সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
চিঠির জবাব

সিরাজুল,

যে চিঠিটা কয়েকদিন ধরে মনের আস্তিনে জড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ভিড় বাসে উঠে...ট্রেনের গুঁতোগুতিতে...অনেক রাতে বাড়ি ফেরার পথে যে শব্দগুলোকে, বাক্যগুলোকে এনে জড়ো করতে চাইছি আমার ল্যাপটপের স্ক্রিনে, তারা ক্রমশ কথা না শোনার মতো অবাধ্য হয়ে উঠছে। আর কিছুতেই লেখা হয়ে উঠছে না তোমার চিঠির জবাব। ওকি! মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছো তুমি সিরাজুল? ভাবছো এ আর এমন কি? কত কত চিঠির জবাব তো না দেওয়া অবস্থায় পড়ে থাকে সরকারী দপ্তরে...পত্রিকার সম্পাদকের অফিসে...নতুন কবির কবিতা লেখার খাতায়...সন্তানের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকা মায়ের চোখের জলে। দুষ্টুমিটা আমি তোমার ধরে ফেলেছি সিরাজুল। রচনা লেখা প্রতিযোগিতায় স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়েছো বলে আমাকে তুমি শব্দের জালে আষ্টে পৃষ্ঠে বাঁধতে চাইছো। ঠিক যেমন করে গফুর চাচারা তোমাদের সেই বাঁধের ধারের পুকুর থেকে দুষ্টু কুমীরটাকে বেঁধেছিল। আর তারপর ছেড়ে দিয়ে এসেছিল মাথাভাঙার গভীর জলের স্রোতে। কি বলছো আড়ি করেছো আমার সাথে? শুনতে চাও না আমার কথা? ভাবছো রাগ করার ভয় দেখিয়ে আমাকে পিছু হটাবে? সে আমি কিছুতেই হতে দেবো না সিরাজুল। কভি নেহি...! আমাকে আনন্দি কানে কানে ফুস মন্তরে জানিয়েছে ঈদের দিন তুমি পাখিরালার খেয়া ঘাটে বসেছিলে অনেকক্ষণ। করছিলে আমার প্রতীক্ষা। ওখানে ওই বড় সজনে গাছটার তলায় বসে লিখে ফেলেছিলে রাগ আর দুঃখের সেই বড় চিঠিটা। তুমি কি জানো সিরাজুল আমি তোমার সেই নীল খামের চিঠিটা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি আজ সমস্ত দিন। এই যে এখন লিখছি তোমার জন্যে একটা ইয়াবড় চিঠির জবাব সেখানেও সামনে খোলা রয়েছে তোমার সুন্দর হাতের লেখায় লেখা চিঠিটা। এতোক্ষণে নিশ্চই তোমার একটু রাগ কমেছে সিরাজুল। আমি তো বেশ দেখতে পাচ্ছি মাটির দাওয়ায় শরতের সকালের রোদে পিঠ দিয়ে তুমি আনন্দিকে পড়ে শোনাচ্ছো আমার চিঠি। ওদিকে দাদি মুড়ি দিয়ে খাবার জন্যে ভাজছেন ডালের বড়া। আম্মা পুকুড় থেকে তুলে নিয়ে এসেছেন কলমি শাক। আর আব্বু বাজার থেকে এনেছেন ইলিশ মাছ। জানি ইলিশ মাছের নাম শুনে তুমি মুখ শিঁটকোবে। কাঁটা বেছে খেতে যে জানো না, সেটা কি তোমার ক্লাস নাইনের সব বন্ধুরা জানে? ওকি মুখ ঘুরিয়ে চললে কোথায়? আচ্ছা...বাবা...ঠিক আছে। এই নাক মুলছি...কান মুলছি...বাবা বসন্ত রায়... মা বন বিবির দিব্বি! বলবো না আর এমন কথা। সে তুমি মাছের কাঁটা বেছে খাও...আর নাই খাও। গলায় ফোটাও...যা ইচ্ছে করো। তবে এটা কি জানো সিরাজুল, তোমাদের নোনা পানির চৌহদ্দি ছেড়ে কেনো ইলিশ মাছ আমাদের এই মিষ্টি পানির দিকে চলে আসে? ওরা ডিম পাড়ে যে এখানে এসে। ওরা কিন্তু আসে ওদের নিজেদের ইচ্ছায়। জৈবিক তাড়নায়। স্বাধীনভাবে। কিন্তু ওদের যদি কেউ ভয় দেখিয়ে, বন্দুক উঁচিয়ে, মারধোর করে নিজের জায়গা থেকে তাড়িয়ে দিতো তাহলে ওরা হয়ে যেত 'উদ্বাস্তু'। মিষ্টি জলে এসে ওদের থাকতে হতো। আর সেটা হতো ওদের জন্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর। বাঁচতেও যে পারতো না ওরা ঠিক করে। নিজের জায়গা ছেড়ে অন্যের জায়গায় গিয়ে কি ঠিক থাকতে পারে কেউ বেশিদিন? পারে না। কাজেই এবার বুঝতে পারছো নিশ্চই তোমার রচনায় 'শরণার্থী' বানান ভুলটা যে বাংলার দীপক স্যার ভালো চোখে দেখেননি, লাল কালীর খোঁচা দিয়ে কেটে দিয়েছেন এবং তোমাকে এক নম্বর কম দিয়েছেন সেটা মোটেই ইচ্ছে করে নয়। এর পেছনে ন্যায় সঙ্গত অনেক কারণ আছে।

চিঠির জবাব

তুমি লিখছো উদ্বাস্তু নিয়ে রচনা আর বানান ভুল করছো শরণার্থীর? মুশকিলটা হয়েছে ওখানেই। যে শব্দটা ভুল করেছো সেটার আপাত অর্থ শরণ নেওয়া হলেও কাদের শরণ, কোথায় শরণ নেওয়ার কথা বলছো একবার ভেবে দেখেছো সিরাজুল? যাদের জোর করা হয়েছে নিজেদের দেশ ছাড়তে, নিজেদের বাড়ি ছাড়তে, বন্দুকের ভয় দেখিয়ে, দিনের পর দিন না খেতে দিয়ে, সব রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কিম্বা যারা নিজের দেশকেই আর প্রাণ বাঁচানোর আদর্শ জায়গা বলে ভাবতে পারছে না। দীর্ঘ দিনের খরা, বন্যা, রাহাজানি তাদের রেখেছে ভয়ে, অস্তিত্ত্ব হীনতায়, প্রাণ সংশয়ে। তারাই তো জীবনের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে ভিটে মাটিকে পরিত্যাগ করছে। না হলে কেউ তার সাধের গ্রাম ছেড়ে, দেশ ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁটে অন্যের দেশের কাঁটাতার ডিঙোতে যাবে কেনো? কেনো বিপদসঙ্কুল সমুদ্র পার হতে যাবে? তুমি লিখেছো সেই বাচ্চা ছেলেটার কথা। লিখেছো খবরের কাগজে ছবি দেখার পর রাতে ঘুম হয়নি তোমার। আনন্দি যাতে দেখতে না পায় লুকিয়ে রেখেছিলে কাগজটা টালির চালে বাকারির নীচে। তোমার এই মন খারাপটাই যে বাঁচিয়ে রেখেছে তোমার রচনায় সেই বাচ্চা ছেলেটাকে যে সমুদ্রে পাড়ি দিলো বাবা-মার সাথে নতুন দেশে, নতুন বাড়ি খোঁজার তাড়নায়। তারপর একদিন সমুদ্র ফিরিয়ে দিলো তার নিস্তেজ শরীরটা। তুমি লিখেছো সিরিয়ার কথা, ইরাকের কথা, আফগানিস্তানের কথা। সেইসব মানুষদের কথা যারা দেশ ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, আত্মীয় পরিজন ছেড়ে ঠিক এখন এই মুহূর্তে কাটাচ্ছেন নিদ্রা বিহীন রাত গুলো রাস্তায়। ঈদের আনন্দের মাঝে...পুজোর খুশির মাঝেও তাই মন খারাপের শিশির বিন্দু তোমার রচনার খাতায়, আমার এই মুহূর্তের চিলে কোঠার ঘরে, নীল খামের চিঠির পরতে পরতে।

তোমার কি মনে আছে সিরাজুল সেই শীতের রাতের কথা? দাদি বলছিলেন কী করে গফুর চাচার নৌকা করে পালিয়ে এসেছিলেন নিজের গ্রাম ছেড়ে, জমি ছেড়ে। দেশ স্বাধীন মানে তো মুক্তির আস্বাদ। আনন্দের তুফান। সেখানে মাঝরাতে নিজের জমিটাই কি করে পরের জমি হয়ে যাবে? ভাই কেন ভাইয়ের বুকে ছুড়ি বসাবে? তোমার কি মনে আছে সিরাজুল? সেইদিন রাতে সুন্দরবনের ঝিম ধরা অন্ধকারে দাদি আমাদের কী দেখিয়েছিলেন? কাঁপা কাঁপা কুপির আলোয় আমরা দেখেছিলাম সেই ছোট্ট পেতলের কৌটোটা, যেখানে দাদি যত্ন করে তুলে রেখেছেন দেশের মাটি। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে উদ্বাস্তুর সংখ্যা যে কতটা বেড়ে গেছে তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। ইন্টারনেট থেকে যে পরিসংখ্যানটা তুমি আমাকে দিয়েছো সেটা হয়তো এই কয়েকদিনে আরো কয়েকশো লাফে অনেক গুন বেড়ে গেছে। কেমন করে জানতে চাইছো তো? তাহলে শোনো। তুমি যখন আমার এই চিঠিটা মন দিয়ে পড়ছো তখনো হয়তো কোনো এক পরিবার, কোনো এক সিরাজুল, কোনো এক কল্লোল তাদের বাড়ি ছেড়ে, পাড়া ছেড়ে, দেশ ছেড়ে রওনা দিচ্ছে অন্য এক নতুন দেশে। সেখানে পেছনে পড়ে থাকছে গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, স্কুলের মন কেমনের উঠোন। তারা যে নিজের ইচ্ছেতে দেশ ছাড়ছে এমনটা নয় কিন্তু সিরাজুল। তাদের বাধ্য করা হচ্ছে।

কি ? আরো ভারী হয়ে গেল মন সিরাজুল? ভাবছো কোথায় আমরা আলোচনা করবো অন্যবারের মতো শরতের পেঁজা পেঁজা তুলোটে মেঘের, শিউলি ফুলের। কোথায় আমরা পুজোয় নতুন জামা-কাপড় নিয়ে আলোচনা করবো, নতুন গল্পের বই নিয়ে কথা বলব আর কোথা থেকে চলে এলো তোমার সেই রচনা...আমাদের লুকিয়ে রাখা দুঃখ গুলো। তোমার মাটির ঘরে পড়ার টেবিলের সামনে যে লোকটার ছবি সেঁটে রেখেছো, যে লোকটা একটা প্রজাপতি গোঁফ, একটা বিরাট সাইজের ঢোলা প্যান্ট, ছেঁড়া কোট, ফুটো টুপি আর ব্যাঁকা ছড়ি নিয়ে সারা বিশ্ব ভ্রমণ করলো। মানুষের মন জয় করলো। সেই ট্র্যাম্প ও তো উদ্বাস্ত ছিল। কিন্তু প্রাণে খুশির তুফানটা কম ছিল না লোকটার। এবার যখন যাবো তখন সেই ভুবন বিখ্যাত লোকটার নিজের লেখা বই তোমার জন্যে নিয়ে যাবো সিরাজুল। কথা দিলাম। আর রাগ করে থেকো না। বিকেলের দিকে ফাঁক পেলে আনন্দিকে নিয়ে সুবোচনির নতুন গজিয়ে ওঠা চরটা একবার ঘুরে এসো তো। কেমন কাশফুল হয়েছে আমাকে জানাবে। শীতকালে হয়তো তোমার সাথে আবার আমার দেখা হবে পাখিরালার খেয়া ঘাটে। তখন মজা করে পাট কাঠি খেজুর রসে ডুবিয়ে সোঁ সোঁ করে টান দিতে দিতে বাকি গল্পটা সারবো আমরা।

ভালো থেকো সিরাজুল।

তোমার আর আনন্দির জন্যে রইলো অনেক অনেক আদর।

কল্লোল।
উত্তরপাড়া, হুগলী


ছবিঃ উইকিপিডিয়া

চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনা, তথ্যচিত্র নির্মাণ, ফিল্ম ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যরচনা, এবং ফাঁকে ফাঁকে পেলে নিজের ব্লগে নানা স্বাদের লেখালিখি - বিবিধ ধারার ব্যস্ততার মধ্যে চাঁদের বুড়ির সাথে ইচ্ছামতীর প্রথম পায়ে হাঁটার দিনগুলিতে হাত ধরেছিলেন কল্লোল । এখনো সময় পেলে মাঝেমধ্যেই ইচ্ছামতীর জন্য কলম ধরেন হুগলী, উত্তরপাড়া নিবাসী কল্লোল।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা