যদিও নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার আসা যাওয়া শুরু হয়ে গেছে, মাঝেমধ্যে এক পশলা -দু পশলা দুষ্টু বৃষ্টি হুড়মুড়িয়ে এসে পথচলতি মানুষের গা ভিজিয়ে দিচ্ছে, সকালের রোদ্দুর একটু বেশি ওম ধরানো সোনালি হয়ে গেছে, দিন লম্বায় ছোট হচ্ছে একটু একটু , শেষ বিকেলের নীল-কমলা মাখা আলো দেখে কেন কে জানে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে — মানে শরৎকালের সব লক্ষণই বেশ দেখা যাচ্ছে চারদিকে, তবুও এইবছর পুজো বেশ দেরীতেই আসছে। অক্টোবরের শেষে, আজ থেকে আরও প্রায় মাসখানেক পরে। তাতে অবশ্য একটা ব্যাপার ভালো হল — এই পুজো আসছে, পুজো আসছে ভাবটা য়ারও বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকবে। কারণ কে না জানে, পুজো এসে গেলেই হুশ করে শেষও হয়ে যায়। তাই আনন্দের আমেজ, আশার আমেজ, পুজোর আসার আমেজ যত বেশিদিন থাকে , ততই ভালো।
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর। আজ ইচ্ছামতী পনেরো বছর সম্পূর্ণ করল। সেই ২০০৮ সালে যখন প্রথম ইচ্ছামতী আর চাঁদের বুড়ি হাত ধরাধরি করে পথ চলতে শুরু করেছিল, তখন কি ভেবেছিল যে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে পনেরোটা বছর পার করে দেবে? সত্যি কথা বলতে গেলে, একেবারেই ভাবেনি। নিতান্তই নতুন এক প্রযুক্তি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একটা ছোট্ট পরিকল্পনা শুধুমাত্র বীজ থেকে চারাগাছ হয়েই বেড়ে উঠল না, তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে এতই বড় হয়ে উঠেছে যে আজ তাকে সামলাতে চাঁদের বুড়ি হিমশিম খায়। মাত্র আট পাতার প্রথম সংখ্যার ইচ্ছামতীকে ছাব্বিশটি আলাদা বিভাগে বেড়ে উঠতে বছরের পর বছর সাহায্য করেছেন ইচ্ছামতীর লেখক, শিল্পী ও সহযোগী বন্ধুরা। ইচ্ছামতীকে ভালোবেসে তার খবর চেনা-অচেনা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের কত বন্ধু, কত শুভানুধ্যায়ী। আমাদের এই সমস্ত বন্ধুদের জন্য, ইচ্ছামতী আর চাঁদের বুড়ির তরফ থেকে রইল উষ্ণ শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। আর আমাদের ছোট্ট বন্ধুদের জন্য ইচ্ছামতীর তরফ থেকে রইল আলোমাখা ভালোবাসা। ছোট থেকে বড় — আমাদের এত এত বন্ধুদের সঙ্গে পেয়েছি বলেই আমাদের এই পনেরো বছরের যাত্রাপথ এত রঙিন, এত গল্পে ঠাসা, এত উত্তেজনা ভরা।
পুজোর সময়ে চাঁদের বুড়ির চিঠি থাকবে, আর সঙ্গে একটা পুজো পোস্টার থাকবে না তা কি হয়? এই বছরেও, পুজো উপলক্ষ্যে ইচ্ছামতীর বন্ধুদের জন্য আঁকা হয়েছে এক বিশেষ পোস্টার। এই ছবিতে দেখছি, দুগ্গাদিদির কাছে বসে গল্প শুনছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। দুগ্গাদিদির হাতে কি ওটা ট্যাব? তাহলে দুগ্গাদিদি কি সবাইকে ইচ্ছামতীর থেকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছে? না কি ইচ্ছামতী আর চাঁদের বুড়ির গল্প বলছে? তার উত্তর জানে দুগ্গাদিদি আর ইচ্ছামতী। গত বছর দুয়েকে, বিশেষ করে অতিমারি পেরোনো সময়ে, আমাদের কাছে ইচ্ছামতীর নবীন পাঠক তরফ থেকে স্কুল বা কলেজপাঠ্যের প্রশ্ন বা বিষয়ের উত্তর চেয়ে বহু মেসেজ এসেছে। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, বাংলা ভাষায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে ইচ্ছামতীর কাছে সাহায্য চাইছে ছেলেমেয়েরা। এই সাহায্য করার ক্ষমতা ইচ্ছামতীর মত ছোট্ট পত্রিকার নেই। কিন্তু আমরা জানি, লেখাপড়া আমাদের ভাবনা-চিন্তা-কাজের স্বাধীনতা দেয়, আমরা ঠিক-ভুলের বিচার করতে শিখি, দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হই। তাই আমাদের পোস্টারে আবার ফিরে এল পড়াশোনার, জ্ঞান আহরণের গল্প। অন্যান্যবারের মতই, ইচ্ছামতীকে এই বিশেষ পোস্টারটি এঁকে দিয়েছেন শিল্পী অনুভব সোম। তাঁকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সঙ্গে সারা বছর ধরে ইচ্ছামতীকে নানা ধরনের ছবিতে সাজিয়ে তোলার জন্য শিল্পী পার্থ মুখার্জি, শিল্পী ঘোষ, অঙ্কুশ চক্রবর্তী, আবির এবং মিতিলকে ধন্যবাদ জানাই।
ছবি আঁকার কথায় মনে হল, গত কয়েক মাসে ইচ্ছামতীতে অনেকগুলি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর সাহায্যে তৈরি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন বদলে যাওয়া প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে ইচ্ছামতীও কিন্তু কম বদল দেখল না! আমাদের প্রথম সংখ্যায় সমস্ত ছবি হাতে এঁকে ছবি তুলে বা স্ক্যান করে ব্যবহার করা হয়েছিল। তারপরে এক সময়ে হাতে আঁকা এবং কম্পিউটারে আঁকা ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা এমন ছবিও ব্যবহার করছি যেখানে একজন মানুষ শিল্পীর কোনো ভূমিকাই নেই। যন্ত্রকে সঠিভাবে নির্দেশ দিলেই সে আমার মনোমত ছবি মূহুর্তে বানিয়ে দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজকাল গল্প বা কবিতাও লিখে দিচ্ছে, লিখে দিচ্ছে স্কুল পাঠ্যের প্রশ্নের উত্তর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার করতে পারা অসংখ্য কাজের মধ্যে এগুলি মাত্র দুয়েকটি কাজ। মানুষের বদলে এমন সমস্ত কাজ যন্ত্রই যদি করে দেয়, তাহলে তো অনেক মানুষের কাজ চলে যেতে পারে। তাহলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক সময়ে যন্ত্র মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নামবে কি? ভবিষ্যৎ আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
এইসব আলোচনার মাঝে, ইচ্ছামতী আমাকে বলল, "চন্দ্রযান-৩ তো চাঁদের পিঠে নেমে গেল; সেখান থেকে চাঁদের ছবি তুলে পাঠাল। এইবারে কেউ আর 'চাঁদের বুড়ি'-র কথা বিশ্বাস করবে না। তুমি চরকায় রঙিন সুতো কেটে রং-বেরঙের গল্প বোনো, এমন কথা আমার বন্ধুরা কি আর বিশ্বাস করবে?" আমি ভেবে দেখলাম, এমন কথা ইচ্ছামতীর বন্ধুরা বিশ্বাস না করুক, কল্পনা করতে তো বাধা নেই! তবে, এই বিষয়ে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা কী ভাবছে জানতে পারলে বেশ হয়।
এইবারে, আপাতত এটুকুই। আগামী দিনগুলি আমাদের প্রত্যেকের জন্য নিয়ে আসুক আনন্দ, শান্তি, সুস্বাস্থ্য। উৎসবের মরসুমে সবার দিন ভালো কাটুক, আনন্দে কাটুক। ইচ্ছামতীর প্রত্যেক বন্ধুর জন্য রইল শিউলির সুগন্ধ আর শরতের সোনালি রোদের পরশ। সবাই খুব ভালো থেকো।
৯ আশ্বিন ১৪৩০
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ছবিঃ অনুভব সোম, মিতিল