খেলাঘরখেলাঘর

অচিনপুরের কল্পকথা

অচিনপুর গ্রামটাকে ম্যাপে খুঁজলে পাওয়া যাবে না – ছোট্ট নদী রঙ্গিনীর একটা বড় বাঁকের মধ্যে প্রায় লুকিয়ে আছে যেন রঙ্গিনী গ্রামটাকে নিজের বুকের মধ্যে ‘সাত রাজার ধন এক মানিকের’ মত আগলে রেখেছে। গ্রামের তিন দিক দিয়ে বয়ে চলেছে রঙ্গিনী তবে যত বর্ষাই হোক না কেন গ্রামকে কখনই ভাসিয়ে নিয়ে যায় না বরং মাটিকে সমস্ত বছর সরস রেখে গ্রামকে ফলে, ফুলে, ফসলে ভরিয়ে রাখে। তাই তো গ্রামের পঞ্চাশ খানেক ঘরের লোকের মুখে সব সময়ই হাসি – সারা দিন মাঠে খেটে ওরা সোনার ফসল তোলে। এছাড়াও চাষ হয় আখ, নানা রকমের ডাল ও সব্জির। গরু, মোষ, ছাগলরাও নদীর ধারের নরম সবুজ ঘাস খেয়ে বেশ নধর চেহারার তাই দুধ ঘির অভাব নেই। রঙ্গিনীর ওপাড়ে বসতি নেই - বেশ ঘন জঙ্গল কারণ বর্ষাতে ওদিকটা প্রায় প্রত্যেক বছর ডুবে যায়। গ্রামের অন্য দিকে অনেক দূর অবধি চাষের জমি তারপর জঙ্গলা নাবাল - এদিকে সব থেকে কাছের গ্রাম প্রায় দশ মাইল দূরে। একটা ঘাসে ঢাকা মাটির রাস্তা ধান ক্ষেতের ধার দিয়ে ঘুরে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছে ওই গ্রামের দিকে তবে লোকে জমির আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়াই পছন্দ করে কারণ তাতে রাস্তা মাইল দুয়েক কমে যায়।
এই রকমের সুখী গ্রামে নিয়ম মত সব রকমের লোকই আছে – আছেন জমিদার হিমাংশু লাহিড়ী বা ছোটবাবু। প্রায় দুশো বছরের পুরাতন জমিদার বাড়ি তো এখন ধ্বংস স্তুপ তাই থাকেন মোটামুটি একটা নতুন অংশে যেটা পরে বানানো হয়েছিলো আত্মীয় স্বজনদের থাকার জন্য তবে তাতেও অনেক জায়গাতে ফাটল ধরেছে, দেওয়ালের নানা জায়গায় বট গাছ, অস্বত্থ গাছ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। এখন তো আর জমিদারিও নেই তাই রোজগারও নেই – বাড়ি সারাই হবে কোথা থেকে! জমিদার বাড়ির সব সম্পত্তি গিয়ে হিমাংশুর আছে শুধু দাদুর আমলের এক বিশাল পালঙ্ক যাতে জনা ছয়েক লোক আরামে ঘুমাতে পারে। বার্মা থেকে সব থেকে ভালো সেগুন কাঠ আনিয়ে বানানো – চারটে পায়া যেন হাতির পা আর সমস্ত পালঙ্কে সূক্ষ্ণ কারুকার্য্য দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। যেমনি বড় তেমনি ভারি – চার / পাঁচ জন জোয়ান লোকের পক্ষেও নাড়ানো প্রায় অসম্ভব – তার উপরে প্রায় এক হাত মোটা গদি। মনে হয় দাদুরা পুরাতন বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে আসার পর এই ঘরের মধ্যেই পালঙ্কটা বানানো হয়। এছাড়া লাইব্রেরি বহু পুরাতন বইতে ঠাসা - এটা হিমাংশুর খুবই প্রিয় এবং রোজই কয়েক ঘন্টা কেটে যায় এখানে তবে বই গুলোকে পোকার হাত থেকে বাঁচাতে হিমসিম খেতে হয়। ধীরে ধীরে সমস্ত পুরাতন কাজের লোক এক এক করে চলে গিয়ে শুধু বিষ্টুকাকাই রয়ে গিয়েছে প্রাণের টানে - ওই হিমাংশুর দেখা শোনা করে।
গ্রামে আছে পর নিন্দা পর চর্চা করার জন্য অকর্মণ্য বুড়োদের দল যারা সারাদিন গ্রামের শিব মন্দিরের চাতালে বসে থেলো হুঁকোতে তামাক খেতে খেতে আর না হলে আফিমের মৌতাতে ঢুলতে ঢুলতে গ্রামের কার বাড়িতে কি হলো সেই সব হাঁড়ির খবর অথবা নিজেদের বাড়িতে বৌমারা কি রকম ঝগড়াটে এই ধরনের আলোচনায় ব্যস্ত থাকে। আছেন পূজারী নরহরি চক্কোত্তি, নায়েব শ্রীপদ সরকার, পাঠশালার পণ্ডিত সুদাম রায় – এরা যদিও বংশ পরম্পরা জমিদারের চাকুরে – এখনও মাসে দশ পনের টাকা মাসোহারা পান তবে তাতে তো আর সংসার চলে না তাই বাইরের কাজও করেন। জমিদার বাড়ির শিব মন্দির হলো পূজারী ঠাকুরের প্রধান দায়িত্ব এছাড়াও গ্রামের অন্যান্য বাড়িতে পূজো আচ্চা ইত্যাদি করে রোজগার খারাপ হয় না। সুদাম রায়ের একটা মনোহারী দোকান আছে - সেটার দেখা শোনা করতে করতে পাঠশালা সামলান। এমন কি আছে এক চোর শম্ভু যার ত্রিসংসারে আর কেউ নেই – থাকে এক ভেঙ্গে পড়া খড়ের বাড়ির দাওয়াতেই। বাবার কাছ থেকে সিঁধ কাটাও শিখতে পারে নি তাই রাত্রে গ্রামের লোকের ঘটি বাটি ইত্যাদি বাইরে পড়ে থাকলে তাই নিয়ে সটকে পড়ে তবে ওকে পেট ভরে খেতে দিলে সাথে সাথে জিনিষ ফেরৎ। যেদিন কিছুই জোটে না সেদিন বিষ্টুকাকাই শেষ ভরসা – এক থালা পান্তা ভাত দুটো কাঁচা লঙ্কা দিয়ে সাঁটিয়ে টেনে ঘুম। আর আছে বিল্টু যাকে পণ্ডিত মশাই বছর চারেক চেষ্টা করেও অ, আ, ক, খ শেখাতে না পেরে বলেছিলেন,
‘তোর মত গন্ড মুর্খের দ্বারা কিচ্ছু হবে না – যা মাঠে ঘাটে চরে বেড়া।’
সেই থেকে বিল্টু সারাদিনই গ্রামের মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, গ্রামের লোকের গরু, ছাগল চরায় আর নানা ফাই-ফরমাস খাটে। থাকার মধ্যে ওর আছে একটা ভাঙ্গা ঘর যার দরজার আদ্ধেক পাল্লা নেই আর জানালা কখনই বন্ধ হয় না। সেটা নিয়ে অবশ্য বিল্টুর মাথা ব্যথা নেই – একা মানুষ, কোন রকমে রাত্রে মাথা গুঁজতে পারলেই হলো আর গ্রামের লোকের ফাই-ফরমাস খেটে খাওয়াটা এদিক ওদিক হয়েই যায়। নায়েব শ্রীপদ সরকারের মেয়ে সরলা বা সরু গ্রামের সব থেকে বেশী পড়াশুনা জানা মেয়ে – পাঠশালা পাশ করে ছোটবাবুর অবৈতনিক স্কুলে সাত ক্লাস অবধি পড়েছে। ভীষণ ডাকাবুকো মেয়ে – ভয় ডরটা নেই বললেই হয় - বাজি ধরে রাত্রে শ্মশান অবধি ঘুরে এসেছে। শম্ভু একবার ওদের বালতি বাইরে পড়েছিলো বলে সেটা নিয়ে পালিয়েছিলো - সরু আঁস বঁটি নিয়ে ওকে গ্রামের সীমানা অবধি তাড়া করে বালতি আদায় করে ছেড়েছিলো। তারপর থেকে শম্ভু ওদের বাড়ির ত্রিসীমানাতে পা দেয় না।
ছোটবাবুর বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে – ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছিলেন। বাবা প্রয়াত জমিদার সুধাংশু শেখর লাহিড়ী মশাই পাঠিয়েছিলেন বড় শহরে পড়াশুনা করতে তবে পড়াশুনার থেকেও বেশী নেশা ধরে গেলো গান বাজনা ও শরীর চর্চার। রক্তে ছিলো বলে দুটোই খুব ভালো ভাবে শিখলেন ফলে পড়াশুনাতে টেনে টুনে বিএ পাশটাই হলো। তারপর বাবার শরীর ভালো নেই বলে গ্রামে ফিরে আসতে হয়। রোজ নিয়ম করে কাক ভোরে উঠে বাড়ির ছাতে যোগাসন ও ব্যায়াম করেন, মুগুর ভাজেন। তারপর ছাতে পায়চারি করতে করতে উদাত্ত গলায় গান গাইতে থাকেন - ছোটবাবুর গান শুনেই গ্রামের লোক বিছানা ছাড়ে। রোজ সকালেই ওর প্রিয় ঘোড়া শ্বেতাতে চড়ে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে – শ্বেতার রাস্তা ঘাট একেবারে মুখস্ত তাই জমির আল ধরে যেতে কোন অসুবিধা হয় না – যেতে যেতে দেখেন কার জমিতে কেমন ফসল হচ্ছে, কে কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, এই সব। বিকেলে চওড়া পাড়ের ধুতির কোঁচা বাঁ হাতে নিয়ে পিরান পরে ডান হাতে চন্দন কাঠের কাজ করা লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ান সমস্ত গ্রামে – দাদু, জেঠা, খুড়ো সবার খোঁজ খবর নেন ফলে গ্রামের লোকের সাথে ছোটবাবুর একটা আত্বিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। জমিদারি না থাকলে কি হলো গ্রামের রক্ষাণাবেক্ষনের দায়িত্বটা নিজের ঘাড়েই রেখেছেন।
কোথাও এই রকম জমিদার বাড়ির ধ্বংস স্তুপ থাকলে যেমন আপনা থেকেই গুপ্তধনের গল্প ছড়ায় অচিনপুরেও তাই। কেউ বলে ওই ধ্বংস স্তুপের ভেতরে এক বিরাট কাল কেউটে সেই গুপ্তধন আগলে রেখেছে আবার কেউ বলে শিব মন্দিরের ভেতরেই আছে সেই গুপ্তধন আর ওখানে হাত দেওয়া মানেই শিব ঠাকুরের রোষে পড়তে হবে। আবার অনেকের মতে মাটির নিচে লুকানো একটা ঘরে সেটা আছে আর সেখানে একজনকে রেখে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিলো সেই যক্ষ হয়ে ওটা পাহারা দিচ্ছে। এর কোনটাই সাধারণ গ্রামের লোককে গুপ্তধন খোঁজার ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহিত করে নি। হিমাংশু এ ব্যাপারে ওদের বাড়ির পুরাতন লোক মানে বিষ্টুকাকা, পূজারী ঠাকুর নরহরি চক্কোত্তি আর নায়েব মশাই শ্রীপদ সরকারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কিন্তু সবারই বক্তব্য হলো ওরাও শুনেছেন তবে এর বেশী জানেন না। তবে নরহরি চক্কোত্তি সবার আড়ালে শিব মন্দির তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গুপ্তধনের কোন হদিশ পান নি। এই গুপ্তধন গল্পের ধোঁয়া নিয়ম মতই অচিনপুর ছাড়িয়ে আশেপাশের গ্রাম ও শহরেও ছড়িয়েছে আর একে উড়ো খবর বলে কেউ পাত্তা না দিলেও শহরের বিশে গুন্ডাকে ভাবিয়েছে - প্রায় বিনা পরিশ্রমে যদি এই রকম একটা বিরাট দাঁও মারা যায় তবে তো বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তাই দুই সাকরেদকে পাঠিয়ে দিলো গ্রামে একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে তারপর বাকিদের নিয়ে ও নিজেই আসবে।
সেদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে দূর থেকে হিমাংশুর নজরে এলো ওদের ভাঙ্গা বাড়ির সিংদরজার কাছে দুটো লোক কেমন যেন ঘুর ঘুর করছে – এক নজরেই বোঝা গেলো এরা বাইরের লোক কারণ এদের চেহারা, চাল চলন, পোষাক অন্য ধরনের।
‘এই, তোরা কে রে? এখানে ঘুর ঘুর করিস কেন?’
মনে হলো লোক দুটো ওর কথার কোন পাত্তাই দিলো না। এবার হিমাংশু রেগেই গেলেন।
‘বলি কথা কি কানে যায় না? কান পট্টি দিতে হবে নাকি?’
দুজনের মধ্যে বেটে গাট্টা গোট্টা গলায় লাল রুমাল বাঁধা ছেলেটা তেড়িয়া ভাবে জবাব দিলো,
‘আরেঃ ছোঃ, তুমি কে হে যে উত্তর দিতে হবে? মানে মানে নিজের কাজে যাও, নয়তো - -’
হিমাংশু একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন – অচিনপুরের চৌহদ্দির মধ্যে কেউ এ ধরনের কথা বালার সাহস রাখে না। এগিয়ে এসে সপাটে ছেলেটার গালে এক থাপ্পড় মারতে ছেলেটা ছিটকে পড়লো রাস্তার ধারে। সঙ্গের রোগা লম্বা ছেলেটা সাথে সাথে পকেট থেকে একটা ছুরি বের করতেই হিমাংশুর লাঠের এক ঘায়ে সেটা উড়ে গেলো। বেঁটে ছেলেটা কোন রকমে উঠে টলতে টলতে প্রায় দৌড়ালো আর লম্বাটা আরো গোটা কয়েক লাঠি খেয়ে ‘ওরে বাবারে’ বলে দৌড় দিতেই হিমাংশু দেখেন কখন বিল্টু এসে হাজির হয়েছে।
‘এই বিল্টু, গ্রামের লোক নিয়ে ছোড়া দুটোকে ঢেলা মারতে মারতে তাড়িয়ে গ্রামের বাইরে করে দে তো – কোথা থেকে এসেছে নচ্ছার দুটো কে জানে। আর শোন, আধ ঘন্টা পরে গ্রামের সবাইকে চণ্ডী মন্ডপে আসতে বলিস।’
চণ্ডী মন্ডপে সবাই জমায়েত হলে হিমাংশু বিকেলের ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে বললেন,
‘এই গ্রামে বাইরের গুন্ডা আসার ঘটনা এর আগে হয় নি তাই মনে হচ্ছে এটা একটু চিন্তার ব্যাপার। এরা কেন এলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না – হয়তো আবার আসবে সেই জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তোমাদের কি মনে হয় এদের আসার কারণ?’
কারুর কাছ থেকেই কোন উত্তর না আসাতে হঠাৎ সরু গলা বাড়ালো,
‘ছোটবাবু, এরা তো আমাদের গ্রামে বেড়াতে আসে নি – নিশ্চয়ই কোন লোভে এসেছে। অচিনপুরে লোভ করার বা টাকা পয়সার কি আছে বলো? তবে গুপ্তধনের গুজবের খোঁজ খবর নিতে আসে নি তো? তাহলে কিন্তু আপনার কাছে মার খাওয়ার পর আরো দলবল নিয়ে আসতে পারে – এক ওই গুপ্তধন আর দুই আপনার মারের শোধ নেওয়া।’
‘তুই ঠিক বলেছিস সরু – আমারও তাই মনে হয়। আমাদের তা হলে দিন রাত পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার মনে হয় দিনের বেলা বিল্টু তো গ্রামের মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, ওই গ্রামে ঢোকার রাস্তার দিকে নজর রাখুক আর রাত্রে - -’
বলে একটু মুচকি হেসে শম্ভুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কিরে শম্ভু, তোর তো রাত্রেরই কারবার আর অন্ধকারে তুই বোধ হয় বেড়ালের মত দেখতে পাস, তোর চলাফেরাও তো বেড়ালের মত নিঃশব্দে – রাত্রের পাহারাটা তুইই দে – কারুর বাড়ি থেকে কিছু নিতে হবে না। দুবেলা আমার সাথে খাওয়া দাওয়া করবি আর ভোর বেলা আমাকে খবর দিবি। আর তোমরা সবাই যে যার বাড়িতে লাঠি, সড়কি যাই থাক সেগুলো তৈরি রাখো। রফিক চাচা তোমার বন্দুকটা পরিষ্কার করে নদীর ধারে দু চারটে পাখী মেরে দেখো ঠিক আছে কিনা। বিল্টু বা শম্ভু কোন খবর দিলে সবাই মিলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে আমার মনে হয় ওরা এলে রাত্রেই আসবে সবার অজান্তে।’
দু দিন দু রাত্রি বিল্টু কিংবা শম্ভুর কাছ থেকে কোন খবর আসে নি। এর মধ্যে হিমাংশু ওদের বহু পুরাতন দোনলা বন্দুকটা তেল দিয়ে ঠিক ঠাক করেছেন। রোজ রাত্রেই দোতলার ছাতে ঘুরে বেড়ান কারণ ওখান থেকে অনেক দূর অবধি কোন আলো জ্বলছে কিনা দেখা যায়। শ্রীপদ সরকার ওদের পূর্ব পুরুষের পাওয়া সেই তলোয়ারটা ঘষে মেজে চকচকে করে নিয়েছেন। রফিক মিঞার বয়স প্রায় সত্তরের কাছে তবুও মহা উৎসাহে বন্দুকটা ঘাড়ে করে গ্রামের রাস্তায় মিলিটারি কায়দায় প্যারেড করেন।
দিনের বেলা হিমাংশু নিয়ম মতই লাইব্রেরিতে সময় কাটান। সেদিন আলমারির বই গুলোকে ঝাড় পোঁছ করে তুলে রাখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত বইএর দিকে নজর গেলো – যেন সব কটা পাতাই চট লেগে গিয়েছে। একটু টানাটানি করতেই বইটা মাঝখান থেকে খুলে যেতে হিমাংশু দেখেন বইএর পাতা গুলোর মাঝ খানটা কেটে বের করে নিয়ে তার মধ্যে একটা ছোট্ট সুন্দর ডায়েরি ঢোকানো। হিমাংশ শিউরে উঠলেন – তাহলে কি সত্যিই গুপ্তধন আছে আর এই ডায়েরিতেই তার সন্ধান দেওয়া আছে না হলে ডায়েরিটাকে এ ভাবে লুকিয়ে রাখার মানে কি? ডায়েরিটা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে পালঙ্কের ওপর বসে ধীরে ধীরে খুললেন – সমস্ত পাতাই খালি শুধু মাঝ খানের পাতায় অদ্ভূত একটা কবিতা বা ছড়া - হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে এটা বাবারই লেখা।
কালাপানির ওধারেতে
গহীন নদীর ওপাড়েতে
মস্ত এক জঙ্গল হতে
চার পেয়ে এক বস্তু এলো।
টিকির টিকির টিক।।
গ্যাঁট হয়ে সে বসলো চেপে
ছয় জোয়ানে নাড়তে নারে।
হ্যাঁইও হো হ্যাঁইও।।
তোমরা সবাই খুঁজছো যারে
সে আছে তার পাহারাতে
বুদ্ধি তোমার খাটো যে তাই
ঘুরে বেড়াও খান্ডারেতে।
বকম বকম বক।।
বার কয়েক পড়েও হিমাংশু এটার কোন মানে পেলেন না – বাবা সত্যিই ধাঁধাঁ জানত তাই এ রকম এক কিম্ভূত কবিতা লিখেছে। শেষ প্যারাটা বুঝতে কোন অসুবিধা হলো না – গুপ্তধন ওই চার পেয়ে বস্তুর পাহারাতেই আছে আর সেটা খান্ডার মানে পুরাতন বাড়ির ধ্বংস স্তুপে নেই। দ্বিতীয় প্যারাটাও মোটামুটি বোঝা গেলো – ওই চার পেয়ে বস্তুটা প্রচণ্ড ভারী যাকে ছয় জন জোয়ানেও নাড়াতে পারে না – তাহলে কোথায় সেটা আর বস্তুটাই বা কি? অনেক ক্ষণ চিন্তা করে প্রথম প্যারার মানে বের করতে না পেরে হিমাংশু বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লেন। নাঃ, এটাকে ঠাণ্ডা মাথায় পরে চিন্তা করতে হবে। দ্বিতীয় দিন আবার ধীরে ধীরে ছড়াটা পড়লেন – কালাপানি মানে বোধহয় বঙ্গোপসাগর – আগে তো লোকে তাই বলতো। তাহলে কালাপানির ওধারেতে মানে কি আন্দামান – নাঃ, আন্দামানে তো গহীন নদী নেই। তাহলে? - - তাহলে কি বার্মার দিকে? এইবার হিমাংশু লাফিয়ে উঠলেন – বার্মার ইরাবতী নদীই হবে। তার মানে ওই চার পেয়ে বস্তুটা এসেছে বার্মার ইরাবতী নদীর ওপাড়ের জঙ্গল থেকে – তাহলে কি সেটা?? বার্মার জঙ্গলের কি বিখ্যাত? তাছাড়া শেষ লাইনটাও অদ্ভূত ‘টিকির টিকির টিক’ – এটাতো ছড়ার লাইন মেলানো নয় – তাহলে নিশ্চয়ই এর কোন মানে আছে। এই টিকির টিকির টিক হিমাংশুর মাথায় টিকটিক করতে লাগলো।
তৃতীয় দিন প্রায় মাঝ রাত্রে ছায়ার মধ্যে গা মিশিয়ে শম্ভু হাজির হলো অন্ধকারে - হিমাংশু চমকে উঠলেন।
‘ছোটবাবু, পাঁচ জন লোক এসেছে – তার মধ্যে একজনকে ভ্যান রিক্সাতে বসিয়ে ঠেলে ঠেলে এনেছে তার মানে ওই হয়তো নেতা। ওরা এখন আপনাদের ভাঙ্গা বাড়ির সিংদরজার পাশের একটা ছোট ঘরে আছে। সঙ্গে মনে হয় জিনিষ পত্রও আছে।’
হিমাংশু ছাতে উঠে দেখেন সত্যিই ওখানে একটা আলোর রেশ দেখা যাচ্ছে - একটু সময় চিন্তা করলেন।
‘শোন শম্ভু, তুই ওই ঘরের পাশে মটকা মেরে ওদের কথা বার্তা শোন। ওদের কি উদ্দেশ্য আর বন্দুক টন্দুক কিছু আছে কিনা জানা দরকার। কাল সকালে সব জেনে তারপর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। মনে হয় কয়েক দিন থাকার ব্যবস্থা নিয়েই এসেছে – আগের ওই দুই ছোঁড়াই ঘর টর পরিষ্কার করে গিয়েছে’।
পর দিন সকালে শম্ভু জানালো ওদের নেতার কাছে একটা রিভলবার আছে আর সেটা দিয়ে কটা খুন করেছে তার খুব গর্ব করছিলো। ওদের উদ্দেশ্য আজ রাত্রে এসে আপনাকে ধরবে তার কারণ দুটো – এক তো মার খেয়ে আপনি গুপ্তধনের হদিশ দিয়ে দেবেন আর দুই হলো সেদিন ওর দুই সাগরেদকে মারধোর করার শোধ তোলাও হবে। হিমাংশু বললেন,
‘হুঁ, তুই এক কাজ কর – বিল্টুকে বল দুপুরে গ্রামের সবাইকে চণ্ডী মন্ডপে আসতে।’
হিমাংশু পালঙ্কে বসে বালিসটা কোলের ওপর নিয়ে একটা কাগজে ছক করতে শুরু করলেন কি করে রাত্রে এই গুন্ডাদের মোকাবিলা করা যায়। লিখতে লিখতে আনমনে পালঙ্কের সূক্ষ্ণ কারু কাজের ওপর হাত বোলাচ্ছিলেন – এত সুন্দর কাজ তো এক মাত্র সেগুন কাঠের ওপরই করা যায়। মনে হতে হঠাৎ লাফিয়ে প্রায় মাটিতেই পড়ে যাচ্ছিলেন – সেগুন কাঠ মানে তো ইংরেজিতে টিক – সেই টিকির টিকির টিকের ‘টিক বা সেগুন কাঠ’ - তার মানে চার পেয়ে বস্তুটা সেগুন কাঠের তৈরি আর সেই কাঠ এসেছে বার্মার ইরাবতী নদীর ওপাড়ের জঙ্গল থেকে যেখানকার সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত আর এটা এত ভারি যে ছয় জন জোয়ানেও তুলতে পারে না। আরেঃ এই খাটও তো তাই আর এরও তো চারটে পায়া আছে। হিমাংশু উত্তেজনাতে খাট থেকে নেমে পড়লেন – তার মানে গুপ্তধন এই খাটের তলাতেই আছে। খাটের তলায় উঁকি দিয়ে অবশ্য কিছুই দেখতে পেলেন না আর ওর একার পক্ষে এই খাট নাড়ানো অসম্ভব।
দুপুরে চণ্ডী মন্ডপে সবাই জমায়েত হলে হিমাংশু বললেন,
‘তোমরা তো শুনেছো পাঁচটা লোক গতকাল রাত্রে গ্রামে এসেছে – আজ রাত্রে ওরা আসবে গুপ্তধনের খোঁজ নেওয়ার জন্য আমাকে ধরতে। আমার প্ল্যানটা শুনে তারপর তোমাদের মতামত দিও। দু তিন জনের গোটা ছয়েক দল পুরাতন জমিদার বাড়ির সামনের রাস্তার আশে পাশে লাঠি, সড়কি নিয়ে লুকিয়ে থাকবে গাছের আড়ালে। ওদের নেতার কাছে রিভলভার আছে সেই জন্য খুব সাবধান – আমার আওয়াজ না পেলে একেবারেই বেরুবে না। আমি বন্দুক নিয়ে রাস্তার বাঁ দিকটা দেখবো আর রফিক চাচা তুমি ডান দিকটা তবে তোমার সাথে আর কাউকে নিয়ে নিও সাহায্যের জন্য। দেখা যাক এই ফাঁদে ব্যাটারা ধরা পড়ে কিনা তবে ওই নেতাকেই প্রথমেই কাবু করতে হবে - দরকার না হলে কাউকে জখম করো না। শম্ভুর কাজ হবে নিঃশব্দে ওই লোক গুলোর ওপর নজর রাখা আর ও তো খুব ভালো প্যাঁচার ডাক ডাকতে পারে তাই ওরা বেরুলেই তিন বার শম্ভু প্যাঁচা ডেকে উঠবে।’
হিমাংশুর কথা শেষ হতেই সরু লাফিয়ে উঠলো,
‘ছোটবাবু, আমি রফিক নানার সাথে থাকবো।’
নায়েব মশাই কিছু বলতে যেতেই হিমাংশু থামিয়ে দিলো,
‘নায়েব মশাই ভয় পাবেন না – গ্রামে সরুর মত সাহসী মেয়ে আর নেই আর ওর উপস্থিত বুদ্ধিও খুব। রফিক চাচার সাথে ওর তো খুব ভাব ওরা ঠিক ম্যানেজ করে নেবে।’
হিমাংশুর কথা মত ছটা দল রাত্রের খাওয়া দাওয়ার পর রাস্তার দুধারের গাছের আড়ালে চুপচাপ গা ঢাকা দিয়ে বসলো। রফিক মিঞা গুলি ভরা বন্দুক নিয়ে সরুর সাথে রাস্তার ডান দিকে একটা খেজুর গাছের পেছনে বসলেন – সামনে রাস্তার এক পাশে বাঁশ বন আর অন্য দিকে বড় বড় গোটা কয়েক নারকেল গাছ। এর মধ্যে বিকেলেই সরু বন্দুকের ব্যাপারটা রফিক নানার কাছে বুঝে নিয়েছে। গ্রামের বাকি লোক জন উদগ্রীব হয়ে চণ্ডী মন্ডপে জেগে বসে আছে কি হয় জানার জন্য। সময় বয়ে চলেছে কিন্তু শম্ভু প্যাঁচা আর ডাকে না – যারা লুকিয়ে ছিলো এত সময় ধরে বসে থাকাতে হাতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে উসখুস করতে শুরু করেছে – রাজ্যের মশাও ছেঁকে ধরেছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর হঠাৎ শম্ভু প্যাঁচা ডেকে উঠতেই সবাই লাঠি সড়কি শক্ত করে ধরে টান টান হয়ে বসলো। হঠাৎ সরু দেখে রফিক নানা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছে – সরু আস্তে করে কনুইএর গোত্তা দিতেই নানা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘ওরে সরু, আমি পারবো নি রে – আমার শরীর যে কাঁপে। চল বাড়ি যাই।’
সরু ওর হাত চেপে ফিসফিস করে বললো,
‘আরে নানা ভয় পেও না – আমি তো আছি। শক্ত হয়ে বসো তো।’
একটু পরেই দেখা গেলো গুন্ডাদের দলটা এদিকেই আসছে – দেখেই তো রফিক মিঞার দাঁতে দাঁতে ঠকঠকানি শুরু হয়ে গিয়েছে – সরু ওকে রীতিমত চেপে রেখেছে না হলে বুড়ো হয়তো উঠে দৌড় দেবে আর তা হলে সমস্ত ব্যাপারটাই ভেস্তে যাবে। ওরা নারকেল গাছের কাছে আসতে সরু নানাকে খোঁচালো,
‘নানা, আকাশে গুলি করো তাড়াতাড়ি।’
নানাকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সরু তাড়াতাড়ি বন্দুকটা তুলে নিলো। উত্তেজনাতে হাত একটু কাঁপছে সেটা গুন্ডাদের দেখে না জীবনে প্রথম বন্দুক হাতে নিয়ে তা নিজেই জানে না। তবুও বন্দুকটাকে শক্ত করে ধরে ঘাড়ে নিয়েই ‘গুড়ুম’ আর বন্দুকের ধাক্কাতে সরু পেছন দিকে গড়িয়ে একেবারে রাস্তার ধারে ঝোপের মধ্যে। ওদিকে বন্দুকের গুলিটা গিয়ে লেগেছে নারকেল গাছে আর গুলির ঘায়ে গোটা দুয়েক বড় নারকেল পড়বি তো পড় একেবারে বিশে গুন্ডার মাথায় ও পিঠে। ‘ওরে বাবারে’ বলে সে তো চিৎপাত আর হাতের রিভলভার ছিটকে গিয়ে পড়েছে জঙ্গলে। এদিকে গুলির আওয়াজ পেয়েই হিমাংশু ওদিক থেকে আকাশের দিকে গুলি করে চিৎকার করে উঠলেন,
‘ধর, ধর, ব্যাটাদের চেপে ধর।’
দুদিক থেকে বন্দুকের আওয়াজে আর নেতাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে গুন্ডাদের সব সাহস নিমেষে উবে গিয়েছে। হিমাংশুর চিৎকার শুনে সব কটা দল একেবারে রে রে করে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দমাদম পেটাতে শুরু করলো – হিমাংশু দৌড়ে এসে ওদের থামালেন,
‘ওরে আর মারিস না – দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে হাত পা বেঁধে চ্যাংদোলা করে চণ্ডী মণ্ডপে নিয়ে যা। আরে, রফিক চাচা গুলি চালিয়ে কোথায় গেলো দেখতো?’
ওদের আওয়াজ পেয়ে সরু উত্তর দিলো,
‘ছোটবাবু, আমি কাঁটাঝোপে আটকে গিয়েছি – উঠতে পারছি না।’
হিমাংশু তাড়াতাড়ি গিয়ে সরুকে বন্দুক সহ টেনে বের করলেন কাঁটা ঝোপ থেকে তারপর দেখেন রফিক মিঞা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। সবাই মিলে চণ্ডী মণ্ডপে ফিরে আসতে গ্রামের লোক একেবারে হৈ হৈ করে চারদিক থেকে হ্যারিকেন, পেট্রোম্যাক্স নিয়ে এসে হাজির – রফিক মিঞার মুখে জলের ঝাপটা দিতে বুড়ো ধীরে ধীরে উঠে বসে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিলেন। হিমাংশু ওই পাঁচটা লোককে চণ্ডী মণ্ডপের খুঁটির সাথে ভালো করে বাঁধতে বলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘আমাদের সরু আজকে কেল্লা ফতে করে দিয়েছে। ও বন্দুক না চালালে ব্যাপারটা খুব গোলমেলে হয়ে যেতো। এই গুণ্ডাদের কাল সকালে ওদেরই ভ্যান রিক্সাতে বেঁধে আমি নিজেই নিয়ে যাবো পাশের গ্রামের থানাতে। আর একটা কথা – গুপ্তধনের খবরটা গুজব নয় – এটার হদিশ আমি আজই পেয়েছি। কালকে থানা থেকে ফেরার পর তোমরা আমার বাড়িতে এসো – ওখানে সবার সামনেই আমরা ওটাকে বের করবো তারপর ঠিক করা যাবে ওই গুপ্তধনের কি ব্যবস্থা করা যায়।’
শুনেই সবাই চমকে উঠেছে – চার দিকে উত্তেজনাতে ফিসফিসানি থেকে একেবারে হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। হিমাংশু ভাবলেন, আজ রাত্রে গ্রামের কারুরই ঘুম হবে না - ওর নিজেরও নয় - এত বছর ধরে নিজে ওই গুপ্তধনের ওপর চেপে বসে ছিলেন ভাবতেই কেমন লাগছে।
পর দিন ভোর বেলা পাঁচ গুণ্ডাকে ভ্যান রিক্সাতে শুইয়ে ভালো করে বেঁধে বিল্টু চালিয়ে নিয়ে গেলো আর পেছন পেছন হিমাংশু শ্বেতাতে চেপে চললেন পাশের গ্রামের থানাতে। ফিরে আসতে প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে – দেখেন ওর বাড়িতে পুরো গ্রামের লোকে একেবারে গিস গিস করছে। গ্রামের সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ – এমন কি বাড়ির বৌ ঝিরা পর্য্যন্ত রান্না বান্না ছেড়ে চলে এসেছে - বিরাট হৈ হট্টগোল চারদিকে। এদিকে রাতারাতি নানা রকম গল্প চালু হয়ে গিয়েছে গুপ্তধনের পরিমাণ নিয়ে – কেউ বলছে এক সিন্দুক হীরে মুক্তো আছে আবার কেউ বলছে, না রেঃ, এক সিন্দুক বাদশাহী মোহর আছে। মোহরের সপক্ষের লোকেরা আরো আশা করছে যে ছোটবাবু যে রকম দয়ালু লোক তাতে গ্রামের সব বাড়িতে একটা করে মোহর তো দেবেনই। আবার মহিলাদের মধ্যে আলোচনা চলেছে যে এক সিন্দুক অলঙ্কার আছে আর তা থেকে সবাই ভাগ পাবে। ঘোড়া থেকে নেমে হিমাংশু চেঁচিয়ে উঠলেন,
‘আরেঃ, বাড়িটাকে তো মাছের বাজার বানিয়ে ফেলেছো দেখছি – সবাই একটু চুপ করো তো। শোন তোমাদের পুরো ঘটনাটা খুলে বলছি - -।’
ছড়া শুনে তো গ্রামের সবাই অবাক – সত্যিই বড় কর্তার বুদ্ধি ছিলো আর বড় কর্তার ছেলে ছোটবাবুর তো বুদ্ধি হবেই না হলে এই ছড়ার মানে কে বার করতে পারে। সব ঘটনা জানানো ও ডায়েরিটা দেখানোর পর হিমাংশু জানালেন ওর শোবার ঘরে এত লোক তো ধরবে না তাই গ্রামের মাথা এবং লাহিড়ী বংশের সাথে যুক্ত থাকার জন্য পূজারী ঠাকুর, নায়েব মশাই, পন্ডিত মশাই আর বিষ্টু কাকাকে ভেতরে নেবেন এ ছাড়া কালকে রাত্রে ভীষণ সাহস দেখানোর জন্য সরুও থাকবে সেই সাথে আট জন জোয়ান ওই পালঙ্ক সরানোর জন্য। গুপ্ত ধন পাওয়া গেলে সেটা বাইরে এনে সবার সামনেই খোলা হবে। সবাইকে বাড়ির উঠানে বসিয়ে গুপ্তধন বের করার দলকে নিয়ে হিমাংশু ঘরের মধ্যে এলেন। ঘরের ভেতরে বাইরে নিদারুণ উত্তেজনা – একটা ‘কি হয়, কি হয়’ ভাব চারদিকে। আট জন লোক ওই পালঙ্ক তুলতে ঘেমে গেলো – একজন তো বলেই বসলো,
‘ছোট বাবু এটা কি সেগুন কাঠের না পাথরের বানানো?’
হিমাংশু হাসলেন,
‘ওরে, এটা হলো আসল সেগুন কাঠ বার্মা মুলুক থেকে দাদু জাহাজে করে আনিয়েছিলেন। এর ওজন হবে না তো তোদের আম কাঠের ওজন হবে নাকি! নে, পালঙ্কটাকে ঠিক করে সরা।’
পালঙ্ক সরাতে দেখা গেলো মেঝেতে লম্বা চওড়াতে দুই হাতের মত একটা পাথর আলাদা করে বসানো। হিমাংশু একটা শাবল এনে চাড় দিতেও ঠিক নড়লো না তখন আর একটা শাবল নিয়ে দুজনে মিলে চাড় দিয়ে পাথরটা তুলতে ওটার নিচে একটা ছোট্ট কুঠরির মত চোখে পড়লো। ঘরের সবাই উত্তেজনাতে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ওই গর্তের ওপর – পাথরটা পুরোপুরি সরাতে দেখা গেলো ওই গর্তের মধ্যে সুন্দর কাজ করা সেগুন কাঠের একটা সিন্দুক। ওটার দুধারের হাতল ধরে দুজন লোক ওপরে তুলতে হিমসিম খেয়ে গেলো। এক জন থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
‘ছোট বাবু এত ভারী সিন্দুক মানে এটা তো ভর্তিই হবে?’
হিমাংশু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন – পূর্ব পুরুষের এই সম্পত্তির কি উপায় করবেন সেটাই ওকে ভাবিয়ে তুলেছে। আনমনে বললেন,
‘বাইরে উঠোনে তো নিয়ে চল – সবার সামনে খুললেই বোঝা যাবে।’
চার জন লোক সিন্দুকটাকে নিয়ে বাইরে আসতে চার দিক একেবারে চুপচাপ যেন গাছের পাতা ঝরে পড়লেও তার আওয়াজ শোনা যাবে – লোকে একেবারে দম বন্ধ করে বসে আছে সিন্দুকের ভেতর কি আছে দেখার জন্য। সিন্দুকটাকে উঠানের মাঝ খানে রাখতে দেখা গেলো ওটার পাল্লাতে একটা বিদঘুটে ধরনের তালা লাগানো। হিমাংশু শাবলের চাড় দিয়ে ওটাকে ভেঙ্গে ফেলে পাল্লার নিচে শাবলটা লাগিয়ে ধীরে ধীরে চাপ দিতে পাল্লাটা আস্তে আস্তে ওপরে ঊঠে এলো – গ্রামের লোকের তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার উপক্রম হয়েছে। হিমাংশু এক ধাক্কায় পাল্লাটা খুলে ফেললেন - ভেতরটা একেবারেই ফাঁকা। চারদিকে চরম হতাশার দীর্ঘশ্বাসের একটা ঝড় বয়ে গেলো। কত আশা ছিলো – বড় কর্তা এভাবে সবাইকে ভেলকি দেখালেন? কি দরকার ছিলো এই নাটক করার? তবে হিমাংশুর মনে হতাশার থেকেও স্বস্তি অনেক বেশী হলো – যাক মাথা থেকে একটা বিরাট দুঃশ্চিন্তা নামলো – গুপ্তধন থাকলে তার ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই অনেক বেশী ঝঞ্ঝাট হতো। ভেতরে ঝুঁকে বের করলেন একটা মোহর, একটা খুব সুন্দর সোনার বালা আর একটা প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ – খুলে দেখলেন চিঠিটা বাবার লেখা। ধীরে ধীরে সবাইকে শুনিয়ে হিমাংশু চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন।

বাবাজীবন হিমাংশু,
লাহিড়ী বংশের সম্পত্তির কিছুই তোমার জন্য রাখিয়া যাইতে পারিলাম না। তোমার দাদুর স্বর্গবাসের পর দেখিলাম আমাদের পূর্ব পুরুষের যথেচ্ছাচারের বিরাট দেনায় লাহিড়ী বংশ ডুবিয়া আছে। তাই বংশের শেষ সম্পদ এই সিন্দুকের সমস্ত মোহর ইত্যাদি ভাঙ্গাইয়া আমি সেই দেনা শোধ করিয়াছি। যদিও তোমার জন্য কিছুই রাখিয়া যাইতে পারলাম না তবুও আমি আনন্দিত – তোমাকে বংশ পরম্পরার ঋণ হইতে মুক্ত করিতে পারিয়াছি। এই মোহর দিয়া তোমার জন্মের পর তোমার দাদু তোমার মুখদর্শন করিয়াছিলেন তাই এইটা তোমার প্রাপ্য আর তোমার মা নিজের শেষ অলঙ্কার এই বালাটি রাখিয়া গিয়াছেন পুত্রবধূর জন্য অতএব তুমি এই বালার জিম্মাদার।
ইতি
আশীর্বাদক
তোমার পিতা
সুধাংশু শেখর লাহিড়ী

অঞ্জন নাথ
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক