আবার একটা রবিবারের আসর। প্রতিমাসের শেষ রবিবার আমরা ভাই-বোনেরা জড়ো হই মেজদার ঘরে। মেজদা আমাদের নিজের অভিজ্ঞতার গল্প বলে। বহুকষ্ট করার পর মেজদা এই গল্পগুলো বলতে রাজী হয়েছে। আমাদের বহুবার হাঁকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা একটুও দমিনি। নতুন উদ্যম নিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
বিট্টু মাথা খেয়ে ফেলছে তখন থেকে একটা ভূতের গল্প শোনার জন্য। মেজদা মাথার চুল টেনে টেনে ভাবছে কী বলা যায়। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মেজদা কি ভূতের গল্প বলতে পারবে?
বড়দা বলে উঠল, না না ভূতের গল্প একদম নয়। রাতবিরেতে আমি একা বাইক নিয়ে ফিরি।
-তাতে কী হয়েছে? ভূতে কি লিফট চাইবে? চাইলে না হয় দিও। পেছনে বসিয়ে হুশ করে চলে আসবে।
-সব সময় ইয়ার্কি আমার ভাল লাগে না। যথেষ্ট বয়স হয়েছে তোর। বড়দা রেগে গিয়ে প্রতিবাদ করে।
-বেশ তোমার ভয় লাগলে বাইরে চলে যাও। জেঠুরা বসে গল্প করছে ওদের সাথে যোগ দাও। মেজদি বলল।
-ওদের গল্প ভীষণ বোরিং। পার্টি-পলিটিক্স, এখনকার প্রজন্ম কতটা খারাপ, খুন-খারাপি, সরকার কিরকম ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে এইসব গল্প আমার ভাল্লাগে না।
-আচ্ছা আমি যে ভূতের গল্পটা বলব সেটা ততটা ভয়ের নয়। কিন্তু একটু চা খেতে হবে - মেজদা বলল।
-আবার সেই চা! উফফ। তুমি নিজে করে খাও- মেজদি রেগে গেল।
-গল্পও বলব আবার চা'ও নিজে করব এটা কোথাকার বিচার- মেজদার সোজা জবাব।
গল্পের দফারফা হয়ে গেল। দূর আমি খেলতে যাই গিয়ে। আমি উঠে পড়লাম। এমনিতেই মনটা আমার খারাপ হয়ে আছে। এক প্যাকেট জেমস নষ্ট হয়েছে। দোষটা আমারই। প্যাকেটটা ছিঁড়তে গিয়ে এমন জোরে টেনেছি যে সব জেমসগুলো ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে গেল। অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে টিয়ে মোটে চারটে উদ্ধার করতে পেরেছি। বাকিগুলো সব খাটের তলায় দুর্গম স্থানে। এখন এই সব ঝগড়া ভাল লাগে না।
-হ্যাঁ তুমি থাকলেই তো ঝামেলা করবে। তার চেয়ে তুমি খেলতেই যাও- মেজদা বলল।
-আহা থাকুক না। এত ভূতের গল্প শুনতে ভালবাসে- মেজদি বলল।
-তবে থাকুক। আমি গল্প শুরু করছি। কেউ কথা বললে বা কারোর ফোন বাজলে তাকে বাইরে বার করে দেব কথাটা মনে থাকে যেন।
ইস যেন অঙ্ক ক্লাসে এসেছি। যা বলছ তাই হবে।
আমি তখন বেঙ্গালুরু তে থাকি।
বড়দা হেসে ফেলল হি হি করে। হাসতে হাসতে সোফায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
-কী হল? তুমি হাসছ কেন? বেঙ্গালুরুতে কি মানুষ থাকতে পারে না? ভুরু দুটো সাংঘাতিক কুঁচকে গেছে মেজদার।
বড়দা হেসেই চলেছে। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, ব্যাঙ্গালোর বললেই পারিস।
-লোর বলব না লুরু বলব সেটা আমার ব্যাপার!
-লুরু শুনলে লেরো বিস্কুটের কথা মনে পরে তাই হেসে ফেলেছি। বড়দার অকপট স্বীকারোক্তি।
বিন্দুদি বলল, আমার আবার লুল্লু ভূতের কথা মনে পড়ছে।
এবার আমরাও হেসে ফেলি। হাসি আর কান্না মারাত্মক ছোঁয়াচে জিনিস। মেজদাও হেসে ফেলল। বলল, লেরো বিস্কুট শুনে আবার আমার চায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
ঘুরে ফিরে আবার সেই চা!
আমি গিয়ে মাসিকে চায়ের কথা বলে আসলাম। মুখে যতই গালমন্দ করুক মাসি মানে টুনির মা চা ঠিক করে আনবে। তবে সামনের বার থেকে একটা ফ্লাস্কে চা রেখে দেব।
বিট্টু বলল, হ্যাঁ তারপর কী হল।
-কতদূর বলেছি রে!
-ব্যাঙ্গালোর থাকতে তখন।
-হ্যাঁ। আমি তখন ব্যাঙ্গালোরে থাকি। পড়াশোনা শেষ করে নতুন জব পেয়েছি একটা প্রাইভেট ফার্মে। স্কুলের অনেক বন্ধু গেছিল একই সঙ্গে পড়াশোনা শেষ করে। কেউ কেউ হোস্টেলে থেকে গেল। বরাবরই ইচ্ছা ছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে দূরে থাকব। অনেকে আবার বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেস করে থাকতে লাগল। আমার কোনটাই পছন্দ হল না। চিরকাল একা একা থেকে এসেছি। এখন অতজনের সঙ্গে থাকতে হবে ভেবে বেশ মন খারাপ লাগছিল। মাঝে মাঝে গল্প কবিতা লিখি এত ভিড়ের মধ্যে থাকলে সেটাও আর হত না। ভাবছিলাম কী করব। মেসে কিছুদিন ছিলাম কিন্তু এত হই হট্টগোলে খুব অসুবিধা হতে লাগল। আমি বাড়ি খুঁজতে লাগলাম। কপাল ভাল যে তাড়াতাড়ি আমি একটা বাড়ি পেয়ে গেলাম, শহর থেকে বেশ দূরে। নির্জন জায়গায়। ঠিক যেমনটা আমি চাইছিলাম। আমি জবের সাথে সাথে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে লাগলাম। বিদেশে পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছে ছিল। বিভিন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। আমার বন্ধুরা অনেক বারণ করেছিল এইভাবে একা একা ফাঁকা বাড়িতে থাকার ব্যাপারে।
-হ্যাঁ কারোর বারণ শুনবে তুমি! বড়দার হঠাৎ এই মন্তব্যে মেজদা থেমে গেল। আসন্ন কালবৈশাখীর পূর্বাভাস মেজদার চোখে মুখে। বলল, সবার বড়ই যদি এই রকম হয় তাহলে সবার ছোটোটিকে আর দোষ দিয়ে কী লাভ?
বড়দা আবার হেসেই চলেছে। হাসতে হাসতে আবার সোফায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাসি ভীষণ ভাবে সংক্রামিত হয় আমাদের মধ্যে।
মেজদি টিফিন ক্যারিয়ার খুলে কেক বার করে আমাদের খেতে দিল। বলল, সব আমি বানিয়েছি।
কেক খেয়ে মেজদার মনটা এবার একটু ভাল হল। সত্যি কেকটা বড্ড ভাল বানায় মেজদি। আবার বলতে শুরু করল, আমাকে সবাই বারণ করল ঐ বাড়িতে থেকো না। ওখানে ভূত আছে। আমি ভাবলাম ভাড়াটা বেশ সস্তায় পাচ্ছি তাই লোকে হিংসে করে এরকম বলছে। আর কিছুদিন পর আরেক জন কাও কে সঙ্গে নেবো। একদম একা থাকার চেয়ে সঙ্গে একজন কাও কে রাখা ভাল।
-আর সে তোকে ঘন ঘন চা করে খাওয়াবে। বড়দা আজকের আসর মাটি করবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে বোঝা যাচ্ছে। ঘন ঘন বিরক্তিকর কমেন্ট করেই চলেছে।
মেজদি বলল, তুমি চুপ করো তো। তারপর বলো মেজদা।
-সামনের বার থেকে আসরে শুধু ছোটোরা থাকবে। এখন থেকে বলে দিলাম। তারপর কি যেন হল! ধুর ভুলেই গেছি!
-তুমি শহর থেকে দূরে একটা ফাঁকা বাড়িতে থাকতে এলে।
-হুম। আমি একা একাই থাকতে শুরু করলাম। একজন কেয়ারটেকার গোছের লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন মিস রেড্ডি। মানে যার বাড়ি আমি ভাড়া নিয়েছিলাম। মিস রেড্ডি একা মানুষ বিয়ে করেননি। দোতলায় থাকতেন আমি নিচটা পুরো।
-মিস রেড্ডিই তাহলে ভূত ছিল। টুকাইদি বলল।
-না না খুব ভাল মানুষ। নিরীহ বয়স্ক ভদ্রমহিলা। ওনার একজন রাতদিনের কাজের লোক ছিল। তবে এঁরা নীচে বেশি নামতেন না। আমি মাসে একবার ওপরে গিয়ে মিস রেড্ডির হাতে ভাড়ার টাকাটা দিয়ে আসতাম। মাঝে মাঝে ভাল মন্দ কিছু রান্না করলে উনি আমাকে পাঠিয়ে দিতেন। আমার আবার ওনার রান্না তেমন ভাল লাগত না। খালি টক খায়।
-হ্যাঁ তোমার তো সোনায় বাঁধানো মুখ! যা তা জিনিস তোমার মুখে রুচবে কেন! বড়দা মন্তব্য করে।
-উফফ বড়দা! তুমি বাইরে গিয়ে বস প্লিজ। টুকাইদি বলল।
-টিভিতে খেলা হচ্ছে গিয়ে দেখো না! ইন্দুদি বলল।
-অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা হচ্ছে ওটাও দেখতে পারো। আমি বললাম।
-নাহ। আমিও গল্প শুনব।
মেজদা বলল, দাদা কে আর কোনওদিন গল্পের আসরে ঢোকাবো না। যাই হোক, আমার কখনও মনে হয়নি যে বাড়িটায় ভূত আছে। কলেজ থেকে ফিরে যখন বন্ধ দরজাটা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকতাম তখন একটু একটু গা ছম ছম যে করত না তা নয়। বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খেতে বড় ভাল লাগতো। কিন্তু একদিন রাত্তিরে আমার একটা আনক্যানি ফিলিংস হয়। রাতে বসে বসে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। তাও বেশি রাত নয়। সাড়ে আটটা হবে প্রায়। ল্যাপটপ অন করে লিখছি। হঠাৎ মনে হল আমার পেছনে কেউ রয়েছে। সে ঝুঁকে পড়ে আমি কী লিখছি সেটা পড়ার চেষ্টা করছে। পেছন ফিরতেই আলো নিভে গেল। পাওয়ার কাট। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সাদা একটা জমাট বাঁধা কুয়াশা ঘরের মধ্যে চলা ফেরা করছে। আমার পড়ার টেবিলের একটা ড্রয়ারে মোমবাতি আর দেশলাই ছিল। জ্বালাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু জ্বলল না। কেমন শীত শীত করে উঠল।
আলো জ্বাললে আমার খুব ভয় করে। একটা নরম নরম ভিতু ভিতু গলা শুনে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। বলে কি আলো জ্বাললে নাকি ভয় করে! আমি তো জানি অন্ধকারে মানুষের ভয় করে!
-কিন্তু আমাদের সবই উল্টো দাদা।
-আমার কানের কাছে কেউ কথা বলছে কিন্তু জমাট সেই কুয়াশা ছাড়া আমি কিছুই দেখতে পারছি না। বললাম, আপনি কে?
-জানি না। এখানে একা একা থাকি।
-গলার আওয়াজ শুনে মনে হল ভূতের বেশি বয়স নয়। আপনার নাম কী? আমি ভূতটাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
-জানি না।
-নিজের নামও জানো না? স্ট্রেঞ্জ! আমি তুমি বলে ফেললাম।
-নামে কী যায় আসে তোমার ইচ্ছামত একটা নাম ধরে ডেকো।
-তোমাকে ডাকতে আমার ভারি বয়েই গেছে। এখানে কী করতে এসেছে? লোককে ভয় দেখাতে লজ্জা করে না।
-আমাকে বকছ কেন? ভ্যাঁআআআ! এই দাদাটা খুব বাজে! আমি কোথায় ভয় দেখালাম! ভ্যাঁআআআ! আমার বাড়িতে এসে আমাকেই বকছে!
-এটা তোমার বাড়ি? কথায় কথায় কাঁদাটা ভাল নয়।
-হ্যাঁআআআ! আমি এখানে থাকি তাই এটা আমার বাড়ি! আমি এখানে অনেকদিন আছি। তুমি ভারি বদমাশ লোক।
-কিন্তু কী ভাবে এটা তোমার বাড়ি হল? এখানে তো কোন বাঙালী লোক থাকে না। মিস রেড্ডির বাড়ি এটা।
-আমি এখানে বহুদিন আছি তখন মিস রেড্ডি ফ্রক পরে ইস্কুলে যেতেন। মিস রেড্ডি রোজ বায়না করতেন আমি ইস্কুলে যাবো না! কিছুতেই যাবো না! ওনার মা কান ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে ইস্কুল নিয়ে যেতেন।
বকবক শুনতে শুনতে বিরক্ত লাগছিল। আমি এবার একটা মোমবাতি ধরালাম। সেই সাদা কুয়াশা বলল, আবার আলো জ্বাললে কেন? বেশ তো অন্ধকারে গল্প করছিলাম। ওমা ! একটা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে বাতিটা নিভিয়ে দিল। আমার ঠাণ্ডা লাগছিল। বললাম, বাতিটা নেভালে কেন?
-আমার আলো সহ্য হয় না।
-ইলেকট্রিক কি তুমিই বন্ধ করেছ?
-হ্যাঁ। তুমি এখানে আসলে কেন? পুরো শহরে এত জায়গা থাকতে তোমার আমার বাড়িই মিলল আমাকে জ্বালাতন করার জন্য। আমার একাকীত্ব নষ্ট করতে এসেছ। কালকেই বাড়ি ছেড়ে দেবে। বেশ ধমকে বলল সে।
-মরার পরও আমার বাড়ি আমার বাড়ি করতে লজ্জা করে না? যাও না বাবা নিজের লোকে যাও না! এখানে কি! কী করে এটা তোমার বাড়ি হয়? আমিও রেগে গিয়ে বললাম।
-নাহ। আমি এখানেই থাকব। বেরোতে হলে তুমি বেরুবে।
আমার খুব অসহায় লাগছিল। ভাগ্যিস কারেন্ট চলে এসেছিল। আমি ভাবলাম ভূতেশ্বরের গল্প বোধ হয় শেষ হল কিন্তু এই তো সবে শুরু হল। হ্যাঁ আমিই তার নাম ভূতেশ্বর রেখেছিলাম।
পরের দিন থেকে শুরু হল যন্ত্রণার দিন। কষ্টের দিন। ভূতটা খুব অত্যাচারী ভূত। আমাকে বাড়ি ছাড়া করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। যখন তখন কারেন্ট চলে যেত। মোমবাতি জ্বাললে দমকা বাতাস এসে নিভিয়ে দিত। আমার জিনিসপত্র হারিয়ে যেত। আমার বই খাতা লুকিয়ে রাখত। প্রজেক্ট গুলো ব্যাকস্পেস দিয়ে মুছে দিত। সব উল্টোপালটা করে দিত। অফিসে বসের কাছে আমি বকা খেতাম। ঘুমনোর সময় নাকে সুড়সুড়ি দিত। মাথার চুল ধরে টানত। আমার লেখা কবিতা গুলো পর্যন্ত মুছে দিয়ে নিজের ইচ্ছা মত লিখত। মানে আমার লেখা কবিতাগুলো নষ্ট করে দিত। দেওয়ালে ছবি এঁকে রাখত। শেষে তাকে ছবি আঁকার জন্য ড্রয়িং খাতা আর রঙ পেন্সিল কিনে দিলাম। আর অনেক করে অনুরোধ করলাম সোনা ভাইটি আমার দেওয়ালে ছবি এঁকো না। মিস রেড্ডি রেগে যাবেন। তখন সে দেওয়াল পেইন্টিং বন্ধ করল। সাপ ব্যাং যা এঁকেছিল সব মুছেও দিল। আমার খাবার খেয়ে নিত। মাঝে মাঝে পেছনে ধাক্কা মারত। কিন্তু আমি তার কিছুই করতে পারতাম না। মনে মনে পণ করলাম আমিও বাড়ি ছাড়ব না। মিস রেড্ডিকে অ্যাডভান্স করা ছিল এখন বাড়ি ছেড়ে দিলে আমার ক্ষতি হবে। একদিন মিস রেড্ডিকে সব খুলে বললাম কিন্তু উনি ভূতের কথা বিশ্বাস করলেন না। উল্টে পাঁচ মিনিট ধরে হাসলেন। বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে হাসলেন। আমার ভয় লাগছিল এই হাসির চোটে ওনার না একটা ভাল-মন্দ কিছু ঘটে যায়।
আমার কিছু বন্ধু ছিল তাদের বললাম। তারা বলল , আমরা তো তোকে আগেই বলেছিলাম ওই বাড়িতে ভূত আছে। কিন্তু তুই বিশ্বাস করিসনি আর ওই বুড়িও খুব ঘু ঘু। এখন ঠ্যালা সামলা।
-প্লিজ কিছু একটা উপায় বল। আমি কী করব! ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাসই করিনি।
-সব চেয়ে পুরানো পদ্ধতি হল রামনাম করা। আমার বন্ধু জ্ঞান বলল। ও খুবই জ্ঞানী। আর কিছু বলতে হবে না। আমি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ি চলে এলাম। ইস এত সহজ সমাধান আমার মাথায় আসেনি! রামের একটা ছবি কিনলাম। রাম সীতা লক্ষ্মণ আর পায়ের কাছে হনুমানজী। ছবিটা রাখলাম আমার পড়ার টেবিলে। মোমবাতি ধুপ বাতাসা ফুল সব কিনে এনেছিলাম। বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে কাচা জামা পরলাম। জয় শ্রীরাম বলতে বলতে পুজো করলাম। তারপর ধুপ আর বাতি ধরিয়ে গান শুরু করলাম রঘুপতি রাঘব রাজা রাম পতিত পাবন সীতারাম।
আমার সমস্ত আশায় একঘটি জল পরল যখন দেখলাম একটা ছায়া শরীর হাতজোড় করে রামের ছবির সামনে বসে আছে।
-কী আশ্চর্য ! রাম নামে তুমি পালালে না!
-আমার মাও বাড়িতে পুজো করত। তোমার চেয়ে ভাল গানের গলা ছিল মায়ের। আমি অনেকগুলো ভজন জানি শুনবে? এই বলে সে শুরু করে দিল। একটা হারমোনিয়াম আর খঞ্জনি পেলে ভাল হতো। ওমা বলতে বলতেই ওপর থেকে খঞ্জনি এসে টুপ করে আমার কোলে পড়ল।
জয় গনেশ জয় গনেশ জয় গনেশ দেবা। তারপর হনুমান চাল্লিশা পড়ল। সরস্বতী বন্দনা স্তব করল।
গানটা সে ভালই গাইতে পারে। বসে বসে হাততালি মানে খঞ্জনি বাজানো ছাড়া কোন উপায় ছিল না। একসময় বলল, আচ্ছা হারমোনিয়াম আনব কি?
আমি বললাম, আমি বাজাতে জানি না।
-আমি জানিইইইই।
একটা হারমোনিয়াম চলে এল চোখের পলকে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে আবার ভজন ধরল ভূতেশ্বর। এবার রঙ দে চুনারিয়া। তারপর ঠুমক চলিত রামচন্দ্র। খানিকবাদে সে বলল, আচ্ছা তবলা আনলে ভাল হবে না? নাকি খোল আনব?
আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।
পরের দিন সকালে মিস রেড্ডি আমাকে ডেকে পাঠালেন।
তুমি এত ভাল ভজন শিখলে কোথা থেকে বাবা?
আমি বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যে বললাম। মিসেস রেড্ডি পুরস্কার স্বরূপ আমাকে ওনার হাতের সেই বিচ্ছিরি সম্বর ডাল আর ইডলি খাওয়ালেন। উনি বোধ হয় ওই একটাই রান্না জানেন। সরি দুটো রান্নাই শিখেছেন। ধোসা আর ইডলি।
মেজদা চুপ করে গেল। ইন্দুদি বলল, ব্যাস গল্প শেষ? তারপর কী হল?
তাতাইদা বলল, এরকম ভূত হতেই পারে না যে রাম নামে ভয় পায় না। সব তোমার কল্পনা।
মেজদা কুটিল চোখে তাতাইদার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বুঝতে পারছি ভাই হিসেবে সে খুবই মিষ্টি ছিল। গেছো হনুমানদের চেয়ে বেটার অপশান।
মেজদি বলল, আহ। তারপর কী হল!
তারপরের দিন থেকে অবস্থার অনেকখানি পরিবর্তন হল। সে আর রোজ আমাকে বিরক্ত করত না। মাঝে মাঝে করত। আমার পড়তে বসার সময় গল্পের ঝুলি খুলে বসতো। ওইটুকু সহ্য করতেই হতো। এমনিতেও সে বেশি বড় ছিল না। অনেক ছোটই ছিল আমার থেকে। আমারই ওর জন্য কষ্ট হত। সন্ধে হলেই আরতি গাইত।
টুকাইদি বলল, ভূতটা তাহলে খুব ভাল ছিল।
একদিন মিস রেড্ডি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তো ভয়েই মরি আবার বোধ হয় ইডলি ধোসা। কিন্তু সেদিন মিস রেড্ডি আমার হাত ধরে বললেন, তুমি ঠিক ধরেছিলে। একতলায় ভূতের উৎপাত ছিল। আমার বাবা কিনেছিলেন যখন তখন থেকেই হন্টেড। কিন্তু কাওকে বলতে পারতাম না। পেয়িং গেস্ট যারা থাকতে এসেছিল কেউ থাকতে পারেনি। কিন্তু তুমি অনেকদিন টিকে গেলে। এর কারণ তুমি প্রতিদিন শুদ্ধমনে ইশ্বরকে ডাকো। তাঁকে গান শুনিয়ে মুগ্ধ করো। তুমি খুব ভাল ছেলে। আজকালকার দিনে এমন ভক্তিমান ছেলে দেখা যায় না।
আমি মিস রেড্ডির পায়ের ধুলো নিলাম। মুখে কিছু বললাম না।
আমার খাতির খুব বেড়ে গেল। ধোসা ইডলি কে এখন ভয় পাই। ভূতকে নয়। রাস্তায় বেরুলে অনেকেই অবাক হয়ে আমাকে দেখে।
ইন্দুদি বলল, এইভাবে তুমি খুব পপুলার হয়ে গেলে?
বড়দা , লোকে তোর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য লাইন দিত নিশ্চয়ই।
মেজদা আপন মনে বলে চলে, বহুদিন ধরে ও ওই বাড়িতে ছিল। ওর বাবা মার সাথে ও থাকত। তারপর ও কী করে ভূত হয় বা মারা যায় সেটা বলতে পারেনি। ওর মৃত্যুর পর ওর বাবা মা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে যান শহর ছেড়ে। মিসেস রেড্ডির বাবা বাড়ি কেনেন।
তাহলে গল্প কি শেষ হল? বাপ্পাদাদা জিজ্ঞাসা করে।
না। একদিন সে আমাকে তার ড্রয়িংখাতা খানা দেখাল। দারুণ দারুণ ছবি সব। গুপি বাঘা ফেলুদা, তোপসে, লালমোহন বাবু, শঙ্কু, ব্যোমকেশ, কলাবতী, পাণ্ডব গোয়েন্দা, কাকাবাবু, অর্জুন। খাতা ভর্তি করে এঁকেছে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তুমি এদের চিনলে কী করে?
-আমি পড়েছি। তোমার গল্পের বইয়ের তাক থেকে নামিয়ে সব পড়ে ফেলেছি।
আমি সাবাশ বলে তার পিঠ চাপরে দিতে গেলাম, কিন্তু পারলাম না । ওর শরীর ছুঁতে পারলাম না।
-তারপর তারপর?
-ভূতটা এত বই পড়তে ভালবাসে? আবার গানও করে ! ছবিও আঁকে!
সবাই বলাবলি শুরু করে দিল।
মেজদি বলল, তারপর কী হল বল না!
-তারপর ভূতেশ্বর আমার গল্পের বইগুলো নিয়ে ভূতেদের দেশে চলে গেল। আর আমাকে দিয়ে গেল সেই ড্রয়িং খাতা।
-সে কি! সব বইগুলো ওকে দিয়ে দিলে! আমরা চেঁচিয়ে উঠি।
বড়দা বলল, ড্রয়িং খাতাটা দেখা তো যদি এখনও থেকে থাকে! হ্যাঁরে ওখানে গিয়ে কি হ্যাসিস ধরেছিলি?
-আরে আমার আর গল্পের বই পড়ার সময় হত না। ও পড়ে আনন্দ পেয়েছিল নিজের একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিল তাই ওকে দিয়ে দিয়েছি। রামের ছবিটাও নিয়ে গেছে। বলতে বলতে মেজদা উঠে গেল।
বড়দা বলল রামের ছবিও ভূতেশ্বর নিয়ে চলে গেল! এই রকম জীবনে প্রথম শুনছি।
পাপাইদাদা বলল, মেজদার টপসিড খাওয়া উচিৎ বা প্যান ফর্টি।
মেজদি মেজদার পক্ষে সবসময়। বলল, এতক্ষণ তো হাঁ করে সবাই শুনছিলে!
খানিক বাদে মেজদা ফিরে এল হাতে একটা পুরানো মোটা ড্রয়িং খাতা। আমাদের দিকে খাতাটা এগিয়ে দিল।
সত্যি খাতা খুলতেই মন ভাল হয়ে গেল। প্রথম পাতাতেই গুপি বাঘা তারপর ফেলুদা। সবাই আছেন। কিন্তু আর্টিস্টের কোন সই নেই।
ইন্দুদি আমার কানে কানে বলল, মেজদার ছোটবেলার ড্রয়িং খাতা এটা।
অ্যাই ইন্দু! কী গুজগুজ করছিস মিষ্টুর সাথে! টক টু মি।
বিট্টু বলল, ইন্দুদি বলতে চাইছে, খাতার আঁকা গুলো যে ভূতেশ্বরের তার তো কোন প্রমাণ নেই। বিট্টু ইন্দুদির কথাটা শুনতে পেয়েছিল।
-প্রমাণ করতে আমার ভারি বয়ে গেছে। আমার কাজ ছিল গল্প বলা। বিশ্বাস করা না করা তোমাদের ব্যাপার। প্রকাণ্ড এক হাই তুলতে তুলতে মেজদা বলল।
ড্রয়িংখাতাটা টেনে উলটোতে শুরু করলাম। শেষপাতায় ছোট্ট করে জ্বলজ্বল করছে কেসি। অর্থাৎ কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। আমাদের সবার প্রিয় মেজদা। ইন্দুদির অনুমানই ঠিক কিন্তু কথাটা বলে খামোখা সমস্যা বাড়িয়ে লাভ কি!
ছবিঃ অঙ্কুশ চক্রবর্তী