এবারে যাই মাটির তলায় এক রাজ প্রাসাদে। রাজপ্রাসাদ বললে চোখের সামনে যা ভেসে ওঠে এই প্রাসাদ ও তাই, শুধু বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায়না রাজপ্রাসাদ এর শুরু কোথায় আর শেষ কোথায়; কিংবা কটা মহল আছে, কোথায়ই বা কটা থাম। অবাক লাগছে? তাহলে আরো বলি - এই প্রাসাদে একফোঁটাও আলো ঢোকে না। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে এত অন্ধকার যে নিজের হাতটা চোখের সামনে তুলে ধরলে দেখা যায় না।নিঃস্তব্ধ, ছমছমে, একটুও বাতাস নেই। চারিদিকে দম বন্ধকরা পরিবেশ। এই প্রাসাদে কোন রাজা নেই, রানি নেই, রাজপুত্র নেই, নেই কোন রাজকন্যা। নেই কোন প্রহরী এই রাজপ্রাসাদের সামনে। প্রাসাদ বানাতে কোন রাজ মিস্ত্রী লাগেনি, লাগেনি চূণ সুরকি। এই প্রাসাদ মানুষের বানানো নয়। কান পাতলে শুনতে পাবে না কোন আওয়াজ। ভূতের গল্পের বইতে যে সব জায়গায় ভূতেরা থাকতে ভালবাসে - সেরকম একটা জায়গা। মনে হবে আরেক পা এগোলেই কঙ্কাল আর খুলির ওপর পা পড়বে! জোর করে দেখার চেষ্টা করলে দেখবে কোণ থেকে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ তোমাকে দেখছে। এই একটা রক্তখেকো বাদুর উড়ে গায়ে পড়ল বলে। কিংবা আগে আগে যে লোকটা এতক্ষন ধীরে ধীরে হাঁটছিল, সে হটাত পেছন ঘুরে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে- তার চোখ দুটো জ্বলছে- ভয়ানক একটা হাসি হেসে ঘাড় নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছে। ভয় লাগছে নাকি? ভাবছ ছুটে পালানোর রাস্তাটা কোথায়? নাকি ভাবছ কে বানাল এই প্রাসাদ? আর এত অন্ধকারই বা কেন?
ফ্লোরিডার ক্যাভার্নস স্টেট পার্কের প্রবেশপথ। আমাদের গাইড গুহার দরজা খুলছেন
এবার আমরা যাব দুটো দারুন জায়গায়- ফ্লোরিডা ক্যাভার্ন্স স্টেট পার্ক, ফ্লোরিডা তে আর ওনান্ডাগা কেভস স্টেট পার্ক, মিসৌরি তে। দুটো জায়গাই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে।
এই জায়গা দুটোয় ঢুকতে গেলে একজন গাইড এর সাথে যেতে হয়। আমাদের আগে চলেছে আমাদের গাইড। মাটির মধ্যে হটাত একটা গর্ত আর তাতে সিঁড়ি করা আছে গুহার মধ্যে যাওয়ার জন্য। দর্শকদের দেখার জন্য ভেতরে কিছু আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে ছাদ থেকে লম্বা লম্বা কি সব ঝুলছে। তারপর চোখটা ধাতস্থ হয়ে গেলে দেখলাম সে মাটির থেকেও কি সব ওপোরের দিকে উঠে আছে। গাইড বললেন যে ছাত থেকে যেটা ঝুলছে সেটা স্ট্যালাকটাইট (stalactite) আর মাটি থেকে যেটা ওপর দিকে উঠে আছে সেটা স্ট্যালাগমাইট (stalagmite)।
স্ট্যালাকটাইট, ছাত থেকে ঝুলছে, ওনান্ডাগা, মিসৌরি
স্ট্যালাগমাইট, মাটির থেকে উঠেছে,ওনান্ডাগা, মিসৌরি
মনে রাখার সুবিধার জন্য গাইড বলে দিলেন স্ট্যালাগমাইট (stalagmite) এ 'g' আছে। 'G' হল 'ground' -জমির প্রথম অক্ষর। এরপর আমাদের বললেন অনুমান করতে ওই স্ট্যালাকটাইট এর বয়স কতে পারে? কি মনে হয় তোমার? কত দিন লাগতে পারে ওই পাথরটা জমতে? দুই বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর? না। ভাবতে অবাক লাগবে এইরকম সরু, কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়ার স্ট্র এর মতন সরু একটা জমতে পাঁচ থেকে দশ হাজার বছর লাগে!!
