খেলাঘরখেলাঘর

ছোট্ট মেঘ



ছোট্ট মেঘ। আকাশে ভেসে বেড়ায়। এখনও তার বয়স হয়নি। সবে তো ক'টা দিন হল। সে জানে না কোথা থেকে এখানে এল। সে জানেনা কোথায় যেতে হবে। সবে তো ক'টা দিন হল। এরই মধ্যে সে দেখে চিনতে পেরেছে তার দাদা দিদিদের। তারাও তো তার মত আকাশে ভেসে বেড়ায়।

একদিন ওইরকম এক বড়ো মেঘ এল কাছে। শরীরটা ভারী ভারী। জলভরা মেঘ বলল, তুমি আমার ছোটো বোন। আমি তোমার বড় ভাই। এখন থেকে আকাশের পাড়ায় তুমি ঘুরে বেড়াবে। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।

ছোটো মেঘ বলল, তোমার শরীরটা ভারী ভারী কেন?
বড়ো মেঘ বলল, আমার শরীর জুড়ে জলকণা। তুমি যখন বড়ো হবে আমার মতো, তোমার শরীরও জলকণায় ভরে যাবে। আমার মত তখন তুমি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে।
এবার ছোটো মেঘ বলল, দেশে দেশে মানে কী?
বড়ো মেঘ বলল, তা-ও বুঝলে না? এই পৃথিবী জুড়ে কত শহর, গ্রাম, কত দেশ, কত মহাদেশ। কত মানুষ, কত ছেলে, কত মেয়ে। তারা সবাই যে যেখানে থাকে সেটাই তো তাদের দেশ।
ছোটো মেঘ অবাক হয়ে শোনে বড়ো মেঘদাদার গল্প।
ছোটো মেঘ বলে, তোমার খুব মজা তাই না? যখন দেশে দেশে ঘুরে বেড়াও!
বড়ো মেঘ বলে, মজা তো হবেই। তবে তা কিছুদিনের জন্য। তারপরেই আমরা সবাই ফুরিয়ে যাই। হারিয়ে যাই। সময় যখন হবে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ব মাটিতে। তখন মরে যাব ঠিকই, তবে কী জানো, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে ভারী মজা! সে এখন তুমি বুঝবে না। তুমি যে এখনও অনেক ছোটো।
বড়ো মেঘদাদা কথা বলতে বলতে এগিয়ে যায়।ছোটো মেঘ এখনও জানেনা বৃষ্টি কাকে বলে। ঝরে পড়া মানে কী। তবু তার মনে হয় এখনই সব কিছু না জানলেও হবে।
আর একদিনের কথা। সেদিন ওর সামনে উড়ে এল হালকা সোনালি রঙের এক মেঘ। বলল, তুমি আমার বোন। আমি তোমার দিদি।
ছোটো মেঘ তখন তাকে বলল, দিদি আমিও খুব খুশি তোমাকে পেয়ে। দিদি আমাকে বলো বৃষ্টি কী, ঝরে পড়া মানে কী।
মেঘ দিদি বলল, তুই আমি যখন বাতাস থেকে বেশি করে জলকণা খেয়ে ফেলি, তখনই আমাদের শরীরে জল ঢুকে যায়। জলভরা হলেই একসময় পৃথিবীতে ঝরে পড়ি। তখন তাকে বৃষ্টি বলে, বুঝলি?
ছোটো মেঘ শোনে মেঘদিদির কথা।
মেঘদিদি আরও বলে, তোর খুব সুন্দর শরীর। বাতাস থেকে বেশি বেশি জল কখনোই খেয়ে নিবি না, তাহলে বৃষ্টি হয়েও ঝরবি না। অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারবি তাহলে।  ঝলমল শরীরে আকাশে উড়ে বেড়াবি, তোকে কি সুন্দর লাগবে দেখতে। পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে তোকে দেখবে।
মেঘদাদা, মেঘদিদির কথা শুনে ছোটো মেঘ বড়ো হয়ে ওঠে। তবু এখনও সে অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে খোঁজে তার মা-কে তার বাবাকে। এত খুঁজ়ে বেড়ায় তবু পায় না। মনে দুঃখ হয়। দুঃখ হবেই বা না কেন? বাবা-মার আদর এখনও যে তার জোটেনি!
ছোটো মেঘ এখন আর ছোটো নেই। সে-ও দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেছে।
একদিন উড়তে উড়তে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেল এক গরমের দেশে। সে চেয়ে দেখল তার মেঘদিদি আর মেঘবোনেরাও বেশ ভেসে বেড়াচ্ছে।গরমদেশে ভেসে বেড়াতে তাদের যে খুব ভালো লাগে। ভাসতে ভাসতে ভাসতে ভাসতে ছোট মেঘের চোখ গেল মাটির পৃথিবীতে। দেখল কত মানুষ! আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা নাকি বৃষ্টি চায়। যা মেঘেরাই দিতে পারে।
এক মেঘদিদি কাছে এসে বলল, একফোঁটা বৃষ্টির জন্য মানুষ প্রার্থনা জানাচ্ছে। ছোটো মেঘ-বোন ওসবে কান দিস না। বৃষ্টি হয়ে একবার ঝরে পড়লে আর তোকে আমরা পাব না। তখনই তুই হারিয়ে যাবি, ফুরিয়ে যাবি।
ছোট মেঘ কী করবে ভেবে পায় না। গরমদেশে এসে অবধি তার মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তার চোখে পড়ছে ফুটি-ফাটা মাটি।
কত পুকুর দেখেছে সে, এক ফোঁটা জল নেই সেখানে। জল না পেয়ে মাঠের ফসল শুকিয়ে গেছে, মানুষের কান্নাও শুনেছে সে, হা জল! হা জল! এমনকি গানও শুনেছে সে, আল্লা মেঘ দে, পানি দে। এমনকি চাতকপাখির কান্নাও তার মনকে খুব কষ্ট দিয়েছে। ওদিকে মেঘদিদির সাবধান বাণীও কানে বাজছে তার।- বৃষ্টি হয়ে ঝরিস না, তা হলেই তুই হারিয়ে যাবি, ফুরিয়ে যাবি।
এবার ছোটো মেঘের মনে হল সে সত্যিই হারিয়ে যাবে, ফুরিয়ে যাবে। যদি কোন ভালো কাজে সে আসে, তবে এ জীবন তার সার্থক হবে।
ছোটো মেঘের মনে হল, আমার কাছে যতটুকু জল আছে তা দিয়েই সেবা করব আমি।

মেঘ

এ কথা ভাবা মাত্রই ছোটো মেঘ তার ছোট্ট জলভরা শরীর নিয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করল। নামছে তো নামছেই। একসময় সে-ও বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল মানুষের কাছে।
শেষবারের মতো ছোটো মেঘের মনে পড়ল বড়ো মেঘদাদার কথা-সময় যখন হবে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ব মাটিতে। তখন মরে যাব ঠিকই, তবে কী জানো, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে ভারী মজা!
আজ সে অনুভব করল সত্যিই কী মজা!চেয়ে দেখল ওকে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে দেখে, পৃথিবীর কচিকাঁচার দল কেমন আনন্দে নেচে উঠেছে ! সকলের মুখেই খুশি-হাসি। ওদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বড়োরাও কেমন লাফালাফি করছে! যা সে এর আগে কোনোদিন দেখেনি।

 

 

 

সুনির্মল চক্রবর্তী
জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত শিশু সাহিত্যিক সুনির্মল চক্রবর্তী ইচ্ছামতীকে উপহার দিয়েছেন এই রাশিয়ার রূপকথাটি। এই গল্পটি পূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত হয়েছে।