অনেক বছর পরে এবার চিকুদের গ্রামের বাড়িতে আবার কালীপুজো হবে। গ্রামের বাড়ি ওরা বলে বটে, এককালে গ্রামই ছিল সেটা, এখন নয়। তবে কলকাতার তুলনায় কিছুই নয়। গ্রামের বাড়ি নামটাই রয়ে গেছে। সেখানে চাকরবাকর নিয়ে থাকেন শুধু বড়োমা, চিকুর বাবার ঠাকুমা। বুড়ি হয়ে গেছেন কিন্তু ওই বাড়ি ছাড়তে নারাজ। আগে প্রতিবছরই খুব ঘটা করে কালীপুজো হত। সারা গ্রামের লোক খেত, আতসবাজি জ্বালানো হত। দীপাবলীর ঘন কালো আকাশে আলোর ফুলকি দিয়ে মালা তৈরি হত, ফুলদানি হত, আরো কত কী! সে নাকি এক দেখার জিনিস ছিল। ক্রমশ গ্রামের সীমা ছাড়িয়ে সারা দেশে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল, দেখতে দেখতে অত বড়ো বাড়িটাতে বড়োমা একা হয়ে পড়লেন। কালীপুজোতেও আর সবাই আসতে পারত না। বড়োমার বয়স হয়ে গেছে, পুজোর সব ঝক্কি ঝামেলা সামলানো একা ওনার পক্ষে সম্ভব হত না। ফলে অত বছরের পুরোনো পুজো এক সময় বন্ধই হয়ে গেল।
এবার দুর্গা পুজোর অনেক আগেই সবার বাড়ি বাড়ি ফোন এল যে এবার আবার কালীপুজো হবে গ্রামের বাড়িতে। সবাইকে আসতেই হবে। বড়োমা নাকি বলেছেন, "কবে আছি কবে নেই, এবার একবার ঘটা করে পুজো করব। আমি গেলে তো এই বাড়িই আর থাকবে কীনা সন্দেহ। আর একবার হোক পুজোটা।"
এবার তাই আর কারুর কোনো অজুহাত চলে নি। আগে থেকেই কালীপুজোর সময় ছুটি নিয়ে রাখতে হয়েছে। দুদিনের জন্যে হলেও যেতে হয়েছে।
ভূত চতুর্দশীর আগের দিনই বেশীরভাগ আত্মীয়স্বজন পৌঁছে গেলেন। যারা পারলেন না তাঁরা এলেন ভূত চতুর্দশীর সকালে। বাড়ি একেবারে জমজমাট হয়ে গেল। কাজও কী কম! এই এত বড়ো বড়ো পেতলের সব বাসন কোসন বেরোচ্ছে, তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতেই দুজন ব্যস্ত। রান্নাঘরে এত এত কুটনো কোটা হচ্ছে। চিকুরা সব মিলিয়ে লোক কম নাকি! তাদের রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করতে হবে না? ওদিকে ঠাকুরের ভোগের ঘর পরিষ্কার করা হচ্ছে। ওখানে পুজোর দিন কালী ঠাকুরের ভোগ রান্না হবে, সেও অনেক রকম। আবার ভিয়েনও বসবে। এ বাড়ির কালীপুজোয় নাকি মিষ্টি খাওয়ানোর চল আছে। এত মিষ্টি বাইরে থেকে কেনা হয় না, বাড়িতেই তৈরি হয়। হচ্ছে যখন তখন সব আগের মতো করেই হোক, বড়োমার ইচ্ছে।
এসব কান্ডকারখানা দেখে তো চিকু আর ওর খুড়তুতো, পিসতুতো ভাইবোনেদের চক্ষু চড়কগাছ। এসব কখনও দেখে নি তো, তাই।
"এতেই তো দেখি তোদের চোখ গোল গোল হয়ে যাচ্ছে। কাল যখন আতসবাজি জ্বলতে শুরু করবে আর রসগোল্লা খাওয়ার লড়াই হবে তখন কী করবি?" বললেন বড়োমা।
"রসগোল্লা খাওয়ার লড়াই! সে আবার কী?" ওরা সমস্বরে বলে উঠল।
"তাও জানিস না? তোদের বাবা মারা কি তোদের কিছুই বলে না? ওরাও অবশ্য দেখে নি কোনদিন, কিন্তু শুনেছে তো," বড়োমা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন।
কিন্তু এসব কথায় দমবার পাত্র চিকুরা নয়।
"বলো না বলো না রসগোল্লা খাওয়ার লড়াই কেমন হয়," ওরা বড়োমাকে চেপে ধরল।
"সে আমার শ্বশুরমশায়ের আমলের কথা, বুঝলি। মানে তোদের ঠাকুরদার ঠাকুরদা। কালীপুজোর সবচেয়ে ঘটা ওই সময়েই হত। মিষ্টি যে কতরকমের বানানো হত তার ঠিক ঠিকানা নেই। তোরা না সেসব দেখেছিস না তাদের নাম শুনেছিস। একবার কালীপুজোর আগে মতিখুড়ো, এখানকারই লোক ছিল মতিখুড়ো, খাইয়ে বলে খুব নাম ছিল, কী যেন বেশ বলছিলাম, হ্যাঁ মনে পড়েছে, মতিখুড়ো আমার শ্বশুরমশাইকে বললেন, 'তোমাদের ময়রার হাতে যাদু আছে, এত ভালো রসগোল্লা তৈরি করে যে মনে হয় যত পারি খেয়ে যাই।' শ্বশুরমশাই বললেন, "তা খাও না কেন? যত ইচ্ছে খাও।' মতিখুড়ো শুনে বলল, 'তাহলে একটা লড়াই হোক না। মজা আরো জমবে।'
সেই বছর থেকে শুরু হল কালীপুজোর সন্ধ্যেয় রসগোল্লা খাবার লড়াই। লড়াই-এর দিন মতিখুড়ো আমার শ্বশুরমশাইকে বললেন, এতে আমাকে কেউ হারাতে পারবে না। এ গ্রামের সেরা খাইয়ে আমিই। এক কাজ করো না কেন, তুমিও বসে যাও খেতে।' উনি প্রথমে রাজি হন নি কিন্তু পরে সবার জোরাজুরিতে হলেন। কম খাইয়ে তিনিও ছিলেন না। ঠিক হল যে জিতবে তাকে সোনার মেডেল দেওয়া হবে। মতিখুড়ো গর্ব করে বললেন, "ও মেডেল ধরে নাও আমিই পেয়েছি। গলায় ঝুলিয়ে গোটা গ্রাম ঘুরব।' শেষ পর্যন্ত কিন্তু তা হল না। মতিখুড়ো মার শ্বশুরমশায়ের কাছে হেরে গেলেন পাঁচ রসগোল্লায়। সোনার মেডেল বাড়িতেই রয়ে গেল। সেই থেকে কালীপুজোয় রসগোল্লা খাওয়ার লড়াই হয়ে আসছে। যত বছর হয়েছে তত বছরই আমার শ্বশুরমশাই জিতেছেন। গ্রামের লোকজনের চাপাচাপিতে ওনাকে খেতে বসতেই হত। নাহলে নাকি লড়াই জমত না। কিন্তু হারাতে ওনাকে কেউ কখনো পারে নি।"
"এবার যে জিতবে তাকেও সোনার মেডেল দেওয়া হবে বুঝি?" চিকু জিজ্ঞেস করল।
"সে এখনও ঠিক করি নি। এও এক তাজ্জব ব্যাপার বুঝলি," বললেন বড়োমা, "সোনার মেডেলটা হারিয়েই গেছিল। এত জিনিস এদিক ওদিক হয়েছে, আমি ভেবেছিলাম তার সঙ্গেই বোধহয় কোথাও চলে গেছে বা কেউ নিয়েও নিতে পারে। এ বছর পুজোর আগে সব ঝাড়াঝুড়ি করতে গিয়ে একটা পুরোনো কাঠের বাক্স থেকে বেরোল সেটা। স্যাকরাকে দিয়ে পালিশ করিয়ে নিতেই আবার আগের মতো ঝকঝকে হয়ে গেল। আর কী বেরোল জানিস? আমার শ্বশুরমশায়ের ফটোটা। সেটা বৈঠকখানার দেওয়ালে টাঙানো থাকত। একবার ঝড়ে দড়ি ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে কাঁচ ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। সেই থেকে সেটা কাগজে মুড়ে রাখা ছিল। কত বছর যে ওভাবে আছে তার ঠিকই নেই। আমি তো ভুলেই গেছিলাম। খুঁজে পেয়ে আবার সেটাকে বাঁধাতে দিলাম।"
কালীপুজোর সন্ধ্যে হতে না হতেই রসগোল্লা খাওয়ার লড়াই দেখতে সারা গ্রাম ভেঙে পড়ল। প্রতিযোগীরা সার বেঁধে দালানে বসে পড়ল। প্রত্যেকের জামার সামনে পেছনে ১, ২, ৩, ৪ করে নম্বর লেখা কাগজ আটকে দেওয়া হয়েছে। তার আগে অবশ্য একটা খাতায় প্রতিটা নম্বরের পাশে পাশে নামগুলোও লিখে রাখা হয়েছে। বড়োমা সব খোঁজখবর নিচ্ছেন, ক'জন লড়াই-এ নাম দিয়েছে, কারা তারা, চেনা কে কে এল – এইসব আর কী।
"এখনকার ছেলেপিলেরা আর কী আর অত খেতে পারবে? একটুতেই যা হাঁসফাঁস করে সবাই! যাক গে তোমরা এদিকটা দেখো, কে কটা খাচ্ছে ঠিক করে তার হিসেব লিখো। আমি পুজোর ওদিকে আছি। পুজোর নিয়মকানুন তো কেউ জনেই না। আমি না থাকলে চলবে না," বড়োমা বললেন।
প্রতিযোগীদের সামনে বাড়ির তিনজন বসলেন খাতা কলম নিয়ে। হিসেব রাখতে। পরিবেশনকারীরা রসগোল্লা দিয়ে যেতে লাগলেন, প্রতিযোগীরা খেতে লাগল আর খাতায় লেখা হতে লাগল কে কটা খাচ্ছে। লড়াই জমল চার নম্বর, তেরো নম্বর আর সতেরো নম্বরের মধ্যে। অন্যরা রণে ভঙ্গ দিলেও এই তিনজন খেয়েই যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত চার নম্বর জিতল, একশো সাতটা রসগোল্লা খেয়ে! সবাই জোরে হাততালি দিয়ে উঠল। চার নম্বরের কিন্তু তেমন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে শুধু মুচকি হেসে চলে যাবার উপক্রম করল।
"আরে যাচ্ছেন কোথায়? সোনার মেডেল নেবেন না?" কে একজন যেন বলল। "সে তো কাল সকালে। আগে পুজো হোক, তারপরে তো, এখন যাই," বলে চার নম্বর চলে গেল।
সেটা অবশ্য সত্যি কথা। বড়োমা বলেছেন যে জিতবে তাকে কাল সকালে মেডেল দেওয়া হবে।
বাজী পোড়ানো তো ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আতসবাজীর বেশীরভাগ অবশ্য কাল সন্ধ্যেয় জ্বালানো হবে, আজ তো অনেকেই পুজোর কাজে ব্যস্ত। বড়োমাও ভেতরেই। সবাই গেল তাঁকে ফলাফল জানাতে।
সব শুনেটুনে বড়োমা বললেন, "আমি তো ভেবেছিলাম এবার লড়াই জমবেই না। কিন্তু দেখছি মন্দ হয় নি। তা এই চার নম্বরটি কে? নাম কী তার?"
চিকুর ছোটোকাকা মাথাটাথা চুলকে বললেন, "ওটা একটা ভুল হয়ে গেছে ঠাম্মা। চার নম্বরের নামটা দেখছি লেখা হয় নি। এমন হুড়োহুড়ি হল সেই সময়টাতে! সবাই বসতে চাইছে। নম্বর দেওয়া হল, নামটা আর লেখা হয় নি। পরে উত্তেজনায় আর খেয়াল নেই।"
"কোনো কাজ তোরা ঠিক করে করতে পারিস না। একদম ভরসা করা যায় না তোদের ওপর। যেদিকে আমি দেখব না সেদিকেই কিছু না কিছু গোলমাল হবে," বড়োমা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন।
"আরে এত চিন্তা করছ কেন? যে সোনার মেডেল পাবে সে কাল আসবে না? নিশ্চয়ই আসবে। নিজেই তো বলে গেল যে আগে পুজো হোক, তারপরে তো। কাল আসলেই জানা যাবে," চিকুর বাবা বললেন।
"হ্যাঁ কাল এলে মনে করে নামধাম সব জেনে নিও। এত বছর সোনার মেডেল আমাদের বাড়িতেই আছে, সেটা কোথায় গেল জানতে হবে না। কাল অবশ্য আমি থাকব, মেডেল তো আমিই দেব। যাক, পুজো শুরু হচ্ছে, এখন আর গোলমাল কোরো না।"
