বাম পকেটে হাত কী তাজ্জব বাত!
বনরূপার মাঝ বরাবর যে রাস্তাটা 'লা মেরিডিয়ান' এর সামনে গিয়ে যুক্ত হয়েছে সে রাস্তায় হাঁটছি আমি। বরাবরের মতো গিট্টুও আমার সাথে। গন্তব্য কাকলীদের ডেয়ারী ফার্ম। অর্ধেক রাস্তা ক্রস করেছি এমন সময় বুঝলাম ব্যাপারটা। কে যেন মোবাইলটা বের করে নিতে চাইছে পকেট থেকে। গিট্ট তো নয়। তাহলে? গিট্টু ভালো একটা বাচ্চা ভূত। মোবাইল পছন্দ করে কিন্তু আমাকে না বলে পকেট থেকে নিতে চাইবে না। তা ছাড়া ও আমার ডান পাশে দশ বারো বছরের বাচ্চা সেজে হাঁটছে। মোবাইল আমার বাম পকেটে। ধরতে চাইলাম। ফুড়–ৎ করে হাতটা বের হয়ে গেলো। ভৌতিক কান্ড! আমি থামলাম।
: থামলেন যে মামা? গিট্টুর প্রশ্ন।
: বুঝতে পারছি না। কে যেন বাম পকেটে হাত ঢুকালো!
শূণ্য রাস্তা সন্ধ্যের বেশী বাকী নেই। গিট্টু সাথে। অন্য কোন ভূত থাকলে গিট্টু দেখতো। হলোটা কী? গিট্টুর মুখের দিকে তাকাই। ওকে একটু বিব্রত মনে হয়!
: মনের ভূল মনে হয় মামা। বাসে তো প্রচুর পকেটমার। হয়তো আপনার মনে হচ্ছে বাসে যাচ্ছেন আর কেউ আপনার পকেটে এই মাত্র হাত ঢুকিয়ে দিলো।
: না রে, ও রকম কিছু না। আচ্ছা চল হাঁটি।
আমি হাঁটতে থাকি। ভেতরটা খচখচ করছে। বাড়তি কেউ একজন আমাদের সাথে আছে। গিট্টু কি জানে? গিট্টুকে বিব্রত দেখালো কেন। গিট্টু একটু পিছিয়ে পড়েছে। আমি হাঁটা না থামিয়ে একটু ঘাড় বাঁকা করে তাকাই। অদৃশ্য কাউকে চোখ পাকাচ্ছে গিট্টু। মানে আর কেউ আমাদের সাথে আছে। গিট্টুও সেটা জানে। কাকলীদের গেটের সামনে পৌঁছে গেছি আমরা। আমি পেছন ফিরি।
: ঘটনাটা বলে ফেল গিট্টু।
: কী মামা?
: কেন গোপন করছিস বল তো?
গিট্টু মাটির দিকে তাকায়। কী যেন চিন্তা করে। তারপর অনেক দ্বিধা নিয়ে কথা বলা শুরু করে।
: মামা ওর নাম মিট্টু। আমার পিসতুতো ভাই। বাড়িতে ওর অনেক বিপদ তাই পিসি ওকে আমার কাছে দিয়ে গেছেন।
: ভালো। তা তুই আমাকে বললি না কেন? ঠিক আছে। ওরে মানুষ হতে বল। দুজনে দাঁড়া। আমি দুধ নিয়ে আসি। তারপর যেতে যেতে ওর কথা শুনবো।
আমি কাকলীদের গেটে নক করি।
ও হলো গিট্টু, পিসতুতো ভাই মিট্টু
দুধ নিয়ে বের হতেই গিট্টু আমার সামনে এসে দাঁড়ায় ঠিক ওর পিছনে আর একটা পিচ্চি। গিট্টুর চাইতে একটু ছোট। মুখে ভয়ের ছাপ।
: এবার কাহিনিটা বল গিট্টু। আমি কিন্তু খুব রেগে আছি। কেউ আমার পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল টানবে আর তুই সাথে থেকেও বলবি জানি না মামা, এটা আমি সহ্য করতে পারছি না।
: কথা ঠিক মামা। দুঃখ দুঃখ ভাব গলায় এনে গিট্টু তার বয়ান শুরু করে। হল কী মামা, ওর নাম মিট্টু। আমার নামের সাথে মিল রেখেই পিসি ওর নামটা রেখেছিলেন। এতদিন তো ভূত সমাজে মিট্টু ভালোই ছিলো। আট বছর বয়স হলেই ভূত সমাজে বাচ্চাভূতদের কাজ শুরু করতে হয়। মানুষকে ভয় দেখানোর ট্রেনিং বলতে পারো। কিন্তু মিট্টু হচ্ছে ঠিক আমার মতো। ও মানুষকে ভয় তো দেখাবেই না, উল্টো মানুষদের সাথে মিলে মিশে দিনের বেলায় ক্রিকেট, দাড়িয়াবান্ধা, ফুটবল খেলে বেড়ায়। আর রাতের বেলা দিব্যি ঘুমায়। ভুতের মূখ্যমন্ত্রী এই খবর পেয়ে তো রেগে বরফ (ভুতেরা অতিরিক্ত রেগে গেলে বরফ হয় যায়)। বহু কষ্টে মন্ত্রীর রাগ কমানো হয়। কিন্তু মিট্টুকে শুধরানো যায় না। ও কাউকে ভয় দেখাতে পারে না উল্টো মানুষদের কাছ থেকে নানা রকম ঝাড়ি খেয়ে আসে। ফলে যা হবার তাই হয় পিসি ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। আমিও তো একই কারণে এলাকা ছাড়া। আপনি রাগ করবেন এ জন্য আমি আপনাকে বলিনি মামা।
: বুঝলাম তা মিট্টু আছে কোথায়?
: আমার সাথেই মামা। ছাদের বড় কামিনী ঝোপটার নীচে।
: ঠিক আছে থাক। কিন্তু ওরে সাবধান করে দে। যখন তখন যার তার পকেটে হাত যেন হাত না ঢুকায়। বি কেয়ার ফুল। আর যখন তখন যেন হাপিস না হয়ে যায়। মানুষ থাকলে হঠাৎ করে অদৃশ্য যেন না হয়। আর বলে দে মানুষের বিপদে যেন সাহায্য করে। এবার পা চালা। অন্ধকার হয়ে এলো।
আবছা আধারে, সামনে পিছনে কে?
দূরে মেরিডিয়ানে আলো জ্বলে উঠেছে। আমাকে পুরো বনরূপা এখন পাড়ি দিতে হবে। বনরূপার পিছনের দিকে কোন বাড়ি ঘর নেই। ফলে মানুষও নেই। আমার বাসা লেকসিটির কাছে। উত্তরপাড়া দিয়ে ঘুরে গেলে অনেক সময় লাগে। তাই বনরূপার শর্টকার্ট রাস্তাটা ধরেছি। বনরূপার বদনামও আছে। আগে মাঝে মাঝে নাকি ছিনতাই হতো। লোকজন তাই ভয়ে সন্ধ্যের পর এদিকে চলাফেরা করে না। গিট্টু সাথে থাকায় সাহস করলাম।
কিন্তু ভাব ভালো মনে হচ্ছে না। সামনে দুজন আর পিছনে দুজন জুটেছে। ভালো মোবাইল, হাজার খানেক টাকা আর পাঁচ লিটার দুধ সাথে রয়েছে। ফাউ আছে গিট্টু-মিট্টু। অল্পক্ষণ আগে গিট্টু মিট্টু অদৃশ্য হয়ে গেছে। আর তখনই ভোজবাজির মতো শূণ্য প্লটগুলোর ভিতর থেকে দুজন দুজন সামনে পিছনে সেট হয়ে গেছে। খালি জায়গায় গিয়েই মনে হয় চেপে ধরবে। আমার চিন্তা হয়। গিট্টুদের নিয়ে সামলাতে পারবো তো। নাকি মোবাইলটা যাবে?
: গিট্টু আছিস তো? অবস্থা মনে হয় সুবিধার না রে।
: আছি মামা। টেনশন নিয়েন না। মিট্টুও আছে।
গিট্টু আন্দাজ করেছে। থাক এগিয়ে দেখি কী হয়। এলাকাটা আসলেই ভালো না। এক সময় পুরো এলাকাটাই ছিল বিল। গভীর পানি ছিল। এলাকার লোকজন মাছ ধরত। নৌকা চালাত। একবার নৌকা ডুবিতে তিনটি শিশু এখানে পানিতে ডুবে মারা যায়। তারপর থেকে কেউ আর এদিকে বেড়াতে আসতো না। বেশ কবছর আগে পুরো এলাকাটা কিনে নেয় এক ব্যবসায়ী। সাইনবোর্ড লাগায়। বনরুপা আবাসিক এলাকা। তারপর শুরু হয় মাটি ভরাট। প্লট বিক্রি। হঠাৎ করেই মালিক মারা যায়। তার উত্তরসূরীরা মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পরে। এরপর থেকে পোড়ো এলাকা হয়ে গেছে বনরূপা। প্লট ভাগ করা আছে। আছে কাঁচা রাস্তা। এয়ারপোর্ট রোডের কাছাকাছি কিছু প্লটে একচালা টিনশেডে কিছু নিম্ন আয়ের মানুষের আবাস। বিদ্যুৎ লাইন থাকলেও গ্যাস এবং পানি সাপ্লাই নেই। সন্ধ্যের পর শুনশান নীরব হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। ভোরে-বিকেলে স্বাস্থ্যসেবীরা হাঁটতে-ব্যায়াম করতে আসেন। পূর্ব নামাপাড়া-বোটঘাটের কিছু মানুষ খাঁপাড়া থেকে দিনের বেলা শর্টকার্ট হিসাবে বনরূপার মেইন রোডটা ব্যবহার করে। আমি এখন মেইন রোডের সবচেয়ে নীরব জায়গাটায়। উত্তর পাড়া আর কাওলার ঠিক মাঝামাঝি। দুপাশেই জনবসতি অনেক দূরে। আমি হাঁটার গতি বাড়ালে সামনে পিছনেও গতি বাড়ছে। আমি গতি কমালে তারাও।
কপালে কী আছে কারা আছে কাছে?
একটা প্লটকে ক্রিকেট পিচ বানিয়েছে উত্তরপাড়ার ছেলেরা। তার পাশের প্লটটায় কয়েক সারি গাছ এলাকাটাকে অন্ধকার করে রেখেছে। ওখান থেকে বামে উত্তরপাড়ায় ঢোকার রাস্তা। ওখানে আসতেই সামনে এবং পিছনের দুপক্ষই গতি কমিয়ে আমাকে ঘেরাও এর ব্যবস্থা করে। সামনের দুজন ঘুরে মুখোমুখি হয় তারপর মিষ্টি সুরে আওয়াজ দেয়-
: কাকু, কী কী আছে হাতে নিয়ে নেন।
: মানে কী?
: মানে হলো আমাদের সময় খুব কম। আপনার সাথে যা যা আছে তা বের করে হাতে নেন না হলে আমরা একশনে যাবো কাকু।
: তাই নাকি? একশনে যাবে?
আমি বলা শেষ করার আগেই ঐ ভাতিজার গালে ঠাস ঠাস করে অদৃশ্য থেকে চড় শুরু হয়ে যায়। ভয়াবহ রকম ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় আমার নতুন ভাতিজা। চড় অন্যদের গালে, কানের নীচে সমানে চলতে থাকে। ভাতিজারা দুই ভাগ হয়ে দুজন উত্তর পাড়ার দিকে আর দুজন কাওলার দিকে ছুটতে থাকে। আমি দেখি দুটো বাঁশের টুকরো ওদের পেছন পেছন ছুটছে। অর্থাৎ গিট্টু-মিট্টু। আর সামনে আওয়াজ হচ্ছে ভূত..ভূত..ভূত...
মানুষ তাড়িয়ে ভূতরা ফিরে আসে।
: কি খেল দেখালাম মামা। গিট্টু হাসে, মিট্টু ও।
: মিট্টুর প্রথম অপারেশন তাই না।
: হ্যাঁ মামা। মিষ্টি, রিনরিনে কণ্ঠ মিট্টুর।
আমরা উত্তর পাড়ার দিকে এগিয়ে যাই। জনবসতি যেখান থেকে শুরু সেখানেই একটা চায়ের দোকান ও রিক্শা গ্যারেজ। ছিনতাইকারীর দুজন এদিক দিয়েই পাড়ার ভেতরে ঢুকেছে। আমার চা খেতে ইচ্ছে করে। তিনজন দোকানের বেঞ্চে বসি।
: কী খাবি গিট্টু-মিট্টু?
: বাটার বন খাবো মামা।
: তোরা বাটার বন খা আমি চা-টোষ্ট খাই।
: ভাই আপনারা কি বনরূপা থেকে এলেন? অন্যপাশের বেঞ্চে বসা ভদ্রলোকের জিজ্ঞাসা।
: জী।
: কিছু দেখলেন? দুটো ছেলে তো ভূত..ভূত বলে দৌড়ে চলে গেল। আগে ছিলো ছিনতাইকারী এখন এসেছে ভূত। এখন তো দিনের বেলাও ওদিকে যাওয়া যাবে না মনে হয়।
: হতে পারে। তবে আমরা কিছু দেখিনি তো। তবে ছিনতাইকারীর চেয়ে ভূত থাকা ভালো।
: কী বলেন ভাই।
: ঠিকই বলছি ভাই। ছিনতাইকারী তো সব পরিষ্কার করে ছিনিয়ে নেয়। ভূত হয় তো একটু ভয় দেখাতে পারে। আর আজকাল নাকি ভালো ভূতও আছে। ওরা মানুষের উপকারও করে থাকে।
: লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
: কি ভাই চা হলো?
দোকানদার চা এনে দেয়। আমি চুমুক দেই।
গিট্টু একটা বাটার বন শেষ করে দ্বিতীয়টায় কামড় বসিয়েছে। এমনি সময় চায়ের দোকানের ছেলেটা চিৎকার করে উঠলো ভূত.. ভূত..। বলেই অজ্ঞান।
গিট্টু বাটার বন খাচ্ছে কিন্তু মিট্টু নেই। ভ্যানিশ। দোকানের টিমটিমে আলোতে লোকজনের ভয়ার্ত চেহারা। ছেলেটার মাথায় পানি ঢালার পর জ্ঞান ফিরে আসে। ভয়ার্ত চোখে চারদিকে তাকায়। দোকানদারকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় যা বলে তা হল, ছোট ছেলেটা একটা বাটার বন শেষ করে ওখানে বসেই অনেক দূরের বয়েম থেকে হাত লম্বা করে আরেকটা বাটার বন আনতে গেলেই ও দেখে ফেলে। তার পরেই ছেলেটা উধাও। সবাই অবাক আর ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। ইতিমধ্যে গিট্টুও উধাও।
: ভাই বাচ্চা দুটো আপনার সাথে এসেছে না?
এবার আমাকে প্রশ্ন করেন সেই ভদ্রলোক। এই রে মেরেছে। এবার?
: হ্যাঁ বনরূপায় হাঁটতে গিয়েছিলাম। আসার সময় বাচ্চা দুটোর সাথে দেখা। বললো উত্তরপাড়া যাবে। আমার সাথে কথা বলতে জানাল খুব ক্ষুধা পেয়েছে। আমিও ভাবলাম চা খাবো। বাচ্চা মানুষ। খাক কিছু একটা। নাম বললো গিট্টু।
: কইরে গিট্টু...। ভয়ে বোধ হয় চলে গেছে। কী যে হচ্ছে আজকাল। ছিনতাইকারী, গুমপার্টি, মলমপার্টির পর এখন ভূতপার্টি। না থাকা যাবে না এ শহরে। ভারিক্কি চালে জবাব দেই আমি। তারপর চা আর বাটার বনের দাম মিটিয়ে বাইরে আসি। মোড় ঘুরতেই গিট্টু-মিট্টু সামনে এগিয়ে আসে।
: স্যরি মামা। হাত লম্বা করলে ছেলেটা যে ভয় পাবে বুঝতে পারিনি। আর হবে না কখনো।
: ঠিক আছে মনে রাখিস। আর সাবধানে থাকিস। গিট্টুর কথা শুনে চলিস। এবার আমরা বাসার কাছে চলে আসি। ফুস করে গিট্টু-মিট্টু উধাও হয়ে যায়।
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি