অনেকদিন আগে মিশরদেশে এক রাজা ছিলেন, ওদেশের ডাক অনুযায়ী ফারাও আর কী, তা রাজা মাত্রেই যুদ্ধ করে রাজ্যের সীমানা বাড়ায়, প্রজাশাসন করে, আর ভাল খায়, ভাল মাখে, নিজেদের যা শখ শৌখিনতা সহজেই পুষিয়ে নেয়। এই রাজারও শখ ছিল তবে তা একটু বিশেষ ধরনের, রাজার নেশা ছিল বই সংগ্রহের, রাজ্যে ছিল তাঁর বাবার আমলে তৈরী এক নতুন মিউজিয়াম, তার ভিতরে এক ছোট্টমাপের লাইব্রেরী, হয়ত ছোট বেলায় পড়াশোনা করতে রাজা ওখানেই যেতেন আর তা থেকেই এই নেশার উৎপত্তি। সে সময়ে সেদেশে বই লেখা হত প্যাপিরাস গাছের কান্ডের থেকে তৈরী কাগজের ওপর আর তা অবশ্যই হাতে লিখতে হত, ছাপার পদ্ধতি তো তখন জানা ছিল না। রাজার সেই মিউজিয়ামে বাস করত সে সময়ের জ্ঞানী গুনী ছাত্র ও শিক্ষক, তারা আসতেন গ্রীস, রোম,আরব ও আরো বহু দেশ থেকে। তারা সেখানে পড়াশোনা গবেষনা তো চালাতেনই সঙ্গে হাতে লেখা বই তৈরী করতেন। রাজা নিজের রাজ্যের সব মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহে যেসব ভাল বই ছিল তা জোগাড় করে লাইব্রেরী সাজাতেন, আর বই মালিককে ফেরত দিতেন নতুন কপি। এইভাবে শুধু রাজ্যের নয় তাঁর রাজধানীতে বেড়াতে আসতো যারা তাদের কাছে কোনো বই আছে কিনা সেটাও রাজার কর্মচারীরা তল্লাশী করে দেখে নিতো, তারপর কিছুদিনের জন্যে সেই বই ধার নিয়ে কপি বা নকল তৈরী করে আসলটা রেখে নতুনটা ফেরত দেওয়া হত মালিককে। মেধাবী ছাত্রদের তৈরী বইগুলো সবসময় দেখতে এত সুন্দর হত যে মালিকদের তা নিয়ে কোনো ক্ষোভ থাকতো না, তাছাড়া তেমন অসাধারন বই হলে রাজা নিজেই কপি র সাথে আসলটির দরুন অর্থও ফেরত দিতেন ক্ষতিপূরণ বাবদ। এভাবে তাঁর লাইব্রেরীতে অনেক গ্রীক ও রোমান সাহিত্যের মূল প্রথম বইটি তিনি নিয়ে আসেন। । ধীরে ধীরে রাজার নেশা আরও বেড়ে গেলে তিনি শুধু বই খুঁজে আনার জন্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজের পর্যটক পাঠাতে থাকেন, ফলে রাজার লাইব্রেরী ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে, আর দারুন সব বই এর আকর্ষনে রাজধানীতে পন্ডিত ও গুনীদের আনাগোনাও সাথে সাথে বেড়ে চলে। তা এইরকম এক বইসন্ধানী দল রাজার কাছে খবর নিয়ে এল প্রাচীন ইহুদী সাহিত্যের, (যা পরে ওল্ড টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত হয়)। হিব্রু ভাষায় লেখা ইহুদীদের সেসব ধর্মীয় সম্পদ বিশ্ববাসীর কাছে তখন আজানা অধরা। জেরুজালেম এর মন্দিরে ইহুদী পুরহিত ও পণ্ডিতরা অতি যত্নে সেগুলো রক্ষা করেন। এই সংবাদ বইপাগল রাজাকে আরো পাগল করে তুলল। । রাজা তো শুধু বই জমাতেন না তাঁর জ্ঞানও ছিল অগাধ, তিনি সহজেই বুঝে গেলেন এই বই পৃথিবীর এক দুষ্প্রাপ্য সম্পদ, যা তাঁর লাইব্রেরীর রত্ন হতে চলেছে।
এই বই পাবার জন্যে তিনি যে অসাধ্য সাধন করেছিলেন তা মানবিকতার ইতিহাসে বিরলতম। জেরুজালেম এর মন্দিরের পুরহিত ও পণ্ডিতরা রাজার বইটি নকল করে ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব মোটেই মেনে নিলেন না, টাকার প্রলোভন কে তাঁরা তুচ্ছ করলেন, তাঁদের পবিত্র বই বলে কথা, তা কিভাবে বিদেশে পাঠান যাবে বিশ্বাস করে। এবার রাজা বই এর বদলে মানুষ ফেরত এর প্রস্তাব দিলেন, মিশর দেশে তখন বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দী অনেক ইহহুদী দাস ছিল, তারা অনেক বছর ধরে বড়লোক মিশরীয়দের বাড়িতে কাজ করতো, এরকম ১ লক্ষ ২০ হাজার দাস মুক্ত হয়ে নিজেদের দেশ জেরুজালেম ফিরে যাবে, রাজা কথা দিলেন । এর জন্যে দাস মালিকদের দিতে হয়েছিল ৬০০ টালেন্ট যা ৬ লক্ষ ডলারের সমান । এই প্রস্তাব ইহুদী পুরহিতরা মেনে নিলেন খুব খুশীমনে এবং ৭২ জন গ্রীক ও হিব্রু জানা অনুবাদকের ব্যবস্থা করে দিলেন যারা আলেকজান্দ্রিয়া গিয়ে লাইব্রেরি তে থেকে ওই বইগুলো অনুবাদ করে দেবেন। ওই ৭২ পন্ডিতের নামে বইগুলো Septuagint নামে বিখ্যাত হয়, যার অর্থ লাতিন ভাষায় ৭২ (septuagint duo)। বই এর জন্যে মুক্তি পেল লক্ষ মানুষ যাদের জীবন ছিল মৃত্যুরই নামান্তর । ফারাও টলেমী ফিলাডেলফাস এর লাইব্রেরি থেকে এই বই তারপর ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীর গুনী সমাজে। । এইভাবে ৪ লাখের বেশী বই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি তে জমা হলে, রাজাকে তাঁর রাজধানীর সবথেকে বিখ্যাত দেবমন্দির (দেব সেরাপিস) এ দ্বিতীয় লাইব্রেরী বানাতে হয়। দুই লাইব্রেরী মিলে প্রাচীন বিশ্বের বিখ্যাত শহর আলেকজান্দ্রিয়ার মোট বই সাত আট লাখ ছাড়িয়ে যায় । প্যাপিরাস কাগজে সুন্দর নির্ভুল হাতের লেখায় সোনার জলের অলংকরণে বই তৈরী কত পরিশ্রমসাধ্য ছিল তা আজকের যুগে বসে আমরা কল্পনাও করতে পারব না। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী মানুষ যত গড়ে তত নষ্ট করে, আলেকজান্দ্রিয়ার ওই অমূল্য সম্পদ পরবর্তীকালে বার বার ধ্বংস করেছে যুদ্ধবাজের দল, আর তাঁদের মধ্যে নাকি রোমান জেনারেল বিশ্বখ্যাত জুলিয়াস সিজার একজন।
টলেমী ফিলাডেলফাস ছিলেন আমাদের অতি পরিচিত রানী ক্লিওপেত্রার পূর্বপুরুষ, টলেমীয় বংশের প্রথম ফারাও আসলে ছিলেন গ্রীক, মহাবীর আলেকজাণ্ডারের বন্ধু ও সেনাপ্রধাণ, যিনি আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর মিশরে জয় করা সাম্রাজ্যর দায়িত্ব নেন। আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নাম থেকে বুঝতে পারছ নিশ্চই তাঁর প্রভাব, এই শহরের বুকেই কোথাও আছে আলেকজাণ্ডারের গোপন সমাধী , সে এক অন্য গল্প । তা এই টলেমীয় বংশে একই নাম বারবার ব্যাবহার হত , যেমন বিশ্বখ্যাত রানী 'ক্লিওপেত্রা' আসলে সপ্তম ক্লিওপেত্রা, তেমনি 'টলেমী' ফারাওদের সাধারন নাম, তাই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর সময়কাল ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রচুর গল্প প্রচলিত, ইতিহাসের সেসব দ্বিধা এড়িয়ে মানুষের ভাল কাজের গল্পটুকু বললাম ।
তথ্যসুত্রঃ History of Cleopatra Queen of Egypt by Jacob Abbott
ছবিঃ ম্যাগনোলিয়াবক্স