সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
হারুণ

ডান হাতে জলভরা একটা বালতি। মুখ ভিজে গামছায় ঢাকা। অন্য হাতে মগ আর গোটা দুই গ্লাস। কলকাতায় বড় ক্লাবের ফুটবল শুরু হলেই চম্পাহাটির হারুণ ময়দানে জল বেচতে শুরু করে।
প্রতি গ্লাস জলের দাম পাঁচ পয়সা। তাও নিমেষে উড়ে যায়। জ্যৈষ্ঠের দারুণ রোদ আর ফুটিফাটা গরমে হাজার হাজার খেলা পাগল মানুষ টিকিটের আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। সুতরাং খদ্দের অনেক।
ঘন ঘন লাইনের পাশ দিয়ে চক্কর দেয় ও। বালতি খালি হয়ে গেলেই হাঁসফাঁস করে ছোটে দূরে টেন্টের দিকে। নষ্ট করার মতো এক মুহূর্ত সময় নেই তখন। খেলা শুরু হতে লাইন ফাঁকা হয়ে যায়। হারুণের খদ্দের তখনও কম নয়। চলে আসে র্যামপার্টের দিকে। লাইনে যারা টিকিট পায়নি তাদের একটা বড় অংশ তখন ভিড় করেছে সেখানে। তাই মেলা খদ্দের সেদিকেও।
হারুণের আব্বা রহিম শেখ ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। কত ভাল ভাল কথা বলতেন! হারুণের ভাল লাগত শুনতে। কিন্তু সে বছর কয়েক আগের কথা। ওসবে আজ আর বিশ্বাস নেই তার। পরোয়া করে না। আব্বা হঠাৎ মারা যাওয়ার পর এই চার বছরে অনেক ঝড় বয়ে গেছে ওর জীবনে।
মনে পড়ে‚ আব্বা বলতেন‚ তৃষ্ণার্তকে জল দেওয়া পবিত্র কাজ।
হারুণও জল দেয়‚ তবে পয়সার বিনিময়ে। প্রাইমারি ক্লাসের বিদ্যে নিয়েও বোঝে‚ কাজটা পবিত্র নয় মোটেই। কিন্তু ওসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামায় না সে। আগে পেট। শুধু নিজের নয়‚ ঘরে রয়েছে মা আর ছোট দুটি ভাই বোন। তাই ছাড়তে হয়েছে স্কুল। সেই ভোর সকালে ট্রেন ধরে কলকাতায় চলে আসে ও। সকাল খানিক কাগজ ফেরি করে। তারপর যেদিন বড় দলের খেলা থাকে সোজা চলে আসে ময়দানে।
বালতি‚ মগ আর গ্লাস ময়দানেই এক ছোট ক্লাবের মালির কাছে রাখা থাকে। জলটাও ওই ক্লাব থেকে নেয়। কিছু কমিশন দিত হয় তাকে।
সেদিন হারুণ যথারীতি জলের বালতি নিয়ে ঘুরছে। হঠাৎ সামনে একটা লাইনের মাঝে জটলা দেখে থমকে দাঁড়ায়। গোলমাল দেখলে হারুণ সেখানে আর নেই। সাত হাত দূরে। একবার ওর খপ্পরে পড়লে আর রক্ষে নেই। জল তো যাবেই। সেই সাথে বালতি‚ মগ কিছুই রেহাই পাবে না। মুহূর্তে অন্য দিকে সরে পড়ছিল ও। হঠাৎ ভিড়ের ভিতর থেকে জল–জল চিৎকারে থমকে যায়। ভাল করে তাকিয়ে বুঝতে পারে গোলমাল নয়‚ লাইনের কয়েকজন হাত নেড়ে ওকেই ডাকছে। উৎসাহে হাতের গ্লাস রেডি করতে করতে হারুণ দৌড়ে যায় এবার। হাঁসফাঁস করে বালতি নামিয়ে বলে‚ 'পাঁচ পয়সা করে গ্লাস বাবু। কয় গ্লাস চাই?'
ততক্ষণে জটলা কিছু পরিষ্কার হয়েছে। জনা কয়েক মানুষ একটা অচৈতন্য দেহ ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। প্রচণ্ড রোদ আর ভিড়ের চাপে মানুষটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। নীল হয়ে গেছে মুখ। ওলটানো চোখ। একেবারেই ভাল নয়।
দ্রুত এগিয়ে যায় হারুণ। 'নামিয়ে দিন বাবু। নিচে নামিয়ে দিন।'
সময় নষ্ট না করে হারুণ মগে জল নিয়ে আঁচলা করে জলের ঝাপটা দিতে থাকে অচৈতন্য মানুষটির চোখেমুখে।
খানিক বাদে কিছুটা যেন স্বাভাবিক মনে হয়। সঙ্গের লোকগুলিকে নিয়ে হারুণ ধরাধরি করে তাকে খানিক দূরে এক গাছতলার ছায়ায় এনে শুইয়ে দেয় এবার। আরও কয়েক ঝাপটা জল দেবার পরে মানুষটি একসময় কিছু সুস্থ হয়ে উঠে বসে। ধরা গলায় জল খেতে চায়। বালতিতে তখন সামান্য জলই অবশিষ্ট। গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দেয় হারুণ।

হারুণ

সঙ্গের একজন হারুণের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে‚ 'তুমি ছিলে ভাই‚ তাই রক্ষে! নইলে কী বিপদ যে হত আজ!'
একটু লাজুক হাসে হারুণ। গ্লাস আর মগ বালতিতে রেখে উঠে দাঁড়ায়। 'চলি বাবু।'
হাতে বালতি নিয়ে টেন্টের দিকে পা বাড়ায় ও। টেন্ট থেকে সবে জল ভরে এনেছিল। সব বরবাদ গেল। একটা পয়সাও মেলেনি। মালিকে বললেও হয়তো বিশ্বাস করবে না। কমিশনের পয়সা নিয়ে নেবে। কিন্তু সেজন্য একটুও যে আপশোশ হচ্ছে না! বরং অনেক দিন পরে ভীষণ ভাল লাগছে আজ। আব্বার মুখটা খুব বেশি করে মনে পড়ছে। উনি বলতেন‚ 'ভাল কাজ করলে মনটাও ভাল থাকে রে হারুণ।'
পরম উৎসাহে ও ছুটতে থাকে টেন্টের দিকে।*

*বিগত শতকে আশির দশকের ময়দানে এক বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে

 

ছবিঃ নভনীল দে

জন্ম কলকাতায়। অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক। প্রথম প্রকাশিত গল্প 'মৌচাক' পত্রিকায়। লেখা প্রকাশিত হয়েছে প্রথম সারির সমস্ত কিশোর পত্র–পত্রিকায়। একাধিক বই প্রকাশ করেছেন বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা 'শিশু সাহিত্য সংসদ'।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা