বুবুন আর ছোটনের খুব মজা এবার বড়োদিনের ছুটিতে। দিন ছয়েকের জন্যে পুরী যাচ্ছে যে মা বাবার সঙ্গে। ছোটনের তো পুরী মনেই নেই, সমুদ্রও নয়। সেই কোন ছোটবেলায় গিয়েছিল, দু আড়াই বছর বয়েসে আর তখন নাকি ঢেউ দেখে খুব ভয় পেয়েছিল, নামতেই চায় নি, ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিল নাকি। ছোটন এখন ক্লাস ওয়ানে উঠে গেছে অথচ ওর দাদা বুবুন এখনো ওকে ওই কথা বলে ভীতু ভীতু বলে খেপায়। আসলে সাত বছরের বড়ো তো, তাই ভাইকে একদম পাত্তাই দেয় না। এবার তাই ছোটন ভেবেই এসেছে ও অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্রে চান করে দেখিয়ে দেবে যে ও মোটেই ভীতু নয়।
তার ওপর আবার পুরীতে গিয়ে ছোটনের বাবার বন্ধু সমরেশ আর তাঁর পুরো পরিবারের সঙ্গে দেখা হবে। সমরেশের দাদু পুরীতে চাকরি করতেন, সেখানে বাড়িও তৈরী করেন। সমরেশের বাবা, জ্যাঠাদের ছোটবেলা পুরীতেই কেটেছে। কিন্তু ওনারা সব বড়ো হয়ে কোলকাতা আর তার আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েন। পুরীতে আর কেউই ফিরে যান নি। সমরেশের দাদুর এই নিয়ে খুব আক্ষেপ ছিল। ছেলেদের হাজার জোরাজুরিতেও পুরী ছেড়ে কলকাতায় যান নি, শেষ বয়স এখানেই কাটিয়েছে, মারাও গেছেন এখানে। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর থেকেই বাড়িটাতে আর কেউ থাকত না, আস্তে আস্তে বাড়িটা পোড়োবাড়ির চেহারা নিতে থাকে। দেখভাল করার জন্যে সমরেশরা কয়েকবছর আগে দু একটা ঘর সারিয়ে সুরিয়ে একজন কেয়ারটেকার রাখেন। বাড়িটার পজিশন খুব ভালো, সমুদ্রের একদম কাছে। সম্প্রতি সমরেশরা বাড়িটাকে বিক্রি করে দেবেন বলে ঠিক করেছেন, ওখানে হোটেল তৈরী হবে। সেইসব ঠিক করতেই সমরেশরা এখানে এসেছেন।
শিয়ালদা পুরী দুরন্ত ভোর চারটের অন্ধকারে পুরী পৌঁছল। জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলারে মুড়িসুড়ি দিয়ে বুবুন, ছোটন ওদের বাবা মা দেবাশিস আর পাপড়ির সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে নামল। সমরেশ একটা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন ওদের নিয়ে যাবার জন্যে। হোটেল আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। হোটেলের ঘরে ঢুকেই বুবুন, ছোটন এ জানলা ও জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বাইরে তখনো বেশ অন্ধকার, ভালো মতো কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। ওদের অবস্থা দেখে সমরেশ একটা বড়ো জানলার পর্দা সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আলো ফুটলে এখান দিয়েই সমুদ্র দেখতে পাবি। আর ব্যালকনিটা তো সমুদ্রের ঠিক সামনে। সমুদ্র আসলে হোটেলের পেছন দিকে। আমরা সামনের বড়ো রাস্তা দিয়ে এসেছি তো, তাই সমুদ্র দেখতে পাস নি। এখন একটু বিশ্রাম করে নে, বেলায় সমুদ্রে চান করা যাবে।’
সকাল ন’টার মধ্যেই সবাই ব্রেকফাস্ট সেরে সমুদ্রের বীচে চলে গেল। সঙ্গে সমরেশ, তাঁর স্ত্রী স্মিতা আর ছেলে অর্ঘ্য। মজার ব্যাপার দেখা গেল, ভয় পাওয়া তো দূরের কথা ছোটন জলে এমন হুটোপুটি শুরু করল যে দেবাশিস অবধি অবাক হয়ে বললেন, ‘বাবা, ছোটন তো দেখছি খুব সাহসী হয়ে উঠেছে! বুবুন, তুই কিন্তু আর ওকে ভীতু বলে খেপাতে পারবি না।’
সমুদ্রে ঢেউএর সাথে যুদ্ধ করতে করতে কিছুক্ষণ স্নান করলে কি যে হয় কে জানে, পেটের মধ্যে একেবারে ছুঁচোর ডনবৈঠক শুরু হয়ে যায়। জল থেকে উঠে কোনোরকম স্নান সেরেই সবাই রেস্টুর্যান্টে চলে গেল লাঞ্চ সারতে।
খেতে খেতে দেবাশিস বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়াই ঠিক করলে? এদিকে তো জমির দাম খুব চড়া হোটেলের জন্যে। কিনছে কারা?’
‘দাম খুবই ভালো পাব। পজিশন তো খুব ভালো, সমুদ্রের একদম কাছে। কিনছে পি এন মুখার্জী এন্ড সনস। ওদের আরো দুটো হোটেল আছে এখানে, দুটোই স্বর্গদ্বারে। এদিকটাতে জমি খুঁজছিল। স্বর্গদ্বারটা তো খুব কনজেস্টেড হয়ে গেছে। অনেকেই ওখানে থাকতে চাইছে না। একটু ফাঁকায় ফাঁকায় সমুদ্রকে উপভোগ করতে চাইলে এদিকটা আইডিয়াল,’ সমরেশ উত্তর দিলেন।
‘বাড়িটা এতদিন কেয়ারটেকারের ভরসাতেই ফেলে রেখেছিলে?’
‘আরে প্রথমে তো কেয়ারটেকারও ছিল না। দাদু মারা যাবার পর জিনিসপত্র সব বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। বাড়িটা খালিই পড়ে ছিল। হঠাৎ বেশ কয়েক বছর আগে খবর পাওয়া গেল যে এক বুড়ো নাকি বাড়িটাতে আস্তানা গেড়েছে। বুড়োর ছেলেরা পুরীতেই থাকে কিন্তু কেউ বুড়োকে রাখতে চায় না, বলে বুড়োর নাকি মাথায় গোলমাল আছে, খালি খালি খেতে চায়। ছেলেদের বাড়িতে গেলে ছেলেরা দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়। তাই কেয়ারটেকারের ব্যবস্থা করা হল যাতে উল্টোপালটা লোক বাড়িটা জবরদখল না করতে পারে।
মজার ব্যাপার কি জানো? বৃন্দাবন মানে কেয়ারটেকারটির দয়ার প্রাণ। তিনি আরো ভালো করে বুড়োর থাকার ব্যবস্থা করলেন! বলে, ছেলেরা দেখে না, কোথায় যায় বেচারা, থাক না আমাদের সঙ্গে। আমার বাচ্ছারা ভালোবাসে। বৃন্দাবন বিশ্বাসই করে না যে বুড়ো পাগল, বলে, ওসব ওর ছেলেরা ওকে না রখার জন্যে রটিয়েছে। আমরা আর কতবার কলকাতা পুরী করি বলো। বৃন্দাবনকেও শুধু এই কারণে ছাড়ানো যায় না, খুব বিশ্বাসী এমনিতে। এই থেকে বুড়ো ওখানেই রয়ে গেল।’
‘তা এখন যে বাড়ি বিক্রি করে দেবে বৃন্দাবন আর বুড়োর কি হবে?’
‘বুড়ো মারা গেছে বছর খানেক হল। বৃন্দাবন কাছেই একটা হোটেলে মালীর কাজ করে। থাকার ব্যবস্থা ও করে নেবে। নেবে কেন, নিয়েছেই। এখন তো আর ওখানে থাকতেই চাইছে না, ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচে।’
‘কেন, কেন ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচে কেন? হঠাৎ কি হল?’ দেবাশিস কৌতূহলী।
‘কিছুই নয়, যতো সব আষাঢ়ে গপ্প বানাচ্ছে। বুড়ো নাকি ওর বাচ্ছাদের খুব ভালোবাসত, খেলত। আশেপাশের কয়েকটা বাচ্ছাও নাকি জুটত। তা বুড়ো মারা যাবার পর নাকি ওর বাচ্ছারা কবে সন্ধ্যেবেলা বুড়োকে বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। ব্যাস, আর যায় কোথায়! ভয়ে সব থরহরি কম্পমান!’
বুবুন, ছোটন, অর্ঘ্য ওদের মাদের সঙ্গে একটু দূরে বসেছিল আর নিজেদের মধ্যে গল্পেই ব্যস্ত ছিল। বড়োদের কথায় কারুরই মন ছিল না। এখন হঠাৎ সমরেশের কথাগুলো কানে যেতেই বুবুন নড়েচড়ে বসল, ‘তোমাদের বাড়িতে ভূত আছে সমরেশকাকু? আমাকে কিন্তু দেখাতে হবে।’
এদিকে বুবুন ভূতের নামে মজা পাচ্ছে, ওদিকে ছোটন, তার খাওয়া হয়ে গেছিল, সে হাত ধুতে গেছিল, প্রথম থেকে কিছুই শোনে নি, এখন হঠাৎ ভূতের নাম শুনে ভয় পেয়ে গেল।
‘না না কেউ ভূতের কথা বলবে না এখানে,’ সে বেশ জোরে চেঁচিয়ে উঠল।
‘সে কি রে, তুই ভূতে ভয় পাস বুঝি?’ অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করল।
‘ছোটন? ছোটন তো এক নম্বরের ভীতু। ও কিসে ভয় পায় না?’ বুবুন বলল।
‘এখানকার ভূতটা কিরকম বল তো ছোটন? মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, গলাটা খোনা খোনা, দাঁতগুলো উঁচু উঁচু, বাইরে বেরিয়ে থাকে। ছোট বাচ্ছাদের ভয় দেখিয়ে অজ্ঞান করে সমুদ্রের ধারে ফেলে দিয়ে আসে রাত্তিরে। মা বাবারা বাচ্ছাদের খুঁজেই পায় না। বিশেষ করে ক্লাস ওয়ান টু র বাচ্ছাদের ওদের খুব পছন্দ, চট করে ভয় পেয়ে যায় বলে,’ অর্ঘ্য ছোটনকে ভয় দেখায়।
ছোটনের ভয় লাগছিল। কিন্তু সবার সামনে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করার জন্যে বলল, ‘মোটেও ভূতেরা সব সময় ভয় দেখায় না। সব ভূত এরকম বাজে হয় না, অনেক ভূত আছে যারা ছোটদের ভালোবাসে। আমি পড়েছি। বাজে ভূতরাও ভয় শুধু দুষ্টু ছেলেদেরই দেখায়, তাই না মা?’
পাপড়ি কিছু বলার আগেই বুবুন বলে উঠল, ‘তাহলে রাত্তিরে বাথরুমে যেতে ভয় পাস কেন? মাকে কেন দাঁড়াতে বলিস দরজার বাইরে?’
ছোটন কিছু বলতে পারল না কিন্তু মনে মনে বেজায় চটে গেল দাদার ওপর। কি দরকার ছিল সবার সামনে এসব কথা বলার? নাহয় ছোটন একটু ভয়ই পায় তাই বলে এভাবে বলতে হবে? এবার থেকে তো অর্ঘ্যদাদাও খ্যাপাবে। একেই তো ক্লাস ওয়ান বলে কেউ পাত্তা দেয় না।
‘ব্যাস ব্যাস আর ভূত নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না, ছোটনকে ভয়ও দেখাবে না কেউ,’ পাপড়িই সবাইকে সামলালেন, ‘চল ছোটন, আমরা ঘরে যাই।’
ওরা চলে যেতেই বুবুন সমরেশকে ধরল, ‘ বলো না সত্যি সত্যি ভূত আছে ওখানে?’
‘সত্যি মিথ্যে কি করে জানব? বৃন্দাবনের ছেলেমেয়েরা দেখেছে বুড়ো নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে,’ সমরেশ হাসলেন।
‘বুড়োকে মিস করছিল হয়তো, তাই মনে হয়েছে দেখেছে। সব মনের ভুল,’ দেবাশিস বললেন।
‘একদিন গেলে হয় না ওখানে? রাত্তির বেলা? যদি দেখতে পাই ভূত?’ বুবুন অতি উৎসাহী।
‘খুব যে ভূত দেখার ইচ্ছে! সত্যি সত্যি দেখলে এত হাসি উবে যাবে। সত্যি সত্যি কেন, কেউ যদি রাত্তির বেলা অন্ধকার ঘরে ভয় দেখায় তাহলেও এত সাহস টিঁকবে বলে মনে হয় না,’ সমরেশ বললেন।
‘তুমি আমাকে রাত্তিরবেলা ওই বাড়িতে রেখে এসো, দেখো আমি ভয় পাই কি না। আমাকে ছোটনের মতো ভীতু ভেবেছো নাকি? ভূত ফূত কিচ্ছু নেই, সব বাজে, আমি ওসব বিশ্বাস করি না,’ বুবুন বেশ জোরের সঙ্গে বলল।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ ভূত বলে কিচ্ছু নেই,’ অর্ঘ্যও বুবুনের সুরে সুর মেলায়, ‘আমরা যাব ওখানে রাতে।’
‘না না ওসবের কোনো দরকার নেই। বেড়াতে এসেছো, বেড়াও, মজা করো, ওখানে যেতে হবে না। আর বুবুন শোন, ভাইকে একদম ভয় দেখাবি না,’ বললেন দেবাশিস।
দিন দুয়েক কাটল। সবাই চিল্কা দেখা এল। সাতপাড়াতে মোটরবোটে করে যেতে যেতে ডলফিন দেখে ছোটদের উচ্ছ্বাস দেখে কে! ছোটন তো পারলে একটা জ্যান্ত ডলফিনই বাড়ি নিয়ে যায়, এত ভালো লেগেছে। সমুদ্র, বেড়ানো এসব নিয়েই সবাই মেতে রইল, ভূতের কথা চাপা পড়ে গেল। ছোটনও খুব খুশী। সবাই স্বীকার করেছে ওর মতো স্যাণ্ড ক্যাসেল কেউ বানাতে পারছে না, বুবুন, অর্ঘ্য কেউ না।
ফেরার আগের দিন হঠাৎ বুবুন আর অর্ঘ্যর ওই বাড়িতে যাবার ইচ্ছে হল যদিও বড়োদের কারুরই খুব একটা ইচ্ছে নয় ওদের ওখানে সন্ধ্যেবেলা যেতে দিতে। ছোটন তো যেতেই চায় না, কিন্তু বুবুন, অর্ঘ্য নাছোড়বান্দা।
‘তুই একদম যাস না ছোটন। ভূতটা বাচ্ছাদের ভয় দেখাতে ভালোবাসে। যদি তোর দিকে হাঁউমাউখাঁউ করে তেড়ে আসে?’ অর্ঘ্য হাঁউমাউখাঁউ এর ভঙ্গী করে ছোটনকে দেখায়।
ছোটন চটে যায়। বুবুন তো সব সময় ওকে খেপিয়েই যায়, এখন আবার অর্ঘ্যটাও জুটেছে। বিরক্ত হয়ে ও ঠিক করল ওও ওদের সঙ্গে যাবে। কিন্তু পাপড়ির একদম ইচ্ছে নয় ছোটনকে ওদের সঙ্গে ছাড়ার। ওরা নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াবে, ছোটনের কোনো খেয়ালই রাখবে না। শেষ পযন্ত বড়োদের মধ্যে কি কথা টথা হল কে জানে সবাই ওদের যেতে দিতে রাজী হয়ে গেল। শুধু সমরেশ এক ফাঁকে বুবুন, অর্ঘ্যর আড়ালে ছোটনকে ডেকে বললেন, ‘বুবুনরা ভেতরে যায় যাক, তুই যাস না ছোটন। উলটে ওরা তোকেই ভয় দেখিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসবে। তোর খারাপ লাগবে। তুই বরং বৃন্দাবনের সঙ্গে গেটের পাশের ছোট্ট ঘরটাতে বসে থাকিস, বুঝলি?’
সন্ধ্যে হব হব এমন সময় সমরেশ আর দেবাশিষ বুবুন, অর্ঘ্য, ছোটনকে নিয়ে সমরেশদের বাড়িতে পৌঁছলেন। বৃন্দাবন গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল, ওদের দেখে এগিয়ে এল। সমরেশ আগে থেকেই বৃন্দাবনকে বলে রেখেছিলেন ছোটনের সামনে ভূতের ভও না উচ্চারণ করতে। তাছাড়া এখন বৃন্দাবনের বউ, ছেলেমেয়েরা কেউ নেই, তাই ছোটনকে ভূতের কথা বলার সম্ভবনাও নেই। ছোটনকে ওর জিম্মায় রেখে দেবাশিসরা বাড়ির ভেতর ঢুকলেন।
বাড়িটার সামনের দুটো ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যে দুটোতে বৃন্দাবনরা থাকে। বাকী সব ঘর বন্ধই থাকে, পরিষ্কার টরিষ্কারও বিশেষ করা হয় না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বুবুন বলল, ‘বাবা, তুমি তো আমাদের সঙ্গেই রয়েছো, তাহলে ছোটনকে আনলে না কেন? ওকে শুধু শুধু ওখানে বসিয়ে রাখলে।’
‘কোনো দরকার নেই। তোমরা ছোটনের পেছনে বড়ো বেশী লাগো। তোমাদেরও এখানে আসতে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। ধুলোবালি, পোকামাকড় ছাড়া এখানে দেখার আছেটা কি? বৃন্দাবনের বাচ্ছারা কি না কি দেখেছে, তোমরাও অমনি ভূত দেখব বলে নেচে উঠলে,’ দেবাশিস বেশ বিরক্ত।
‘তা নয় তো কি? অন্ধকারে কি দেখতে কি দেখেছে, ভূত্তো ভূত্তো বলে ভয়েই অস্থির! ভূত যেন সব সময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব কথা প্রচারিত হওয়ার আগেই যে বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এই ভালো,’ সমরেশ বললেন।
‘বুড়োটা তো নিজের বাড়িঘর ছেড়ে এখানেই থাকত। কি করত সারা দিন?’ জিজ্ঞেস করল অর্ঘ্য।
‘কি আবার করবে? পাগলাটে ছিল, সারাদিন বাচ্ছাগুলোর সঙ্গে খেলে বেড়াত,’ সমরেশ উত্তর দিলেন।
পুরো বাড়িটাতে দেখার কিছুই নেই। সবাই এঘর ওঘর ঘুরে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
‘হয়েছে? শখ মিটেছে? ছোটনকে উলটোপালটা বলে একদম ভয় দেখাবে না,’ দেবাশিস বুবুনকে সাবধান করলেন।
গেটের পাশে ছোট্ট ঘরটাতে গিয়ে সবাই দেখল ছোটন চুপটি করে বসে আছে, বৃন্দাবন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। ওদের দেখে কথা বলা বন্ধ করে এল। সমরেশ বৃন্দাবনের সঙ্গে দরকারী কিছু কথা বললেন, তারপর সবাই চলে গেল।
ফেরার পথে ভূত নিয়ে কোনো কথা হল না, শুধু বুবুন বলল, ‘তুই না গিয়ে ভালো করেছিস রে ছোটন। কিচ্ছু নেই বাড়িটাতে, ভূত তো দূরের কথা।’
ছোটন মনে হল বেশ খুশী হয়েছে। হোটেলে ফিরে এল সবাই। বড়োরা ব্যালকনিতে বসে গল্প করছে, ছোটরা এঘর ওঘর ঘোরাঘুরি করছে, কখনো টিভি দেখছে। বুবুন কি একটা দরকারে ওদের ঘরে ঢুকে দেখল ছোটন বিছানায় বসে একমনে ক’টা রঙ বেরঙের মার্বেল নিয়ে খেলছে। পাশে একটা লাট্টু পড়ে আছে।
‘কি সুন্দর মার্বেলগুলো, তুই কোত্থেকে পেলি?’ বুবুন জানতে চাইল।
‘তোরা তো বাড়িটার মধ্যে ঢুকে গেলি। আমি বৃন্দাবনকাকুর সঙ্গে বসে ছিলাম। তখন বৃন্দাবনকাকুর মোবাইলে ফোন এল আর বৃন্দাবনকাকু কথা বলতে বলতে গেটের বাইরে চলে গেল। তখন আমি বাগানটায় ঘুরছিলাম। পেছন দিকে যাই নি, জঙ্গল ছিল। এমন সময় একটা দাদু এল। ধবধবে সাদা চুল, খালি গা, সোয়েটারও পরে নি। আমাকে হাত নেড়ে ডাকল। আমি কাছে গেলাম, আমাকে মার্বেলগুলো আর লাট্টুটা দিল। আমি ওগুলো হাতে নিয়ে দেখছিলাম, থ্যাংক ইউ বলতে যাব, দেখি দাদুটা পেছনের গেট খুলে চলে গেল। আমি তখন আবার ঘরে এসে বসলাম, তারপরেই তোরা চলে এলি। মার্বেলগুলো আর লাট্টুটা কিন্তু তুই একদম নিবি না দাদা, এগুলো আমার। দাদুটা আমাকে দিয়েছে,’ ছোটন মার্বেলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলল।
বুবুনের গলা শুকোলো, বুবুন ঢোঁক গিলল। ছোটন পাগলা বুড়োর কথা জানেই না, শোনেই নি। তাছাড়া ও মার্বেলগুলো পেল কোত্থেকে? কোথা থেকে কুড়িয়ে পেয়ে এত বড়ো গল্প ও বানাবে না। ছোটন যে একদম মিথ্যে কথা বলে না সেটা ও খুব ভালোই জানে। মুশকিল হচ্ছে এখন ও ছোটনকে বলতেও পারবে না যে ও আসলে ভূত দেখেছে। আর বললেও বা কি হবে? সেই তো ছোটনের কথাই সত্যি বলে প্রমাণিত হবে যে ভূতরা সবসময় ভয় দেখায় না, বরং লক্ষ্মী ছেলেদের ভালোবাসে আর সবাই বলবে ছোটন কি সাহসী, ভূত দেখেও ভয় পায় নি!