প্রথমে পৃথিবী ছিল এক আগুনের গোলার মত
দুর্গাপুজো দরজায় কড়া নাড়ছে। এই পুজোর সাথে জড়িয়ে আছে কতধরণের পৌরানিক গল্প; কয়েকটা গল্পের মধ্যে আবার মিলেমিশে গেছে সত্যিকারের মানবজীবনের ঘটনাপরম্পরার কথাও। মা দুর্গা নাকি ক্রোধিত হলে সৃষ্টিকেও বিনাশ করতে পারেন -' সৃষ্টি-স্থিতি বিনাশানং শক্তিভূতে সনাতনী' - পুজোর সকালে অঞ্জলি দিতে গেলে এই মন্ত্রটা বলতে হয়, তাই না? - এই 'সৃষ্টি' শব্দটার কথা ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল আমাদের সবার মা, পৃথিবী মায়ের কথা। দশভূজা মা দুর্গার স্থৈর্য্য- শক্তি-বীরত্ব সম্পর্কে কত গল্পই তো আমাদের জানা। কিন্তু তিনি তো আসলে আমাদের কল্পনার সৃষ্টি। আর যে মা আমাদের আসল মা, স্বয়ং মা দুর্গার মতই, যুগ যুগ ধরে দশ হাতে আগলে রেখেছেন আমাদেরকে - খাদ্য, পানীয়, বাসস্থান, উষ্ণতা - বেঁচে থাকার সবরকমের রসদ জুগিয়ে, সেই মায়ের কথা আমরা কতটুকু জানি? পুরোপুরি জানি কি?
তাই ভাবলাম, মানুষের কল্পনার রঙে রাঙানো মা দুর্গার গল্পের পাশেপাশে, আমরা এবারে গল্প করব স্বয়ং পৃথিবীকে নিয়ে- আমাদের সবার আসল মা, আদি মা কে নিয়ে।
তুমি কি জান, পৃথিবী ঠিক কতদিন আগে জন্মগ্রহণ করেছিল?
ধরে নিতে পার প্রায় ৪৫00 কোটি বছর আগে। কেমন ছিল দেখতে আমাদের এই পৃথিবী, সেই সময়ে?
ভূগোল বই যারা পড়তে ভালবাসে-টাসে, তারা তো এটা জানেই যে সেই সময়ের আর এখনকার চেহারা একদমই এক নয়। ব্যাপারটা অনেকটাই মানুষের জন্ম থেকে বড় হওয়ার মত। যখন এক মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে, তখন সে থাকে ছোট্ট, নরম। তাকে আদরে যত্নে কাঁথায় মুড়ে রাখতে হয়; দিনে দিনে তার শরীরে কতই না পরিবর্তন ঘটে। তুমি সেটা নিজেকে দেখেই তো বুঝতে পার।
পৃথিবীর ব্যাপারটাও তাই। একদম শুরুতে সে ছিল গলা পাথরের এক ভয়ানক আগুনের গোলা। সেই আগুনের গোলা থেকে সে আজ পরিবর্তিত হয়েছে আজকের এই চেহারায়।
কিন্তু সেটা হল কিভাবে? প্রাণীজগতের বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠার জন্য পৃথিবীকে কি কি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল? পৃথিবীর বুকে প্রথম প্রাণের স্পন্দন কবে দেখা গেছিল ? ডাইনোসরেরা কোন সময়ে পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করত? মানুষই বা তার আজকের চেহারা কবে পেল?
যবে থেকে মানুষ পৃথিবীর এই ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করেছে, তবে থেকেই এইরকম হাজার হাজার প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের মাথায় ঘুরে চলেছে ।
আজকে আমরা চেষ্টা করব পৃথিবীর জন্মরহস্যের বিষয়ে খুব ছোট্ট করে জানতে। ৪৫00 কোটি বছরের ইতিহাস বড়ই লম্বা, সেই পুরো গল্প এই ছোট্ট পরিসরে বলা সম্ভবই নয়। তাই আমরা ছোট ছোট প্রচুর তথ্যের মধ্যে না ঢুকে, চেষ্টা করব আমাদের প্রিয় পৃথিবীর জন্মকাল থেকে শুরু করে ঘটে যাওয়া বড় বড় ঘটনাগুলির দিকে।
এই কাজটাকে সহজে করার জন্য ভূবিজ্ঞানীরা, যাঁরা 'জিওলজিস্ট' নামেও পরিচিত, পৃথিবীর ইতিহাসকে এক Geological Time Scale বা ভূতাত্বিক সময় স্কেলে ভাগ করে নিয়েছেন।
কিন্তু এই জিওলজিক্যাল টাইম স্কেল ধরে কথাবার্তা শুরু করার আগে জেনে নেওয়া দরকার, কিসের ভিত্তিতে এই স্কেল তৈরি হল? ভূবিজ্ঞানীরা অতীতকে কোন প্রমাণের ভিত্তিতে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করলেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে লক্ষ কোটি বছর ধরে একটু একটু করে জমে ওঠা বা সৃষ্টি হওয়া পাথরের মধ্যে। পাথরকে ভিভিন্ন ভাগে ভাগ করার পড়াশোনাকে বলা হয় লিথোলজি ( Lithology)। এই পড়াশোনার মাধ্যমে এবং পাথরের গায়ে লেগে থাকা ফসিল বা জীবাস্ম দেখে মোটামুটি ভালভাবেই সেই পাথরের বয়স আন্দাজ করা যায়। বিভিন্ন পাথরের সঠিক বয়স জানা যায় 'রেডিওমেট্রিক ডেটিং' এর মাধ্যমে।এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা পাথরের ভেতরে থাকা তেজস্ক্রিয় খনিজ এবং তাদের থেকে উদ্ভূত অন্যান্য খনিজের পরিমাণ মেপে দেখেন এবং তার সাহায্যে সেই পাথরের বয়স নির্ধারণ করেন।
এইবার আমরা দেখি কতরকম বিভাগে ভূতাত্বিক সময়কে ভাগ করা হয়েছে।
জিওলজিক্যাল টাইম স্কেল
পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সময়কে বিভিন্ন Eon (প্রাক প্রত্নপ্রস্তরযুগ), Era, Period, Epoch, Age এবং Chron- এ ভাগ করা হয়েছে। এই সময় বিভাজন খুবই গভীর এক পড়াশোনার বিষয়। এই মূহুর্তে সেগুলিকে নিয়ে আর বেশি কিছু বলছি না। শুধু নামগুলো মনে রাখলেই চলবে।
পৃথিবীর সৃষ্টির বিভিন্ন তত্বগুলির মধ্যে যেটিকে সবথেকে বেশি মেনে চলা হয় ( কারণ সেটি সবথেকে যুক্তিপূর্ণ বলেও), সেটা হল এই যে সূর্যের চারিদিকে ভাসমান পাথর এবং ধূলিকণার পরিবৃদ্ধির (accretion) কারণে ধীরে ধীরে পৃথিবীর জন্ম হয়। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঘুরতে থাকা পাথরের পিন্ড এবং ধূলিকণাগুলি যখন একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়ে পৃথিবীকে সৃষ্টি করছিল, তখন সেগুলি সব মিলে মিশে এক প্রচন্ড গরম আগুনের মত গলা পাথরের পিন্ড হয়ে উঠেছিল। সেই গলা পিন্ডটি সূর্যের চারিপাশে ঘুরতে থাকার সাথে সাথে আবার নিজের অক্ষেও আবর্তন করছিল। এই ভাবে বহু বহু সময়ে পেরিয়ে যেতে যেতে ধীতে ধীরে সেই ভয়ানক উষ্ণ গোলাটি একটু একটু করে ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। একদম ওপরের স্তরে প্রথম কঠিণ পাথরের পাতলা পরতটি জমে ওঠে। এর পরেও কেটে যায় কয়েক লক্ষ বছর, যার পরে ভূ-পৃষ্ঠের ওপর সৃষ্টি হয় জল। এরও অনেকদিন পরে সেই জলে দেখা দেয় প্রথম প্রাণী। সেও প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগের কথা। কিন্তু এই পৃথিবীর বুকে প্রাণীজগৎ পুরোপুরি ভাবে স্বমহিমায় দেখা দিয়েছিল আজ থেকে মোটামুটি ৫৪০০ লক্ষ বছর আগে।
এই পুরো ব্যাপারটা মাথায় রাখলে , জন্মলগ্ন থেকে পৃথিবীর গড়ে ওঠার ইতিহাসকে চারটি Eon বা প্রাক-প্রত্নপ্রস্তরযুগে ভাগ করা যায় - একদম প্রথমে হেডিয়ান (Hadean), তার পরে বয়ঃক্রম অনুসারে আরকিয়ান (Archaean), প্রোটেরোজোয়িক (Proterozoic)এবং ফ্যানেরোজোয়িক ( Phanerozoic)।
পৃথিবীর প্রথম সৃষ্টি হওয়া থেকে শুরু করে পৃথিবীর বুকে প্রথম প্রাগৈতিহাসিক প্রাণের সঞ্চার হওয়া অবধি সময়কে হেডিয়ান ইয়ন বলে অভিহিত করা হয়। এইসব প্রাণীর জীবাশ্ম ৪০০০০ লক্ষ বছরের পুরনো পাথরের গায়ে দেখতে পাওয়া গেছে। আরকিয়ান ইয়ন শুরু হয় ৪০০০০ লক্ষ বছর থেকে আর চলতে থাকে ২৮০০০ লক্ষ বছর আগে অবধি। আরকিয়ান ইয়নেই প্রথম আদিম প্রাণের সঞ্চার ঘটে, প্রথম অক্সিজেন সরবরাহকারী ব্যাক্টেরিয়া দেখা দেয়, স্ট্রোমাটোলাইট দেখা দেয় এবং প্রথম ভূখন্ডগুলি ধীরে ধীরে স্থিতাবস্থায় আসতে থাকে। প্রোটেরোজোয়িক ইয়ন শুরু হয় ২৮০০০ লক্ষ বছর আগে আর চলতে থাকে আজ থেকে প্রায় ৫৪০০ লক্ষ বছর অবধি। এই সময়টা ছিল পৃথিবীর জীবনের এক জরুরী সময়। এই যুগেই পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে অক্সিজেন। ক্রমে ক্রমে জটিল এককোষী এবং বহুকোষী প্রাণীর জন্ম হয় এই যুগে।
ফ্যানেরোজোয়িক ইয়ন শুরু হয় প্যালেওজোয়িক এরা (Paleozoic Era ) থেকে, যেটা ৫৪০০ লক্ষ বছর আগে থেকে শুরু হয়ে ২৫০০বছর আগে অবধি ছিল। এই সময়ে পৃথিবীতে পবিবিধ ধরনের প্রানীর আবির্ভাব হয়। পৃথিবীর ভূত্বকে চলে নানাধরণের পরিবর্তন। এই যুগেই পৃথিবীতে প্রথম মেরুদন্ডবিহীন প্রানীদের সমাগম হয়, যাদের মধ্যে অনেকেই পরে মেরুদন্ডী প্রাণীতে পরিবর্তিত হয়। মাছেরা দেখা দেয়, উভচর প্রাণীরা জলে এবং ডাঙ্গায়- উভয় জায়গাতেই বসবাস করতে শুরু করে। প্রথম উদ্ভিদ দেখা দেয়, যেগুলি ধীরে ধীরে আদিম ফার্ণ , ঘাস এবং পরে বিরাট মহীরূহে পরিণত হয়। এই যুগের শেষের দিকে, বিভিন্ন ভূখন্ডগুলি একত্রিত হয়ে এক সুবিশাল মহাদেশে পরিণত হয়। তার নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছে প্যাঞ্জিয়া (Pangea)। এই সময়েই পোকা-মাকড়, মাছি, মশাদের ও উৎপত্তি ঘটে। বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ এই যুগে ছিল সবথেকে বেশি। প্রথম সরীসৃপদেরও উদ্ভব ও হয় এই যুগে। মহাদেশের তীরভূমি ধরে ধরে বিশাল জলাভূমির সৃষ্টি হয়, যেখানে যুগ যুগ ধরে গাছপালা পলি চাপা পড়ে, অনেকদিন পরে ধীরে ধীরে কয়লার আকরিক স্তরে পরিণত হবে।
প্যালেওজোয়িক এরা শেষ হয় এক ভয়ানক ধ্বংসলীলার মধ্যে দিয়ে। এই সময়ে পৃথিবীর জীবজগতের প্রায় ৯৫% পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেইটাই একমাত্র এই ধরণের ঘটনা ছিল না। পরেও এই ধরণের ঘটনা বার বার ঘটেছে।
এর পরেই শুরু হল ছোটদের কাছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবথেকে উত্তেজনাপূর্ণ বা, বলা ভাল, আকর্ষণীয় যুগ - যার নাম মেসোজোয়িক এরা (Mesozoic Era) । মেসোজোয়িক যুগ কে তিনটি ভাগে বা পিরিয়ডে ভাগ করা হয় - ট্রিয়াসিক (Triassic), জুরাসিক( Jurassic)আর ক্রেটাশিয়াস (Cretaceous)। এইবার বোঝা গেল তো, কেন বলেছিলাম এই যুগের প্রতি ছোটদের আকর্ষণ থাকবে !
আদিম ডাইনোসর
ট্রিয়াসিক পিরিয়ডেই প্রথম ডাইনোসরদের আবির্ভাব ঘটে - ডাঙ্গায় দেখা দায় আরকোসরেরা (Archosaur), আর সমুদ্রে দেখা দেয় ইকথিওসর (Ichthyosaurs) আর নথোসরেরা (Nothosaurs)। এই পিরিয়ডেই প্রথম স্তন্যপায়ী এবং কুমীরদের উদ্ভব হয়। জুরাসিক পিরিয়ডে নানা ধরণের ডাইনোসরদের বিবর্তন ঘটে। এদের মধ্যে কয়েকটি হল ব্রন্টোসরাস, অ্যালোসরাস, স্টেগোসরাস, ব্র্যাকিওসরার, ডিপ্লোডকাস ইত্যাদি।
আমি নিশ্চিত, তুমি 'জুরাসিক পার্ক' সিরিজের সব কটা ফিল্ম দেখে নিয়েছ; অন্তত পক্ষে সবে যে 'জুরাসিক ওয়ার্ল্ড মুক্তি পেয়েছে, সেটা দেখেছ, তাই ডাইনোসরদের সম্পর্কে তোমার যে বেশ খানিকটা আন্দাজ আছে, সেটা মাথায় রেখেই আমরা চলে যাব পরবর্তী পিরিয়ডে।
ক্রেটাশিয়াস পিরিয়ডের বিবর্তিত ডাইনোসরেরা
ক্রেটাশিয়াস পিরিয়ডে ডাইনোসরদের দুনিয়া বিবর্তনের চরম শিখরে ওঠে। এই সময়ে টারবোসরাস, সল্টোসরাস, ইসিসরাস, ট্রিসেরাটপদের সাথে পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করে বেড়াত সবার পরিচিত টির্যানোসরাস রেক্স। টেরোসর বা উড়ন্ত টিকটিকিদের থেকে বিবর্তিত হয়ে পাখিরা দেখা দেয়। সমুদ্রে দেখা যায় হাঙরেরা। আর হ্যাঁ, এই পিরিয়ডেই বেড়ে ওঠে নানারকমের ফুলে ভরা গাছ।
আদিম জলজ প্রাণীরা
মেসোজোয়িক এরার (Mesozoic Era)শেষে আবার একটি বড়সড় বিলুপ্তিকরণ ঘটে। এই ঘটনার ফলে পৃথিবীর সমস্ত ডাইনোসর এবং অন্যান্য আরো অনেক প্রাণী চিরতরের মত পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায়।
এর পরে পৃথিবীর জীবনে আসে আবার এক নতুন অধ্যায়। শুরু হয় সেনোজোয়িক এরা (Cenozoic Era )।
জিওলজিক্যাল টাইম স্কেলের ত্রিমাত্রিক চিত্র
সেনোজোয়িক এরা বা সেনোজোয়িক যুগ শুরু হয় প্যালিওজেন পিরিয়ডের (Paleogene Period ) হাত ধরে, আজ থেকে প্রায় ৬৫০ লক্ষ বছর আগে। প্যালিওজেন পিরিয়ডের শুরুতে দেখা দেয় আধুনিক গাছপালা; আদিম স্তন্যপায়ীরা নানাভাবে বিবর্তিত হয়। তার সাথে শুরু হয় এক বিরাট ভূতাত্বিক পরিবর্তন, যা ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পিরিয়ডেই শুরু হয় হিমালয় পর্বতমালার উত্থান। ধীরে ধীরে আধুনিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিবর্তন হয়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেশ কমে যেতে থাকে। ফলে মাঝে মধ্যেই দেখা দিতে থাকে ওল্ডার আইস এজ, বা প্রাচীন তুষার যুগ। প্যালিওজেন পিরিয়ডের শেষের দিকে সমুদ্রে দেখা দেয় আদিম তিমিরা।
প্যালিওজেন পিরিয়ডের পরে আসে নিওজেন পিরিয়ড (Neogene Period ), যে সময়ে আদিম ঘোড়া আর হাতিরা উদ্ভূত হয়। পৃথিবীর বুকে দেখা দেয় প্রথম বনমানুষ (এপ)। এই সময়ে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা খুবই কমে যায়। নিওজেন পিরিয়ড শেষ হতে হতে, প্রাচীন মানুষ হোমো হেবিলিস (Homo habilis ) দেখা দেয়। এই নিওজেন পিরিয়ড শেষ হয় আধুনিক তুষার যুগের আগমনে।
আদিম হাতি- ম্যামথ
এবার আমরা ধীরে ধীরে বর্তমান সময়ের দিকে এগিয়ে আসছি। তবে খুব কাছে এখনো আসিনি। আমরা এখনো আজকের দিনের থেকে ২৫০ লক্ষ বছর পেছনে আছি। নিওজেন পিরিয়ডের পরে আসে কোয়াটারনারি পিরিয়ড (Quaternary Period ), যেটি আবার দুটি ইপক এ বিভক্ত - প্লেইস্টোসিন ইপক (Pleistocene Epoch) আর হলোসিন ইপক (Holocene Epoch)। কোয়াটারনারি তুষার যুগ শুরু হয়েছিল মোটামুটি ২৫.৮ লক্ষ বছর আগে আর , মাঝেমধ্যে পৃথিবীকে একটু দম ফেলার সুযোগ দিয়ে, চলতে থাকে প্রায় ১৫০০০ বছর আগে অবধি। প্লেইস্টোসিন ইপক চলাকালীনই প্রথম প্রস্তর যুগের সূচনা হয়। প্রায় ৭৫০০০ বছর আগে, এক ভয়ানক লাভা উদ্গিরণের ফলে, মানবজাতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। এই ইপকের আগে, অনেক বড় বড় স্তন্যপায়ীরা দিব্যি বেড়ে উঠেছিল, কিন্তু তারপরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই ইপকের সময়েই ম্যামথরা ছুরির মত বড় দাঁতওয়ালা বাঘেদের সাথে এবং দৈত্যাকৃতি স্লথেদের সাথে সহাবস্থান করত। ডিজনির অ্যানিমেটেড মুভি 'আইস এজ' এর কথা মনে পড়ছে?
প্লেইস্টোসিন ইপকের শেষে এই সমস্ত প্রানীদের বিলুপ্তি শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অথবা নানা রোগ বিস্তারের জন্য হয়নি। ছিল আরেকটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যেটি পরে পৃথিবীর পরিবেশগত ভারসাম্যকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
মানুষের বিবর্তন
এই সময়ে মানুষদের বিবর্তন ঘটতে থাকে। তারা ক্রমে গোষ্ঠীবদ্ধ , সামাজিক জীব হয়ে ওঠে। এইভাবেই তারা পরিণত হয় আদিম শিকারিরূপে। অনেক স্তন্যপায়ীরাই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মানুষের শিকার করার অভ্যাসের ফলে।
হলোসিন ইপক শুরু হয় বর্তমান inter-glacial period বা আন্তর্হিমবাহ পিরিয়ডের হাত ধরে, প্রায় ১ লক্ষ ১৫ হাজার বছর আগে। এই সময়ে মানব সভ্যতার ক্রমশঃ অগ্রগতি হতে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সুবিশাল সব সভ্যতা গড়ে ওঠে - মেসোপোটেমিয়ার সভ্যতা, সিন্ধু সভতা, অ্যাজটেক এবং ইন্কা সভ্যতা। মানুষ কৃষিকাজ করতে শেখে। প্রস্তর যুগের অবসানে ব্রোঞ্জ যুগের শুরু হয়; আর তারপরে আসে লৌহ যুগ, সাথে সাথেই আসে আধুনিক শিল্পভিত্তিক জীবন যাপন পদ্ধতি।
এই সব কিছুর ফলে বাড়তে থাকল দূষণের পরিমান আর বায়ুমন্ডলে বেড়ে গেল কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমান। গ্রীনহাউজ গ্যাস বেড়ে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ওজন (Ozone) স্তরে দেখা দিল ছোট বড় সব ফুটো। বহু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেল শুধুমাত্র শিকার হয়ে, অথবা বনজঙ্গঅল কেটে ফেলার পরে, অথবা অন্যান্য কোন ভাবে মানুষেরা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নাক গলানোর জন্য।
আমাদের বাসভূমি এই গ্রহ, আমাদের পৃথিবী, গত ৪.৫ লক্ষ কোটি বছর ধরে পরিবর্তিত হতে হতে আজকের এই চেহারায় এসেছে। কিন্তু দুঃখের কথাটা হল, এত যুগ যুগান্তের ইতিহাসে , পৃথিবী আজকের মত এত ভয়ানক বিপদে কোনদিন পড়েনি, যার মধ্যে সে আজকে পড়েছে। পৃথিবী জুড়ে এই মূহুর্তে শুরু হয়ে গেছে আবার এক ব্যাপক বিলুপ্তিকরণ (Mass Extinction), আবার হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির পশু-পাখি-প্রাণীরা। আর তার জন্য কোন প্রাকৃতিক ঘটনা দায়ী নয়।
তাহলে তার জন্য দায়ী কারা ? তার জন্য দায়ী আমরা, মানুষেরা। আমাদের একটু একটু করে বাড়তে থাকা লোভ আমাদের নিজেদেরই বিপদ ডেকে আনছে, আর আমরা সেটা জানিও না, বা জেনেও না জানার ভান করে থাকছি।
কিন্তু এইরকম বিপদ আসছে জেনেও আমরা কি এইরকম আত্মতুষ্টি নিয়ে বসে থাকতে পারি?
আমরা যদি পৃথিবীর বিবর্তনের ইতিহাসকে একটা ছোট মাপকাঠিতে ফেলি, আমাদের বোঝার সুবিধার জন্য, তাহলে কেমন হয়? যদি ধরে নিই, পৃথিবীর বয়স মোটে এক বছর, তাহলে আমরা মানুষেরা দেখা দিয়েছি ৩১শে ডিসেম্বরের রাত ১১-৩০ মিনিটে। বছর শেষ হওয়ার মাত্র ২০ সেকেন্ড আগে শুরু হয়েছে শিল্প বিপ্লব। আর এইটুকু সময়ের মধ্যেই আমরা পৃথিবীর ৫০% বনজঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলেছি।
তাহলে কি এই অসাধারণ সুন্দর গ্রহে, আমরাই হতে চলেছি শেষ বিবর্তিত প্রজাতি? আমরা রোজ যা করে চলেছি, তার পরে কি আর আমাদের পৃথিবী মায়ের বুকে বেঁচে থাকতে পারে প্রাণের স্পন্দন ? আমরা নিজেরাই কি হয়ে উঠব এই পৃথিবীর ধ্বংসকারী - যে পৃথিবী আমাদের বুক উজাড় করে শুধু দিয়েই গেছে ? আমি চাই, তুমি নিজেকে এই প্রশ্নগুলো কর; বার বার করে কর। এটা আসলে কোন মনগড়া গল্প নয়, এটা সত্যি ঘটনা। আর এটা একটা খুব দুঃখজনক সত্যি ঘটনা।
তাহলে কি আর কোনই আশার আলো নেই? আমি মনে করি এখনো সময় আছে, এখনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এই যে তুমি এখন পড়ে শেষ করলে এই নিবন্ধ, আমি আশা রাখি, তুমি আর তোমার যত বন্ধু, একদিন এই পৃথিবীর অনেক বেশি ভাল সন্তান হয়ে উঠবে। তোমাদের হাত ধরেই হয়ত সেই সব ক্ষতগুলি সেরে উঠবে, যেগুলি আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষেরা পৃথিবীকে দিয়ে গেছে, আর আমরাও দিয়ে যাচ্ছি।
তোমার মত ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েরাই এখন পৃথিবীমায়ের একমাত্র ভরসা।
ছবিঃ বিভিন্ন ওয়েবসাইট