-২-
তাই বলে আবার ভেবে বোসনা যেন যে রোজ রোজই ফেনা ভাত খেতাম। তোমরা কী রোজ একরকম খাবার খাও নাকি? একঘেয়েমি কাটাতে মাকে হিমশিম খেতে হয়না? আমার জন্য ও নানারকম ব্যবস্থা থাকত। সে সব বলতে বসলে সব শুনতে ভাল লাগবে না তো বটেই, এমনকি আমাকে "পেটুক বুড়ো" ভেবে বসবে। তবে একেবারেই কিছু না বললে কেমন করে হয়! যেমন ধর, শীতের সকালে রোদে পিঠ দিয়ে বসে বাসি পিঠে-পায়েস খাওয়ার মজাই আলাদা। তোমাদের নিশ্চয়-ই এরকম অভিজ্ঞতা আছে। এছাড়া মোয়া মুড়কি, চিঁড়ে-পাটালি ও থাকত পালটে পালটে।
আমাদের বাড়ির কাজের ছেলে ছিল হরিশ। ওর দাদার নাম ছিল জিকা। ও খেজুর গাছ থেকে রস বার করত। মাঝে মাঝে সকালে এসে ডাকাডাকি শুরু করে দিত-"কী বেণুবাবু, একটু রস হবে নাকি? গেলাস নিয়ে এস..." শীতের ভোরে হি হি কাঁপতে কাঁপতে দুই গ্লাস রস ঢক ঢক করে গিলে ফেলতাম। এই অনুভূতিটা বলে বা লিখে বোঝানো যায়না। পারলে একবার গ্রামে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা করে এস। ভুলতে পারবে না কখনো।
যাকগে, যে কথা বলছিলাম... সকালের খাওয়ার পাট চুকলে যতক্ষন না পাঠশালা যাবার সময় হচ্ছে ততক্ষন যা খুশি কর।
এই সময়ে দাদু মাঝে মাঝে হারমনিয়াম নিয়ে গান গাইতে বসতেন। তিনি ভাল গান করতেন। এক এক দিন আমাকে ডেকে নিতেন। দাদুর সঙ্গে গলা মেলাতাম ঠিকই তবে কতটা হত বলা মুশকিল। এরকম একটা গানের কথা মনে আছে -"আজি এসেছি বন্ধু হে..."
পাঠশালা যাওয়ার সময় দিয়ানি স্নান করিয়ে খাইয়েদাইয়ে বইপত্র গুছিয়ে দিতেন। বই পত্রের কথা বললাম যেন কতই বই ছিল তোমাদের মত!। মাত্র তো দুখানা বই! একটা বর্ণপরিচয় আর একটা ধারাপাত। এছাড়া ছিল সেই ভারি স্লেট খানা আর পেন্সিল।
আমার শিক্ষার শুরু হয়েছিল যাঁদের হাতে তাঁদের প্রথম জনের নাম তো আগেই বলেছি। তিনি আমার দাদু। এর পর যাঁর নাম করতে হয় তিনি হলেন পাঠশালার "হেড স্যার", যিনি "বড় মাস্টার" নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। মোট তিনজন শিক্ষকের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রধান। নাম ছিল রামসুন্দর বাবু। গ্রামের লোকেরা পাঠশালাকে বলত রামসুন্দরের পাঠশালা।
অতি সাধারণ পোষাক ছিল তাঁর। হাঁটুর ওপর তোলা ধুতি, গায়ে ফতুয়া, পায়েও একটা কিছু থাকত। দেখতে কালো, রোগা, ঢ্যাঙামত এবং মাথায় কদমছাঁট পাকা চুল। আর বয়স? পঞ্চাশ থেকে সত্তর - যে কোন একটা।
যেকোন কারনেই হোক, তিনি মাঝে মাঝেই কামাই করতেন। যেদিন আসতেন বেশির ভাগ দিনই মেজাজ থাকত তিরিক্ষি। হাতে একটা লিকলিকে বেত নাচাতে নাচাতে পড়াতেন। কী যে ভয় করত, বাপরে! জানা জিনিস ভুল হয়ে যেত। অবশ্য আমি কোনদিন শাস্তি পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। সোমবারটা হত ভয়ঙ্কর। বেঞ্চিতে সপাং করে বেতটা মেরে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করতেন "আজ কী বার?"-অর্থাৎ গতকাল রবিবার ছিল, তাই সোমবার পড়া চাই-ই চাই!!
তোমরা "পথের পাঁচালি" বইটা পড়েছ, বা সিনেমাটা দেখেছ? অপুর পাঠশালার কথা মনে পড়ে? সেই যে গুরুমশাই যিনি মুদিখানা চালাতেন, পাড়ার মাতব্বরদের সাথে আড্ডা দিতেন, আবার পড়াতেন ও!
আমাদের বড় মাস্টার ও কতকটা সেরকমই ছিলেন। তিনি দোকান চালাতেন না, তবে পাশা খেলার দারুন নেশা ছিল।খেলতেন আবার আমার দাদুর সাথে। সেই কারণেই বোধহয় আমি কখনো শাস্তি পেতাম না। আমাদের ধারাপাত মুখস্থ করতে দিয়ে তিনি চলে যেতেন পাশা খেলতে!
ধারাপাত মুখস্থ করার ব্যপারটা ছিল বেশ মজার। শ্রেণীর সবচেয়ে গাঁট্টাগোট্টা ছেলে ছিল আমার বন্ধু ছানু, তাকেই ডেকে নিতেন তিনি। ছানু জোরে চেঁচিয়ে বলত, "একে চন্দ্র-অ-অ-অ" বাকিরা একসাথে চিতকার করে সেটাই আবার বলত। এরকম করে এক থেকে একশো পর্যন্ত চলত। শুনবে নাকি কিছু কিছু? প্রথমে এক থেকে দশ এরকম -
একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ,
তিনে নেত্র, চারে বেদ,
পাঁচে পঞ্চবান, ছয়ে ঋতু,
সাতে সমুদ্র, আটে অষ্টবসু,
নয়ে নবগ্রহ, দশে দিক।
এর পরে "একের পিঠে এক এগারো, একের পিঠে দুই বারো..." এমন করে চলত, "নয়ের পিঠে নয় নিরানব্বই, একে শূণ্য দশ, দশে শূণ্য 'শ। অর্থাৎ এক থেকে একশো পর্যন্ত গোনা শেষ। এরকম বলতে হত বারবার। ক্লান্ত হয়ে পড়তাম একেবারে, গলা নেমে আসত আমাদের।
পাঠশালা ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছে। পাশা খেলার হারজিতের খবর সবটাই কানে আসত পরিষ্কার ভাবে। বেশ মজা পেতাম আমরা। বড় মাস্টার জিতলে চিতকার করে দাদুকে দুয়ো দিয়ে পাড়া মাথায় করতেন।
একটা করে দান শেষ হওয়ার পর খেয়াল হত ছাত্রদের পড়তে দিয়ে আসার কথা। তাই মাঝে মাঝে হাঁক পাড়তেন আমাদের উদ্দেশ্যে। আমাদের ক্লান্ত গলা আবার হয়ে উঠত চনমনে।
তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ভুলেই যেতেন যে আমাদের পড়তে দিয়ে এসেছেন। তাই অন্য সকলের সাথে আমাদেরও সেদিনের মত ছুটি হয়ে যেত।
আমাদের বাড়ির কাজের ছেলে ছিল হরিশ। ওর দাদার নাম ছিল জিকা। ও খেজুর গাছ থেকে রস বার করত। মাঝে মাঝে সকালে এসে ডাকাডাকি শুরু করে দিত-"কী বেণুবাবু, একটু রস হবে নাকি? গেলাস নিয়ে এস..." শীতের ভোরে হি হি কাঁপতে কাঁপতে দুই গ্লাস রস ঢক ঢক করে গিলে ফেলতাম। এই অনুভূতিটা বলে বা লিখে বোঝানো যায়না। পারলে একবার গ্রামে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা করে এস। ভুলতে পারবে না কখনো।
যাকগে, যে কথা বলছিলাম... সকালের খাওয়ার পাট চুকলে যতক্ষন না পাঠশালা যাবার সময় হচ্ছে ততক্ষন যা খুশি কর।
এই সময়ে দাদু মাঝে মাঝে হারমনিয়াম নিয়ে গান গাইতে বসতেন। তিনি ভাল গান করতেন। এক এক দিন আমাকে ডেকে নিতেন। দাদুর সঙ্গে গলা মেলাতাম ঠিকই তবে কতটা হত বলা মুশকিল। এরকম একটা গানের কথা মনে আছে -"আজি এসেছি বন্ধু হে..."
পাঠশালা যাওয়ার সময় দিয়ানি স্নান করিয়ে খাইয়েদাইয়ে বইপত্র গুছিয়ে দিতেন। বই পত্রের কথা বললাম যেন কতই বই ছিল তোমাদের মত!। মাত্র তো দুখানা বই! একটা বর্ণপরিচয় আর একটা ধারাপাত। এছাড়া ছিল সেই ভারি স্লেট খানা আর পেন্সিল।
আমার শিক্ষার শুরু হয়েছিল যাঁদের হাতে তাঁদের প্রথম জনের নাম তো আগেই বলেছি। তিনি আমার দাদু। এর পর যাঁর নাম করতে হয় তিনি হলেন পাঠশালার "হেড স্যার", যিনি "বড় মাস্টার" নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। মোট তিনজন শিক্ষকের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রধান। নাম ছিল রামসুন্দর বাবু। গ্রামের লোকেরা পাঠশালাকে বলত রামসুন্দরের পাঠশালা।
অতি সাধারণ পোষাক ছিল তাঁর। হাঁটুর ওপর তোলা ধুতি, গায়ে ফতুয়া, পায়েও একটা কিছু থাকত। দেখতে কালো, রোগা, ঢ্যাঙামত এবং মাথায় কদমছাঁট পাকা চুল। আর বয়স? পঞ্চাশ থেকে সত্তর - যে কোন একটা।
যেকোন কারনেই হোক, তিনি মাঝে মাঝেই কামাই করতেন। যেদিন আসতেন বেশির ভাগ দিনই মেজাজ থাকত তিরিক্ষি। হাতে একটা লিকলিকে বেত নাচাতে নাচাতে পড়াতেন। কী যে ভয় করত, বাপরে! জানা জিনিস ভুল হয়ে যেত। অবশ্য আমি কোনদিন শাস্তি পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। সোমবারটা হত ভয়ঙ্কর। বেঞ্চিতে সপাং করে বেতটা মেরে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করতেন "আজ কী বার?"-অর্থাৎ গতকাল রবিবার ছিল, তাই সোমবার পড়া চাই-ই চাই!!
তোমরা "পথের পাঁচালি" বইটা পড়েছ, বা সিনেমাটা দেখেছ? অপুর পাঠশালার কথা মনে পড়ে? সেই যে গুরুমশাই যিনি মুদিখানা চালাতেন, পাড়ার মাতব্বরদের সাথে আড্ডা দিতেন, আবার পড়াতেন ও!
আমাদের বড় মাস্টার ও কতকটা সেরকমই ছিলেন। তিনি দোকান চালাতেন না, তবে পাশা খেলার দারুন নেশা ছিল।খেলতেন আবার আমার দাদুর সাথে। সেই কারণেই বোধহয় আমি কখনো শাস্তি পেতাম না। আমাদের ধারাপাত মুখস্থ করতে দিয়ে তিনি চলে যেতেন পাশা খেলতে!
ধারাপাত মুখস্থ করার ব্যপারটা ছিল বেশ মজার। শ্রেণীর সবচেয়ে গাঁট্টাগোট্টা ছেলে ছিল আমার বন্ধু ছানু, তাকেই ডেকে নিতেন তিনি। ছানু জোরে চেঁচিয়ে বলত, "একে চন্দ্র-অ-অ-অ" বাকিরা একসাথে চিতকার করে সেটাই আবার বলত। এরকম করে এক থেকে একশো পর্যন্ত চলত। শুনবে নাকি কিছু কিছু? প্রথমে এক থেকে দশ এরকম -
একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ,
তিনে নেত্র, চারে বেদ,
পাঁচে পঞ্চবান, ছয়ে ঋতু,
সাতে সমুদ্র, আটে অষ্টবসু,
নয়ে নবগ্রহ, দশে দিক।
এর পরে "একের পিঠে এক এগারো, একের পিঠে দুই বারো..." এমন করে চলত, "নয়ের পিঠে নয় নিরানব্বই, একে শূণ্য দশ, দশে শূণ্য 'শ। অর্থাৎ এক থেকে একশো পর্যন্ত গোনা শেষ। এরকম বলতে হত বারবার। ক্লান্ত হয়ে পড়তাম একেবারে, গলা নেমে আসত আমাদের।
পাঠশালা ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছে। পাশা খেলার হারজিতের খবর সবটাই কানে আসত পরিষ্কার ভাবে। বেশ মজা পেতাম আমরা। বড় মাস্টার জিতলে চিতকার করে দাদুকে দুয়ো দিয়ে পাড়া মাথায় করতেন।
একটা করে দান শেষ হওয়ার পর খেয়াল হত ছাত্রদের পড়তে দিয়ে আসার কথা। তাই মাঝে মাঝে হাঁক পাড়তেন আমাদের উদ্দেশ্যে। আমাদের ক্লান্ত গলা আবার হয়ে উঠত চনমনে।
তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ভুলেই যেতেন যে আমাদের পড়তে দিয়ে এসেছেন। তাই অন্য সকলের সাথে আমাদেরও সেদিনের মত ছুটি হয়ে যেত।
(ক্রমশঃ)
সন্তোষ কুমার রায়
রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান