ঘুম নেই হরিমোহনবাবুর চোখে। সারা পাড়া ঘুমে কাদা। কেউ জেগে নেই। শুধু এইচ এম দে ছাড়া। হরিমোহন ঘড়ি দেখলেন, রাত একটা। তিনি বাথরুম গিয়ে চোখে মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা নিলেন। তারপর খোলা ছাদে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ পায়চারি করলেন যদি এতে করে ঘুম আসে। কিন্তু না ঘুম আর আসে ন।
সকালে তিনি ছুটলেন ডাক্তার পাকড়াশির কাছে। হরিমোহনকে দেখে ডাক্তারবাবু বললেন, কি হরিবাবু ওষুধে কাজ দিচ্ছে? নাকি মাত্রা একটু বাড়িয়ে দেব। হরিমোহনবাবু বললেন একটু নয় ডাক্তারবাবু বেশ কড়া ডোজ দিন। ওষুধে কোন কাজ দেয়নি। কালকেও সারারাত জেগে কাটিয়েছি। ডাক্তারবাবু হরিমোহনের নাড়ি টিপলেন, চোখ দেখলেন, জিভ দেখলেন। তারপর এক সপ্তহের কড়া ডোজ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। হরিমোহনবাবু বাড়ি ফিরে এলেন।
হরিমোহনবাবু সম্প্রতি কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। পাক্কা তেত্রিশ বছর অডিট সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত শুধু যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ-শতকরা এই নিয়ে ছিল তার কাজ কারবার। আয়ের সঙ্গে ব্যায়ের হিসেব মেলানো বড় সহজ কাজ নয়। দুটোর পাল্লা সমান করার লক্ষ্যে হরিমোহনকে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হত। সবই তিনি করতেন নিজের হাতে। পাশে রাখা ক্যালকুলেটার মেশিনটায় ঝড় উঠত। খট খট শব্দের কোন বিরাম ছিল না। বাঁধানো মোটা রেজিস্টারের প্রতি কলমে আলাদা আলাদা হিসেব। সেই হিসেব নেমে আসে পাতার একেবারে নীচে। সেই হিসেবর জের টেনে নিয়ে যেতে হয় অন্য পাতায়। এইভাবে জের টানার কোনো ইতি নেই। এক বছরের হিসেবের জের গিয়ে ওঠে নতুন বছরের রেজিস্টারে। অফিসের রেজিস্টার বদল হলেও হরিমোহনের চেয়ার বদল হয় না কোনদিন। রুটিন মাফিক কাজ করে যান তিনি। তবে তার ফাঁকে তিনি ঘন্টা দেড়েক সুন্দর ঘুমিয়ে নেন। সেই ঘুমের স্বাদই আলাদা। অনেকটা ভাত ঘুমের মত। ছুটি হলে বাসে বা ট্রেনে হাফ-ঘুম দিতে দিতে দিব্যি বাড়ি ফিরে আসেন। হাফ-ঘুম জিনিসটা বেশ মজার। হরিমোহনবাবু হয়তো বাসে বা ট্রেনে উঠে বসার জায়গা পেলেন না, তা বলে খামতি থাকবে কেন? বাসের রড ধরে চোখ বন্ধ করে আধো জেগে দোল খেতে খেতে সুন্দর করে ঘুমানো যায়। এটাই তার হাফ-ঘুম। ড্রাইভার কোন কারণে হঠাৎ ব্রেক কষলেও হরিমোহনবাবুর হাত রডের সঙ্গে সেঁটে থাকে। হাত কখনো ঘুমোয় না। বাড়ি ফিরে তিনি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন। রাতের খাবার খেয়েউঠতে না উঠতে তাঁর ঘুম পেয়ে যায়। তো সেই হরিমোহনবাবুর আজ এ কি দশা! এত সুন্দর ফুলের মত নরম ঘুমটা তার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এটা কি কম কষ্টের!
ভগীরথবাবুর বাড়িতে প্রতিদিন যে দাবার আড্ডা বসে সেটা এ পাড়ার একটা মিনি ক্লাব। ভগীরথবাবুর রাঁধুনি কাম হেল্পার ধরণী সকাল থেকে স্টোভ জ্বলিয়ে আদা দিয়ে লাল চা সাপ্লাই করে যায়। প্রথম দাবার আসর বসে সকাল আটটায়। খেলা চলে সাড়ে নটা পর্যন্ত। যাঁরা দশটা পাঁচটা অফিস করেন তাঁরা এই খেলায় অংশ নেয়। এরপর ধাপে ধাপে খেলা চলতে থাকে। হরিমোহনবাবু আগে মাঝেমধ্যে এই মিনি ক্লাবে উঁকি-ঝুঁকি মেরে গেছেন কয়েকবার। তবে এক দান যে বসে খেলেন সে সময় পাননি। আজ ভাবলেন একবার ভগীরথবাবুর বাড়ি থেকে ঘুরেই আসি।
হরিমোহনবাবুকে দেখা মাত্রই সকলে হৈ - হৈ করতে করতে দলে নিয়ে নিল। তারাশঙ্করবাবু হরিমোহনের থেকে দ-বছর আগে রিটায়ার করেছেন।তিনি বললেন, কি ভায়া এরই মধ্যে চোখের নীচে কালসিটে পড়ে গেল যে! অফিসে পাতার পর পাতা যোগ বিয়োগ করেই তো জীবন কাটিয়ে দিলেন। এবার বেশ আয়েশ করে খান আর ঘুমোন। আর মাঝ্যেমধ্যে আমাদের দর্শন দিয়ে যান। তারাশঙ্করবাবুর এই 'ঘুমোন' শব্দটা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে গেল।
লাল চা খেতে খেতে এই 'ঘুম বৃত্তান্ত' বর্ণনা করতেই সকালে দাবার চাল ভুলে তাকে নিয়েই পড়লেন। ব্যানার্জীবাবু বললেন, এ আর নতুন কথা কি? চাকরি জীবনের ইতি টানা কি সহজ কথা। একটানা কয়েক হাজার মাইল ছুটে এসে ঝট্ করে দাঁড়ানো সহজ কাজ নয়। তা একটু সময় লাগবে বৈকি। ঘুমের ব্যপার স্যাপার বোঝা অত সহজ নয়। তাকে যতই পায়ে ধরে সাধবেন ততই দূরে দূরে সরে যাবে। তার চেয়ে আমি বলি কি, একটা ফুলের বাগান করুন। মাটি কোপান, চারা বসান। বাগানের পরিচর্যা করুন। এতে শরীর ও মন দুইই ভালো থাকবে। আর মন ভালো থাকলে ঘুম যাবে কোথায়? সেও সুড় সুড় করে এসে হাজির হবে।
প্রণবেশ ভটচায একটু সেকেলে মানুষ। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় তাঁর ভরসা নেই। সব রোগের তিনি কবিরাজি ঔষধ-পথ্যের পথ বাতলে দেন। ব্যানার্জীবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন, ঘুম আছে। ঘুম আপনার কাছে পিঠেই ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। বায়ু-পিত্ত-কফ এই তিন প্রকার জিনিসের মধ্যে বায়ু যখন কুপিত হয় তখনই এই ঘুমের ব্যঘাত হয়। বায়ু ঘুমকে কাছে ঘেঁষতে দেয়না। এর দাওয়ই হল ভোরে উঠে ত্রিফলার জল খেয়ে এক ঘন্টা পরে এক চামচ মধু ও তুলসী পাতার রস সেবন করে থান্ডা জলে স্নান করবেন। তিন দিন পরে নিদ্রাদেবী হাজির হবেন।
বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় শৈলেন দাসের সঙ্গে দেখা। কি ভাবে যেন তাঁর ঘুম-কাহিনি তিনিও জেনে গেছেন। হরিমোহনকে চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা ধরিয়ে বললেন, ঘুমের সাথে মাথায় টাক পড়ার একটা সম্পর্ক আছে মাশাই। চুল একটা করে ঝরতে শুরু করলে দুশ্চিন্তায় ঘুম চলে যায়। তখন কেউ যদি বলেন মাথায় টাক পড়েছে কেন? তখন হয় বলতে হবে রাতে ঘুম হচ্ছেনা বলেই টাক পড়ছে অথবা টাক পড়ছে সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছেনা। শৈলেনবাবুর কথা শুনে হরিমোহনের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল। তিনি মাথায় একবার হাত বুলিয়ে অবশ্য অনেকটা নিশিন্ত হলেন, কেননা টাক জিনিসটা এখনো তাঁকে দর্শন দেয়নি।
বাড়িতে বসেও কি রেহাই আছে। পাড়া-প্রতিবাশীরা ঘরে এসে ঝুড়ি ঝুড়ি উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। কি করতে হবে আর কি করা চলবেনা। তার লম্বা ফিরিস্তি শুনিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে ভাত খেয়ে যেই একটু নিদ্রা দেবীর আরাধনায় বসবেন অমনি ভুপেন চক্কোতি এসে হাজির। বললেন, কি হে হরিমোহন, তুমি কি দিবা-নিদ্রার আয়োজন করছো নাকি? ভুলেও ও পথে যেও না যেন। তাহলে সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারবেনা। তারচে সারাদিন হাওয়া খেয়ে আর গল্প গুজব করে কাটানই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এই সব উপদেশ শুনে হরিমোহনবাবুর কান পচে গেছে। তিনি আর পেরে উঠছেন না। এরপর যেদিকে দু-চোখ যায় তিনি চলে যাবেন। তার ঘুম হচ্ছে না বলে পাড়া পড়শিদেরও ঘুম হচ্ছেনা এমন তো নয়। তারা তো বেশ খাচ্ছে দাচ্ছে, হরিমোহনকে দেখতে পেলেই ঘুম-বিষয়ক বিস্তর আলোচনায় ডুবে যাচ্ছে আর রাতে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে।
তো হরিমোহনবাবু সত্যি চললেন। কোথায় চলেছেন নিজেও জানেননা। লোকালয় ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে ছোট্ট একটা নদী। নদীর উপর বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা সাঁকো। হরিমোহন সাঁকোটা পেরিয়ে গেলেন। তারপর একটা গাছের নীচে বসে পড়লেন। সূর্য্য অনেকখানি পশ্চিমে ঢলেছে। বকের ঝাঁক ইংরাজির 'ভি' আকার নিয়ে পূব দিকে উড়ে যাচ্ছে। এক একটা ঝাঁকে অনেকগুলো করে বক থাকছে। রোদ পেয়ে বকের ডানা ঝিকমিক করে উঠছে। হরিমোহন প্রতিটি ঝাঁকে মোট ক-টি বক থাকছে তার হিসেব করতে লাগলেন। প্রথম ঝাঁকে মোট চৌদ্দটা বক ছিল। ঝাঁকটা দূরে মিলিয়ে যেতেই আবার এক ঝাঁক বক উড়ে এল। তিনি দ্রুত গতিতে গুনতে লাগলেন এক-দুই-তিন। মোট এগারোটি। চৌদ্দ আর এগারোর যোগ করলেন মোট পঁচিশ। যোগটা শেষ করতে না করতেই এক সঙ্গে দু-ঝাঁক বক হাজির। এই বুঝি হিসেবে ভুল হয়ে গেল। কিন্তু না, তিনি চোখ চালিয়ে সব কটাকে পাকড়াও করলেন। একটাও পালাতে পারল না। তারপর পঁচিশের সঙ্গে যোগ করে মোট বকের সংখ্যা কত হল তার হিসেব কষতে না কষতেই তাঁর মস্ত একটা হাই উঠল। তবে হাইটা তাঁর নিজের হলেও তিনি সেটা খেয়াল করলেননা। পঁচিশের পাঁচ আর উনিশের নয় যোগ করলে ডান দিকে বসল চার আর হাতে থাকে এক...। ব্যাস অঙ্কের দাওয়াই সোজা ধাক্কা মারল হরিমোহনের ব্রহ্ম তালুতে। মগজ থেকে ঘুমের বার্তা এসে গেল দ-চোখের পাতায়। তিনি ঘাড় কাত করে ঘুমে কাত হয়ে পড়লেন। ঠিক যেমনটি এতদিন অফিসের চেয়ারে বসে ঘন্টা দেড়েক সুখ-নিদ্রায় মগ্ন হয়ে যেতেন তেমনটি। হরিমোহনের মাথার উপর দিয়ে অনেক বক উড়ে যাচ্ছিল। তবে সে সবের হিসেব রাখার মত আর কেউ ছিল না।
তরুণ কুমার সরখেল
আমডিহা, পুরুলিয়া