সেই অনেক, অনেক দিন আগে, যখন সময়ের হিসাব ছিল না, যখন পৃথিবী সবে সৃষ্টি হয়েছে, তখন রাত ছিল না। সবসময়েই দিন থাকত। কেউই তখন সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের কথা শোনেনি, তারার আলো বা চাঁদের কিরণ কাকে বলে জানত না। ছিল না কোন রাতের পাখি, রাতের পশু, রাতের পোকা, বা রাতের ফুল। ছিল না কোন লম্বা ছায়া, বা ফুলের সুগন্ধে ভরা রাতের শীতল বাতাস।
সেই সব দিনে, সমুদ্রের গভীর অতলে বসবাসকারী বিরাট সর্পরাজের মেয়ে, বিয়ে করলেন মাটির দেশে রাজ্ত্বকারী মানুষদের এক ছেলেকে। তিনি অতল জলের তলায় ছায়ায় ঘেরা তাঁর বাড়ি ছেড়ে দিনের আলোয় ভরপুর দেশে তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকতে এলেন। উজ্জ্বল দিনের আলোয় থেকে থেকে তাঁর চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়ল, তাঁর রূপ ফ্যাকাশে হতে থাকল। তাঁর স্বামী দুঃখভরা চোখে তাঁর দিকে দেখতেন, কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারতেন না কিভাবে স্ত্রীকে সাহায্য করবেন।
" ওহ, যদি রাত আসত..." তাঁর স্ত্রী খাটে শুয়ে ক্লান্ত ভাবে এপাশ-ওপাশ করতে করতে বললেন।" এখানে সবসময়ে দিন, কিন্তু আমার বাবার রাজত্বে কত ছায়া। আহা, আমি যদি একটুও রাত্রির ছায়া পেতাম!"
তাঁর স্বামী তাঁর কথা শুনতে পেলেন।" রাত্রি কি?" তিনি জিজ্ঞেস করলেন।"আমাকে বল রাত্রি কি তাহলে নাহয় আমি তোমার জন্য একটু আনানোর চেষ্টা করতে পারি।"
"রাত্রি", বললেন সর্পরাজের মেয়ে,"হল সেই সব গভীর ছায়ার নাম যা সমুদ্রের অতলে আমার বাবার রাজত্বকে আঁধারে ঢেকে রাখে। আমি তোমাদের মাটির দেশের সূর্যকিরণ ভালোবাসি, কিন্তু এত আলোতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। যদি আমার বাবার রাজত্বের ছায়ার কিছুটা অংশও পেতাম আমার ক্লান্ত চোখ গুলিকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য।"
তাঁর স্বামী সেই শুনেই নিজের তিনজন সবথেকে অনুগত ক্রীতদাসকে ডেকে পাঠালেন। " আমি তোমাদেরকে এক যাত্রায় পাঠাব," তিনি তাদের বললেন, " তোমাদের যেতে হবে বিরাট সর্পরাজের রাজত্বে, গভীর সমুদ্রের নিচে, আর ওঁকে বলতে হবে তোমাদেরকে কিছুটা রাত্রির অন্ধকার দিতে যাতে ওঁর মেয়ে আমাদের মাটির দেশে সূর্যের আলোর প্রকোপে মারা না যান।"
সেই তিন জন ক্রীতদাস বিরাট সর্পরাজের রাজত্বের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে, অনেক দিন পরে তারা গিয়ে পৌঁছাল গভীর সমুদ্রের নিচে তাঁর বাড়িতে, আর তাঁকে অনুরোধ জানাল কিছুটা রাত্রির ছায়া দিতে যাতে তারা মাটির দেশে নিয়ে যেতে পারে। বিরাট সর্পরাজ তক্ষুণি তাদেরকে এক বিরাট বস্তা ভর্তি করে দিলেন। সেটা শক্ত করে আটকানো ছিল, আর বিরাট সর্পরাজ তাদেরকে সতর্ক করে দিলেন যেন তারা সেই বস্তাটিকে ততক্ষণ না খোলে, যতক্ষণ না তারা তাঁর মেয়ের কাছে পৌঁছাচ্ছে।
তিনজন ক্রীতদাস ফিরে চলল, তাদের মাথায় সেই বিরাট বস্তা যার মধ্যে রাত্রি বাঁধা আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বস্তার ভেতর থেকে নানাধরণের শব্দ শুনতে পেল। সেই শব্দগুলি ছিল রাতের পশু, রাতের পাখি আর রাতের পোকাদের। তুমি যদি কোন-দিন নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে রাতের প্রাণীদের সমবেত আওয়াজ শুনে থাক , তাহলে বুঝতে পারবে সেই শব্দ কেমন ছিল। সেই তিনজন ক্রীতদাস এরকম ধরণের শব্দ কোনদিন শোনেনি। তারা খুব ভয় পেয়ে গেল।
"চল আমরা এই রাত্রি ভর্তি ব্যাগটাকে এইখানেই ফেলে রেখে যত জোরে পারি দৌড়ে পালাই," প্রথম জন বলল।
"আমরা মরব। যাই করি না কেন, আমরা মরবই," দ্বিতীয় জন বলল।
"আমরা মরি বা বাঁচি, আমি এখন ওই বস্তাটাকে খুলে দেখব এইসব ভয়ানক শব্দ কারা করছে," বলল তৃতীয় কৃতদাস।
এই কথার পরে তারা সেই বস্তাটাকে মাটিতে রেখে তার মুখ খুলে ফেলল। অমনি বেরিয়ে এল রাতের পশু, রাতের পাখি আর রাতের পোকারা আর তার সাথে বেরিয়ে এ্ল রাতের কালো আঁধার। সেই দেখে ক্রীতদাসেরা খুব ভয় পেয়ে দৌড়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেল।
ওদিকে তো সর্পরাজের কন্যা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন কখন কৃতদাসেরা ফিরবে বস্তা ভর্তি রাত্রি নিয়ে। যবে থেকে তারা যাত্রা শুরু করেছে, তিনি তাদের অপেক্ষায় রয়েছেন, হাত দিয়ে নিজের চোখকে ছায়া দিচ্ছেন আর দূর প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে আছেন, এই আশায় যে তারা দ্রুত ফিরে আসবে। তিনি এইরকম ভাবে এক রাজকীয় তাল গাছে নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যখন সেই তিনজন কৃতদাস বস্তার মুখ খুলে রাত্রিকে বেরিয়ে আসতে দিয়েছিল। তিনি দূর দিগন্তে রাতের আঁধার দেখতে পেলেন আর আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন- "রাত্রি আসছে, অবশেষে রাত্রি আসছে।" তারপরে তিনি চোখ বুজে সে গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়লেন।
ঘুম যখন ভাঙল তখন তাঁর শরীর খুব ভাল লাগল। তিনি ঠিক সেই আগের মত প্রাণোচ্ছল রাজকন্যা হয়ে গেলেন যিনি সমুদ্রের তলায় বাবার রজত্ব ছেড়ে মাটির দেশে এসেছিলেন। তিনি এখন দিনকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত। তিনি রাজকীয় তাল গাছের মাথায় সে ঝকঝকে তারাটা জ্বলজ্বল করছিল, তাকে বললেন,"ও ঝকঝকে, সুন্দর তারা, এর পর থেকে তোমাকে সবাই চিনবে ভোরের তারা বলে আর তুমিই দিন শুরু হওয়ার বার্তা দেবে। এই সময়ে তুমিই হবে আকাশের রানী।"
তারপর তিনি সমস্ত পাখিদের ডেকে বললেন, "ও আমার সুন্দর গান গাওয়া পাখির দল, এর পর থেকে তোমরা এই সময়ে দিনের আগমন ঘোষণা করে সবথেকে সুন্দর, মিষ্টি গান গাইবে।" তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মোরগ। তাকে ডেকে তিনি বল্লেন, "তুমি হলে রাতের পাহারাদার। তোমার ডাক শুনেই সবাই বুঝতে পারবে রাত শেষ হয়েছে আর দিন আসছে।" সেই থেকে রাত পোহালে মোরগ ডাক দিয়ে দিনের আগমণ ঘোষণা করে। অপেক্ষমাণ পাখিরা সেই শুনে মিষ্টি সুরে গান গায় আর ভোরের তারা আকাশে রাজত্ব করে।
ওদিকে দিনের আলো ফেরার পরে ওই তিনজন কৃতদাস খালি বস্তা নিয়ে চুপিচুপি জঙ্গল থেকে বাড়ি ফিরে এল।
"অবিশ্বাসী কৃতদাসের দল, " তাদের মনিব বললেন, " তোমরা কেন বিরাট সর্পরাজের কথা মেনে চলনি আর বস্তাটা কেবলমাত্র তাঁর কন্যার সামনে খোলনি? যেহেতু তোমরা অবাধ্য হয়েছ, তাই আমি তোমাদের বাঁদরে পরিবর্তিত করব। এর পরথেকে তোমরা গাছে থাকবে। তোমাদের ঠোঁটে সবসময়ে বস্তার মুখ বন্ধ করা মোমের দাগের মত দাগ থাকবে।"
এইজন্যই আজকের দিকেও বাঁদরদের ঠোঁটের ওপর সেইরকম দাগ দেখতে পাওয়া যায়, যে ঠোঁট ব্যবহার করে তারা বস্তার মুখ আটকানো মোমের প্রলেপ কামড়ে খুলেছিল; আর ব্রাজিলে রাত ঠিক সেইভাবেই দিনের ওপর দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক সেই অনেকদিন আগে যেরকম ভাবে বস্তার মধ্যে থেকে বেরিয়েছিল। আর সেইসময়ে, সমস্ত রাতের পশু, রাতের পাখি আর রাতের পোকারা একসঙ্গে কলধ্বনি করে ওঠে।
ব্রাজিলের উপকথা
অনুবাদঃ
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলি, কলকাতা