আমাদের পৃথিবী থেকে প্রতিদিন একটি বা দুটি করে ভাষা চিরকালের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। মানে তারা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই ভাষায় কেউ কোনো দিন আর কথা বলবে না...কবিতা লিখবে না...গান গাইবে না। কি মনখারাপ হয়ে গেল বুঝি? আমারও মনটা ঠিক তোমারই মতন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যখন শুনলাম ভাষার এই হারিয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের দেশ ভারত থেকেও এরকম ভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে অনেক ভাষা। তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু সেটা তুলনায় অনেক কম। তুমি যখন অনেক বড় হবে তখন নিজের মাতৃভাষার সাথে এমন অনেক ভাষার খোঁজ রেখো যারা তোমার প্রতিবেশী কিম্বা তোমার দূরের দেশের বন্ধু। তাদের সাথে ভাব জমিও দেখবে কেমন মজা পাবে,আনন্দ হবে।
মাতৃভাষা যাতে হারিয়ে না যায়, মাতৃভাষা যেন তার যথার্থ সম্মান পায় তার জন্য বেশ কিছু তরুণ লড়েছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন। তাঁদের জন্যই বাংলা ভাষা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা। সেই ভাষার কল্যাণেই আমরা ইচ্ছামতীর ভেলা ভাসাতে পেরেছি ইন্টারনেটে। সেই ভাষাটা ভালোবাসো বলেই তুমি এই মুহুর্তে অমর একুশে পড়ছো। আর সেই ভাষায় বেঁচে থাকি বলেই একুশে আমাদের প্রাণ...বসন্তের এক টুকরো সকাল...মাথা উঁচু করে বলতে পারার দিন এটাই পৃথিবীর আন্তর্জাতিকমাতৃভাষা দিবস। এই দিনে বিশ্বের সব মানুষ শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় স্মরণ করে মাতৃভাষাকে...নিজের দেশকে।
এতক্ষণে হয়তো জানতে ইচ্ছে করছে একুশে ফেব্রুয়ারী ঠিক কী ঘটেছিলো। ভাষা আন্দোলনটা কি? তবে শোন সেই সময়ের সেই বীর গাথা।
১৫ আগষ্ট, ১৯৪৭ ভারতের যেমন স্বাধীনতা দিবস তেমনই ভারতবর্ষের দ্বিখন্ডিত হবার দিন। একটা গোটা দেশ দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। যে দুটো ভাই গায়ে গা লাগিয়ে ইস্কুলে যেত, মাঠে খেলতো,দুজনে একপাতে খেত,একই মায়ের কোলে ঘুমোতো তাদের জোর করে, ইচ্ছে করে দূরে সরিয়ে দেওয়া হল। একই মাকে ভাগ করা হল ভারত আর পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তান রয়ে গেলেন হাজার হাজার বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। তাদের ওপর জোর করে উর্দু ভাষার ব্যবহার চাপিয়ে দেওয়া হল।
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৮সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের আইন সভার প্রথম অধিবেশনে ইংরাজী ও উর্দুর সাথে বাংলাও হোক রাষ্ট্রভাষা এই প্রস্তাব রাখেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু তাঁর প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় এক বিশাল জন সভায় পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্না ঘোষণা করেন পাকিস্তানে উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আততায়ীর হাতে সেই সময়কার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের মৃত্যু হবার পর খাজা নিজামুদ্দিন প্রধান মন্ত্রী হন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী তিনি ঢাকার জনসমাবেশে জিন্নার কথাই পুনরাবৃত্তি করে বলেন,"উর্দু-একমাত্র উর্দুই হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা।" তাঁর এই উদ্ধত উক্তির প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় ভাষা সমিতি ৩০ জানুয়ারী সবাইকে হরতাল পালনের আহ্বান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গনে সিন্ধান্ত নেওয়া হয় ৪ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রের অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতীক ধর্মঘট পালন করা হবে। হরতালের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারী সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসকরা ছাত্রদের এই দাবী মানতে রাজী হন না। তাঁরা বিশ্ব বিদ্যালয়ের চত্বরে সমস্ত মিছিল, জমায়েত নিষিদ্ধ করে দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করেন। বিরোধী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতেরাও আসন্ন নির্বাচনের অজুহাতে ছাত্রদের এই ধর্মঘট তুলে নিতে বলেন। কিন্তু অধিকাংশ ছাত্ররা তাঁদের দাবীতে অবিচল থাকেন। ২১ ফেব্রুয়ারীর সকাল থেকেই ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের(বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ)চত্বরে জমায়েত হতে থাকেন। সেখানকার জমায়েত থেকেই তাঁরা প্রাদেশিক বিধান সভায় (বর্তমান জগন্নাথ হল) তাঁদের দাবী পেশ করতে ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল নিয়ে এগোতে থাকেন। মিছিলের গতিরোধ করতে পুলিশ প্রথমে শূন্যে গুলি ছোঁড়ে। ছাত্ররা কিন্তু তাতে ভয় পায় না, পিছু হটে না। বরং আরও সাহস নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। এবার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি বর্ষনের নির্দেশ আসে। গুলি চলে মুহুমূহু। মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত,মানিক গঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিকউদ্দীন আহমদ,গফরগাঁও গ্রামের তরুণ কৃষক আব্দুল জব্বার এবং ব্যাঙ্ক কর্মচারী অবদুস সালাম। এছাড়া আরও দুজন শহিদ হয়েছিলেন, তাদের দেহ ছাত্ররা পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। অসংখ্য আহত ছাত্র সেদিন তাঁদের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষার শপথ নিয়েছিলেন।
বর্বর এই পুলিশী হত্যাকান্ডের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে জমায়েত হন। ইস্কুল,কলেজ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে। সরকার পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে কার্ফু জারী করেন। ২২ ফেব্রুয়ারী সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ছাত্রদের আয়োজিত গায়েবী জানাজা মিছিলে (আততায়ীদের হাতে যাঁরা খুন হয়েছিলেন তাঁদের অনেকের দেহ পাওয়া যায় নি। তাই অদৃশ্য শব সজ্জিত সেই শবাধার নিয়ে যে মিছিল) অংশ নেন শতশত মানুষ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে ২৩ ফেব্রুয়ারী শহিদদের স্মৃতিতে ছাত্ররা রাতারাতি নির্মাণ করেন শহিদ মিনার। তিন দিন ধরে তাঁরা এই মিনার রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তারপর সরকারী পুলিশ বাহিনী এসে মিনার ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।
শহিদ মিনার ভেঙে ফেললেও মানুষের মন থেকে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা মুছে ফেলা যায় নি। প্রতিদিনের ধূমায়িত এই বিক্ষোভে পরাজিত শাসক গোষ্ঠী ৯ মে ১৯৫৪ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারীতে যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো...যে বিদ্রোহ মানুষের মনে একটু একটু করে জমে উঠছিলো তার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের লড়াইয়ে। সে এক অন্য গল্প একটা ছোট্ট দেশের এগিয়ে চলার...মাথা উঁচু করার আখ্যান। সময় পেলে অন্য কোনো একদিন শোনাবো সেই গল্প।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো (UNESCO) ২১ ফেব্রুয়ারী দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' রূপে স্বীকৃতি দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে ভাষা শহীদ মিনার
বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হল বাংলা । ভারতবর্ষের ২৩টি স্বীকৃত ভাষার মধ্যে একটি হল বাংলা। বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার সরকারি ভাষা। এছাড়া আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং অসম রাজ্যের দক্ষিনের তিনটি জেলায় বাংলা ভাষা প্রচলিত আছে। তাদের দেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফ থেকে উপস্থিত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীবাহিনী কে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে আফ্রিকার ছোট্ট দেশ সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে তাদের সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলাভাষার জন্য আরেকটি বিদ্রোহ হয়েছিল ১৯৬১ সালে অসমের বরাক উপত্যকায়, যখন অসম সরকার একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা রূপে ঘোষনা করে। ১৯শে মে, ১৯৬১ সালে শিলচরে ১১ জন তরুন ভাষার জন্য মৃত্যু বরণ করেন। শেষ অবধি অসম সরকার বাধ্য হয় কাছাড়, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দি- এই তিন জেলায় বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃতি দিতে।
সামনেই খোলা আছে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা 'একুশের গান'। ইচ্ছে করছে পড়তে...শুনবে কি তুমি?
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?
আমি কোনোদিন বাংলাদেশ যাইনি। ইচ্ছে আছে,স্বপ্ন আছে একবার যাওয়ার। শহিদ মিনারের সামনে একবার মাথা নীচু করে দাঁড়ানোর। মনে মনে বলা...ভুলিনি তোমাদের, ভুলবো না কোনোদিন...তোমাকে মাতৃভাষা।
কল্লোল লাহিড়ী
উত্তরপাড়া, হুগলী
সূত্র -
একুশে,প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা,মাতৃভাষা দিবস উদযাপন সমিতি,বালি
বাঙ্গালনামা ব্লগ
ছবি সূত্র
উইকিপিডিয়া