' গুপি গাইন বাঘা বাইন ' - এই ছবিটা তো তুমি দেখেছ; ছবিটা কে বানিয়েছেন তাও জানো; কিন্তু এই গল্পটা কার লেখা সেটা জানো কি? -তুমি জানো? বাঃ! খুব ভালো। কিন্তু যারা জানেনা, তাদের উত্তরটা জানিয়েই দিই, কি বলো? - গুপি গাইন বাঘা বাইন গল্পটা লিখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি; তিনি সুকুমার রায়ের বাবা, সত্যজিত রায়ের দাদু। শুধুই কি এই? মোটেও নয়। আরো অনেক কিছু বলার আছে তাঁর বিষয়ে...আমাদের এই সংখ্যার মনের মানুষ যে তিনি।
১৮৬৩ সালের ১০ই মে, এখনকার বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম হয়েছিল। তাঁর বাবা শ্যামসুন্দর ছেলের নাম রেখেছিলেন কামদারঞ্জন। সেই ছেলেকে কিছুদিনের মধ্যেই দত্তক নেন শ্যামসুন্দরের ভাই হরিকিশোর। তিনি ছেলের নাম বদলে রাখেন উপেন্দ্রকিশোর।
ময়মনসিংহে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় থেকেই তিনি ছোটদের জন্য যে সব পত্রিকা গুলি প্রকাশ হত - যেমন 'সখা', 'সাথী', 'মুকুল', 'বালক', সেগুলিতে নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। এই লেখাগুলি ছিল বেশিরভাগই জীব-বিজ্ঞান বিষয়ক। তারপরে তিনি গল্প লিখতেও শুরু করেন। আর বেশিরভাগ লেখাগুলির সঙ্গে তিনি খুব সুন্দর ছবি এঁকে দিতেন।
কিন্তু সেই সময়ে আমাদের দেশে ছাপাখানার ব্যবস্থা খুব ভালো ছিলনা। কাঠের ব্লক দিয়ে ছবি ছাপা হত, সেগুলি দেখতে মোটেও ভালো হত না। কিন্তু ছোটদের বই যদি ঝকঝকে সুন্দর, রঙে ভরা না হয়, তাহলে কি আর তারা সেগুলিকে পছন্দ করবে?
ছোটদের জন্য সুন্দর ছবি সহ, রঙচঙে বই কিভাবে ছাপানো যায়, সেই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করলেন উপেন্দ্রকিশোর। নিজের খরচায় বিদেশ থেকে তিনি নানাধরনের বই ও যন্ত্রপাতি আনালেন, আর বাড়ীতে বসে নানারকমের পরীক্ষা -নিরিক্ষা করলেন। সেই সময়ে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের 'সিটি বুক সোসাইটি' থেকে, উপেন্দ্রকিশোরের লেখা প্রথম বই -'ছেলেদের রামায়ণ' প্রকাশিত হল। সেই বইতে তিনি অনেক ছবি এঁকেছিলেন, কিন্তু যেহেতু ছাপার ব্যবস্থা ভাল ছিলনা, তাই ছবিগুলি ভালো করে ছাপা হল না। এই ঘটনার পরেই উপেন্দ্রকিশোর বিদেশ থেকে সমস্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনিয়ে, নিজের বাড়িতেই প্রেস খুলে বসলেন ১৮৯৫ সালে। সেই প্রেসের নাম হল ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্স; ঠিকানা ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রীট।
এইবার উপেন্দ্রকিশোর মনের মত করে ছোটদের জন্য বই ছাপতে শুরু করলেন। সাথে সাথে চলতে থাকলো ছোটদের জন্য নানান ধরনের বই লেখা, ছবি আঁকা, ছোটদের জন্য নাটক লেখা, ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের সাথে কাজ করা, গান লেখা। আর চলতে থাকলো মুদ্রনশিল্পের উন্নতির জন্য আরো পড়াশোনা। হাফ-টোণ পদ্ধতিতে ব্লক-প্রিন্টিং নিয়ে অনেক গবেষণা করেছিলেন তিনি। তাঁর সমস্ত গবেষণা ও হাতে -কলমে কাজের ফলাফল নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে পাঠাতেন ব্রিটেনের পেনরোজ অ্যানুয়াল পত্রিকায়। তাঁর উদ্ভাবন করা নিয়মটি পরবর্তীকালে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হত।
'ছেলেদের রামায়ণ' এর পরে তিনি একইরকম সহজ সরল ভাষায় লিখলেন 'ছেলেদের মহাভারত'। লিখলেন গ্রহ-নক্ষত্র-পশু-পাখি-ইতিহাস-ভূগোল-আবিষ্কার-ভ্রমণ-কাহিনী-এইরকম নানান বিষ্য নিয়ে 'সেকালের কথা'। লিখলেন মহাভারতের গল্প, পৌরাণিক কাহিনী। আরো লিখলেন বাংলার লোককথা-উপকথার ভান্ডার থেকে নানা ধরনের গল্প সংগ্রহ করে 'টুনটুনির বই' । লিখলেন দেশ-বিদেশের নানারকম মজাদার গল্প। উপেন্দ্রকিশোরের যাবতীয় লেখা পরে একসঙ্গে করে প্রকাশ করা হয়েছে বহুবার 'উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র রচনাবলী' নাম দিয়ে। এসব ছাড়াও আমাদের তিনি উপহার দিলেন আরেকটি অসাধারন জিনিষ - 'সন্দেশ' নামের এক সুন্দর, ঝকঝকে, রঙিন মাসিক পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে, অর্থাৎ বাংলা ১৩২০ সালের বৈশাখ মাসে। সেই সময়ের সমস্ত বিখ্যাত লেখক ও গুনীজনেরা এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। উপেন্দ্রকিশোরের ছয় ছেলেমেয়েও লিখতেন এই পত্রিকায়। এই পত্রিকা বহুবছর সফল ভাবে চলার পর বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে যায়। অনেকদিন পরে, উপেন্দ্রকিশোরের পৌত্র সত্যজিত আবার এই পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন। এই পত্রিকা এখনও কলকাতা থেকে নিয়মিত প্রকাশ করেন শ্রী অমিতানন্দ দাশ।
১৯১৫ সালে বাহান্ন বছর বয়সে ডায়াবিটিস রোগের শিকার হয়ে প্রয়াত হন আমাদের এই মনের মানুষ। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের বন্ধু। আনন্দ-আমোদের মধ্যে দিয়েই যে ছোটদের পড়াশোনা শেখানো উচিত, সেই বিষয়ে এঁরা ছিলেন একমত। ছোটরা যেন স্কুলের বাঁধাধরা পড়াশোনার বাইরে অন্যান্য জ্ঞান লাভ করে, সেইদিকে সদাই তাঁর নজর ছিল। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষায় শিশু-সাহিত্যের জনক। ছোটদের ভালোবেসে, ছোটদের জন্য ভাবনাচিন্তা করে আজীবন কাজ করে গেছেন। যিনি আমাদের এত ভালবেসে এত উপহার দিয়ে গেছেন, তাঁকে ভাল না বেসে কি পারা যায়?
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলী, কলকাতা