"আজকে আর ফুলদাদুকে ছাড়া যাবে না। নলে মানে আমাদের অতি বৃদ্ধ পিতামহের একটা গল্প শুনতেই হবে। ফুলদাদুই তো বলেছিলেন ওনার জীবনে নাকি অনেক কাণ্ডকারখানা আছে, মনে নেই?" সোম বলল।
"ফুলদাদুর সামনে এরকম 'নলে মানে আমাদের অতি বৃদ্ধ পিতামহ' বললেই হয়েছে আর কী! গল্প শোনা বেরিয়ে যাবে!" বললাম আমি।
"সোমদা তো নাহয় আমাদের সামনে বলেছে আর তুমি যে নলে নাম দিয়ে এই এত্ত বড়ো একখানা গল্প লিখে সোজা ইচ্ছামতীতে পাঠিয়ে দিলে তার বেলা? তারা আবার ছবি টবি আঁকিয়ে সে গল্প বারও করল! সেখানে কতবার নলে লিখেছ বলো তো?" পুটকি বলল, বেশ গম্ভীর মুখে।
পুটকি অবশ্য বেশীরভাগ সময়েই এরকম গম্ভীর মুখে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব করে কথা বলে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো তো, যদি কেউ ওকে পাত্তা না দেয় – এই ভয়েই বোধহয়।
আমি আমতা আমতা করে সবে বলছিলাম, "বা রে আমি তো শুধু লিখেছি, মুখে তো আর উচ্চারণ করিনি, তাছাড়া গল্প লিখতে গেলে তো ও নামটাও লিখতে হবে............"
এমন সময় ফুলদাদুর গলা, "সবক'টা মাথা এক হয়ে কী মতলব ভাঁজা হচ্ছে শুনি একবার।"
ফুলদাদুর গলা শুনেই তো আমার হয়ে গেছে। হাত পা ঠান্ডা, গলা শুকিয়ে কাঠ। গল্পতে আমি এক জায়গায় লিখেছিলাম কীনা ফুলদাদুর মুডটা আজ মনে হচ্ছে ঠিক সুবিধের নেই। ফুলদাদু সে গল্প পড়েছেন কিন্তু কিচ্ছু বলেননি, ভালো মন্দ কিচ্ছু না, একটা শব্দ অবধি না। ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হয়নি মনে হয়।
"না মানে এই বলছিলাম আর কী," সোম সামলানোর চেষ্টা করল।
"অত কায়দা করে না মানে বলতে হবে না, স্পষ্ট করে বলো দেখি মাথায় কী ঘুরছে তোমাদের," ফুলদাদু বললেন।
"আমরা আমাদের অতি বৃদ্ধ পিতামহের আরেকটা গল্প শুনতে চাই। ওই আগেরটার মতো। তুমিই বলছিলে না ওনার জীবনে ......" গুড্ডুর কথা শেষ হল না, ফুলদাদু ধমকে উঠলেন, "গপ্পো বলছিস যে বড়ো! ওটাকে তোর গপ্পো মনে হয়েছে? কী যে হবে তোদের! সত্যি ঘটনা আর গপ্পোর মধ্যের ফারাকও বুঝিস না! এই যেমন এই মেয়েটা একখানা সত্যি ঘটনাকে দিব্যি গপ্পো বলে চালিয়ে দিল, যেন উনি মাথা খাটিয়ে লিখেছেন আর তোরাও সেই গপ্পো গপ্পো করছিস! ঠাকুরদার কথা কেন বলব তোদের? আমি বলি আর তোমরা আবার সেটাকে গপ্পো বলে চালাও! আর তাতে ঘটা করে লেখো আমার মেজাজ মর্জি নাকি ঠিক সুবিধের নয়! যত্ত সব!"
"আর লিখবে না, কক্ষণো লিখবে না, লিখলেও সত্যি ঘটনা বলেই লিখবে। আর তোমার কথা মানে তোমার মেজাজ মর্জি ওই সব কথা আর কী, সেসব তো কিছু লিখবেই না। আমি বলছি," পুটকি বলল, সেরকম গম্ভীর মুখেই।
"আমি বলছি! উফ, ভারি এলেন আমার বলনেওয়ালা!" ফুলদাদু কিন্তু পাত্তাই দিলেন না পুটকিকে, ব্যাগ হাতে বাজারে চলে গেলেন।
সোম, গুড্ডু, পুটকি কটমট করে আমার দিকে তাকাল, যেন যত দোষ আমারই।
সন্ধ্যেবেলা ফুলদাদু নিজের মেহগনি কাঠের পেল্লায় খাটে বাবু হয়ে বসে বেশ আয়েস করে কাঁসার জামবাটি থেকে মুড়ি আর বেগুনি খাচ্ছিলেন, আমরা চারজনে গিয়ে আবার ধরলাম, "ও ফুলদাদু প্লিজ রাগ কোরো না। একটা ঘটনা বলো না, প্লিজ।"
সবাই মিলে ঠিক করেছি এবার থেকে 'ঘটনা' বলব, আর 'গল্প' বলি!
"রাগ করারই কথা। ঘরের কথা বাইরে বলার অভ্যেস মোটে ভালো নয়। তাও আবার ওই ইন্টারনেটে। তবে এ হল গিয়ে নিজের পূর্বপুরুষের কথা। ভেবে দেখলাম এক হিসেবে মন্দ হয়নি। লেখা তো রইল অন্তত, নয়তো এসব আর জানবে কে? আমি চোখ বুজলেই তো সবাই সব ভুলে যাবে। তাই এবারের মতো তোকে ছেড়ে দিলাম। তবে ওই ইচ্ছামতী না কী যেন তার সম্পাদকের ফোন নম্বরটা দিবি, তোকে বলে আর কী হবে, তোর মাকে বলতে হবে, ওটার মাথার ওপর গপ্পো টপ্পো লেখা যাবে না, সত্যি ঘটনা লিখতে হবে আর সত্যি সত্যিই যে এসব আমি বলেছি তাও লিখে দিতে হবে," বললেন ফুলদাদু।
"ঠিক আছে ঠিক আছে, তুমি যা বলছ তাই হবে, এখন বলো তো। না বললে আমরা জানবে কী করে?" আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলাম।
ফুলদাদু তক্ষুণি কিছু বললেন না, কিন্তু দু কানে হাত দিয়ে চোখ কপালে তুলে ওঁর বিড়বিড় করা দেখে বুঝলাম আমাদের অতি বৃদ্ধ পিতামহের জীবনের আরো একটা ঘটনা আমরা আজ শুনতে পাব।
বাটি থেকে একটা বেগুনি তুলে কামড়ে ফুলদাদু বললেন, "ঠাকুরদা ইস্কুলের মাস্টারমশাই হলেন, তিনতলা বাড়ি করলেন, বড়ো পুকুর কাটালেন, দেখতে দেখতে নলিনাক্ষ মৈত্রর নাম ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বেশ সমঝে চলতে লাগল। এ আর সেই ছোটো নলে নয় যার পড়াশোনায় মোটে মতি নেই।
একবার কী হল, ঠাকুরদার এক বন্ধু এসে নেমন্তন্ন করে গেল, বলল, 'নলে, কালীপুজোর সময়ে আমাদের বাড়িতে আয়, সবাই মিলে একসঙ্গে আতসবাজি পোড়াব। আগে থেকেই আসিস, বাজি তৈরি করতে হবে তো।'
ঠাকুরদা তো এক পায়ে খাড়া। এসব বাজি টাজি ঠাকুরদার খুব পছন্দের ব্যাপার ছিল কীনা। নিজেও ভালো বাজি তৈরি করতে পারতেন। বাড়িতে তৈরি সেসব তুবড়ি, রংমশালের কথা তোরা কল্পনাও করতে পারবি না। তোরা তো ওই অমুক বাজার, তমুক বাজার থেকে কীসব হাবিজাবি কিনে আনিস! তুবড়ি জ্বলতে না জ্বলতেই ফুস! তখন তুবড়ির কম্পিটিশন হত, বুঝলি? কার তুবড়ির আলো কত দূর ওঠে! বাজি ছিল বটে! সেসব তোদের বলে কোন লাভ নেই, কিছুই বুঝবি না তোরা। যাই হোক ঠাকুরদা তো কালীপুজোর আগেই চলে গেলেন পঞ্চুঠাকুরদার বাড়ি। পঞ্চুঠাকুরদা মানে ঠাকুরদার ওই বন্ধু, ঈশ্বর পঞ্চানন রায়। ছোটোবেলার বন্ধু, তার কথা কখনও ফেলতে পারেন!
পঞ্চুঠাকুরদার বাড়ি গিয়ে কিন্তু বুঝলেন সেখানে একটা গোলমাল চলছে। বাজি টাজি তৈরি হচ্ছে, এত এত মাটির প্রদীপ এসেছে, কালীপুজোর দিনে ও বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হত, তার প্রস্তুতিও চলছে – কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই যেন কীরকম মনমরা, অপ্রসন্ন। কিছু একটা গোলমাল তো হয়েছে বটেই।"
এই অবধি বলে ফুলদাদু চুপ করে গেলেন আর এক মনে মুড়ি, বেগুনি খেতে লাগলেন। আমরা একটুখানি চুপচাপ বসে রইলাম, তারপরেই উশখুশ শুরু করলাম।
শেষে আর থাকতে না পেরে গুড্ডু বলে উঠল, "ও ফুলদাদু বলো না কী হল তারপর।"
"বড্ড অধৈর্য তোরা, তোদের এই এক বড়ো দোষ। কী হল তোরা ভাব দেখি। বল দেখি কী গোলমাল হতে পারে?" বললেন ফুলদাদু।
"আমরা কী করে বলব কী গোলমাল হতে পারে? তুমিই তো বলো যে আমরা কিছুই জানি না আর তুমি না বললে তো আরোই কিছু জানব না," পুটকি বলল।
"ওই জন্যেই তো বলি, তবু যদি কিছু জানিস। নাহলে মুখ ব্যথা করে এত বকবক করতে আমার বয়েই গেছে।"
ততক্ষণে চা এসে গেছে। ফুলদাদু বেশ জুত করে গরম চায়ে একটা চুমুক দিলেন, বেশ জোরে একবার আহ বললেন, তারপর বললেন, "এসব ব্যাপার কিন্তু ঠাকুরদার চোখ এড়ায়নি। বুড়ি গিন্নীমার বাড়িতে ক'বছর থেকে ঠাকুরদা একেবারে পালটে গেছিলেন। সাধে ওঁর ঠাকুমা বলতেন, 'আহা, বাগবাজারের রায়গিন্নী যেন আমার নলেকে একেবারে নতুন করে গড়ে পাঠালেন। ওনার অক্ষয় স্বর্গবাস হোক।'
দুই বন্ধুতে ছাদে বাজির তদারকি করছিলেন। ঠাকুরদা সুযোগ বুঝে পঞ্চুঠাকুরদাকে চেপে ধরলেন, 'কী হয়েছে বল তো? বাড়িতে তো সবাই দেখছি কীরকম যেন হয়ে আছেন।'
পঞ্চুঠাকুরদা প্রথমে কিছুই বলতে চান না, বলেন, "কই কিছু তো হয়নি! পুজো আসছে, চারদিকে লোকজন, সবদিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে, পরিশ্রমও কম হচ্ছে না, তাই তোর মনে হচ্ছে। কী আবার হবে? কিচ্ছু হয়নি তো।'
'বেশ বলবি না যখন তখন বলিস না। তবে আমিও আর থাকব না এখানে। এই চললাম। বেশ বুঝতে পারছি তুই আর আমাকে বন্ধুই ভাবিস না। নাহলে কী আর কোনো কথা গোপন করতিস? চললাম আমি,' ঠাকুরদা উঠে পড়লেন।
'করিস কী নলে, করিস কী! যাস না ভাই, আমার কথা শোন, ও নলে,' পঞ্চুঠাকুরদা দৌড়লেন বন্ধুর পেছনে।
অনেক বোঝালেন কিন্তু যখন বুঝলেন ঠাকুরদা অনড়, তখন বললেন, 'আচ্ছা বেশ সব বলছি তোকে। কিন্তু এখানে নয়, আগে ঘরে চল। চতুর্দিকে মেলা লোকজন, সব কথা সবার সামনে বলা উচিত নয়। কোথাকার কথা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তার ঠিক আছে!'
এটা একেবারে খাঁটি কথা। ঠাকুরদা ঘরে গেলেন বন্ধুর সঙ্গে। পূবদিকের ছোট্ট ঘরখানা ওঁর জন্যে বরাদ্দ হয়েছে।"
ফুলদাদু থামলেন, দম নেওয়ার জন্যে। চা শেষ করলেন, তারপর বললেন, "পঞ্চুঠাকুরদা কথা রেখেছিলেন। ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করে সব বললেন, 'জানিস নলে আমাদের বাড়িতে একখানা সিন্দুক আছে। ঠাকুরদার আমলের। তাতে এখন আর বিশেষ জিনিসপত্র রাখা হয় না, শুধু ছোটো একখানা বাক্স আছে। তার ভেতর দুটো গিনি রাখা ছিল।' গিনি কাকে বলে জানিস? ওসব অবশ্য তোরা দেখিসনি," ফুলদাদু আমাদের জিজ্ঞেস করলেন।
কিন্তু আমরে কেউ কোনো উত্তর দেওয়ার আগে নিজেই আবার বললেন, "না জানলেও আমার কিছু করার নেই। আমি আর অত ব্যাখ্যা করতে পারব না বাপু। এই বলতেই আমার মুখ ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। নেহাত পূর্বপুরুষের কথা, তাই এত কষ্ট সহ্য করেও বলছি। যা বলছিলাম, পঞ্চুঠাকুরদা বললেন, 'সিন্দুকের ভেতরে বাক্সে দুটো গিনি রাখা ছিল। ও দুটো খরচ করা তো দূর, ওখান থেকে নড়ানোও নিষেধ ছিল। ঠাকুরদার নিষেধ। ও নাকি লক্ষ্মীর জিনিস। কেউ হাত টাতও দিত না। শুধু প্রতি বছর এই লক্ষ্মীপুজোর দিনে একবার সিন্দুক খোলা হয়, পুরুতমশাই মন্ত্র পড়ে ফুল ছিটিয়ে দেন বাক্সটার ওপরে, আবার সিন্দুক বন্ধ হয়ে যায়।
সিন্দুকটা কাঠের, নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তাই ক'দিন আগে সেটা খোলা হয়েছিল। সিন্দুকে তো আর কিছু নেই, শুধু ওই বাক্সটাই, ঠিক হল সেটা ঠাকুরঘরে লক্ষ্মীর আসনের কাছে রাখলেই হবে। তা বাক্স খুলে কী দেখলাম জানিস?'
'কী দেখলি?'
'গিনিদুটো নেই!'
'নেই!'
'না নেই। অথচ ও সিন্দুক তো কেউ খোলেই না। চাবি থাকত ঠাকুমার কাছে, ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবার কাছে। তাছাড়া ও গিনি কে নেবে? ও তো লক্ষ্মীর জিনিস, ও কেউ ধরতেই সাহস পাবে না। সবার ধারণা ঠাকুমাই কোথাও হারিয়েছেন।'
'ঠাকুমা হারিয়েছেন!' ঠাকুরদা তো শুনে অবাক।
'হ্যাঁ, শেষ বয়সে ঠাকুমার মাথাটা তেমন ঠিক ছিল না কীনা। উলটো পালটা কথা বলতেন। ও উনিই করেছেন, মাথা খারাপ হলে যা হয়, কী করছেন আর কী না করছেন কোনো জ্ঞান থাকে নাকি! বাবা, কাকারাও তাই বলছেন, এ ঠাকুমারই কাজ। সিন্দুকের চাবি তো কাছছাড়া করতেন না, কোন ফাঁকে বার করে নিয়েছেন,' বললেন পঞ্চুঠাকুরদা।
শুনে তো ঠাকুরদার খুব মন খারাপ হল। নিজে ঠাকুমার খুব প্রিয় ছিলেন তো, উনিও ঠাকুমাকে খুব ভালোবাসতেন। এদিকে এখানে সবাই পঞ্চুঠাকুরদার ঠাকুমাকে দোষারোপ করছেন। বছর দেড়েক হল মারা গেছেন। ঠাকুরদার খুব ইচ্ছে হল সত্য সন্ধানের। সত্য সন্ধান মানে বুঝিস তো?"
আমরা ঘাড় কাত করেই হ্যাঁ বললাম, কেউ মুখ খুললাম না। কী দরকার বাবা? গল্প মানে ঘটনা বলার সময়ে কথা বললে ফুলদাদু খুব বিরক্ত হন।
"কিন্তু গিনি কোথায় গেল তা জানবেন কী করে? কবে গেছে তাও তো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। তাছাড়া সবার ওই এক কথা, ঠাকুমাই হারিয়েছেন। ঠাকুরদা বুঝলেন এ ওঁর বন্ধুর বাড়ির ব্যপার, এ নিয়ে কথা বলা ভালো দেখায় না। কিন্তু মনটা খুব ভারি হয়ে রইল। একজন বুড়ো মানুষকে এভাবে দোষারোপ করা! উনি যে হারিয়েই ফেলেছেন তারই বা কী প্রমাণ? হারালে কী বলতেন না? কিন্তু সেসব কেউ ভাবছেই না।
সারাদিন বাজি তৈরিতে খুব ধকল গেছিল। সন্ধ্যের মুখে মুখে হাত মুখ ধুয়ে চা, জলখাবার খেয়ে ঠাকুরদা সবে ঘরে ঢুকেছেন দেখেন বিছানার ওপরে এক খুনখুনে বুড়ি বসে। পরণে সাদা থান কাপড়, চুলগুলো একেবারে ধবধবে সাদা, গায়ের চামড়া কুঁচকে হিজিবিজি নকশা হয়ে গেছে।
'আমার গিনি আমি নিলাম তাতে এমন হইচই করার কী আছে তা তো বাপু বুঝছি নে,' ঠাকুরদা ঘরে ঢুকতেই সেই বুড়ি বললেন।
ঠাকুরদার পাদুটো মেঝের সঙ্গে একেবারে আটকে গেল, গলা শুকিয়ে কাঠ।
'ও গিনি তো বিয়ের সময় আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন। পঁচিশখানা ছিল, লাল ভেলভেটের বটুয়ায় পোরা,' বুড়ি আবার বললেন, 'তার তেইশখানা তো দেখতে দেখতে চলে গেল। ননদের বিয়ে, ভাসুরপোর পৈতে, বড়ো ননদের মেয়ের বিয়ে – লৌকিকতা কি কম? দুখানা মাত্র পড়ে রইল। আমার একখানা গিনি বসান আংটির খুব শখ ছিল, কিন্তু সে শখ আর মিটল না। কত্তা বললেন, দুটি মাত্তর আছে, ও সিন্দুকে পুরে রেখে দিই, ওতে হাত দেওয়া চলবে না, মনে করো ও লক্ষ্মীর জিনিস। সেই থেকে বাক্সর মধ্যে পুরে সিন্দুকবন্দী হল। আমার শখ মিটল না, সে নাহয় হল, কিন্তু মানুষের দুঃখ কষ্ট আমি সইতে পারি নে। লজ্জার কথা আর কী বলব, এ বাড়ির লোকেদের আবার ওদিকে নজর কম,কাউকে কিছু দিতে হলে তাদের বুকে বড্ড ব্যথা হয়। একদিন চুপিচুপি মধু স্যাকরাকে ডেকে ও দুটো দিলাম বেচে। মধু ছিল আমার ছেলের মতো, কথা এদিক ওদিক করেনি। তখন দরকারও ছিল। বামুনমেয়ের ছেলেটার খুব অসুখ, পয়সার দরকার। তা ও দুটো বেচে যা হয়েছিল তাতে দুচারজনের হলেও উপকার হয়েছিল। সেও কী কম কথা! লক্ষ্মীর জিনিস বলে ওরকম বন্ধ করে রেখে দিয়ে কী লাভ? তার চেয়ে লোকের কাজে লাগা ঢের ভালো কথা। কিন্তু এসব কেউ বোঝে না। কী করলাম, কেন করলাম – কিছু ভাবল না, খালি নিন্দেমন্দই করে যাচ্ছে! এতই যদি লক্ষ্মীর ওপর ভক্তি, এতই যদি অকল্যাণের ভয়, দুটো গিনি গড়িয়ে রেখে দিচ্ছে না কেন? বলতে নেই, এখন তো অবস্থা অনেক ফিরেছে। কিন্তু তা কেউ করবে না, খালি আমাকেই দুষবে।'
'নলে, এই নলে, ওঠ, এই ভর সন্ধ্যেয় ঘুমিয়ে পড়লি কী করে?' পঞ্চুঠাকুরদার ঠেলাঠেলিতে ঠাকুরদার ঘুম ভেঙে গেল।
বুঝলেন স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু স্বপ্ন হলে হবে কী? প্রতিটা কথা এক্কেবারে স্পষ্ট মনে আছে। পঞ্চুঠাকুরদার বাড়ি এ বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিল না, ঠাকুরদা মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসতেন যেতেন, সেদিনও সন্ধ্যেবেলা চলে এলেন। অবশ্য বাড়ি আসার আগে মধু স্যাকরার কাছেও গেলেন।
মধু স্যাকরা তো সব শুনে অবাক, বলে 'এ কথা তুমি জানলে কী করে? আমি আর মাজননী ছাড়া তো কেউ জানত না। তবে যা বলেছ তা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। ওরকম গিনি এখনও পাওয়া যায়, তবে ওজনে একটু হালকা।'
মধু দোকানের নামও বলে দিল, কলকাতার বড়ো দোকান।
পরের দিন ঠাকুরদা আর বন্ধুর বাড়ি গেলেন না, সোজা কলকাতায় চলে গেলেন। পঞ্চুঠাকুরদার বাড়ি গেলেন তার পরের দিন, কালীপুজোর সকালে। সে বাড়িতে তখন হই হই রই রই ব্যাপার। লক্ষ্মীপুজো হবে, এবার বেশ ঘটা করেই। সারা বাড়ি পরিষ্কার করা হয়েছে। ঠাকুরদা দেখলেন সিন্দুকটাকে বার করে রাখা হয়েছে, ফেলে দেওয়া হবে, কাঠে ঘুণ ধরে গেছে।
ঠাকুরদা সিন্দুকের কাছে গিয়ে বললেন, 'ফেলে দেওয়ার আগে একবার ভালো করে দেখে নিলে হয় না? বলা যায় না ও দুটো থাকতেও তো পারে।'
পঞ্চুঠাকুরদা শুনে প্রথমে খুব এক চোট হাসলেন, তারপর বললেন, 'দূর ও আর নেই। তুই যদি তাও দেখতে চাস দেখ নাহয়। দাঁড়া আমিও আসছি।'
ততক্ষণে ঠাকুরদার গিনিদুটো সিন্দুকের এক কোণে রাখা হয়ে গেছে। ধুলোবালি মাখিয়ে একটু ময়লা করে দিয়েছিলেন, নতুনের জেল্লাটা যাতে না বোঝা যায়।
পঞ্চুঠাকুরদা বললেন, 'তুই ওদিকটা ধর, আমি এদিকটা ধরছি, কাত করি, কিছু থাকলে পড়ে যাবে।'
যেই না কাত করা, অমনি ঘটঘট আওয়াজ, কিছু নড়ছে। উত্তেজনায় পঞ্চুঠাকুরদা সিন্দুক সোজা করে ভেতরে হাতড়াতে লাগলেন। পেয়েও গেলেন গিনিদুটো।
'দেখলি দেখ, ঠিকই ছিল গিনিদুটো। বাক্স থেকে কিছু করে খুলে বেরিয়ে গেছিল। তোরা ভালো করে না দেখেই ঠাকুমার নামে বলতে শুরু করে দিলি!" ঠাকুরদা বললেন।
ও বাড়িতেও সবাই ঠাকুরদাকে নিয়ে ধন্যি ধন্যি করতে লাগল। ভাগ্যিস ভালো করে সিন্দুকটা দেখার কথা মাথায় এসেছিল, সবাই তো বাক্সটাই দেখেছে, সে বাক্সরও যা অবস্থা হয়েছিল! ঠাকুরদার নাকি একটু ভয় ছিল, যদি কেউ ধরতে পেরে যায়। তবে নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে পরের জন্যে কেউ এরকম করবে, বিশেষ করে ঠাকুমার নামে নিন্দে মন্দ করছে বলে – এ কথা বোধহয় কেউ ভাবতেও পারেনি। আসলে ঠাকুমার নামে অত কথা, অত নিন্দে, তা সে যার ঠাকুমাই হন না কেন, ঠাকুরদা মোটে সইতে পারেননি, তাই এই কাজ। নিজের পয়সা গেল তো কী হল, মনে নাকি বড়ো শান্তি পেয়েছিলেন।
এসব কথা আমি শুনেছিলাম আমার ঠাকুমার কাছে। তবে ঠাকুরদা সেটা মোটেই পছন্দ করেননি।"
"কেন কেন আমাদের অতি বৃদ্ধ পিতামহ সেটা পছন্দ করেননি কেন?" আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
"কারুর জন্যে কিছু করে বলে বেড়ানো ঠাকুরদা পছন্দ করতেন না। এ যুগের মানুষ ছিলেন নাকি যে একটা রেস্তোরাঁতে খেয়েও ওই ইন্টারনেটে কীসব সাইট টাইটে তার ছবি বার করতে হবে? এখনকার কেউ এ কাজ করলে তো বোধহয় মাইক নিয়ে সারা শহরে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বেড়াত। ঠাকুরদা অন্যরকম মানুষ ছিলেন। সাধে কী আর ওঁর ঠাকুমা বলতেন, 'নলের আমার............'"
ফুলদাদুর কথা শেষ হতে না হতেই আমরা একসঙ্গে বলে উঠলাম, "অতি উচ্চ বিচার!"
"খুব যে বলছিস, যেন ওঁকে এ কথা বলতে কতবার শুনেছিস। বল দেখি উনি কত বছর বেঁচেছিলেন?" ফুলদাদু জিজ্ঞেস করলেন।
কত বছর বেঁচেছিলেন! প্রশ্ন শুনে আমরা তো হাঁ! এ ওর মুখের দিকে তাকালাম।
"আমার ঠাকুরদার ঠাকুমা কত বছর বেঁচেছিলেন সেটা অবধি জানিস না! কী যে ছেলেমেয়ে তোরা, কী যে হবে তোদের!" চোখমুখ কুঁচকে বললেন ফুলদাদু।
ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী