেলেকে ঘিয়ে সবাই বসে আছে আর হেসে হেসে গল্প করছে। তাতান ওর মত একটা জায়গায় একটু আলাদা হয়ে বসে কাঁধে ঝোলান ব্যাগ থেকে বোর্ড, রঙ, তুলি, প্যালেট এইসব বের করে রাখল। কে জানে আজকের নতুন মাস্টারমশাই কখন আসবে। আবার কি আঁকতে দেবে। প্রথম দিনেই প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে না তো?
‘তুমি এরকম দূরে দূরে বসে আছো কেন?’ ছেলেটা ওকে ডাকল। তাতান কিছু বলল না। চুপ করে বসে রইল। সবার সামনে বলবেই বা কি করে যে ও ভাল আঁকতে পারে না। কিন্তু ছেলেটাও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সে বলল, ‘আরে, এসই না এখানে। আমরা কি সুন্দর গল্প করছি।’
‘মাস্টারমশাই কখন আসবেন?’ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল তাতান। জগদীশ স্যার তো কোনদিন হেসে কথাই বলতেন না। কেউ হাসাহাসি করলেও রাগ করতেন। আর এ কে যে সব্বার সঙ্গে বসে গল্প করছে?
‘মাস্টারমশাই? ও না, মাস্টারমশাই তো আসবেন না আজকে।’
‘তাহলে আঁকা শেখাবে কে?’
‘ও তুমি এমনিই শিখে যাবে। কোথাও ভুলটুল হলে আমি না হয় দেখিয়ে দেব এখন।’
তাতান আরো অবাক, ‘ও তুমিই বুঝি আমাদের নতুন মাস্টারমশাই?’ মা বার বার বলে দিয়েছে মাস্টারমশাইকে তুমি করে না বলতে, কিন্তু ছেলেটাকে কিছুতেই আপনি পারছে না সে।
‘না না, আমাকে কিন্তু তোমাদের মাস্টারমশাই বলার দরকার নেই। আমাকে ভুলুদা বলেই ডেকো। এখন থেকে আমরা এখানে রবিবার রবিবার করে সবাই মিলে আঁকব, তোমরাও আঁকবে, আমিও আঁকব। তা তোমার নাম কি?’
‘আমার ভাল নাম অর্কপ্রভ, আর ডাকনাম তাতান।’
‘বাহ, বেশ সুন্দর নাম। ঠিক আছে। দেখি আজকে কি আঁকা যায়।’ এই বলে সে তার ঝোলা থেকে একটা মোটা খাতা বের করে আনল। সঙ্গে কিছু পেনসিল, আর কয়লার টুকরোর মত কিছু। কিন্তু কোন রঙ নেই। এমনকি একটা প্যাস্টেলও। অবাক হয়েই তাতান জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি রঙ কর না বুঝি?’
‘রঙ, হ্যাঁ করি তো। কিন্তু এটা খালি স্কেচের খাতা। কোথাও গেলে নিয়ে যেতে সুবিধে হয়। আর রঙ লাগলে না হয় তোমাদের কাছ থেকে কিছু নিয়ে নেব, কি দেবে তো?’ হেসে ফেলল সবাই। তাতান বলল, ‘আর আমরা কি আঁকব আজকে?’
‘তোমরা যা খুশি তাই আঁকবে। তুমিই বল না তোমার কি আঁকতে ইচ্ছে করছে?’
সবাই কিছু না কিছু বলল। কেউ বটগাছ, কেউ কলাগাছ, কেউ পাহাড় আঁকতে বসে গেল। বাকী রয়ে গেল শুধু তাতান।
‘কি তাতান, তুমি কি আঁকবে ঠিক করলে?’
তাতান আমতা আমতা করে বলল, ‘আমাকে বলে না দিলে যে আমি কিছুই আঁকতে পারি না। আর যাই আঁকতে যাই ভুল হয়ে যায়। শেষে মাষ্টারমশাই একটু ঠিক করে দেন।’
‘হুঁ, তোমার তো দেখছি গভীর সমস্যা’। ভুলু গালে হাত দিয়ে খানিক ভাবল। ‘আচ্ছা, তোমার কি মন থেকে কিছুই আঁকতে ইচ্ছে করছে না?’
মাথা নাড়ল তাতান।
ভুলু আরও খানিকক্ষন কি সব ভেবে তাকে বলল, ‘বেশ। তোমাকে কিছু আঁকতে হবে না। আজকে বরং আমার আঁকা দেখ, কেমন? তোমাকে একটা ধাঁধা দিচ্ছি। কোন তাড়া নেই। এক সপ্তাহ ভেবে পরের দিন আমাকে জানিও। একটা জিনিস তুমি জোর করে ধরে বেঁধে রেখেছ। তাই আঁকতে পারছ না। কেমন? যেই সেটা ছেড়ে দেবে, অমনি দেখবে তরতর করে আঁকতে পারছ।’
৪
রবিবার সন্ধ্যায় আড্ডায় বেরোনর সময় প্রনবেশ লক্ষ্য করলেন তাতান ছবি আঁকছে। দৃশ্যটা একটু অদ্ভুত; কারন তিনি কোনদিনই ছেলেকে আগে ছবি আঁকতে দেখেননি। তাঁর ধারনা ছিল তাতান আঁকতে ঠিক পারেনা। ভয় পায়। অথচ আজ সে অবলীলাক্রমে এঁকে চলেছে। একসময় সে ঘাড় ঘুরিয়ে বায়নার সুরে বলল, ‘আসার সময় একটা আঁকার খাতা আনবে বাবা?’
প্রনবেশ হকচকিয়ে বললেন বললেন, ‘হ্যাঁ, আনব। কেন আনব না।’ যে ছেলে আঁকার ইস্কুলে যাওয়ার নামে ভয় পেত তাকে প্রান খুলে আঁকতে দেখে বড় তৃপ্তি পেলেন তিনি।
তাতানের মনে আজ ফূর্তির সীমা নেই। অন্যান্য রবিবারগুলোয় ঘন্টা দুয়েক ক্লাস হলেই উঠি উঠি করত মনটা। আজকে বাড়ি ঢুকে দেওয়াল ঘড়িটায় দেখল সাড়ে বারটা বেজে গেছে। ভুলুদা যেন ম্যাজিক জানে। ওরা সবাই যা বলছে তাই এঁকে দিচ্ছিল। নাহ, আঁকাটা শিখতেই হবে। এই ভেবে মহানন্দে তাতান স্নান করতে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে মাথায় খেলছিল ধাঁধাটাও।
বারান্দায় টিয়াপাখিটা বসে বসে ছোলা খাচ্ছিল। অন্য সময় হলে হয়তো তাতান ওকে কিছু বলত। আজকে আর সেদিকে হুঁশ নেই। কিন্তু মাথায় একমগ ঠান্ডা জল ঢালার সাথে সাথেই যেন পট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আরে, তাই তো। হ্যাঁ, এটাই তো। নিশ্চয়ই। হতেই হবে। কোন রকমে গায়ের জল মুছে ছুটতে ছুটতে হাজির হল পাখির খাঁচার কাছে। আর চুপিচুপি একটা টুলে উঠে খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, ‘পালা।’ ব্যস আর পায় কে, পাখিও ফুড়ুত হাওয়া। তারপর থেকে পরপর আটখানা ছবি এঁকে ফেলেছে তাতান। আজ আর তাকে পায় কে।
অভ্র পাল
কারডিফ, ওয়েলস, যুক্ত্ররাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অভ্র পাল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প