রানীর বাগানে ট্রেকিং
সকালের ব্রাইস একটু অন্যরকম, আমরা সূর্যোদয় দেখতে পাইনি, সেটার জন্যে পার্কের কাছাকাছি থাকা দরকার। এখন প্রতিটা হুডু অর্থাৎ টাওয়ার ,স্পাইক, হাতুরি সবার রঙের বৈচিত্র স্পষ্ট, গোলাপীই বেশী, কেউ সাদাটে, কেঊ কমলা, হলদেটে। বিভিন্ন ট্রেকিং রুট আছে নীচে ক্যানিয়নে নামার। আমরা Queen's Garden পথে ট্রেকিং করলাম ঘন্টাখানেক, অল্প বরফ ছিল রাস্তায়, বিভিন্ন ভিউপয়েন্ট থেকে সোজা ফোটো তুলতে গিয়ে কায়দা মেরেছো কি সোজা হাজার ফুট খাদে। খাদে নানা রঙ্গের হুডু ভিড় করে দাঁড়িয়ে, থরের হাতুরি তাদের মধ্যে বিখ্যাত, পাতলা মাছের পাখনার মত প্রাচীরকে বলে ফিন, কোথাও কোথাও তাতে সৃষ্টি হয়েছে জানালার মত ফাঁক। ক্যুইন বেশ রাসভারি চেহারার, গাত্রবর্ণ দুধে আলতা, একা বসে আছেন উঁচু আসনের মত ধাপের উপরে, সেখানে অন্য হুডুরা নেই, তাকিয়ে আছেন যেদিকে সেইখানে অনেক হুডু দাঁড়িয়ে, তাই বুঝি নাম কুইন্স্ গার্ডেন (Queen’s Garden) বা রানীর বাগান ।
ফেরৎ পথ কঠিন কেননা চড়াই, এর মধ্যে আবার মেঘ করে এল, হাওয়াও শুরু হল, হুডুদের মধ্যে দিয়ে বয় বলে তার বিচিত্র শব্দ। ব্রাইস বজ্রপাতের জন্যে প্রসিদ্ধ, সবাই দেখি দৌড় লাগিয়েছে শেল্টার নিতে। ব্রাইসকে ক্যানিয়ন বলা হলেও এর আকার অনেকটা অ্যাম্ফিথিয়েটারের মত, আর কোনো নদী নেই এখানে, দিন ও রাতের উষ্ণতার অতিরিক্ত ওঠা পড়া পাথরে জমে থাকা জলকে বরফ করে, ফলে সে আয়তনে বেড়ে পাথর ফাটিয়ে নানা ধরনের আকার বানায় , বাকি কাজ হাওয়া ও বৃষ্টির।
পার্কের ভিজিটারস সেন্টারে ক্যাপিটাল রিফ, ক্যানিয়নল্যান্ড ন্যাশান্যাল পার্কগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিলাম আমরা, লিফলেট ম্যাপ সংগ্রহ করলাম, জানা গেল ক্যানিয়নল্যান্ড সবথেকে দুর্গম পার্ক, সেখানে ভালোরকম প্রস্তুতি ছাড়া যেতে নিষেধই করলেন পার্ক কর্মী। ন্যাশান্যাল পার্কগুলোতে জিপিএস বা মোবাইল সিগন্যালের ভরসা করা চলে না, ধরে নিতে হবে কাগজের ম্যাপই ভরসা, (স্যাটেলাইট ফোন কাজ করে শুনেছি, দেখিনি পরখ করে) আর যদি একটু মেঠো পথে (Dirt Road) এদিক ওদিক অভিযানের প্ল্যান থাকে তাহলে জল ,খাবার, গাড়ির তেল, যাবতীয় যন্ত্রপাতি, সব নিয়ে 'অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে' বলে পথে নামতে হবে কারো ভরসা না করে । এক্ষেত্রে ন্যাশান্যাল পার্ক রেঞ্জাররা পরামর্শ দেন কোন পথে যাবে তার প্ল্যান কাউকে জানিয়ে রাখা, যাতে নির্দিষ্ট সময়ে জায়গামত তুমি না পৌঁছলে সার্চ পার্টি নামানো যায়। বেশী বাড়িয়ে বলছি মনে হচ্ছে? ২০১৬ সালে পৃথিবীর সর্বাধুনিক দেশে ফোন কাজ করবে না, জিপিএস থাকবে না, বললেই হল। আহা সে ও এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা, আজকাল এভাবে হারানো যে কী কঠিন, সবাই সর্বদা জালে জড়িয়ে আছি। আমাদের নর্থ সিকিম ট্যুরের ছবি দেখে আমার ৭০ বছরের আমেরিকান বান্ধবী জুডি বলেছিল -
- " সবাই জানত তোমরা এই দুর্গম জায়গায় যাচ্ছ ?"
