কালু, মালু, বুলু আর টুলু - চার বন্ধু পড়াশোনা করে কাঞ্চনপুরের এক স্কুলে, থাকে হস্টেলে। তারা চারজন প্রানের বন্ধু। পড়াশোনা আর খেলাধুলার ফাঁকে তারা ভালবাসে নানা জায়গায় বেড়াতে। আর ভালবাসে নানারকমের রহস্যের সমাধান করতে। বুদ্ধিমতী আর সাহসী এই চার বন্ধু ধরে ফেলে কত ছেলেধরা, ডাকাত, চোরাকারবারি আর আরো দুষ্ট লোকেদের। তাদের তাকলাগানো গোয়েন্দাগিরি দেখে বন্ধুরা তাদের নাম দিয়েছে 'গোয়েন্দা গন্ডালু' - মানে এক গন্ডা '-লু'।
এই চার বন্ধুর নানা রকম রহস্য সমাধানের গল্প ছাড়াও ছোটদের জন্য আরো নানারকমের গল্প আর প্রবন্ধ লিখেছেন যিনি, তাঁর নাম নলিনী দাশ।তাঁর নিজের জীবনের গল্প ও কিন্তু কম সুন্দর নয়!
নলিনী জন্মেছিলেন ১৯১৬ সালে এক অনন্য পরিবারে। তাঁর দাদু ছিলেন বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্যের জনক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি। বড়মামা ছিলেন হাসির রাজা সুকুমার রায়। আর মা ছিলেন পুন্যলতা চক্রবর্তী, যিনি তাঁর বাবা ,দাদা আর দিদির মত 'সন্দেশ' পত্রিকায় ছোটদের জন্য গল্প লিখতেন। নলিনীর বড়মাসি, পুন্যলতার দিদি ছিলেন আমাদের আরেক প্রিয় শিশু সাহিত্যিক, সুখলতা রাও।
নলিনীর বাবা অরুননাথ চক্রবর্তী বিহার সিভিল সার্ভিসে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কর্মসূত্রে তিনি পরিবারকে নিয়ে হাজারিবাগ, আরা, ছাপড়া - এইরকম সব নানা ছোট-বড় শহরে থেকেছেন। নলিনীরা ছিলেন দুই বোন -কল্যানী আর নলিনী। ওদের ছোটবেলাতেই ওদের সাথে থাকতে আসে অনাথ তিনটি খুড়তুতো ভাই-বোন - কল্যান, লতু আর ডলি। এই চার বোন আর এক ভাই মিলে হই-হুল্লোড় করে কেটে যেত ছোটবেলার দিনগুলো। ছুটিছাটায় ওদের সঙ্গে যোগ দিত ছোট্ট মামাত ভাই মানিক - সেই মানিক যিনি পরে আমাদের কাছে পরিচিত হন সত্যজিত রায় নামে।
এসব হল আজ থেকে প্রায় সত্তর-আশি বছর আগেকার কথা। সেইসময় বিহারের সেইসব ছোট শহরগুলিতে মেয়েদের ভালো স্কুল ছিল না। নলিনীর মা পুণ্যলতা বিভিন্ন বই যোগাড় করে নিজে লিখে পাঠ্য বিষয় তৈরি করে চার বোনকে লেখাপড়া করাতেন। এইভাবে এই চার বোনের প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিল।
১৯৩০-৩১ সালে নলিনী বাকি দুই বোনের সাথে কলকাতায় এসে প্রথম স্কুলে ভর্তি হন- ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে -নবম শ্রেণীতে। তিনজনেই তখন একসঙ্গে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতেন। শৈশবে দেখা বিহারের সেই রুক্ষ সুন্দর প্রকৃতি আর পরে হোস্টেল জীবনের নানান অভিজ্ঞতা , পরবর্তীকালে গোয়েন্দা- গন্ডালু গল্প গুলি লেখার সময় তাঁকে প্রভাবিত করেছিল।
নলিনী কিন্তু পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি কলেজে ভর্তি হন দর্শন(ফিলোসফি) নিয়ে পড়ার জন্য। তিনি এতই ভালো ছাত্রী ছিলেন যে তিনি বি এ পরীক্ষায় সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে 'ঈশান স্কলার' সম্মান লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে তিনি একটি পেপারে তাঁর অধ্যাপক ডক্টর রাধাকৃষ্ণনের থেকে ৯৮% নম্বর পেয়েছিলেন।
এহেন একজন মানুষ তো তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসাবে শিক্ষার জগতকেই বেছে নেবেন! তিনি তাই অধ্যাপিকা রূপে কলকাতার বিভিন্ন কলেজে পড়ান।
১৯৬২ সাল থেকে সত্যজিত রায় ও লীলা মজুমদারের সঙ্গে তিনি 'সন্দেশ' পত্রিকার সম্পাদকরূপে যোগ দেন। মূলতঃ ওনারই উতসাহে ১৯৬৩ সালে 'সুকুমার সাহিত্য সমবায় সমিতি লিমিটেড' তৈরি হয়, যাঁরা 'সন্দেশ' পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। জীবনের শেষ দিন অবধি তিনি 'সন্দেশ' পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি 'সন্দেশ' ও অন্যান্য পত্রিকায় ছোটদের জন্য বহু ছোট -বড় গল্প আর প্রবন্ধ লেখেন। শুধুমাত্র 'সন্দেশ' পত্রিকাতেই তিনি ২৯ টি 'গোয়েন্দা গন্ডালু', ১৮টি অন্য গল্প আর ৭ টি প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলির মধ্যে কয়েকটি হল 'সন্দেশ সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর', 'সন্দেশ সম্পাদক সুকুমার' আর 'সাতরাজ্যির মজা'।
তাঁর লেখাগুলির মধ্যে কিছু কিছুকে একত্রিত করে কয়েকটা বই প্রকাশ হয়। সেগুলি হল 'গোয়েন্দা গন্ডালু', 'গন্ডালু ও রানী রূপমতীর রহস্য', 'গন্ডালু ও হাতিঘিসার হানাবাড়ি' আর 'গন্ডালু আর অলৌকিক বুদ্ধমূর্তি রহস্য'।
অবশ্য একটা খুব ভালো খবর আছে। এই বছরই নলিনী দাশের গল্প সমগ্রের প্রথম খন্ড প্রকাশ হচ্ছে কলকাতা বইমেলায়। তাই যদি কালু, মালু, বুলু আর টুলুর সাথে একসঙ্গে বেড়িয়ে পড়তে চাও নানারকম রোমাঞ্চকর অভিযানে, তাহলে যোগাড় করে ফেল এই বইএর একটি কপি। দেখ, শুধু গোয়েন্দা গন্ডালুকেই নয়, তুমি ভালবেসে ফেলবে তাদের স্রষ্টাকেও।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শ্রী অমিতানন্দ দাশ
মহাশ্বেতা রায়।
পাটুলি, কলকাতা