খেলাঘরখেলাঘর

ঘুড়ি

রূপকথার বই পড়া আর ঘুড়ি ওড়ানো হচ্ছে অর্ক'র কাছে সব থেকে আনন্দের। আরব্য রজনী একবার হাতে পেলে ও নিজেকে হারিয়ে ফেলে রূপকথার চরিত্রগুলোর সাথে। যতক্ষণ না বইটা শেষ হচ্ছে , পড়তে বসা তো দুরের কথা খেতে বা ঘুমোতে পর্যন্ত পাঠানোর উপায় নেই তাকে। তবে অর সবথেকে ভালো লাগে যখন মা ওকে পাশে শুইয়ে গল্প বলে ঘুম পারিয়ে দেন । গল্প শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ও এমন সব প্রশ্ন করে যে ওর মা বিরক্ত হয়ে বলেন - "এখন ঘুমো তো, অনেক রাত হয়েছে, পরে বুঝিয়ে দেব।" বাধ্য হয়ে অর্ক চুপ করে যায়, আর তারপরে কখন যেন ঘুমিয়ে পরে। আসলে ওর মাথায় যে কত প্রশ্ন আসে, আর তা দিয়ে কত সব আজগুবি কল্পনার জাল বুনে চলে, তা ও মাকে বুঝিয়ে উঠতে পারে না। ওর এই কল্পনাই ওকে ঘুমন্ত অবস্থায়ও নিয়ে যায় রূপকথার দেশে। স্বপ্নের মধ্যে কখনো চলে যায় লাল-পরীর কাছে, কখনো আলাদীন, এলিস বা সিন্ডেরেলাদের কাছে। সকালে মা যখন ঘুম থেকে তোলার জন্য ডাকেন "...আমার অর্ক সোনা, ...ওঠো এবার, স্কুল যেতে হবে তো ?" এত সুন্দর স্বপ্ন গুলো কেমন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়, ও চেষ্টা করে বালিশে নিচে মাথা ঢুকিয়ে স্বপ্নের রেশটাকে আর একটু ধরে রাখতে, কিন্তু মা যে কেন আর একটু শুতে দেয় না, অর্ক সেটাই বুঝতে পারে না। মনের দু:ক্ষে, কোনরকমে স্নানটা সেরে, গ্লাসের দুধটা শেষ করে ভারী ব্যাগটা পিঠে চড়িয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পরে স্কুলের উদ্দেশ্যে।

সারাটা দিন স্কুলে কাটে কিছুটা আনন্দ আর বিরক্তির সাথে। এতো বই আর খাতা সামলানো, ক্লাস ওয়ার্ক, হোম ওয়ার্ক, পরীক্ষা…….ওফ:, অর্ক আর পারে না সবকিছু সামলাতে। একমাত্র টিফিনের সময়টা ও একটু হাফ ছেড়ে বাঁচে, আর তখন মন খুলে গল্প করে সব থেকে প্রিয় বন্ধু সৌম্যর সাথে। যদিও পড়াশোনা করতে অর্কর ভালই লাগে, কিন্তু অঙ্ক আর মিউজিক মিস ছাড়া আর স্কুলে কাউকেই ভালো লাগে না, কারণ বাকি সব মিস'রা সবাই ক্লাসে বসে হয় রূপচর্চা অথবা মোবাইল ফোনে কথা বলেন, নিতো ওদেরকে ধরে বকাবকি করেন।

ক্লাসের শেষে অর্ক ব্যাগটা একটানে পিঠে চড়িয়ে ছোটে গেটের বাইরে সামনের বটগাছটার তলায়, যেখানে মা তার জন্য অপেক্ষা করেন। মাকে জড়িয়ে ধরে শুরু হয়ে যায় তার সব গল্প "জানো তো, আজকে ............।" মা'র হাত ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে, ভাবে কখন বাড়ি গিয়ে রজতদা'র সাথে ঘুড়ি উড়ানো শুরু করবে। নিজে ঘুড়ি ওড়াতে না পারলে কি হবে, ঘুড়ি আকাশে উড়তে দেখলে ও একটা অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করে। রজতকে ঘুড়ির ধোলাই দিয়ে অর্ক লাটাই'টা ধরে, আর রজত একটানে ঘুড়িটাকে পাঠিয়ে দেয় ওই নীল আকাশে। একটু করে সুতো ছাড়ার সাথে, ঘুড়িটা কেমন যেন ওদের থেকে অনেক দুরে চলে যায়। রজত অর্ককে বোঝাতে থাকে কেমন করে ঘুড়িকে বাড়াতে হয়, কেমন করে আবার তাকে বাগে আনতে হয়, কেমন করে আকাশে তাকে স্থির দাঁড় করিয়ে রাখা যায়, বা কেমন করে প্যাঁচ খেলতে হ্য়। অর্ক কিন্তু শুধু ভাবতে থাকে ঘুড়িটার কথা, মনে হয় আমারই এই ঘুড়িটা এখন কেমন আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে -কখনো তার মাথার ওপরে, কখনো বা নিচে, কখনো হারিয়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে, কখনো বা মিশে যাচ্ছে উড়ন্ত পাখির দলে। ওর শিশু মন ভেবে পায় না ঘুড়ি যদি এত সহজে উড়তে পারে, মানুষ কেন পারে না আকাশে উড়তে। ইচ্ছে করে এমন ভাবে যদি ও আকাশে যেতে উড়ে পারত, দেখতে পারত পৃথিবীটাকে ওপর থেকে, আর জানতে পারত মেঘের ওপারে লুকিয়ে থাকা কত অজানা রহস্যকে।

ছোট থেকেই অর্ক আকাশে মেঘ ভেসে যেতে দেখলে কেমন বিস্মিত হয়ে যেত, আর কেবল মাকে প্রশ্ন করত "মেঘেরা আসলে কি, ওরা কোথা থেকে আসে আর কোথায় বা যায় ? আমাকে নিয়ে চল না মেঘের কাছে ......"। মা শুনে বলতেন, "তুমি যখন অনেক বড় হয়ে বিদেশ যাবে, তখন এরোপ্লেনে চরে ওই মেঘের পেট চিরে আরো উঁচু আকাশ পথে যাত্রা করবে"। শুনে ছোট্ট অর্কর বিস্ময় আরো বেড়ে যেত আর শুরু হত তার প্রশ্নর পালা - " অনেক মানে কত উঁচু আকাশে আমি যাব ? আমি কি তা'হলে আকাশ ছুঁতে পারব ? আকাশে কারা থাকে ? আকাশের থেকেও উঁচুতে আর কি আচ্ছে ?........."। হঠাত রজতদা'র চিত্কারে ও সম্বিত ফিরে পায়, রজত'দা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে চিত্কার করে বলছে "......আরে ছাগল সূতোটা ছার, পেটকাটিটা আমাকে কেটে দেবে যে।" অর্ক আবার লাটাই'টা ঠিক করে ধরে, আর রজতদা প্রচন্ড ক্ষিপ্রগতিতে সুতোর টানে পেটকাটির সাথে প্যাঁচ খেলতে শুরু করে। অর্ক বুঝতে পারে না কি দরকার এই প্যাঁচ খেলার, তার থেকে তো অনেক ভালো আকাশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো, কথা বলা ওই উড়ন্ত পাখি গুলোর সাথে, আর চোখ মেলে আকাশ থেকে দেখা দুনিয়াটা কে। এমন সময় রজতদা আবার চিত্কার করে ওঠে "ভো - ও - কা - ট্টা, ভোকাট্টা". অর্ক তাকিয়ে দেখে যে পেটকাট্টি ঘুড়িটা এতক্ষণ অত্যন্ত গর্বের সাথে সারা আকাশে বিরাজ করছিল, রজত'দার এক সুতোর টানে তার সমস্ত দম্ভ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল, আর ওই ঘুড়িটা যেন তার পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করে, শোকে মুজ্ঝমান হয়ে ধীরে ধীরে ওলট পালট খেতে খেতে ঝরে পড়ল আকাশ থেকে। রজত'দা বিজয়ের আনন্দে বলল "দেখলি, কেমন একটানে ব্যাটাকে কুপোকাত করে দিলাম। এবার লাটাই'টা ঢিলে কর, আমি এবার ঘুড়িটাকে অনেক দূরে বাড়াব।" দেখতে দেখতে লাটাইয়ের সুতো প্রায় শেষ, ঘুড়িটা অনেক দুরে চলে গিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে, ওকে আর এখন নিজের বলে মনে হচ্ছে না - কেমন যেন পরদেশী মনে হচ্ছে। রজত'দা বলছে "দেখেছিস, আমাদের ঘুড়িটা কত্ত দুরে চলে গেছে", অর্ক বলে "কত দুরে ? মেঘের ওপারে ? আকাশ ছুঁয়েছে কি ?"

এবার রজতদা হঠাত অত্যন্ত ভগ্নোত্সাহে হায় হায় করে ওঠে "কি করলি টা কি ? সুতোটা যে শেষ হয়ে লাটাই থেকে বেরিয়ে গেল, তুই দেখতে পেলি না? তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। মনটা কোথায় থাকে ?" অর্ক তাকিয়ে দেখে ঘুড়িটা এবার রজত'দার নিয়ন্ত্রণ থেকে ছাড়া পেয়ে মুহুর্তের মধ্যে মেঘের ওপারে চলে গেল।

রজত'দার বকুনি খেয়ে অর্ক ফিরে আসে বাড়িতে আর মা'র ধমকানী খেয়ে বসে পরে পড়তে, কিন্তু মাথায় ঘুরতে থাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন - ঘুড়িটা কি সত্যি মেঘের ওপারে রূপ কথার দেশে চলে গেছে ? অর্ক কি পারবে কখনো ওই রূপকথার দেশে যেতে ? যদি যেতে পারে, তবে কি কি করবে সেখানে গিয়ে ? খেতে বসে মা'কে বলে "আজকে রজতদা'র সাথে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে .............ঘুড়িটা আসতে আসতে মেঘের ওপারে চলে গেল। বলো না মা, মেঘের ওপারে কি আছে, কারা থাকে ওখানে ?" মা বলে "সে এক রূপকথা'র দেশ, আর সেখানে সব সুন্দর পরীরা থাকে।" অর্ক আবার তার কল্পনার গভীরে তলিয়ে যায়। বিছানায় শুয়ে ওই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায় অর্ক, আর ভাবতে ভাবতে তার ক্লান্ত শরীর ঢলে পরে গভীর নিদ্রায়।




..........ধীরে ধীরে অর্কর চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল আকাশ, আর তার মধ্যে দিয়ে ভেসে যাওয়া সারি সারি সাদা মেঘ। ক্ষনিকের বিস্ময়তা কাটিয়ে অর্ক বুঝতে পারে যে সে এখন মাটি থেকে উড়ে আকাশ পথে চলেছে। নীচে তাকিয়ে দেখে রজত'দা চিত্কার করে বলছে "ডানা'টা ঠিক আছে ? ঠিক করে উড়তে পারছিস তো ?" সত্যি তো, অর্ক খেয়ালই করেনি যে তার পিঠে এখন দুটো ডানা রয়েছে, আর তাই দিয়েই ও আকাশে উড়ছে। অর্ক ভেবে পায় না কি ভাবে রজতদা'কে তার কৃতজ্ঞতা জানাবে, ত়ার এতদিনের আকাঙ্খা আকাশে ওড়ার আজ সত্যি হয়েছে শুধু রজত'দারই জন্য। "রজত'দা, তুমি ভীষণ ভালো, দেখো তোমার জন্য আমি কেমন আকাশে উড়ছি" - বলে অর্ক।

মাঝে মাঝে পাখির দল কিচিরমিচির করতে করতে অর্কর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। অর্ক খুব জোরে ডানা ঝাপটিয়ে আরও ওপরে ওঠার চেষ্টা করে। এবার অর্ক পৌছে গেছে একটা বড় সাদা মেঘের কাছে। অর্ক দু'হাত সামনে বাড়িয়ে মেঘ ভেদ করে এগিয়ে চলে আরো ওপর আকাশে। এইতো, অর্ক এখন মেঘের গন্ডি ছাড়িয়ে পৌছে গেছে এক অন্য জগতে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য, চতুর্দিক নীল্ আর নীল্, আর তার মধ্যে অসংখ্য আলোর রোশনাই। অর্কতো ঠিক এমনটাই ভাবতো। কিন্তু কই, কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। তা'হলে কি এখানে কি কেউ থাকে না ? অর্ক গতি বাড়িয়ে আরো এগিয়ে চলে। হঠাত শোনে পিছন থেকে সরু গলায় একটি পাখি তাকে ডাকছে "বন্ধু - তুমি কে, কোথা থেকে আসছো? এখানে তো মানুষের আসার কথা নই। কোথায় যাবে তুমি ?" অর্ক বলে "আমি এসেছি এই স্বপ্নের জগতটাকে দেখতে। তোমার নাম কি ? তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে তোমাদের দেশটা ঘুরে দেখতে ?" পাখিটা তাকে বলে "আমার নাম নীলা, আর আমি এই দেশে বন্দি হয়ে আছি। তুমি শিগগির এখান থেকে পালাও, নয়তো ওরা তোমাকেও বন্দি করে ফেলবে।" অর্ক প্রশ্ন করে "কারা তোমাকে বন্দি করেছে এবং কেন?" নীলা এবার বুঝিয়ে বলে যে মেঘের ওপারের এই দেশটার নাম হচ্ছে সুবর্ণলোক। এখানে শুধু পরীদের বাস। এখানকার রানীকে বন্দী করে এক দানবী পরীর রূপ ধারণ করে দেশটা কব্জা করেছে। আকাশপথে কেউ ভুল করে এখানে এসে পড়লে, তাকে চিরদিনের মত বন্দী করে ফেলা হয়, যেমন আমি গত পাঁচ'বছর ধরে এই দেশে বন্দিদশা ভোগ করছি। নীলা অর্ককে বলে "তুমি এখনই পশ্চিমের ওই রাস্তা ধরে পালাও, নয়তো ওরা তোমাকে ধরে ফেলবে।" কিন্তু অর্ক তো পালানোর জন্য আসেনি, ওর তো অনেকদিনের স্বপ্ন এই দেশে আসা, আর ঘুরে বেড়ানো দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, দু'চোখ মেলে উপভোগ করা এই নৈসর্গিক দৃশ্যকে। অর্ক বলে "নীলা, তুমি আমাকে নিয়ে চল ওই দানবীর কাছে।"

- তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ? তোমার ভয় নেই ? তুমি জানো তোমাকে ওরা কি করবে ?
- না নীলা, আমি ভয় পাই না। আমি তো মানুষ, তোমার মত ছোট্ট পাখি নই যে ভয় পাব। আমি ওই দানবীকে একবার দেখতে চাই, আর তারপর আমার কাজ হবে ওই পরীকে উদ্ধার করা।

নিরুপায় হয়ে নীলা বলে "ঠিক আছে, চল তবে আমার সাথে রাজপ্রাসাদে।" অর্ক আর নীলা এক ঝটকায় উড়তে শুরু করে আকাশে। পূর্ব দিকের এই আঁকাবাঁকা পথটাই গিয়েছে রাজপ্রাসাদের দিকে। উড়তে উড়তে দেখে, কি মনোরম এই দৃশ্য, চতুর্দিক থেকে ভেসে আসা রকমারী আলোর ঝলক কালিপূজোর চরকি, আর রবিদা'র তৈরী তুবড়িকেও হার মানায়।আলোর যে এত রং হয়, অর্কর জানা ছিল না। পথে আরো কিছু পাখির সাথে দেখা, আর প্রত্যেকেই অর্ককে মানা করে ওই প্রাসাদে যেতে, কিন্তু অর্ক তার সিদ্ধান্তে অনড়।

অবশেষে তারা এসে পৌছেছে রাজপ্রাসাদের ফটকে। বিশালদেহী পাহারাদাররা ঘিরে ধরে অর্ককে, আর শুরু করে নানা রকমের প্রশ্ন। অর্ক বলে "আমি এসেছি পৃথিবী থেকে মহারানীর উদ্দেশে এক বিশেষ সংবাদ নিয়ে, যা আমি শুধু তাকেই বলতে পারি।" পাহারাদাররা নিজেদের কিছুটা মধ্যে শলা পরামর্শ করে ওকে প্রাসাদের ভিতরে যেতে অনুমতি দেয়।

প্রাসাদে ঢুকে অর্কর বিস্ময় আরো কয়েকগুন বেড়ে যায়। কি অপূর্ব গঠন এই প্রাসাদটার। সমস্তটাই তৈরী সোনা, রুপো, হীরে, মনি, মানিক্য দিয়ে, আর তার ওপর থেকে ঠিকরে আসা আলোকমালার বিচ্ছুরণ দেখে চমকে যেতে হয়। দুরে দেখা যাচ্ছে সেই মহারানী (অর্থাত, সেই দুষ্টু দানবী) এক প্রকান্ড সিংহাসনে বসে আছেন। প্রাসাদের রক্ষীরা অর্ককে ধরে নিয়ে যায় মহারানীর কাছে। অর্ক এখন দাঁড়িয়ে সেই পরী রূপী দানবীর সামনে। দেখামাত্র এক অজানা ভয়ে তার শরীরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় শৈত্যপ্রবাহ, মনে হচ্ছে হাত আর পা'গুলো কেমন যেন ভয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। কোনক্রমে নিজেকে সামলে অর্ক বলে "আমার নাম অর্ক, আমি পৃথিবী থেকে এসেছি আপনার কাছে আমাদের রাজার বার্তা নিয়ে। আপনার এই অতীব সুন্দর দেশটা সম্মন্ধে আমদের রাজামশাই খুবই ওয়াকিবহাল, আর তাই উনি আপনাকে অনুরোধ করেছেন আমাকে এই দেশটা ঘুরে দেখাতে, আর উপদেশ দিতে যে কি ভাবে আমরা পৃথিবীটাকেও এমন সুন্দর করে তুলতে পারি।" শুনে ওই দানবী অত্যন্ত খুশি হয়ে প্রাসাদের এক রক্ষী কে বলে "যাও, আমাদের এই প্রিয় অতিথিকে সারা দেশটা ঘুড়িয়ে দেখাও। দেখো, ওর যা কিছু দেখার ইচ্ছে, সব যেন দেখতে পায়।"

ঘুরতে ঘুরতে অর্ক দেখে, কত বন্দিরা কি অসহায় জীবন কাটাচ্ছে এই দেশে, আর কি পাশবিক অত্যাচার চলছে তাদের ওপর। আর অন্যদিকে রাজপ্রাসাদে কি বিলাসবহুল জীবন। একদিকে যখন বন্দিরা আধপেটা খেয়ে কাটাচ্ছে, অন্যদিকে প্রাসাদে চলছে খুশির জোয়ার। অর্কর মনটা ভেবে ওঠে, তাহলে কি আমাদের পৃথিবীতেও এমনই হয় ? আমার বাবা সারাদিন এত খেটেও কেন আমাকে স্কুলের একটা ভালো জুতো কিনে দিতে পারে না, অথচ আমাদের রাস্তার ওপারের চৌধুরী বাড়ির দুটো ছেলেই তো কত দামী জামা, প্যান্ট, টাই, জুতো পরে বড় একটা গাড়িতে চেপে স্কুলে যায়। মা'কেজিজ্ঞাসা করলেই বলে "ওদের অনেক টাকা, ওর বাবার খুব বড় ব্যবসা।" অর্ক কিছুই বুঝতে পারে না। তবে ওর মনে কোনো কোনো দু:ক্ষ নেই। ঘুড়ি উড়ানো আর রূপকথা পড়তে পারলেই ও খুশি।

সারাদিন ঘুরে ফেরার সময় দুরে একটা লালবাড়ি চোখে পরে অর্কর, আর বলে ওঠে "আমি ওই বাড়িতে যাব।" শুনে রক্ষীটা হায় হায় করে উঠে বলে "ওখানে আমাদের রাজবন্দী থাকেন, তাই কারও যাওয়া বারণ। আমরা এখন প্রাসাদে ফিরে যাব।"

- কেন যাওয়া বারণ ? তুমি শুনলে তো যে মহারানি আমাকে সব কিছু দেখার অনুমতি দিয়েছেন। তা'হলে কেন যাব না, আমি যাবই ওই বাড়িতে।

অগত্যা, রক্ষী তাকে বলে "ঠিক আছে, আমি এখানে অপেক্ষা করছি। তুমি চট করে গিয়ে দেখে এস, আমার যাবার অনুমতি নেই।"




অর্ক ছুট্টে চলে যায় ওই লালবাড়ির দিকে, আর গিয়ে দেখে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটার লোহার গেটটা তালা দিয়ে বন্ধ। দমে যাবার পাত্র নয় অর্ক, মনে পরে যায় পাশের বাড়ির অমন উঁচু পাঁচিল কতবার টপকেছে ঘুড়ি ধরার জন্য, যদিও একবার পরতে পরতে খুব জোর বেঁচে গিয়েছিল। এদিক, ওদিক তাকিয়ে অর্ক লোহার গেটটা বেয়ে উঠে পরে ওপরে, আর তারপর এক লাফে বাড়ির চত্ত্বরের মধ্যে। সোজা গিয়ে ঢুকে পরে সামনের প্রকাণ্ড ঘরটার ভিতর, আর সেখানে দেখা হয় বন্দিনী 'ভালো পরীর' সাথে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার ওই রূপ আর স্নিগ্ধ চেহারার দিকে। অর্কর মাও তো সুন্দরী, ভালো করে সাজলে কি ওই পরীর মতই লাগবে মাকে ?

পরী - "কে তুমি ? তুমি কি আমার বন্ধু না শত্রু ?"
অর্ক - "আমি অর্ক, পৃথিবী থেকে আসছি। আমি তোমার বন্ধু"
পরী - "তাহলে তুমি পারবে আমাকে মুক্ত করতে?"
অর্ক - "আমি তোমাকে মুক্ত করার জন্যই এসেছি। তবে এখন নয়, কাল আমি ওই দানবীকে প্রথমে হত্যা করব আর তারপর তোমাকে মুক্ত করে দেব। তুমি আমাকে পরামর্শ দাও কি ভাবে আমি ওই দানবীকে মারতে পারি।"
পরী - "তুমি প্রাসাদে গিয়ে ওখানকার এক পাহারাদার বিল্লা'র সাথে কথা বল। ও তোমাকে সবরকম সাহায্য করবে, কারণ ওই দুষ্টুটা বিল্লা'র ছেলে, মেয়ে, বউ সকলকে বন্দী করে অত্যাচার করে চলেছে।"

অর্ক খুঁজে বার করে বিল্লাকে আর বলে "আমি এই দানবীকে দিবালোকে রাজপ্রাসাদের মধ্যে সকলের সামনে হত্যা করতে চাই, আর তার জন্য আমার প্রয়োজন তোমার সাহায্য।"

পরদিন সকালে দানবী যখন সিংহাসনে বিরাজমান, অর্ক এসে ঢোকে প্রাসাদে আর প্রনাম জানিয়ে দানবী বলে "প্রনাম, আর এই দেশটা দেখতে দেওয়ার জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।"

দানবী - "আপনি আমাদের দেশে আসার জন্য আমি যথার্থই কৃতার্থ। আশা করি আপনার আমাদের এই সাজানো সুন্দর দেশটা ভালই লেগেছে। আপনি আমার শুভেচ্ছা নেবেন, আর ফিরে গিয়ে আপনার রাজামশাইকে আমার আমন্ত্রণ জানাবেন এই দেশে আগমন করার জন্য।"

অর্ক - "ধন্যবাদ। আপনার এই দেশ সাজানো ঠিকই, তবে সুন্দর নয়। সুন্দর করার উপায় আমার জানা আছে, আর তার ব্যবস্থাই আমি এখন করব।"

এই বলে, অর্ক দানবীর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্লাকে ঈশারা করে আর নিজে ডানদিকে সরে গিয়ে ওপর থেকে ঝোলানো দড়িটা চেপে ধরে। মুহুর্তের মধ্যে বিল্লা দড়ির ফাঁসটা পরিয়ে দেয় দানবীর গলায়, আর সঙ্গে সঙ্গে অর্ক ঠিক রজতদা'র মতো করে সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়িটা টানতে থাকে। ক্ষনিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে যখন সম্বিত ফিরে পায়, দেখে তার হাতে তখনও দড়িটা শক্ত করে ধরা আছে, আর দানবীর মুন্ডুটা দুরে পরে ছটফট করছে। তাকিয়ে দেখে প্রাসাদের সবাই আনন্দে মত্ত। অর্ক চিত্কার করে ওঠে "ভো - ও - কা - ট্টা, ভোকাট্টা। দেখো রজত'দা, আমি কেমন ওই দুষ্টু দানবীকে কেটে দিয়েছি, আর আমি কিন্তু এখনো দড়ি ছাড়িনি। আমি আর কক্ষনো অমন ভুল করব না।"

অর্কর মনে পরে যায় পরীর কথা। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যায় পরীর কাছে, আর তার গলা সজোরে জড়িয়ে বলে "তুমি আর এখন বন্দী নও, তুমি মুক্ত। তোমাকে আর কেউ কোনো কষ্ট দিতে পারবে না।" পরীও অত্যন্ত আনন্দের সাথে অর্ককে জড়িয়ে ধরে, আর বলে "আজ আমি খুব খুশি। বল তুমি কি চাও আমার কাছে?" অর্ক বলে "তুমি আমাকে একটা ভালো গল্প বলে শোনাও "

দূর থেকে অর্ক শুনতে পায় কে যেন বলছে "আমি আবার কবে বন্দী ছিলাম ? আর এখন সকালে স্কুল যাবার সময় কেউ গল্প বলে বাবা ? রাত্রে ঘুমোতে যাবার সময় আজ একটা খুব ভালো গল্প বলবো। এখন তারাতারি উঠে তৈরী হয়ে নাও, নয়তো স্কুলের দেরী হয়ে যাবে।

দিলীপ ঘোষ
সিঙ্গাপুর