–"নিশ্চই, সেনাবাহিনীর পারমিট নিতে হয় যে"
-"আর এখানে দেখ, একা একা সব পাগল অ্যাডভেঞ্চার করবে, আর পথ হারিয়ে ট্যাক্স পেয়ারদের টাকার শ্রাদ্ধ করবে..."
কথাটা মনে ছিল, তাই আট বছরের বাচ্চা নিয়ে ডেয়ার ডেভিল হতে চাইনি, তবু এবারে যে পথ নিলাম তা সংসারী মানুষদের জন্যেও খুব কম রোমাঞ্চকর নয়।
উটা ১২ (Route 12), যোগ করেছে ব্রাইস ক্যানিয়ন ও ক্যাপিটাল রিফ ন্যাশান্যাল পার্ক কে। 'Scenic byway' নামে এর সৌন্দর্য্য কিছু কিছু পড়ে এসেছিলাম, খুব বেশী তথ্য ছিলনা যদিও। হাইওয়ের বদলে এই রাস্তা ধরলে রাত ৮ টা নাগাদ রিচফিল্ড পৌঁছতে পারি। রাস্তা যাবে 'গ্রান্ড স্টেয়ারকেস এসকাল্যান্তে ন্যাশান্যাল মনুমেন্ট'(Grand Staircase Escalante National Monument) এর পশ্চিম ধার দিয়ে। ১.৯মিলিয়ন একর ভূমি , ১৯৯৬ রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন খনিজ লোভী খননকারীদের হাত থেকে একে রক্ষা করতে তাঁর স্পেশাল পাওয়ার প্রয়োগ করে একে ন্যাশান্যাল মনুমেণ্ট ঘোষনা করেন। এই অংশ ভূতত্ব ও জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণার প্রাকৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়, তাই এখানে ট্যুরিজম কে উৎসাহ দেওয়া হয়না। 'গ্রান্ড স্টেয়ারকেস' নিয়ে কঠিন জিওলজির পড়াশোনাটা আমরা একটু পরে করব। এখন সামনে এমন একটা পথ যার বর্ণনা ভাষা দিতে পারে না, ক্যামেরা ধরতে পারে না। মনে হল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে যদি এখানে এনে দাঁড় করাতে পারতাম তাহলে হয়তো কিছুটা ন্যায় হত, আরণ্যকের লবটুলিয়া বৈহার বা চাঁদের পাহারের আফ্রিকার মত শব্দ দিয়ে এঁকে দিতেন এই আশ্চর্য্য ভূমি। এই পথের আদিম সংস্করনে প্রথম আসা ইউরোপিয় (স্পেনদেশীয়) যাদের এরা 'pioneer' বলে থাকে ও পরবর্তীতে মোরমন(Mormon) মিশনারীরা পাঁচটি ছোট গ্রাম তৈরী করেছিল; ফাদার 'এসকাল্যান্তে' একজন স্প্যানিশ মিশনারি ছিলেন, যদিও এ পথে আসেননি, কাছাকাছি দিয়ে গেছিলেন, তাঁর নামে এখানে অনেক কিছুর নামকরণ রয়েছে।
বারো নম্বর রাস্তায়, পাথরে কমলা হলুদের নানা রূপ
১২২ মাইল পথ, তরঙ্গময় মালভূমি ; ঢালু পাহাড়, উঁচু শৃঙ্গর মধ্যে দিয়ে, কখনো হাজার ফুট উপরে তুলছে কখনো কয়েক হাজার নীচে নামাচ্ছে, চার দশক(১৯৪০-১৯৮০) কী এমনি লেগেছে এই পথ তৈরী হতে! পথের ধারে লেখা দেখেছি মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল এই পথ তৈরী করতে। পাঁচ ছোট জনপদের মধ্যে ‘এসক্যালান্তে’ সবথেকে বড় তার জনসংখ্যা হাজারের কিছু বেশী হবে, সক্কলকে একসাথে করলে জনসংখ্যা হাজার দুই আড়াই। শুরুতে তীব্র লাল পাথরের আয়োডাইজড আয়রন সমৃদ্ধ স্যান্ডস্টোন দেখা গেলেও পথ যত এগোবে রং হবে ধূসর, তারপর সাদাটে, হলদে সাদা বা হাল্কা গোলাপীর ছোঁয়া। রং লুটোপুটি খাচ্ছে চতুর্দিকে, সূর্যের আলো সাথে তা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল। চোখ হার মানবে পাথুরেভূমির আদি অন্তহীন ব্যাপ্তিতে, পথের প্রতিটি অদৃশ্য বাঁক যখনই দৃষ্ট হচ্ছে আমরা চেঁচিয়ে উঠছি মুগ্ধ বিস্ময়ে।
বারো নম্বর রাস্তায়, গোলাপীর বিভিন্ন শেড
ক্যাননভিল গ্রামে গাঢ় মরচে রঙা পাথর জুরাসিক যুগের, এর পর হেনরিভিল গ্রাম পাহাড়ের একটু উঁচুতে অপেক্ষাকৃত বিমর্ষ বাদামী ও ধূসর রং পাথর, এই স্থান কিছু পরের সময়ের গল্প বলে, অসংখ্য ডাইনোসরদের দেহাবশেষ ও অন্য প্রানীদের জীবাশ্মর জন্যে প্যালিওন্টলজিস্টদের প্রিয় এই স্তর, ডানাসুরদের শেষ সময়ের অবিকৃ্ত দলিল। 'এস্ক্যালান্টে' গ্রামের দিকে এগোতে একটা পথের ধারে দৃশ্য দেখার জায়গায় দাঁড়ালাম, এখানে আর একটা গাড়ি ছিল, আমেরিকান জুটি , সচরাচর আমি নিজে থেকে হাই হ্যালো ছাড়া কথা বলিনা, এখানে সামনের দৃশ্য দেখে তাদেরকে বলে ফেললাম "এটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, কী দেখছি আমি !", ছেলেটি গর্বের সাথে বলল "এটাই আমেরিকা, আসল বন্য রূপ। নদীর দিকে যত যাবে তত আরো সুন্দর, তারপর বোল্ডার পাহাড় মাথা ঘুরিয়ে দেবে"। নদীর খাদের দিকে গাড়ি নিম্নগামী, মরু হঠাৎ ঘন গাছপালায় মুখ গুঁজে শ্বাস নিয়ে নিচ্ছে, নীচে নামলেই মনে হচ্ছে সূর্য গেছে পাটে, নদীতে চিকচিকে আলো আঁধারের খেলা, কল্পনাও এ স্বপ্নরাজ্য ছুঁতে পারে না। মনে মনে ভাবলাম কারা থাকে এই স্বর্গরাজ্যে ? দুচারটি লোকের দেখা পাওয়া দুর্লভ, এখানে কয়েকটা মোটেল বোধহয় আছে, রাস্তায় দু একটা গাড়ি পাশ দিয়ে গেছে, তারা সব এখানেই কোথাও আছে বলে মনে হয়। এরপর আর একটা গাড়িও পাইনি।
গ্রামটি ছাড়াতেই আবার উর্ধবমুখী ওঠা, উঠতে উঠতে রাস্তা একটা সংকীর্ণ প্রাচীরের মাথায় চড়লো যেন। এইবার সেই গোলাপি টেবিল পাহাড় সামনে, এক্কেবারে হাতের মুঠোয় যাকে বলে। সারা রাস্তা এটাকে প্রদক্ষিণ করেই আসছিলাম, কিন্তু কিছুতেই একটা ভালো ফটো তুলতে পারিনি। গাড়ি দাঁড় করিয়ে নামলাম সবাই, মানে সাকুল্যে তিনটি প্রানী, চরাচরময় নিঃস্তব্ধতা। ঠান্ডায় হাড় জমিয়ে দিল, ছেলের ইন্সট্যান্ট হাঁচি শুরু, বাবা ছেলেকে নিয়ে ঢুকে গেল গাড়িতে। আমি একা খাদের ধারে ,সামনে গোলাপী , হাল্কা সাদা, বাদামী একটা লেয়ার কেক, উচ্চতা ১০ হাজার ১৮৮ ফুট, পাইন গাছগুলোকে কালো গর্ত বা দাগের মত দেখাচ্ছে। এখানে একটা ফলকে লেখা পাওয়েল পয়েন্ট, কিছু ছবিও আছে সাথে। ঠাণ্ডায় জমে যেতে যেতেও পড়ে ফেললাম ও এতক্ষণে জানতে পারলাম মনোহরণ পাহাড়ের পরিচয় ।
পাওয়েল পয়েন্ট, সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপ
বিখ্যাত অভিযাত্রী জন পাওয়েল এই অঞ্চলে তাঁর দ্বিতীয় অভিযান চালান ১৮৭১ সালে (প্রথম আভিযান ১৮৬৯) মূলত ম্যাপ তৈরীর উদ্দেশ্যে, এই অংশ তখন ইউনাইটেড স্টেটস এর মানচিত্র বহির্ভূত স্থান । তাঁর দলই এই অঞ্চলের নদী ও ভূমির নামে এস্ক্যাল্যান্তের নাম জোড়েন, ভাবা যায় এই ভয়ানক দুর্গম অঞ্চলে নিজেরা পদে পদে বিপদের মোকাবিলা করে কৃ্তিত্ব দিচ্ছেন একশ বছর আগের অন্য এক পথিকৃৎ অভিযাত্রীকে। পাওয়েলের নামে গ্লেন ক্যানিয়ন এর লেক পাওয়েল আর এই পয়েন্টটি পরে নামকরণ হয়েছে। তা ওই লেয়ার কেকটি যাকে পাওয়েল নিজে তরমুজের কাটা টুকরোর সাথে তুলনা করেছিলেন সেটি আদৌ কোনো পাহাড় নয়, গ্রান্ড স্টেয়ারকেস এর সর্বোচ্চ ধাপ । এবারে আর না এড়িয়ে সেই কঠিন কাজটা করে ফেলতে হবে। এমন কিছু তথ্য যে বিষয়ে আমি নিতান্ত মূর্খ, কিন্তু ইতস্তত ঘোরাফেরা করছি কয়েক শো মাইল যেখানে সেটা জিওলজিস্টদের স্বর্গভূমি, পৃথিবীর শিশুকালের ইতিহাস খোলা বই এর মত পড়ে ফেলা যায়, তাই একটু চেষ্টা করা যাক -
এখন আমরা সেই ভূমির এক অংশে দাঁড়িয়ে যা কলোরাডো প্ল্যাটো বা কলোরাডো মালভূমি নামে বিখ্যাত, উত্তর পশ্চিমে উটা (Utah), উত্তর পূর্বে কলোরাডো (Colorado) , দক্ষিণে একইভাবে অ্যারিজোনা (Arizona) ও নিউ মেক্সিকো (New Mexico), এই চারটি রাজ্যের সীমানা কাটাকুটি হয়েছে যেখানে সেই বিন্দুটি কেন্দ্র ধরে মোটের ওপর বৃত্ত আঁকলে ১৩০,০০০ স্কোয়ার মাইল পাথুরে ভূমি নিয়ে যেটা দাঁড়ায় তাকে বলে কলোরাডো মালভূমি। আদিম অতীতে এটা উঁচু ভূমি ঘেরা বিশাল সমুদ্র ছিল। ২০ থেকে ১৫ মিলিয়ন বছর আগে অতি ভীষণ টেকটনিক প্লেট নড়নচড়ন ঠেলেঠুলে ২ মাইল পর্যন্ত তুলে ধরে এই বিশাল ভূখন্ডকে। বিশেষভাবে বললে মালভূমির এই অঞ্চল দৈত্যাকৃ্তি সিঁড়ির ধাপ যা এখন " Grand Staircase Escalante National Monument" নামকরণ হয়েছে। এই ভূমির চরিত্র সিংহভাগ মরুভূমি (পাথরের যদিও), অসীম এই রুক্ষ প্রান্তরে জল যে কী যাদু দেখায় তার উদাহরন জায়ন, গ্রান্ড ক্যানিয়ন , ক্যাপিটাল রীফ , ক্যানিয়নল্যান্ড, ইত্যাদি ন্যাশান্যাল পার্ক। কিভাবে ধাপে ধাপে এই পাওয়েল পয়েন্ট থেকে নেমে গিয়েছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পর্যন্ত তা ছবি দেখে বুঝে নিতে পার । যত উপরের স্তর তত নতুন, যেমন আমার সামনের পিংক ক্লিফ, যত নীচের ধাপ তত আদিম অতীত Grand Canyon এর মধ্যে দেখা যাবে , এইরকম এক অতি আদিম স্তরের নাম বিষ্ণূ বেসমেন্ট রক(Vishnu Basement Rock)। নামটা কি চেনা চেনা লাগছে ? গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের একটা স্তরের নাম কেনধিন্দু পুরাণের দেবতা বিষ্ণুর নামে, সেটা এক অন্য গল্প। সে বিষয়ে পরে আরেকদিন কথা হবে। পাওয়েল পয়েন্ট এর নীচের দিক নীলচে ধূসর, যা আগেও বলেছি ফসিল সমৃদ্ধ জুরাসিক ,ক্রিটেসিয়াস যুগের স্তর।
গ্র্যান্ড স্টেয়ারকেস এর গঠন
পড়াশোনার মুশকিল হচ্ছে তা সরস হয়না প্রায়শই, পাঠক হারানোর ভয়ে আমি তথ্য আর দিতে চাইনা আরো বেশি জানতে চাইলে গুগ্ল্ এর সাহায্য নাও।
আমার প্রিয় অদ্ভূত গোলাপি টেবিলকে বিদায় জানালাম যখন তখন সূর্যদেব ঘুমের আয়োজন করছেন। এরপর অনেক পথ বাকি, দৌড় দৌড়, আঁকা বাঁকা পাহড়ি পথ জোরে যাবার উপায় নেই, সামনে আসবে গঞ্জ 'বোল্ডার', তারপর বোল্ডার মাউন্টেন , সেই ছেলেটি বলেছিল ৯০০০ ফুট সবথেকে ঊঁচু জায়গা এই রাস্তার। উঠতে হবে এবং অন্ধকার হলে সব মাটি। বোল্ডার সুন্দর জনপদ , র্যাঞ্চ ও ফার্ম এখানের মূল ব্যাবসা বোধহয় , লাল পাহাড়ের সামনে সবুজ মাঠ তাতে চকচকে বাদামী ঘোড়ারা ঘাস চিবোচ্ছে নিশ্চিন্তে, শব্দ নেই, বাড়ি আছে, লোক দেখা যায় না, কী অসম্ভব শান্ত।
নির্জন গ্রামের পথে যেতে যেতে
এখানের একটা রেস্তোরার নাম হেল্স্ ব্যাকবোন (Hell's Backbone), এটাতে সামান্য কিছু লোক ডিনার করছে, খুব খিদে পেলেও আমরা দাঁড়ালাম না, একটু পরে ওই নামের একটা ব্রিজ এল খাদের ওপরে, গভীর খাদ ,অপূর্ব সুন্দর পাথরের আলপনা তার মধ্যে। তাড়া থাকলেও জোরে চলবে না গাড়ি, তবুও ছোট্ট ঝামেলা হল একটা, পথের পাথরের টুকরো ছিটকে গাড়ির উইন্ডশিল্ডে সরু ফাটল ধরল, সেই ফাটল প্রতি মিনিটে সর্পিল গতিতে বাড়তে থাকল, শাশ্বতর মাথা খারাপ হয়ে গেল এই বুঝি সামনের কাঁচ ভেঙে পড়ে, ফলে আমি ত্রিবিধ কাজ একসাথে করতে থাকলাম, ফটো তোলা, দৃশ্য উপভোগ ও ফাটলের মাপ দেখা হাতে মেপে। সুখের কথা কাঁচ গাড়ি ফেরত দেওয়া পর্যন্ত টিঁকে ছিল।
বোল্ডার পাহাড়ের উপরে রাস্তার উচ্চতম বিন্দুতে পৌঁছে বিস্ময়ে কথা হারিয়ে যায়। ৩৬০ ডিগ্রী জুড়ে তরঙ্গময় নানা আকার ও রঙের সুবিশাল ল্যান্ডস্কেপ , একটু দূরে বরফ ঢাকা হেনরি পর্বত, যা দুর্গমতার জন্যে বিখ্যাত, নিতান্ত আধুনিক সময়ে এই অঞ্চলের ম্যাপ তৈরী হয়েছে। আসলে যা দেখা যাচ্ছিল সেটা 'ক্যাপিটাল রীফ' পার্কের বিখ্যাত 'ওয়াটারপকেট ফোল্ড'( Waterpocket Fold)। যদি সমুদ্রের ধারে ঊঁচু বাড়ির মাথায় বা উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে পরপর অনেক ঢেঊ পাড়ের দিকে আসছে দেখা যাবে, প্রথমটি বড় হয়ে ভেঙে যাবে, পরেরগুলো ক্রমশ ছোট হবে, এই অবস্থায় যদি গুপী বাঘা বলে ওঠে "থেমে থাক" তাহলে যা দাঁড়াবে সেটা অনেকটা এমন দেখাবে বলে আমার ধারনা। ঢেউগুলো নীল সাদার বদলে রঙীন এখানে । এই বর্ণনা শুধু আমার কল্পনা এর সাথে 'ওয়াটারপকেট' নামের কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু । যে বিশেষ ধরনের ভূমিক্ষয় এর সৃষ্টির কারণ তা ভূতত্বের বিষয়, আমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। এই ভ্রমণের সময় বড় দুঃখ ছিল মনে ভূতত্বের জ্ঞান কম বলে। পরে মনে হল জ্ঞানকে এখানে মুক্তি দেওয়াই ভালো। ৯২০০ ফুটের উপরে সূর্যাস্তের আলোয় হাড় হিম করা শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দের সাথে কী যে শিহরণ জাগানো দৃশ্য দেখেছিলাম সত্যিই বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা নেই । তার সাথে যোগ দিয়েছিল নির্জনতা। পরে জেনেছি যে বিস্তার এইখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় তা 'কানেকটিকাট' রাজ্যের কাছাকাছি আয়তন।
ওয়াটারপকেট ফোল্ড
এইখানেই সূর্যাস্ত হল, আলোর রেশ রইল কিছু, পাইন ও আস্পেন বনভূমির মধ্যে দিয়ে আবার চলল রুট ১২ , সারা রাস্তায় রেডিও থেকে গান চালানো ছিল বোঝার জন্যে যে কোথায় একটু সিগনাল আসছে মোবাইলে। গ্রামগুলোর কাছাকাছি ছিল, এখন এক্কেবারে সাড়া নেই, ফোন সম্ভব নয়, জিপিএস তো নয়ই । এই সব আলোচনা করতে করতে চলেছি হঠাৎ একটা বাঁকের পরে জঙ্গলের ধারে দেখি একজন মহিলা মাথার উপরে হাত তুলে থামতে বলছে, বেশ আঁধার নেমেছে তখন, কান্ডখানা কী বোঝার আগেই শাশ্বত ব্রেক মারল। গাড়ির কাঁচ চিলতে ফাঁক করা হল কথা বলতে। মহিলার থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বিশালদেহী গোঁফ দাঁড়িযুক্ত ভদ্রলোক, দুজনেই ককেশিয়ান। ভদ্রমহিলা জানালেন ভাঙা ইংলিশে উনি ইউরোপিয় ট্যুরিস্ট, ইংলিশ কম জানেন, গাড়ি জঙ্গলের ভিতরে আটকে গিয়েছে, হেল্প লাগবে, আমাদের গাড়িতে যন্ত্রপাতি আছে কিনা। ছিলনা, আমাদের ভাড়া করা গাড়ি, জানালাম। বলল কাউকে ডাকা যাচ্ছেনা, ফোন কাজ করছেনা, আমদেরও একই অবস্থা। ভদ্রলোক সেই দূরেই দাঁড়িয়ে কাকে যেন শিস্ দিয়ে ডাকলেন দুবার। আমি মহিলাকে বললাম আপনি আমাদের সাথে আসুন, টোরি ২০ মাইল মত, টো-ট্রাক নিয়ে আসবেন। কিন্তু সে রাজি হল না, বলল তোমরা গিয়ে হেল্প পাঠিয়ে দাও। আমাদের বলা বাহুল্য বেশ ভয় করছিল, ঘাড় নেড়ে "স্টে সেফ , স্টে ওয়ার্ম" বলে চলা শুরু করলাম। এবার আমাদের আলোচনা শুরু হল, গাড়ি রাস্তা থেকে সরিয়ে জঙ্গলে নেওয়া নিষেধ , বার বার লেখা দেখেছি পথে, ওরা নিয়ম ভেঙেছে, কপালে দুঃখ আছে। ভদ্রলোক কাকে ডাকছিলেন শিস্ দিয়ে, ছেলে বলল, নিশ্চই কুকুর আছে, মানুষকে তো ওভাবে ডাকে না। তার মানে লোকটা এখানের কোথাও থেকে এসেছে, ইউরোপ থেকে তো আর কুকুর আনেনি। তাহলে উনি কথা না বলে দূরে রইলেন কেন? শাশ্বত ব্যাখ্যা দিল এখানে লোকজন যত্রতত্র বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ,বন্দুক ঠেকিয়ে গাড়িটা নিয়ে আমাদের জঙ্গলে ফেলে গেলে কী করার থাকবে? সেটা যাতে আমরা না সন্দেহ করি, ভয় না পাই, তাই উনি এগোননি"। এইসব বিশ্লেষণ করতে করতে পাহাড়ী রাস্তা আধঘন্টা পরে একরকম সমতলে নেমে এল, রাস্তার কোনে একটা মিটমিটে আলোজ্বলা দোকান, ভিতরে ঢুকেই বুঝলাম দোকান বন্ধ করার আয়োজন চলছে, বয়স্ক দোকানী আমাদের দেখে মোটেই খুশী হননি , আমরা বললাম জঙ্গলে আটকে থাকা দুজনের কথা। উনি সামনে রাখা একপাঁজা কার্ড থেকে একটা টেনে নিয়ে ফোন করতে লাগলেন। ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটি কিছু প্রশ্ন করছিল, গাড়িটা কী ধরনের ?কতটা জঙ্গলের ভিতরে আটকেছে? কী বলব, গাড়ির দর্শন পাইনি, তাই জানালাম। এখান থেকে আন্দাজ দূরত্ব, আর লোকজনের চেহারার বর্ণনা দিলাম। দোকানি জানালেন টো-ট্রাক চলে যাবে। দোকানের একপাশে 'সাবওয়ে' স্যান্ডুইচ কাউন্টার দেখে আমার আর ছেলের একটু আশা জেগেছিল, ভদ্রলোক জল ঢেলে দিলেন, উনি এখুনি দোকান বন্ধ করবেন। আজকেও শুকনো খাবার খেয়ে চালাতে হবে মনে হচ্ছে , এ যাত্রায় আধপেটা খেয়ে স্লিম হয় ফিরব। রাত ন'টা নাগাদ রিচফিল্ড শহরে পৌঁছলাম।
এটাই আমাদের এই ভ্রমণ বৃত্তান্তের সর্বোচ্চ ধাপ , এরপর আরো দুদিন কেটেছে লাস ভেগাসে ফেরৎ উড়ান ধরার আগে, দেখেছি আরও দুটো পার্ক, হাইওয়ে ৭০ দিয়ে আরও দীর্ঘ অদ্ভূত ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে দিয়ে ড্রাইভ করেছি , কিন্তু একবারে সব বলা যাচ্ছে না, বড় গুরুপাক হয়ে যাবে। মোয়াব (Moab) শহর ও মিল ক্যানিয়ন এর কথা বলে শেষ করব। মোয়াব 'আর্চেস ক্যানিয়ন' ও 'ক্যানিয়নল্যান্ড' দুই ন্যাশানাল পার্কের প্রবেশদ্বার। এর অনেক ইতিহাস আছে, ১৮৬৯ সালে প্রথম পাওয়েল অভিযানে এই মোয়াব হয়ে পাওয়েল ও তাঁর দশ সঙ্গী গ্রীন রিভার থেকে কলোরাডো নদীতে মেশেন, ছয়জন বেঁচেছিলেন অভিযান শেষে। তখন বিখ্যাত কলোরাডোকে বলা হত গ্রান্ড রিভার, আর তাদের ক্যানিয়নল্যান্ডের মধ্য দিয়ে নদীপথ তখন 'গ্রেট আননোন' নামে বিভীষিকা ছিল। পুরোনো হলিউড সিনেমা দেখতে যদি কারো ভালো লাগে তাহলে 'টেন হু ডেয়ার্ড্' ('Ten who dared' ) দেখে নিতে পারো। শুধু ১৮৬৯ সালের অভিযান নয়, ফাদার এস্ক্যাল্যান্তে ও সঙ্গীরা ১৭৭৬ সালে এই সব অঞ্চলের উপর দিয়ে গ্রীন রিভার ধরে উত্তরে উটা লেক পর্যন্ত যান, তাঁরা নাকি ২০,০০০ মাইল পথ ৬ মাস ধরে ঘুরেছিলেন, সেই অভিযানে ফাদার এস্ক্যাল্যান্তের সঙ্গী ছিলেন 'ক্যাপ্টেন মিয়েরা' । প্রথম এই অঞ্চলের ম্যাপ তিনিই তৈরী করেন, পাওয়েল এর নতুন ম্যাপ তৈরী না হওয়া পর্যন্ত যা ছিল ইউরোপিয়ানদের একমাত্র নির্ভর করার মত ম্যাপ । কেন যে এস্ক্যাল্যান্তের নামে একটা শহর, একটা নদী ও এক অন্তহীন ন্যাশান্যাল মনুমেন্ট নামকরন হয়েছে তা এখানে না এলে বোঝা যাবেনা। কত অকুতোভয় হলে এই অচেনায় ঝাঁপ দেওয়া যায় তা আজ এই আধুনিক সময়েও টের পাচ্ছি।
ফসিল রূপে অ্যালোসরাসের থোরাটিক ভার্টিব্রে
আমার ছেলের ডাইনোসরে মহা আসক্তি, তার বাবা জায়নে ডিম কিনতে না পেরে তাকে জ্যান্ত ফসিল দেখানোর প্রমিস করে বসেছিল, জ্যান্ত মানে দোকানে বা মিউজিয়ামে সাজানো নয় আর কি। কলোরাডো রাজ্যে ডাইনোসর ন্যাশনাল মিউজিয়াম' ( 'Dinosaur National Monument') নামে আস্ত একটা পার্ক রয়েছে সেখান থেকে আমরা এসে পড়েছি বহু দূর। তাই প্রচুর খুঁজে মিল ক্যানিয়ন নামে অজ্ঞাত জায়গার সন্ধান পাওয়া গেল,যেখানে তেনাদের পবিত্র দেহাবশেষ আছে। একটা লাল কাদা ঘোলা জলের নদী ঠেঙিয়ে ছোটখাটো টেকিং করলাম টিলায় টিলায়, পাথরের প্রাচীরে প্রথিত ডাইনোদের হাড় গোড়, এটা সত্যিই নতুন অভিজ্ঞতা, ঠিক যেভাবে পেলিওন্টোলজিস্টরা খুঁজে বের করেন, সেভাবে কখনো দেখিনি।
ফসিল রূপে সরোপডের কাঁধের হাড়
আমাদের ভ্রমণ শেষ হয়নি, কিন্তু কাহিনী শেষ হয়েছে। ২০১৬ সালে, ন্যাশন্যাল পার্ক সার্ভিসের শতবর্ষ পূর্তি, নানান পার্ক ঘুরতে ঘুরতে জেনেছি এদেশের জাতীয় উদ্যানগুলি তৈরির ইতিহাস ,প্রকৃতিকে মানুষের সামান্য একটু হলেও শ্রদ্ধা দেখানোর চেষ্টা । ন্যাশান্যাল পার্ক তৈরি করে প্রকৃতি সংরক্ষণ ধারনা ও আইন কানুন এই দেশেই শুরু হয় ,আজ সারা পৃ্থিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে এই উদ্যোগ। ইচ্ছে হলে তুমি পড়ে দেখতে পার জাতীয় উদ্যানগুলির জনক ('Father of the National Parks' ) ঋষিপ্রতিম জন ম্যুয়র এর গল্প, প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট-এর এই বিশাল কর্মযজ্ঞ রূপায়নের গল্প ( যাঁর নামের টেডি বেয়ার তোমার ছোটবেলার বন্ধু), প্রথম ন্যাশনাল পার্ক ডিরেক্টর স্টিফেন ম্যাথার এর জীবনব্যাপী কাজ, শিল্পপতি রকেফেলার জুনিয়র -এর হিমালয়প্রমাণ দানের আশ্চর্য কাহিনী । এইসব মানুষের ও আমার অজানা আরো অসংখ্য প্রকৃতি প্রেমিকের অবদানে গড়ে উঠেছে আজকের ন্যাশন্যাল পার্কেরা, সারা পৃথিবীর বুকে। তাই হয়তো এত অন্যায়-অত্যাচার করার পরেও প্রকৃতি আমাদের এখনো মুছে দেয়নি, আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ পেয়েছে প্রকৃতির স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের অধিকার।
ছবিঃ
লেখক
ন্যাশ্নাল পার্ক সার্ভিস
নিক ডি বারমোর
ডঃ জ্যাক শেয়ার