গতবারের পড়ে পাওয়া কি পড়েছিলে তুমি? তাহলে নিশ্চই এতক্ষণে পিঁপড়েদের সঙ্গে তোমার বেশ খানিকটা ভাব হয়ে গেছে। আর যদি এখনো পড়া না হয়ে থাকে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পড়ে নাও। আমি জানি তুমি ভাবছো- যে পিঁপড়ে কামড়ালে এতো জ্বালা করে, মা কোনো মিষ্টি খাবার রাখলেই লোভীদের মতো চারিদিক ঘিরে ধরে...নাছোড় হয়ে হামলা করে বার বার তাদের নিয়ে এতো আদিখ্যেতা কেন বাপু? আর কি কেউ নেই? সেই সুন্দর পাখাওয়ালা প্রজাপতি...সেই বদখত দেখতে কেঁচোটা আর সেই বেজারমুখো গঙ্গা ফড়িং যে কাকার গাড়ির উইন্ড স্ক্রিন থেকে কিছুতেই উড়ছিলো না...হাঁ করে চেয়েছিলো সবার দিকে তাদের নিয়ে লিখলেই তো হয়।
সত্যি এদের সবাইকে নিয়ে লিখেছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। তোমরা যদি কোনোদিন তাঁর 'বাংলার কীট-পতঙ্গ' বইটা পড় তাহলে সব জানতে পারবে। কি ধৈর্য ধরে এদের নিরীক্ষণ করতেন গোপালচন্দ্র তা যেন এক গল্প কথার মতো। অনেকে ভাবতো তিনি পাগল...খামখেয়ালী। কিন্তু যারা তাঁর কাজের সাথে পরিচিত ছিলেন তাঁরা জানতেন কি কঠিন বিষয়ের ওপর গবেষণা করে চলেছেন মানুষটি।
এই সময়ে 'ইথোলজি' বা 'অ্যানিম্যাল বিহেভিয়ার' একটি সুপরিচিত বিজ্ঞানের শাখা। ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি আর এনিমেল প্ল্যানেট ইত্যাদি টেলিভিশন চ্যানেলের সুবাদে আমরা খুবই পরিচিত এইসব শব্দ গুলো আর তাদের কর্মকান্ডের সাথে। সমুদ্রের তলায় ছোট্ট ছোট্ট মাছ থেকে শুরু করে বায়ুতে ভাসমান অদৃশ্য পোকার জীবন কান্ড আজ আমরা সহজেই বসে দেখে নিই রাতের খাবার খেতে খেতে। কিন্তু গোপালচন্দ্র যখন তাঁর কাজ শুরু করেন তখন কিন্তু এত সুগম ছিলো না তাঁর পথ। অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে নিজের মতকে নিজের পথকে। মনে রেখো তখন কিন্তু দেশ পরাধীন। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন না থাকায় কাজের এবং গবেষণায় এগিয়ে থাকলেও তাঁর সাথে কাজে অস্বীকার করেন এক বিজ্ঞানী। কিন্তু ফিরে আসেননি গোপালচন্দ্র। নিজে ভেঙে পড়েননি। কাজে পেয়েছেন আরো উতসাহ ও উদ্দীপনা। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে এক সামান্য চাকরী থেকে অর্জন করে নেন গবেষকের পদমর্যাদা। হাজারের ওপর প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলায়। মাতৃভাষাতে বিজ্ঞান চর্চার যে সূত্রপাত করেছিলেন তাঁর পূর্বসূরীরা তাকেই খুব সার্থক ভাবে বহন করে নিয়ে গেছেন গোপালচন্দ্র।
জন্ম হয়েছিলো অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরের এক অখ্যাত গ্রাম লনসিঙে ১৮৯৫ সালের ১১ আগষ্ট। বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। দারিদ্রের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছেন গোপালচন্দ্র। বাবা অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য পুজো আর স্থানীয় জমিদারের খাতা লিখে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে কোনোক্রমে সংসার চালাতেন মা শশিমুখীদেবী। খুব তাড়াতাড়ি কাজে ঢুকতে হয় গোপালচন্দ্রকে। মাঝপথেই থেমে যায় পড়াশুনো। স্কুল শিক্ষকের চাকরী নেন। এই সময় বিশেষভাবে সাহিত্যের দিকে আগ্রহ বাড়ে তাঁর। লিখতে থাকেন সারি গান, জারি গান,পালা গান। আবার চাকরী বদল এইভাবে ১৯১৮ সালে যখন তিনি এক বিদেশী কোম্পানীর টেলিফোন অপারেটর সেই সময় নামকরা 'প্রবাসী'পত্রিকায় প্রকাশিত হয় 'জৈবদ্যুতি'নামে তাঁর লেখা এক বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। সেই লেখা চোখে পড়ে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর। তিনি গোপালচন্দ্রকে নিয়ে আসেন তাঁর সদ্য প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে আজ যা বোস ইনস্টিটিউট নামে বিখ্যাত। খুব সাধারণ কাজ দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করেন জীবনটাকে। প্রকৃতি অন্ত প্রাণ ছিলো যে মানুষটার তিনি পেলেন গবেষণার নতুন বিষয়। ১৯৩২ সালে তিনি প্রথম তাঁর গবেষণা পত্র পেশ করেন। ১৯৫১ সালে অংশ গ্রহণ করেন প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে ন্যাচারাল হিস্ট্রির মতো আন্তর্জাতিক পত্রিকায়। ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরষ্কার আর ১৯৭৫ সালে রবীন্দ্র পুরষ্কার।
কিন্তু পুরষ্কার দিয়েই কি মানুষটাকে চেনা যায় নাকি? কখোনোই নয়। এমনটা কখোনো মনেই এনো না। যিনি রোদে পুড়ে, জলে ভিজে পরম মমতায় লিখলেন পিঁপড়দের সমন্ধে, প্রজাপতিদের সম্বন্ধে। জানালেন মৌমাছিদের রকম সকম...ঘরকন্না...পঙ্গপালের ছবি তুললেন অভাবনীয় দক্ষতায়, লিখলেন তাদের কথা এবার সময় এসেছে তাঁকে ফিরে দেখার। তাঁকে নিয়ে পড়াশুনোর। এই লেখাটা পড়তে পড়তেই একটা প্রমিস করো না নিজের মনে মনে যে খুব তাড়াতাড়ি তুমি পড়ে ফেলবে 'বাংলার কীট পতঙ্গ' বইটা। এতো সহজ সরল ভাষায় কেই বা আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন এক অচেনা অদেখা জগতকে। কেই বা বন্ধুতা পাতাবেন পিঁপড়ের সাথে...পঙ্গপালের সাথে। তুমি কি বন্ধু হবে? তাহলে সেই মতো তৈরী হও এখন থেকে।