পুজো নির্বিঘ্নেই মিটে গেল। শেষ রাতের দিকে সবাই একটু বিশ্রামও নিল। সকাল থেকে আবার কাজের তোড়জোড় শুরু। দুপুরে অনেক লোক খাবে তার ব্যবস্থা করা। তার আগে অবশ্য রসগোল্লা খাওয়ার লড়াই-এর প্রাইজ দেওয়া আছে। বেলা হতে না হতেই বাড়ি ভরে গেল লোকে। শুধু চার নম্বরেরই পাত্তা নেই। দেখা গেল কেউ তাকে চেনেও না।
কেউ বলল, "এখানকার লোক নয়, নাহলে মুখ চেনা হতই," কেউ বললে, "এবার যে এ বাড়িতে কালীপুজো হচ্ছে আর রসগোল্লা খাবার লড়াইও হচ্ছে সে কথা কোথায় না কোথায় ছড়িয়ে গেছে। বাজারেও কত আলোচনা হচ্ছিল এ নিয়ে। দেখো সেরকমই কোন লোক এসে জিতে গেল নাকি, কোন উটকো লোক হয়তো।"
"সে যাই হোক, জিতেছে যখন তখন সোনার মেডেল তো তাকে দিতেই হবে। এই জন্যেই তো মেডেল তৈরি করা হয়েছিল," আরেকজন বলল।
বেলা গড়িয়ে যেতে লাগল কিন্তু চার নম্বর এল না। তাকে কেউ জানে না, চেনে না, তাই তার বাড়িতে খবর দেওয়ারও কোনো উপায় রইল না।
বড়োমা একটা গদি আঁটা পেল্লাই চেয়ারে বসে এতক্ষণ সব শুনছিলেন, এবার বললেন, "হ্যাঁরে চার নম্বরকে দেখতে কেমন? এতক্ষণ বসে বসে একশো সাতটা রসগোল্লা খেল, তাকে দেখেছিস তো ভালো করে? কেমন দেখতে সেটা বলতে পারবি তো?"
"কেন পারব না?" সবাই বলে উঠল। বলে সবাই মিলে তার একটা নিখুঁত বর্ণনাও দিয়ে দিল।
শুনে বড়োমা বাড়ির পুরোনো চাকর স্বপনকে ডেকে বললেন, "ওরে স্বপন, সকালে দোকান থেকে যেটা নিয়ে এলি সেটা একবার আন দেখি।"
সবাই তো অবাক। সকালে দোকান থেকে স্বপন কী আনল আর তার সঙ্গে চার নম্বরের সম্পর্কই বা কী?
স্বপন ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা বড়োসড়ো জিনিস নিয়ে এল, বড়োমার কথামতো ব্রাউন পেপারের মোড়কটা খুলেও ফেলল।
বড়োমা বললেন, "এবার সবাই দেখো তো ভালো করে, ইনিই সেই চার নম্বর নাকি? স্বপন, ফটোটা সোজা করে ধরে দাঁড়া।"
ফটো দেখে তো সবার চক্ষুস্থির। এ তো চার নম্বর!
"এটা কার ফটো?" একজন কোনরকম জিজ্ঞেস করল।
বড়োমা দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, "ইনি হলেন আমার শ্বশুরমশাই। ওই তোমরা যাকে চার নম্বর বলছিলে। সোনার মেডেল বাড়ির বাইরে যাবে, এ সহ্য করতে পারেন নি, তাই এসেছিলেন রসগোল্লা খেতে। ওনার নাতিপুতিদের যে কত এলেম সে তো জানেন ভালো করেই! কী আর করবেন, বংশের নাম রক্ষে করতে ওনাকেই আসতে হল।"
শুনে আর কারুর মুখে রা'টি নেই। সবার মুখই ফ্যাকাশে হয়ে গেল, গলাও কেমন যেন শুকিয়ে গেল। তিন নম্বর আর পাঁচ নম্বর তো মাথা ঘুরে ওখানেই পড়ে গেল। এক্কেবারে পাশে বসেছিল কীনা।
এক বড়োমারই কোন হেলদোল নেই। বেশ খুশীখুশী মুখে বললেন, "যাক, এতদিনে একটা চিন্তা গেল। জানলাম এ বাড়িতে আমি একা নেই। দরকার পড়লে তিনি আসবেন। যেমন কাল এসেছিলেন। ওরে স্বপন, ছবিখানা বৈঠকখানার দেওয়ালে আবার ঝুলিয়ে দে রে আর সোনার মেডেলটার ফিতেটা বড়ো করে ছবিতে পরিয়ে দে। ও মেডেল ওনারই প্রাপ্য। উনিই তো জিতলেন।"
ছবিঃ ত্রিপর্ণা মাইতি