চটুক চটুকির এখন বড়ো সমস্যা। ওরা তো বাসা বাঁধে মানুষের বাড়ির ঘুলঘুলিতে – যাকে ভেন্টিলেটার বলে। আজকাল তো মানুষেরা এমন বিদঘুটে বাড়ি বানায় যাতে ভেন্টিলেটার থাকেই না। ওরা থাকবে কোথায়? মানুষকে বাদ দিয়েও ওদের থাকা মুস্কিল। মানুষের আশেপাশে থেকে, মানুষের ফেলে দেওয়া নানা খাবার, একটু পচা খাবার বা মাটিতে জন্মানো পোকামাকড় খেয়েও ওদের জীবন চলে। ওরা বড়ো ছোটো প্রাণী, তাই সবাইকেই ওরা ভয় পায়। তবু মানুষ ওদের ধরে খাবার চেষ্টা করে না এই যা রক্ষে। তবে ওদের এইটুকু শরীর আর খাবেই বা কী?
তবু বাঁচতে তো হবে, তাই আনাচে কানাচে কোনও রকমে বাসা বেঁধে থাকতে হয় ওদের। বাসা ভেঙে গেলে আবার বাসা বাঁধতে হয়। এমন করেই ওদের কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটে। চটুক বাসায় বসে, ও আজ ডিম পাহারা দিচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক জায়গাতে চটুকির চোখ পড়ল – ওরে বাবা! নারকেল পাতার ফাঁকে কত পোকা! উড়ে গিয়ে বসে ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগল চটুকি, মুখে খুশির চিক চিক আওয়াজ।
মনের সুখে পোকা খেতে খেতে ওর কিছু খেয়ালই নেই। কখন যে আকাশ কালো হয়ে এসেছে তা জানেই না। দমকা হাওয়ার দাপটে উলটে পড়তে পড়তে কোনও রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে ওর খেয়াল হলো। হাওয়ার সাথে শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। ভয়ে দিশেহারা হয়ে কোন দিকে যে ওর বাসা তা ভুলে গেল চটুকি। মানুষেরা তখন দুরুম দারুম করে সব জানলা বন্ধ করছে। সেই ভয়ে আরও দিশেহারা হয়ে কোথায় যে উড়ে চলল তার দিশা রইল না। হঠাৎ একটা জানলা খোলা পেয়ে কিছু চিন্তা না করেই ঢুকে পড়ল চটুকি।
বাড়িতে দু'টো মানুষ ওদের দেখেই হৈ হৈ করে উঠল, "দেখো, একটা চড়াই!"
ভয় পেয়ে ও আবার বাইরে ঝাঁপ দিতে মন ঠিক করল, কিন্তু ঝড়-জলের এমন দমকা দিল যে কিছু না ভেবেই ও ঢুকে পড়ল আরও ভিতরে, আরও, আরও। শেষে একেবারে এক টেবিলের কোনায়।
বাড়ির মোটাসোটা মানুষটা তার স্ত্রীকে বলল, "ওকে বিরক্ত করো না, ভয় কাটাতে সময় দাও।" উঠে পাখা বন্ধ করে দিল সে, "ভয় পেয়ে উড়তে গিয়ে পাখায় না বাড়ি খায়। আমাদের না হয় একটু গরম লাগবে।" স্ত্রী সমর্থন করল, "ঝড়জল হচ্ছে, এক্ষুনি ঠান্ডা হয়ে যাবে। পাখা না চালালে ক্ষতি কি? ওর জীবন বাঁচুক।"
ভিজে ডানা ঝেড়ে কোনায় ঢুকে চটুকির এবার মনে পড়তে লাগল তার চটুক, তার ডিমের কথা। চটুকটা খুব বোকা, তাকে খুঁজতে বেরোবে না তো? বুদ্ধি করে যদি বসে ডিমগুলো আগলে রাখে তবে তো হয়। ওকে দেখতে আরও দু'জন উঁকি দিল, মানুষের কাছে কাছে থেকে চটুকি এটুকু বুঝেছে যে এই মানুষগুলোর কোনও বদমতলব নেই। মানুষগুলোর উঁকিঝুঁকি বন্ধ হলে ও উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল। ওমা! এ তো তার চেনা বাড়ি! এই বাড়ির এক জানলায় রোজ ওদের জন্য চাল রাখা হয়, ওরা এসে খুঁটে খুঁটে খায়। এবার অনেক নিশ্চিন্ত হল ও।
কিন্তু এত পোকা খেয়ে ওর তেষ্টা পেয়েছে, জল কোথায় পাবে? এক ঠোঁট জল না পেলে যে আর চলছে না। মোটা মানুষটা একটা ছোট্ট বাটিতে একটু জল নিল, আরেকটা বাটিতে একটু চাল। আরেকটা ছোট্ট কাগজের বাক্স নিল, তার ভিতরে যত্ন করে খানিক ছেঁড়া কাপড় সাজাল, সন্তর্পণে সেটা এগিয়ে দিল টেবিলের নিচে। স্ত্রীকে বলল, "আশা করি আর কিছু ওর আজ রাতে দরকার হবে না। জানলাটা খোলা থাক, আমাদের বাড়িতে তো বিড়াল-ইঁদুর নেই – ও ভালোই থাকবে আর ভোর হতেই উড়ে যাবে।"
আশ মিটিয়ে জল খেয়ে চটুকি 'চিক' করে একবার ধন্যবাদও দিয়ে ফেলল। তারপরে চটুক আর ডিমের কথা ভাবতে ভাবতে কাগজের বাক্সে নরম কাপড়ের উপরে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে উড়ে গেলেও চটুকি আরেকদিন এই বাড়িতে ঢুকে পরেছিলো। চটুকের কী ভয়! চটুকি দিব্যি এদিক ওদিক করে আর ঘাড় বাঁকিয়ে চটুককে ডাকে, "তুমিও এস না, কোনও ভয় নেই!" বোকা চটুকটা কি আর অত সাহস করে? তবে চটুকি লক্ষ্য করেছিল – ও ঢোকার সাথে সাথেই মোটা মানুষটা মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ওই ভয়ানক জিনিষটার ঘোরা বন্ধ করে দিয়েছিল। যত ভয় তো ওটাকেই।
রোজ সকালে জানলার ধারে ওদের জন্য চাল রাখা থাকে, না থাকলে চটুক চটুকি, আরও অনেকে মিলে একটু দূরে টাঙানো দড়ির উপরে বসে, চিকমিক করে আর নাচ দেখায়। এ বাড়ির মানুষেরা একটু হেসে এসে চাল দেয়। তবে দড়ির কাছের বাড়ির মানুষগুলো যেন কেমন! যে দড়িটা টাঙিয়েছে সেটা বড়ো পিছল। মাঝে মাঝে তার উপরে নরম কাপড় শুকোতে দেয় – তখন চড়াইদের খুব মজা হয়। নরম কাপড়ের উপরে বসে ওরা খুব ভালো নাচ দেখায় তখন। কিন্তু এরা দেখতে পেলেই ওদের তেড়ে আসে, উড়িয়ে দেয়। অবশ্য ওরা যে নাচতে নাচতে এক আধবার ওই কাপড়ের উপরে 'পুচ' করে দেয় না, তা বলা যায় না। তা খুব যদি পেয়ে যায় তবে ওরা আর কী করবে? নাচের তাল তো ভাঙা যায় না!
ছবিঃ শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী