দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেল। রাত পোহালে ষষ্ঠী। কাগজে-কলমে স্কুলে বা অফিসে ছুটিও পড়ে যাবে আগামি কয়েকদিনের জন্য। তবে এইবছর দুর্গপুজো তো একেবারেই আলাদা। ঝকঝকে নীল আকাশ আছে, আকাশে পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘ আছে, মাঝে মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আছে, বাগানে শিউলির আমেজ, পথের ধারে হঠাৎ ছাতিমের সুবাস আছে; রাস্তা জুড়ে আলো আছে, ছোট করে হলেও পাড়ার মন্ডপ আছে, টিভিতে নতুন কেনাকাটার বিজ্ঞাপন আছে, পুজোয় নতুন জামা কেনাও আছে। তবুও , সব কিছু ছাপিয়ে যেটা রয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই যাচ্ছে না, সেটা হল একটা অন্যরকমের মনখারাপ। কারণ, সবসময়েই মনে রেখে চলতে হচ্ছে, যে আমরা অতিমারিকে, করোনাভাইরাসকে ভুলে যেতে চাইলেও, সে কিন্তু আমাদের ভুলেও যায়নি, ছেড়েও যায়নি। তাই চাইলেই মাস্ক ছেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করা যাবেনা। দলবেঁধে ঠাকুর দেখায় নিষেধ জারি হয়েছে। মন্ডপে ভীড় করা যাবে না। মোট কথা,খুব হিসেব করে আনন্দ করতে হবে। কিন্তু হিসেব করে আনন্দ করতে কি আর ভালো লাগে?
এই বছরটা ভারী অন্যরকম। বছরের অর্ধেকটা কেটে গেল ঘরে বন্দী হয়ে। আমাদের জীবনে ঢুকে গেল নতুন নতুন শক্ত যত শব্দ - অতিমারি বা প্যান্ডেমিক, লকডাউন, কোয়ারান্টাইন, কন্টেইনমেন্ট জোন, পিপিই কিট, ভ্যাক্সিন, স্যানিটাইজার, হ্যান্ড ওয়াশ, ফেস মাস্ক, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ইত্যাদি; মেনে চলা অভ্যাস করতে হল একগাদা নতুন নিয়ম কানুন, বদলে গেল নিত্যদিনের জীবন। প্রথম কিছুদিনের অসুবিধার পরে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম অনলাইনে সমস্ত কাজ করতে — সেটা স্কুলের পড়াই হোক, অফিসের কাজই হোক, জিনিষ কেনাকাটাই হোক, আর বন্ধুদের সঙ্গে গপ্পো করাই হোক। অনলাইনেই শিখে ফেললাম গান, ছবি আঁকা, হাতের কাজ। মোট কথা, ইন্টারনেট কানেকশন আর স্মার্টফোনের সাহায্যে আমরা আমাদের বেশিরভাগ অভ্যাসগুলোই বজায় রাখতে শিখে গেলাম।
কিন্তু এই যে'আমরা' বলে লিখছি, এই 'আমরা' কারা? কারা অনলাইন সুযোগ সুবিধার সাহায্যে নিজেদের কাজকর্ম চালাতে পারল বা পারলেন ? এই 'আমরা' হলাম এমন সব মানুষেরা, যাদের নিজেদের কাজ করার জন্য, বা দায়িত্ব পালন করার জন্য বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার পড়ল না, যারা ইন্টারনেটের সাহায্যেই নিজেদের কাজ করে নিতে পারল এবং পারলেন । যেমন ছাত্র-ছাত্রীরা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা,বিভিন্ন অন্য পেশার মানুষেরা যাঁরা অফিসেও কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের সাহায্যেই কাজ করেন। কিন্তু যাঁরা আমাদের মত কাজ করেন না, তাঁরা কী করলেন? চিকিৎসক, নার্স, গবেষক, বৈজ্ঞানিক, ব্যাংক কর্মীরা, বিভিন্ন জরুরী পরিষেবা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা, পুলিস ও সেনাবাহিনীর কর্মীরা, বিভিন্ন যানবাহনের চালকেরা, অনলাইনে কেনা জিনিষ হোম ডেলিভারি করে যাঁরা — এমন অনেক অনেক মানুষকে নিয়মিত কাজে বেরোতে হল। ট্রেন চলা শুরু হয়নি, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাকম, তবুও তাঁরা সবাই নিয়ম করে কাজে গেছেন, আমাদের মত সাধারণ মানুষদের সবরকমের সুযোগ সুবিধার কথা মনে রেখে, করোনাভাইরাসকে ভয় না পেয়ে কাজ করতে বেরোতে হয়েছে তাঁদের। বেশিরভাগ সময়েই তাঁদের এই সমস্ত কাজের মূল অস্ত্র রূপে কাজ করে ইন্টারনেট-ই।
কিন্তু এই আমাদের সবাইকে বাদ দিয়েও ভারতবর্ষ জুড়ে রয়েছেন এমন কোটি কোটি মানুষ, যাঁদের এমন কোনো বাঁধা কিংবা স্থায়ী কাজ নেই। তাঁরা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যান খিদের তাড়নায়, কাজের খোঁজে। কত রকমের যে কাজ — কেউ ইঁটভাটার কাজ করত যান, কেউ কুলির কাজ, কেউ যান ছোট ছোট কল-কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতে,কেউ যান অন্যের ক্ষেতে চাষ করে, ফসল কাটতে । এই যে আমাদের এত বড় দেশ, এই দেশটাকে যদি একটা বিরাট যন্ত্র ভাবা যায়, তাহলে এঁরা প্রত্যেকে হলেন সেই বিরাট যন্ত্রের ছোট্ট ছোট্ট সব কল-কব্জা, যাঁদের ছাড়া এই দেশ অচল হয়ে যাবে। এঁরা প্রত্যেকে বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট কাজ করে আমাদের জীবন সহজ রাখতে সাহায্য করেন, যেগুলির সম্পর্কে আমাদের জানাই নেই। লকডাউনের শুরুর দিকে, যে সব নতুন শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত হচ্ছিলাম, তেমনই একটি শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছিল এইসমস্ত মানুষের জন্য -'মাইগ্রান্ট' বা 'পরিযায়ী'। গত ছয়-সাত মাসে, সবথেকে কষ্টে জীবনযাপন করেছেন এই সমস্ত মানুষেরা। রোজগেরে মানুষেরা রোজগার হারিয়েছেন। ইচ্ছামতীর মত, তোমার মত ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা আর ছেলেরা হারিয়েছে তাদের পড়াশোনার সুযোগ। হঠাৎ রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে, ভাড়া দিতে না পারায় বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছে, দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে শেষে সবাই ফিরে যেতে চেয়েছেন ভারতের দূর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা গ্রামের বাড়িতে, বা ছোট্ট অজানা শহরে, যেখানে রয়েছেন তাঁদের পরিবার, যেখানে গেলে মিলবে খাবার আর শান্তি।
ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের কাঁধে তুলে, আদরের পোষ্যকে কোলে নিয়ে, সামান্য কিছু পুঁজি একটা ব্যাগ বা দুটো পোঁটলাতে বেঁধে, হাঁটতে শুরু করেছেন হাজার হাজার কিলোমিটার — জাতীয় সড়ক ধরে, রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে, খাবার আর জল না পেয়ে... আমরা ঘরে বসে টিভিতে ছবি দেখেছি সেই হাঁটতে থাকা পরিবারগুলির; খবর শুনেছি কেমন ভাবে তেলেঙ্গানার লংকা ক্ষেতে কাজ করে রোজগার করতে যাওয়া বারো বছরের মেয়ে জামলো মাকদম, দেড়শো কিলোমিটার হেঁটে ছত্তিসগড়ে তার বাড়ি ফিরতে গিয়ে চিরঘুমে লুটিয়ে পড়েছে পথের ধারে; আবার অন্যদিকে অবাক হয়েছি জেনে, যে নিজের অসুস্থ বাবাকে হরিয়ানার গুরুগ্রাম থেকে বিহারের দ্বারভাঙায় ফিরিয়ে এনেছে পনেরো বছরের জ্যোতি কুমারি, বারোশো কিলোমিটার পথ পার করেছে সে একটা সাইকেলের ভরসায়। আর বিহারের আরারিয়ার এগারো বছরের তবারক — সে তার বাবা আর মাকে সাইকেল ভ্যানে বসিয়ে, ছয়শো কিলোমিটার সেই ভ্যান চালিয়ে তাঁদের ফিরিয়ে এনেছে বারানসী থেকে।
এই মূহুর্তে আমাদের দেশে লকডাউন উঠে গেছে, আমরা সবাই 'নিউ নর্মাল'- এর নিয়ম মেনে থাকার অভ্যাস করে ফেলতে পেরেছি, চারপাশে উৎসবের আমেজ। একের পর এক বিভিন্ন ধরনের উৎসবের প্রস্তুতি চলছে । কিন্তু সেই যারা মার্চ মাসে হেঁটে বাড়ি ফিরবে বলে বেরিয়েছিলেন , তাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু এখনও হাঁটছেন । কেউ কেউ বাড়ি ফিরতেই পারেননি। কেউ কেউ ফিরেছিলেন , আবার চলেছেন দূর দেশে, নতুন কাজের খোঁজে। আমরা তাঁদের ভুলে গেছি হয়ত। কিন্তু তাঁরা হাঁটছেন। তাঁরা হাঁটছেন কাজের খোঁজে, পেটের খাবারে খোঁজে, ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায়। সেই সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের কথা মনে রেখে — ক্ষেতে সোনার ফসল ফলান যাঁরা, পরনের কাপড় বোনেন যাঁরা, মাথার ওপরে নিরাপত্তার ছাদ নির্মাণ করেন যাঁরা — ইচ্ছামতীর ইচ্ছে অনুসারে, আমার এই চিঠির সঙ্গে, সপরিবার মা দুর্গার অন্যরকমের রূপ — এঁকেছেন আমাদের প্রিয় শিল্পী বন্ধু অনুভব সোম।
মা দুর্গা তো নানা সময়ে নানা রূপে দেখা দেন বলে জানি। এই অন্যরকম বছরে, অন্যরকম উৎসবের সময়ে, আমাদের মনের মধ্যে থেকে যাক মা দুর্গার এই অন্যরকম রূপের ছবি।
সবাইকে নিয়ে সুস্থ থেকো, ভালো থেকো। এই বছর মা দুর্গার সঙ্গে মুখোমুখি হও বাড়ির ভেতর থেকেই, টিভি কিংবা ইন্টারনেটের সাহায্য, কিংবা মনে মনে।
৪ঠা কার্তিক, ১৪২৭
২১শে অক্টোবর, ২০২০
ছবিঃ
অনুভব সোম
মিতিল