ছেলেটির নাম ন্যাড়া । জন্ম থেকেই মাথায় একটিও চুল না থাকায় ঐ নাম । ন্যাড়া জন্মেছে গরীবের ঘরে- নুন আনতে পান্তা ফুরায় | কিন্তু ন্যাড়ার মনে লেখাপড়ার বড়ই সাধ । গ্রামের পুরোহিত জগমোহন মুখুজ্জের পাঠশালায় পড়ার জন্য ন্যাড়া কাল কথা কয়ে এসেছে। লেখাপড়া শেখার বিনিময়ে সে জগমোহনের মিষ্টির দোকান সকাল সন্ধ্যা ঝাঁট দেবে, থালা বাসন ধুয়ে দেবে। তাতে ন্যাড়ার কোনো দুঃখ নেই, একটু কাজের বিনিময়ে লেখাপড়াটাতো হবে।
আজ ন্যাড়া যাবে জগমোহনের পাঠশালায়। সকাল থেকে তোড়জোড়ের তার শেষ নেই , ছেঁড়া প্যান্টের দড়িটা কষে বেঁধে নিয়েছে , যে জামাটা সব থেকে কম ছিঁড়েছে সেটা গলিয়ে নিয়েছে, হাতে শতছিন্ন এক মাদুর আর একটা ভাঙ্গা শ্লেট আর পেনসিল-ন্যাড়া তৈরি । পাঠশালায় পৌছে ন্যাড়া হতবাক। গুরুমশাই পাটিতে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন -তার নাক দিয়ে সপ্তসুর বেজে চলেছে। গোটা দশেক ছেলে মহা উত্সাহে তাণ্ডব জুড়ে দিয়েছে, কেউ আবার গাছের পাতা, কেউ বা খড় দিয়ে গুরুমশায়ের নাকে আর কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। কিন্তু তাতে কি? ওনার নিদ্রা ভাঙ্গার কোনো লক্ষণই নেই যেনো! ন্যাড়া ভীষণ বিরক্ত হয়। এই দিনটা নিয়ে সে কত কি ভেবেছে- তার জীবনের এ এক স্মরণীয় দিন- প্রথম পাঠের প্রথম অভিজ্ঞতা - কিন্তু এ কি? ন্যাড়া আর স্থির থাকতে পারে না । পাশের কলতলা থেকে এক বালতি জল নিয়ে গুরুমশায়ের মুখের ওপর ঢেলে দেয়- ব্যাস আর যায় কোথায় - ধড়মড় করে উঠে বসেন জগমোহন মুখুজ্জে - মুখে একরাশ ক্রোধ, বিরক্তি আর বিস্ময় ! ন্যাড়া এক্কেবারে চুপ, কিন্তু সহপাঠীরা তারস্বরে তার দিকে আঙুল তুলে বলে ওঠে," ওই যে ঐ ছেলেটা " । ন্যাড়া চোখে সর্ষে ফুল দেখে। দশাসই চেহারা নিয়ে গণ্ডারের মত ঘোত ঘোত করতে করতে মুখুজ্জে পুরুত ন্যাড়ার দিকে ধেয়ে যায়- কিন্তু ঈশ্বর সহায়, ঠিক সেই সময়েই দুজন লোক হন্তদন্ত হয়ে ওখানে পৌছায়, আর মুখুজ্জেকে বলে যে জমিদারবাবু জরুরি তলব পাঠিয়েছেন - সেই সকাল থেকে মা মঙ্গল চণ্ডীর পুজোর জোগাড় করে উনি বসে আছেন সেতো প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল, অথচ পুরুতমশায়ের দেখা নেই, কি হোলো? এত ভুলো মন হোলে তো চলবে না, পৌরহিত্য থেকে বরখাস্ত করে দেবেন বলেছেন। জগমোহন যেনো কেঁচোর মত গুটিয়ে যায়, হলুদ ছোপ ধরা দাঁত দুটো বের করে বলে ওঠে," ভাগ্যিস ছোড়াটা আমার গায়ে জল ঢেলেছিল , নইলে আমার এই কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গানো কার সাধ্যি ছিল! "
এর পরের কহিনী আরও মনোরম। ন্যাড়া প্লেটে জগমোহনের দেওয়া চারটে রাজভোগ নিয়ে পরম তৃপ্তির সাথে খেতে থাকে, আর বাকি সহপাঠীদের মুখ হাঁ হয়ে থাকে। ন্যাড়ার ঠোঁট বেয়ে রাজভোগের রস গড়ায়, আর বাকিদের ঠোঁট বেয়ে গড়ায় নোলার জল!
নীনা ঘোষ দস্তিদার
আই. আই. টি. খড়্গপুর