শীত শীত আমেজ এসেছে। দিনে রোদের তাপ মিঠে, বইছে উত্তুরে হাওয়া। পড়াশোনার চাপ আর কোভিড নিয়ে সতর্কতার মধ্যেও মন বলছে বেড়াতে যাব, পিকনিকে যাব, আর সপ্তাহ তিনেক পরেই এসে যাবে বড়দিনের ছুটি, তখন সারাদিন হইহই করব, ভালোমন্দ খাব। বড়দিনের কথায় মনে হল, বড়দিন সহ খ্রীষ্টধর্মের বা অন্যান্য ধর্মের আরও অনেক উৎসব পালন করতে আমরা ভারতীয়রা শিখেছি ইউরোপীয়দের কাছ থেকে। তেমনই আমাদের প্রতিদিনের খাবার-দাবারের মধ্যে বহু খাবারেরই আগমন ঘটেছে ইউরোপীয়দের হাত ধরেই।
প্রতিদিন খাই, মাঝে মাঝে খাই, কখনওবা খাই, বছরে এক-দুইবার খাই, একবার খেয়েছি, একেবারেই খাই না, পছন্দই করিনা, খাওয়া বারণ — এমন গোটা কয়েক খুব পরিচিত খাবারের নামের ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক — যেগুলি কোনো না কোনো এক সময়ে ইউরোপীয়দের হাত ধরেই এসেছে আমাদের দেশে।
টুটি -ফ্রুটি ( Tutti Frutti)
এই নামের আইসক্রিম বা কেক খেতে ভালোবাসেনা, এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। নানারকমের ফলে স্বাদে ভরা, সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট লাল-হলুদ-সবুজ রঙিন ফলের টুকরো ভরা কেক বা আইসক্রিমের 'ফ্লেভার'-এর নাম হল 'টুটি-ফ্রুটি' ( Tutti Frutti/ Tutti-Frooti/ Tuttifrooti ) । এই নামের উৎস হল ইতালীয় শব্দ 'tutti i frutti' , যেখানে tutti শব্দের মানে হল 'সমস্ত' বা 'সব' আর frutti শব্দের অর্থ হল ফল । তাই 'টুটি ফ্রুটি' মানে হল সবরকমের ফল। 'টুটি ফ্রুটি' স্বাদের খাবারে, প্রয়োজন অনুযায়ী নানারকমের স্থানীয় টাটকা ফল এবং বিভিন্ন ধরনের চিনিতে জারানো বা শুকনো ফল এবং ফলের সুগন্ধী ব্যবহার করা হয়।
'টুটি ফ্রুটি' কিন্তু শুধু একটা বিশেষ ধরনের 'স্বাদ' নয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের শুকনো ফল এক সঙ্গে মিশিয়ে আলাদা এক খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয় শেষ পাতের মিষ্টিমুখের জন্য। সেই নানারকমের ফলের মিশেল ও 'টুটি ফ্রুটি' নামে পরিচিত।
মারী বিস্কিট (Marie biscuit)
আমাদের খুব পরিচিত বিস্কুট বা বিস্কিটগুলির মধ্যে একটা হল 'মারী' বিস্কিট। পাতলা, গোল, হাল্কা মিষ্টি, হাল্কা রং, হাল্কা ভ্যানিলার স্বাদযুক্ত এই বিস্কিটগুলির মাঝখানে ইংরেজিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকে ' MARIE', আর চারপাশের কিনারা দিয়ে করা থাকে সূক্ষ্ম সেলাই-এর মত হাল্কা নকশা। দেখতে সাদামাটা, খেতেও খুব যে বেশি ভালো এমন নয়, তবুও এই বিস্কিট কিন্তু কম খানদানি নয়। এই 'টি বিস্কিট' (tea biscuit) সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে একেবারে রাজা-রানীদের গল্প।
গ্র্যান্ড ডাচেস মারিয়া আলেকজান্দ্রোভ্না অফ রাশিয়া (Grand Duchess Maria Alexandrovna of Russia) ছিলেন রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় আলেকজান্দার-এর কন্যা। আর ডিউক অফ এডিনবরা (Duke of Edinburgh) , রাজপুত্র আলফ্রেড ছিলেন ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র। । ১৮৬৮ সালে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ১৮৭৪ সালে রাজকন্যা মারিয়ার সঙ্গে রাজপুত্র আলফ্রেড এর বিয়ে হয়। এমন রাজকীয় বিবাহ অনুষ্ঠান নিয়ে যে দেশজুড়ে হইচই পড়ে যাবে,বলাই বাহুল্য। এই বিয়ে উপলক্ষ্যে ইংল্যান্ডের পিক ফ্রিন্স (Peek Freans) নামের বেকারি সংস্থা বাজারে নিয়ে এল এক বিশেষ বিস্কিট, রাজকন্যার নাম মিলিয়ে নাম তার 'মারিয়া'। সেই বিস্কিটের ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রইল রাজকন্যার নাম- 'MARIA'। এখানে তুমি ভাবতে পারো — বিস্কিট কী এমন আহামরি খাবার, যেটা আবার রাজপরিবারের বিয়ে উপলক্ষ্যে তৈরি করা হতে পারে? আসলে, সেই সময়ে, ইউরোপে, বিশেষতঃ ব্রিটেনে, চা এবং চায়ের সঙ্গে নানারকম কেক-বিস্কিট খাওয়ার প্রথা জনপ্রিয় ছিল। বিকেলের চায়ের আসর / টী -পার্টি ছিল অভিজাত জীবনের অঙ্গ। স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়া অতিশয় খাদ্যরসিক ছিলেন। রাজপ্রাসাদের রান্নাঘরে তাঁর জন্য নিয়মিত তৈরি হত নানা ধরনের শৌখিন বিস্কিট — যেগুলি তিনি অন্য প্রাসাদে সময় কাটাতে গেলে বা বেড়াতে গেলেও নিয়ে যেতেন। তাই তাঁর ছেলের বিবাহ উপলক্ষ্যে, নতুন একটা বিস্কিট যে বাজারে আসবে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে?
আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে প্রথম তৈরি হওয়া সেই বিস্কিট আজও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়, যদিও ভাষাভেদে তার নামও অল্পস্বল্প বদলে যায় — María, Mariebon, Marietta —বিভিন্ন নামে ডাকা হয় তাকে। আমাদের দেশে এই বিস্কিটের নাম 'মারী' বা 'মেরী' বা অনেক সময়ে 'মারীগোল্ড' । নাম যাই হোক, আর যে দেশেই তৈরি হোক না কেন, মারী বিস্কিটের চেহারা কিন্তু একই থেকে গেছে বছরের পর বছর ধরে। এরপর থেকে 'মারী বিস্কিট' এর প্যাকেট বা 'মারী' বিস্কিট দেখলেই মনে পড়বে রাজকন্যা মারিয়ার কথা, তাই না?
নাইস বিস্কিট
আরেকটা মজাদার বিস্কিট আমরা খেয়ে থাকি, তার নামের বানান হল 'NICE'। এই বিস্কুটটার চেহারা আয়তক্ষেত্রের মত, চারদিকে খাঁজকাটা, আর ওপরে ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারস-এ লেখা এর নাম — 'NICE'। 'NICE' মানে 'ভালো' — এ তো জানাই কথা। নামের মান রেখেই এই বিস্কিট খেতে বেশ ভালো— নারকোলের স্বাদ , সঙ্গে ওপরে ছড়ানো চিনির দানা, দেখলেই মনে হয় একটা ছেড়ে দুটো খাই। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই বিস্কিটের নাম উচ্চারণ করা নিয়ে, বিশেষতঃ ইংরেজিভাষী দেশগুলির মানুষদের মধ্যে , হামেশাই তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। একাংশ মানুষের মতে ইংরেজি বিশেষণ 'নাইস' এর মত উচ্চারণ না করে , 'নিস' উচ্চারণ করলে তবেই সঠিক ভাবে এর নাম বলা হবে। কিন্ত 'নাইস' এর বদলে 'নিস' কেন? এর পেছনেও একটা গল্প আছে।
