আর কয়েকদিন পরেই পুজো। মা দুর্গা সপরিবারে বাপের বাড়ি এলেন বলে! এদিকে আমাদের মাথার ওপর থেকে দুর্যোগের ছায়া যেন আর কাটছেই না। একের পর এক নিম্নচাপ, দিনের পরদিন জোরালো ঝড় বৃষ্টিতে সবাই জেরবার হয়ে আছি। তার সঙ্গে গতবছরের মত এবছরেও রয়ে গেছে করোনাভাইরাসের ভয়। একটু অসতর্ক হলেই যে বাসা বেঁধে ফেলতে পারে যেকোনোও মানুষের শরীরে। তবুও, উৎসবের মরসুম যখন বছর ঘুরে ফিরে আসে, তখন সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে, কয়েকদিনের জন্য আবার হেসে উঠতে চায় মানুষ। তাই নানারকমের অসুবিধার মধ্যেও, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠছে মন্ডপ, পটুয়াপাড়ায় ধীরে ধীরে সেজে উঠছেন সপরিবারে মা দুর্গা। কেউ কেউ পুজোর জন্য কিনে নিচ্ছে নতুন জামা। যারা নিজেরা কিনতে পারছেন না, তাঁদের অনেকের কাছে পুজোর কাপড় উপহার দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী দলের মানুষেরা। উৎসবের কয়টা দিন, সবার মুখে হাসি থাকুক, সবার ঘরে আলো থাকুক, সবার পেটে খাবার থাকুক— এমন আশাই তো রাখতে চাই আমরা, তাই না?
গত দেড় বছরে, যে রসদের সবথেকে বেশি অভাব বোধ করেছে সারা পৃথিবীর শিশুরা, তা হল শিক্ষা। তোমার আমার মত যাদের কাছে ইন্টারনেট আছে, অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ আছে, এমন সব ছেলেমেয়েদের কথা বলছি না। আমি সেই সব ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কথা বলছি — যারা কম্পিউটারে বা স্মার্টফোনে 'ইচ্ছামতী' পড়া বা খুলে দেখা তো দূরের কথা, নিজের স্কুলের প্রতিদিনের ক্লাস করারই সুযোগ পায় নি গত দেড় বছরে! যার কাছে বই-খাতা কেনার টাকা নেই, সামনে বসে পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার মত শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই। এদের মধ্যে অনেকেই স্কুলে না যেতে যেতে চেনা অক্ষর ভুলে গেছে, নামতা ভুলে গেছে। স্কুল বন্ধ বলে অনেকেই বাধ্য হয়েছে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে কাজ শুরু করতে, পরিণত হয়েছে শিশু শ্রমিকে। অনেকে হয়ত আর নতুন করে পড়াশোনা শুরুই করতে পারবে না।
এই দুঃখ, এই কষ্ট শুধু আমাদের এই সমস্ত ছোট্ট বন্ধুদের নয়, এ আমাদের সবার দুঃখ।
মানুষের জীবনে লেখাপড়া শুধুই পরীক্ষা দেওয়া, এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে ওঠা বা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য জরুরী নয়। 'জ্ঞান' মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, ঠিক ভুল বুঝতে শেখায়, সত্য আর মিথ্যার ফারাক করতে সাহায্য করে, নিজের এবং অন্যদের জন্য লড়াই করতে শেখায় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখায়। যে মানুষের প্রাথমিক পড়াশোনা থাকে, তাকে ঠকানো বা মিথ্যে বোঝানো সহজ নয়। পেটের ভাত,পরনের কাপড় আর মাথার ছাদ জুটে গেলেও, বিদ্যা বা জ্ঞান আহরণের পথ সবার সহজে মেলে না। এই শারদ উৎসবে, তাই মা দুর্গার কাছ থেকে আমরা সবার জন্য বিদ্যার আশীর্বাদ চাইছি, চাইছি সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ। আমাদের এই ভাবনাকেই রঙে-রেখায় সাজিয়ে তুলেছেন ইচ্ছামতীর বহুদিনের পুরনো বন্ধু শিল্পী অনুভব সোম।
আজ আমাদের কাছে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ ২৭শে সেপ্টেম্বর, ইচ্ছামতীর জন্মদিন। ইচ্ছামতীর তেরো বছর পূর্ণ করল, চৌদ্দোয় পা দিল । আরও একটু বড় হল, ঠিক তোমার মত। ইংরেজিতে তেরোর নাম 'থার্টিন' আর এই বয়সের সংখ্যায় 'টিন' ঢুকে যাওয়া মানেই কাগজে কলমে 'টিন এজ'-এ ঢুকে যাওয়া, মানে প্রায় বড়ই হয়ে যাওয়া। ইচ্ছামতীর এই এত্তটা বড় হয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে যাঁদের সক্রিয় ভূমিকা, আমাদের সেই সমস্ত লেখক- শিল্পী-সহযোহী-পাঠক বন্ধুদের, আমাদের প্রত্যেক শুভানুধ্যায়ীকে আজকের দিনে অকুন্ঠ ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই। আর আমাদের স-অ-ব ছোট ছোট বন্ধুদের জানাই ভালোবাসা। তোমাদের ভালোবাসায় ইচ্ছামতী ভরে উঠেছে। আগামি দিনগুলিতেও আমাদের সবার বন্ধুত্ব অটুট থাকবে, এমনই চাই আমি, চায় ইচ্ছামতী।
ইচ্ছামতীর এই মাসের কিস্তিটা, বোধহয় উৎসবের আমেজ আর জন্মদিনের আনন্দের কথা মনে রেখেই, গল্প, ছড়া, পুরাণকথার সঙ্গে সঙ্গে নানা স্বাদের নিবন্ধ নিয়ে হাজির হল। জানা-অজানা বিভাগে ফসিল খোঁজার গপ্পো, এক্কা-দোক্কা বিভাগে প্যারালিম্পিক্স আর বিশেষ রচনা বিভাগে 'অটিজ্ম্' নিয়ে প্রকাশিত লেখাগুলি পড়ে ভুলো না যেন। 'মনের মানুষ' বিভাগে রয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; আর সত্যজিৎ রায়কে মনে রেখে 'ছবির খবর'-এ আবার হাজির গুপী-বাঘা। রয়েছে ছোটদের জন্য দারুণ এক অনুবাদ নাটক। সঙ্গে রয়েছে 'দেশে-বিদেশে' বিভাগে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণে আগ্নেয়গিরির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতার গল্প। লেখাগুলির সঙ্গত দিতে রয়েছে দুর্দান্ত সব ফটোগ্রাফ, এবং পার্থ মুখার্জি, শিল্পী ঘোষ, আবির ও মিতিল-এর আঁকা মনভোলানো ছবি। সব মিলিয়ে পুজোর ছুটিতে তোমাকে যখন খুশি, যেখানে খুশি সঙ্গ দিতে তৈরি ইচ্ছামতী।
শিউলিফুলের সুবাস, ঝকঝকে নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মত মেঘ, সোনা ঝলমল রোদ, ঢাকের বাদ্যি, ধূপধুনোর গন্ধ, প্রদীপের আলো, খিচুড়িভোগের সুঘ্রাণ, নতুন জামার পরশ নিয়ে— পরিবারের সবার সঙ্গে, তোমার পুজো আনন্দে এবং সুস্থভাবে কাটুক। সবসময়ে ভালো থেকো।
১০ আশ্বিন, ১৪২৮
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ছবিঃ অনুভব সোম, মিতিল