স্ট্র স্ট্যালাকটাইট, ওনান্ডাগা, মিসৌরি
জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিশেষ ধরনের পাথরের মধ্যে দিয়ে পড়তে থাকলে এই ধরনের আকার তৈরি হতে পারে। মুক্তো তৈরি হবার মতনই আশ্চর্যজনক এই ঘটনা। তাই ওই গুহার মধ্যে যেখানে যেখানে ওইরকম আকৃতি হয়ে আছে, সেখানে হাত দেওয়া নিষেধ। হাত দিলে কি হবে জানতো? আর স্ট্যালাকটাইট বা স্ট্যালাগমাইট বাড়তে পারবে না। কারন আমাদের হাত তো তেলতেল। হাতের তেল লেগে গেলে পাথর আর জমতে পারবে না। সবচেয়ে মজা হল, যেখানে স্ট্যালাকটাইট হবে, তার ঠিক নিচে, একদম নিচে, স্ট্যালাগমাইট হবেই হবে।
কিন্ত এরকম হয় কেন? তাহলে শোনো, এই সবের শুরু এক ফোঁটা জল থেকে। মাটির ওপর থেকে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে গুহার মধ্যে ঢুকল। জল মাটির মধ্যে দিয়ে যায় বলে আশে পাশে যা আছে তা জলের মধ্যে গুলে যায়। তাই আশে পাশে যদি চুনাপাথর জাতীয় পাথর থাকে তাহলে জলের মধ্যে চুণাপাথরের মিশ্রন বেশি হয়ে যায়। এবারে জলটা যখন গুহাতে পড়ছে তখন সেই চুনাপাথর জমতে শুরু করে, আর তৈরি হয় স্ট্যালাকটাইট। আর জল যখন, সেটা তো মাধ্যাকর্ষণের জন্য নিচের দিকে পড়বেই। তাই গুহার ছাত থেকে জল ফোঁটা ফোঁটা করে মেঝেতে পড়ে। সেইখানে মেঝেতে তৈরি হয় স্ট্যালাগমাইট, একদম স্ট্যালাকটাইট এর ঠিক নিচে।
জলের ফোঁটা পড়ছে
স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট কিসের মত দেখতে ভাব তো? দেখে মনে হয়না বিভিন্ন মাপের গাজর ঝুলছে ছাত থেকে? তাই বিজ্ঞানীরা স্ট্যালাকটাইট এর আকৃতি গাজরের সাথে তুলনা করেন। তবে এরা কিন্তু গাজরের মত তাড়াতাড়ি বাড়েনা। বছরে সাধারনভাবে ১ সেন্টিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ হয়ত বাড়ে। তাইত হাজার হাজার বছর সময় লাগে একটা স্ট্যালাকটাইট বা স্ট্যালাগমাইট তৈরি হতে। আর এইভাবে জমতে জমতে একসময় ছাত থেকে নেমে আসা স্ট্যালাকটাইট আর জমি থেকে বাড়তে থাকা স্ট্যালাগমাইট জুড়ে যায়। তখন সেটা একটা থামের মত হয়ে যায়। কোন থাম বিশাল মোটা, কোনটা সরু, কোনটা ল্যাম্প-পোস্টের মত দেখতে। নিচের ছবিগুলি ওনান্ডাগাতে তোলা -
স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাগমাইট জুড়ছে
কি মনে হচ্ছে কেউ কি বাঁচতে পারে এই পরিবেশে? নিশ্চয় পারে। প্রকৃতিতে জীবন যেখানে সুযোগ পায় বেড়ে ওঠে। এই গুহাপ্রাসাদের মধ্যেও জীবন আছে। বাদুর, সালামান্ডার এর মত প্রাণী এইরকম পরিবেশ ভাল বাসে। এছাড়া চিংড়ির মত দেখতে একধরনের প্রাণীও থাকে গুহার ভেতরে হলে থাকা জলে।
ঘুমন্ত বাদুর
ঝিনুকের জীবাশ্ম
তিমির দাঁতের জীবাশ্ম
এবারে আমরা আরেকটা ঘরে যাই। রাস্তা করা আছে দেখার সুবিধার জন্য। কিছু জায়গা এত নিচু আর সরু যে মাথা নুইয়ে যেতে হয়।
গুহার ভেতর- চারিপাশে স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাগমাইট
গুহার ভেতরে কোন কোন জায়গা এত বড় যে কথা বললে গম গম আওয়াজ ওঠে। এই মাটির নিচের প্রাসাদে কোন ঘর আবার খুব সাজানো, যেন নক্সা করা পর্দা ঝুলছে ছাত থেকে জমি অবধি। আবার অন্য দিকে তাকালে মনে হবে যেন বাগান হয়ে আছে কোন ঘরে আবার ফোয়ারা, আর জলের বুকে যেন পদ্ম, শালুক ফুটে আছে। এই প্রাসাদের প্রধান দরবারের ছাত ৯০ ফুট উচুঁ কিন্তু। চারিপাশে নক্সা করা থাম মেঝে থেকে ছাত অবধি। জায়গাটা এত বড় যে তার মধ্যে চারটে ক্রিকেট স্টেডিয়াম ঢুকে যাবে। নিচের কিছু ছবি আমার খুব ভাল লাগে, ভাবলাম তোমাকেও দেখাই -
জলের মধ্যে স্ট্যালাগমাইট- যেন ফুল ফুটেছে
নদীর মত দেখতে স্ট্যালাকটাইট জমা হয়েছে (মিসৌরি)
গুহার মধ্যে জলে স্ট্যালাকটাইটের ছায়া
এই স্ট্যালাকটাইটগুলো দেখতে পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান ছবির জলদস্যুদের দাড়ির মত লাগছে না?
কত বড় আর উঁচু ছাত ভাব- ওপর থেকে স্ট্যালাকটাইটের ঝর্না নামছে
আজ এই পর্যন্ত থাক। এখন এখানে বসন্তের ফুলে ভরে আছে চারিদিক। টেক্সাসের রাস্তার দুধারে বুনোফুল হয়ে থাকে। রাস্তা ধরে গেলে রাস্তার দুপাশে লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ সব রঙের ফুলে ভরে আছে। খুব সুন্দর লাগে দেখতে। এবারের ছবিগুলি আমার স্ত্রী আর আমার তোলা। যদি স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট এর বিষয়ে আরো জানতে চাও, তাহলে http://en.wikipedia.org/wiki/Stalagmite আর http://en.wikipedia.org/wiki/Stalactite পড়ে নিও।