'NICE' ('নিস') হল ফ্রান্সের এক অপূর্ব সুন্দর সৈকত শহর, যেটি 'ফ্রেঞ্চ রিভেরা' অঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। ফরাসী ভাষায় 'I' এর উচ্চারণ 'আই' না হয়ে হয় 'ই'। তাই এই উচ্চারণের তফাৎ। এই জায়গার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এবং সুন্দর প্রকৃতি ইউরোপের মানুষদের ধনী এবং রাজকীয় পরিবারগুলির পছন্দের ছিল। তাই অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজবংশের মানুষেরা শীতের সময়ে লম্বা ছুটি কাটাতে চলে আসতেন নিসে। 'হিল বিস্কিটস' নামে ইংল্যান্ডের এক দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো বিস্কিট প্রস্তুতকারী সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, নারকেলের স্বাদযুক্ত 'নাইস' বিস্কিট প্রথম তৈরি হয় ১৮৬০ সালে। খেতে ভালো বলে তার সহজ সরল নাম হয় 'NICE'। তারপরে কোনো এক সময়ে মহারানি ভিক্টোরিয়া, ফ্রান্সের সৈকতশহর 'নিস'- এ বেড়াতে যান এবং সঙ্গে করে নিয়ে যান তাঁর এই প্রিয় বিস্কিট। ফরাসীরা 'নাইস' কে উচ্চারণ করল 'নিস'। শুরু হল নামের উচ্চারণ নিয়ে জটিলতা। এরও অনেক পরে, কোনো এক সময়ে এই বিস্কিটের বিজ্ঞাপনে লেখা হল- 'ফ্রান্সের দুর্দান্ত সুন্দর শহরটির মতই দারুণ এই বিস্কিট' ! এর পর থেকে এই বিস্কিটের নামের উচ্চারণ নিয়ে মতভেদ চলতেই থাকে, এবং মাঝেমধ্যেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু নামে কীই বা আসে যায়? 'নাইস' বা 'নিস' - যে নামেই ডাকো না কেন, বিস্কিটটা কিন্তু খেতে ভালোই।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই
বাঙালির পরিচিত পাতলা, ছোট ছোট, মুচমুচে, ঝুরঝুরে আলুভাজার থেকে লম্বায় এবং চওড়ায় অল্প বড়, লালচে হলুদ রঙের মুখরোচক আলুভাজাগুলির নাম 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' (French Fry)। বিদেশি খাবারের রেস্তোঁরা ছাড়াও, বড় শপিং মলে আলাদা করে কিনতে পাওয়া যায় ঠোঙাভরা কেতাদুরস্ত এই আলুভাজা। সঙ্গে থাকতে পারে কেচাপ কিংবা অন্য কোনো 'ডিপ'। কিন্তু এর নাম সাদামাটা 'পোটাটো ফ্রাই' বা 'আলুভাজা' হওয়ার বদলে 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' — সাদা বাংলায় 'ফরাসী ভাজা'— কেন হল? সত্যিই কি ফরাসীরাই প্রথম এই খাবারটা তৈরি করেছিল, নাকি নাইস/নিস বিস্কুটের মত এর ও নামের পেছনে রয়েছে হরেক গল্প?
একদল গবেষকের মতে, 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই'-এর সঙ্গে ফরাসীদের কোনো সরাসরি সংযোগ নেই। ফ্রান্সের উত্তর সীমান্তের প্রতিবেশী দেশ বেলজিয়াম। ফ্রান্স থেকে বেলজিয়াম হয়ে নেদারল্যান্ডস পেরিয়ে উত্তর সাগরে পড়েছে মিউজ/মাস নদী। এই নদী তীরে অবস্থিত বেলজিয়ামের গ্রামের গরীব বাসিন্দারা সরু সরু টুকরো করে মাছ ভেজে খেতে পছন্দ করতেন। কিন্তু শীতকালে নদীর জল জমে বরফ হয়ে গেলে আর মাছ পাওয়া যেত না। তখন তাঁরা মাছের বদলে আলুর টুকরো লম্বা করে কেটে ভেজে খেতেন। তাই বলা চলে, 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' এর জন্মস্থান ফ্রান্স নয়, বেলজিয়াম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার সৈন্যরা দক্ষিণ বেলজিয়ামে এই খাবারটির স্বাদ পান। ফ্রান্সের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে থাকার ফলে দক্ষিণ বেলজিয়ামের মানুষেরা স্থানীয়ভাবে ফরাসী ভাষাতেই কথা বলে থাকেন। আমেরিকার সৈন্যরা অতশত বোঝেননি। তাঁরা ফরাসী ভাষায় কথাবলা মানুষগুলিকে ফরাসীই ভেবে নেন আর এই খাবারটিকে সহজে চিহ্নিত করার জন্য নাম দেন 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই'।
অন্য একদল গবেষকের মতে, আলুভাজা ফরাসীরা বহুদিন আগে থেকেই খেত। ফরাসী বিপ্লবের আগে, গরীব মানুষদের সুলভ খাবার হিসাবে আলুভাজা জনপ্রিয় ছিল। অন্য আর এক দল গবেষক বলেন, সেভাবে দেখতে গেলে, স্পেনীয়রাই নিশ্চয় সবার আগে এই বিশেষ ধরণের আলুভাজা বানিয়েছিল, কারণ তারাই প্রথম সুদূর পেরু থেকে ইউরোপে আলু নিয়ে আসে।
বেলজিয়ামের ফ্রিটকট/ ফ্রিটারি এবং মেয়োনেজ সহযোগে 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই'
মোট কথা, 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' বা মোটা করে কাটা আলুর মুচমুচে ভাজা যে আসলে কোন দেশে প্রথম কেউ তৈরি করেছিল সেটা জানা এক অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু সেটা সবাই আর সহজে মেনে নিচ্ছে কোথায়? 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' কে 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' বলে ডাকলে কারা সব থেকে বেশি বিরক্ত হয় জানো ? হয় বেলজিয়ামের মানুষেরা। বেলজিয়ামে এই আলুভাজা একটি জনপ্রিয় 'স্ট্রীট ফুড'। এখানে পথের ধারে ধারে নানারকমের ভাজাভুজির সঙ্গে 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' বিক্রির জন্য ছোট ছোট অসংখ্য দোকান রয়েছে, যেগুলিকে বলে ফ্রিটকট ( frietkot)। বেলজিয়ামের মতে, তারা ফরাসীদের থেকে অনেক বেশী 'ফ্রেঞ্চ-ফ্রাই' খেয়ে থাকে এবং বেলজিয়ামে জনপ্রতি 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' বিক্রেতার সংখ্যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ফরাসীদের সঙ্গে আলুভাজা নিয়ে লড়ালড়ি করতে করতে তারা এই মূহুর্তে ইউনেস্কোর কাছে দাবী জানিয়ে রেখেছে, 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই'-কে বেলজিয়ামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকরূপে চিহ্নিত করতে হবে। আরও একটা মজার কথা, বেলজিয়ামেই রয়েছে বিশ্বের একমাত্র 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মিউজিয়াম' - যেখানে গিয়ে শুধু আলুভাজা সম্পর্কে জানাই যাবে না, সঙ্গে চাইলে খেতেও পাওয়া যাবে মুচমুচে আলুভাজা, মেয়োনেজ সহযোগে।
ফ্রেঞ্চ টোস্ট
'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই'- এর ইতিহাস ভূগোল নিয়ে যখন এত গল্প হল, তাহলে 'ফ্রেঞ্চ-টোস্ট' ই বা বাদ থাকে কেন? বেশ কয়েকবছর আগে মুক্তি পাওয়া একটি হিন্দি ছায়াছবিতে, নায়িকা তার বিদেশি বন্ধুদের জলখাবারে 'ফ্রেঞ্চ-টোস্ট' বানিয়ে খাওয়ানোর পরে, তার ফরাসী বন্ধু বলেছিল - আমি ফ্রান্সে থাকি কিন্তু এমন ফ্রেঞ্চ টোস্ট তো কোনোদিন খাইনি!' এই কথার উত্তরে নায়িকা বলেছিল- ' আমরা ভারতে এমনই ফ্রেঞ্চ টোস্ট খাই' ! ভারতে 'ফ্রেঞ্চ- টোস্ট' সাধারণভাবে দেখতে এবং খেতে কেমন হয় সেটা তো আমরা জানি। কিন্তু ফরাসীরা যে 'ফ্রেঞ্চ টোস্ট' খায় সেটা তাহলে ঠিক কেমন?
মাত্র কয়েকশো বছর আগেও, এখনকার মত সুপারমার্কেট, খাবার তৈরির কারখানা, বেঁচে যাওয়া খাবার সংরক্ষিত রাখার জন্য প্রত্যেক বাড়িতে ফ্রিজ — এমন অনেক কিছুই ছিল না। আজকাল আমরা যত বিভিন্ন ধরনের টাটকা খাবার এবং প্যাক করা শুকনো খাবার দেখি, বা রেস্তোঁরা বা দোকানে কিনতে পারি, সেসবের সংখ্যাও ছিল খুব কম। তাই খাবার নষ্ট করার প্রবণতাও ছিল কম। খাবার বাসী হয়ে গেলেও সেটাকে অন্য কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে নতুন পদ বানিয়ে খেয়ে নেওয়া হত। এমন অনেক অভ্যাস মানবসমাজ আজও বজায় রেখে চলে।
বাসী রুটিকে টুকরো করে কেটে, দুধ ডিমের মিশ্রনে ডুবিয়ে তারপরে ভেজে ফরাসীরা যে খাবারটা তৈরি করেন, ফরাসী ভাষায় তার নাম প্যঁ পার্দ্যু (pain perdu) , যাকে ইংরেজি করলে বলা যেতে পারে 'Lost Bread' । দুধ ডিমের মিশ্রনে রুটিগুলি ডুবে (হারিয়ে) যেত বলে কিংবা বাসী রুটি বলেই হয়ত এমন নাম এই খাবারের। ফ্রান্সে এই ভাজা রুটিগুলির ওপরে মধু, ক্রিম বা অন্য সিরাপ ছড়িয়ে মূলতঃ শেষ পাতের মিষ্টিমুখ হিসাবেই খাওয়া হয়।
কিন্তু এই অভ্যাস শুধু ফরাসীদের না, ছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষদের মধ্যেও। রান্নার পদ্ধতিতে বা উপাদানের ব্যবহারে একটু ফারাক থাকত, কিন্তু এই একই খাবার তৈরী হত এবং খাওয়া হত বিভিন্ন জায়গাতে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, এমনকী প্রাচীন রোমেও এই ধরনের একটা খাবার খাওয়া হত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি, এই খাবারটি আইরিশ অভিবাসীদের সঙ্গে ঢুকে পড়ল আমেরিকাতে। সেখানে ফরাসী প্যঁ পার্দ্যু (pain perdu) / 'lost bread' বা ইংরেজি 'eggy bread/ gypsy bread' এর বদলে 'ফ্রেঞ্চ টোস্ট' শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। একদল গবেষকের মতে, 'ফ্রেঞ্চ' বা 'ফরাসী' শব্দটার সঙ্গে যেহেতু শৌখিনতার ভাবনা জড়িয়ে থাকে, তাই এই খুব সাধারণ খাবারটিকে 'ফরাসী খাবার' বলে প্রচার করে রেস্তোঁরার মালিকেরা এর বাজারদর বাড়াতে চেষ্টা করেছিলেন। আমেরিকাতে প্রচলিত আর একটি কাহিনি অনুসারে, ১৭২৪ সালে এই খাবারটি প্রথম তৈরি করেন নিউ ইয়র্ক-এর এক বিক্রেতা যাঁর নাম ছিল জোসেফ ফ্রেঞ্চ। তিনি ইংরেজি ব্যকরণ খুব ভালো জানতেন না, তাই 'French's Toast' লেখার বদলে খাবারের নাম দেন 'French Toast'। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, 'ফ্রেঞ্চ টোস্ট' শুধু মিষ্টি হিসেবে নয়, বিভিন্ন রকমের মশলা এবং অন্যান্য খাদ্যবস্তুর সঙ্গতে মিষ্টি এবং নোনতা দুই স্বাদেই, সকালের জলখাবার বা সন্ধ্যাবেলার মুখরোচক খাবার হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রচলিত হয়। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় এই খাবারের নাম বদলে গেলেও ইংরেজিভাষী দেশগুলিতে এটি 'ফ্রেঞ্চ টোস্ট' নামেই পরিচিত।
তবে 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' আর 'ফ্রেঞ্চ টোস্ট'- এর এই অদ্ভূত ফরাসী-নাকি-ফরাসী-নয় নামকরণের পেছনে অন্য আরও একটা কারণ থাকতে পারে, এবং সেই কারণটাকেই আমার সবথেকে বেশি ঠিকঠাক মনে হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় একটি ক্রিয়াপদ আছে - 'to french' , যার অর্থ হল কোনো কিছুকে সমান অংশ বা টুকরো করে কাটা; মূলতঃ রান্নাবান্নার ক্ষেত্রেই এই শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় - সমান মাপে কোনো সবজিকে কাটার কথা বোঝাতে, কিংবা বড় মাংসের টুকরোর মধ্যে থাকা হাড়ের কিনারার দিক থেকে সুন্দরভাবে মাংস ছাড়ানোর প্রক্রিয়াকে বোঝাতে। 'ওল্ড আইরিশ' বা প্রাচীন আইরিশ ভাষাতে এর অর্থ ছিল 'টুকরো করে কাটা' (to slice)। তাই 'ফ্রেঞ্চ ফ্রাই' বা 'ফ্রেঞ্চ টোস্ট' এর মূল অর্থ টুকরো করে কাটা আলুভাজা বা টুকরো রুটির টোস্ট-ও হতে পারে।
কেমন লাগল চেনা খাবারগুলির নামকরণের এই সব ছোট্ট ছোট্ট গল্পগুলি? তুমিও যদি এমন সব খাবারের নাম নিয়ে কোনো গল্প জানো, তাহলে সেই গল্প লিখে পাঠিও আমাদের কাছে।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া