সেদিন ছিল ২৯শে জুলাই । সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব এটাই ঠিক ছিল । তাও সেই কুঁড়েমি করে বেরোতে বেরোতে ১০টা বাজালাম । কোপেনহেগেন শহরে সেদিনটা খুব ঝলমলেও নয়, তবে বেয়াড়া একঘেয়ে বৃষ্টিও হচ্ছিল না । এরকম দিনকে ও দেশের ওয়েদার রিপর্ট-এ বলে, সানি ইনটার্ভাল্স্ ।
আমি যেখানে থাকতাম তার ঠিক পাশেই নরেব্রো ষ্টেশন । ১৩০ ক্রোনার-এর টিকেট কাটলে ডেনমার্ক-এর জিল্যান্ড দ্বীপ-এর অনেকটা অংশে সারাদিন-এর ঘুরে বেড়াবার টিকেট পাওয়া যায়, যতবার খুশি যেকোনো ট্রেনে চড়া যায় । সেরকমই একটা টিকিট আমি কেটে নিলাম । আগের দিন ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তিনটে জায়গায় যাব বলে স্থির করে ফেলেছি । সেখানে কি ভাবে যাব, লোকাল ট্রেনের কতক্ষণ অন্তর অন্তর ছাড়ে , কি দেখার আছে , সব লিখে চোথা বানিয়ে রেখেছি । কাকতালিয় ভাবে তিনটে জায়গারই নাম 'হ' দিয়ে শুরু - হিলেরড্ , হুন্ডেস্টেড্ , হেলসিঙ্গর ।
নরেব্রো ষ্টেশন থেকে ট্রেনে চাপলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে কান্ট্রিসাইড-এর দৃশ্য শুরু হল । ঠিক যেমন আমাদের কলকাতার দক্ষিণের লোকাল ট্রেনগুলো গড়িয়া ষ্টেশন ছাড়াবার কিছু পরই গ্রাম্য দৃশ্য চোখে পড়ে । ইউরোপ-এর গ্রাম দেখতে খুব সুন্দর লাগে । আকাশে কালো মেঘ, এই বুঝি বৃষ্টি হয় হয়, আর রেললাইনের এপাশে ওপাশে চোখ জোড়ানো সবুজ চিরে ট্রেন চলেছে । এখানেও ক্ষেতের ধারে চাষীদের বাড়ি , শুধু এদেশের সঙ্গে তফাৎ - ওখানকার 'চাষী'-দের বাড়ির পাশেও BMW গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে ।
হিলেরড-এর প্রধান আকর্ষন ফ্রেডেরিক্সবর্গ কাসেল বা ফ্রেডেরিক্সবর্গ প্যালেস । হিলেরড্ ষ্টেশনে নেমে সাইনবোর্ড খুজছি কোন দিকে হাঁটতে থাকলে ফ্রেডেরিক্সবর্গ কাসেল-এর দিকে যাব । ডেনমার্ক-এর গ্রামে এমনিতেই লোকজন কম, তার ওপর রবিবারের বাজার । সাইনবোর্ড তো পেলাম, কিন্তু ভয়ঙ্করী ড্যানিশ ভাষার জ্ঞ্যান নিয়ে কিছুই পাঠোদ্ধার হচ্ছিল না ।
শেষে দেখি এক জায়গায়ে লেখা 'স্লট' , তার পাশে একটা কাসেল-এর মতন দেখতে কিছু আঁকা আর একটা দিক নির্ণয়-এর তীর চিহ্ণ । সেই রাস্তাই ধরলাম, তবে রাস্তায় কোনো লোক চোখে পড়লেই জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি ঠিক পথে যাচ্ছি কি না । অবশেষে কাসেল-এর চূড়া দেখা গেল । বেশ বড় একটা লেক, লেকের গায়েই ১৬২০ সালে তৈরী রাজপ্রাসাদ ।
লেকের জলে মিউট্ সোয়ান, ব্ল্যাক হেডেড গাল আর কমন কুট-এর ভিড় । সেখানে বাচ্চারা বাবা মা-র সঙ্গে এসে সেই পাখিদের কিসব খাওয়াচ্ছে, আর পাখিরা মহানন্দে ক্যাঁ-ক্যাঁ করতে করতে খাচ্ছে । লেকের ধার ধরে গাছের ছায়ায় ঢাকা সুন্দর রাস্তা ধরে প্রাসাদ-এর প্রবেশদ্বার । ডেনমার্ক-এর রাজবংশীয় রঙ হল সবুজ । সব প্রাসাদ বা দুর্গের চূড়ার দিকটা সবুজের ওপর সোনালী কাজ করা , বাকিটা পাথরের রং-এর । ইতিহাসে ঢুকে গেলে মন অন্যরকম হয়ে যায় , মনে হয় কত যুগ আগের এই রাজার বাসস্থান, কত ঘটনার সাক্ষি । তবে ইতিহাসে ঢুকতে গেলে কাসেল-এর ভেতর ঢুকতে হয়, আর কাসেল-এ ঢুকে দেখতে যাওয়ার প্রবেশমূল্যর দিকে চোখ পড়লে মনে হয়, সৌন্দর্য দূর থেকে উপভোগ করাই ভাল । আর ইতিহাস - বইতেই থাক !
হিলেরড-এর পালা সাঙ্গ করে এবারে এগোলাম আমার পরবর্তী গন্তব্য হুন্ডেস্টেড-এর দিকে । আকাশে মেঘ ঘনিয়েছে বেশ, কলকাতা হলে এতক্ষণে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমে যেত । শীতের দেশে বৃষ্টির চেয়ে মানুষ হয়তো মেঘলা আকাশই পছন্দ করে বেশি । ইউরোপ-এর আকাশ তাই বোধহয় মানুষের মনের কথা বুঝতে পেরে মেঘের সঙ্গে সখ্যতা করে রেখেছে । আবার আরেক ট্রেন, আবার নতুন মাঠ ঘাট, কোথাও বড় বড় উইন্ডমিল-এর চাকা, কখনও দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, কখনও সবুজ ঘাসের ওপর স্বাস্থ্যবান ঘোড়া ছুটে বেড়াচ্ছে । কিছু চেনা কিছু অচেনা দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় সমুদ্রের একদম পাশে একটা ছোট্ট ষ্টেশনে ট্রেন থামল । এক ঘটা পরে আবার পরের ট্রেন আসবে, তাই আমার হাতে এক ঘন্টা রয়েছে ঘোরার জন্যে । সেই ট্রেন ধরতে না পারলে আরও এক ঘন্টা পরে পরবর্তী ট্রেন ।
হুন্ডেস্টেড হাভন
ষ্টেশনের পাশেই "হার্বার", ডেনমার্ক-এর ভাষায় "হাভ্ন্" । সারি সারি রংচং-এ নৌকা-র ভীড় । এরা সব আমাদের দেশের ট্রলার-এর মতন মাছ ধরতে যাবার বাহন । ডেনমার্ক-এ "ফিশিং" একটা প্রধান জীবিকা-র অন্যতম । জায়গাটা অদ্ভূত, ঠিক পর্যটক কেন্দ্রিক নয় । এখানে একটা পুরনো জং পড়ে যাওয়া জাহাজ, হার্বার-এ নোঙর ফেলে দাঁড় করানো । তার ওপরে উঠে তিন-চার জন মদ্যপ বীয়ার-এর ক্যান হাতে তান্ডব করছে । আমার কাছেও টাকা চেয়েছিল, আমি পাশ কাটিয়ে শুনতে বা বুঝতে না পাওয়ার ভান করে এগিয়ে গেলাম । সামনে পান্না সমুজ বল্টিক সী, তীরে পাথর ফেলে রাখা হয়েছে, সেই পাথরে বসে আবার কজন ছিপ ফেলে হাপিত্তেশ করে বসে আছে কখন মাছ বঁড়শিতে গাঁথবে । ঢেউ হয়তো থাকেই না এই সমুদ্রে, সেদিন তাও মেঘলা এবং কিঞ্চিৎ ঝোড়ো আবহাওয়ার কারনে কিছুটা জলের ওঠানামা দেখা গেল ।
হার্বার-এর পাশে একটা চমৎকার চন্দ্রাকার সমুদ্রতট । বালি দিয়ে তিনটে বাচ্চা মেয়ে সেখানে কাসেল বানাচ্ছে ।
হুন্ডেস্টেড-এর সমস্ত ঘর বাড়ি খুব রঙচঙে, তাই এই ছোট্ট জনপদ আরও সুন্দর লাগল । বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটতে থাঁটতে সময় কেটে গেল ।
বেশী কিছু দেখা বা করার কিছু নেই, কিন্তু অল্পসময়ে ডেনমার্ক-এর আঘ্রান পেতে হলে এরকম অনামা অচেনা জায়গা-র থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না । ট্রেন আসার আওয়াজ শুনে পা চালিয়ে ষ্টেশনের দিকে গেলাম । হুন্ডেস্টেড-কে বিদায় জানালাম । প্রথমে ফিরে আস্তে হল হিলেরড ষ্টেশনেই, সেখান থেকে আবার ট্রেন বদল করে আমার শেষ গন্তব্য হেলসিঙ্গর-এর দিকে রওনা হলাম । ট্রেন যাচ্ছে এবার হাল্কা জঙ্গলের আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে । লোকজন খুব কম । পুরো ট্রেনই প্রায় ফাঁকা । বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশ জোরে আর তার সঙ্গে বেশ জোরালো হাওয়া । শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেন-এর ভেতরে বসে যদিও বোঝা যায় না বাইরের আবহাওয়া, তাও গাছ গুলোকে দেখে আর ট্রেন ষ্টেশনে দাঁড়ালে যখন দরজা খুলছে তখন দমকা হাওয়ার দাপটে বোঝা যাচ্ছে বাইরে প্রকৃতি তান্ডব শুরু করেছে । এক ঘন্টা পরে একটা শহুরে যায়গা দেখতে পেলাম আর হটাৎ দেখি সমুদ্রের একদম পাশ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে । ঘড়িতে তখন ৭টা বাজে । কিন্তু ইউরোপের গ্রীষ্মে দিন থাকে রাত দশটা অব্ধি । তাই তখনও দিনের আলো যথেষ্ঠ । বৃষ্টি আগের থেকে কমলেও পুরপুরি থামেনি । হিলেরড ষ্টেশনের বাইরে সেই দুটোর সময় একটা বার্গার আর চিপ্স্ খেয়েছিলাম, তাই ক্ষিদেও পেয়েছিল । তাই একটা ছোট রেস্তোঁরায়ে বসে একটা পিজা স্যান্ডউইচ খেলাম । তারপরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে সমুদ্রের ধার দিয়ে কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে হার্বার-এর বাঁধানো রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম সেলসিঙ্গরের প্রধান দ্রষ্টব্যের দিকে ।
শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট্ নাটকে যে এল্সিনোর রাজপ্রাসাদ-এর কথা লেখা হয়েছে, সেটা হল এই হেলসিঙ্গরের ক্রন্বর্গ কাসেল্ । ১৪২০ সালে নির্মিত এই সুবিশাল কাসেল উত্তর ইউরোপের রেনেসাঁ কাসেল-এর স্থাপত্যকর্মের অন্যতম, এবং এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত । সুইডেন আর ডেনমার্ক-এর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বল্টিক সী এই হেলসিঙ্গরে সব থেকে সঙ্কীর্ণ । হেলসিঙ্গরে দাঁড়িয়ে ওপারে স্পষ্ট দেখা যায় সুইডেন, তার বাড়ি ঘর, অনেকটা ডায়মন্ড হার্বার-এ নদীর মতন - চওড়া, কিন্ত ওপার দেখা যায় ।
ডেনমার্ক-এর হেলসিঙ্গর থেকে সুইডেন-এর হেলসিনবর্গে ক্রমাগত ফেরি চলাচল করছে । আর সে ফেরি মানে পেল্লায় জাহাজ ! একটা স্ক্যান্ডলাইন্স-এর আরেকটা এইচ,এইচ,ফেরিস-এর জাহাজ। একবার ডেনমার্ক থেকে সুইডেন, আবার সুইডেন থেকে ডেনমার্ক। ক্রন্বর্গ কাসেল্ একেবারে সমুদ্রের ঠিক ধারেই নির্মিত, সমুদ্রের দিকে তাক করে রাখা সারি সারি কামান । সমুদ্রের দিক থেকে এই দূর্গ আক্রমণ করা অসম্ভব ছিল বোঝাই যায় । সমুদ্র আর কাসেল-এর মধ্যবর্ত্তী আঁকাবাঁকা রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে থাকলে কিভাবে যে সময় চলে যায়, টেরই পাওয়া যায় না ।
বৃষ্টিও থেমে গেছিল, তাই ঠান্ডাটাও কম লাগছিল । কিন্তু ঘড়ির কাঁটা প্রায় নটা ছুঁই-ছুঁই । এবার ফিরে যেতে হবে । কাসেল থেকে বেরিয়ে ষ্টেশনে যাবার পথে দেখলাম কোপেনহেগেন-এর বিখ্যাত 'লিট্ল্ মারমেড'-এর অনুকরণে তৈরে স্টেনলেস স্টীল-এর তৈরী এক মূর্তি । স্টীল-এর তৈরী এরকম মূর্তি আমি এর আগে কোথাও দেখি নি ।
ষ্টেশন-এ যখন পৌঁছোলাম তখন কোপেনহেগেন যাবার ট্রেন ছাড়বার জন্যে প্রায় প্রস্তুত । এই ট্রেন হেলসিঙ্গর থেকে ছেড়ে কোপেনহেগেন হয়ে সমুদ্রের তলার টানেল-এর মধ্যে দিয়ে সুইডেনের মাল্মো শহরে পৌঁছোয় । আড়াই-তিন ঘন্টার সফর।
সারাদিনের ক্লান্তি তো ছিলই, তাই ট্রেনে বসে একটু চোখ লেগে আসছিল । বাইরেটা এবারে সন্ধ্যে থেকে রাত হয়ে যাচ্ছে । হেলেরুপ ষ্টেশনে নেমে যখন নরেব্রো যাবার ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করছি তখন সারাদিনের কথা ভাবছিলাম । মনে হচ্ছে তিন দিনের ঘোরা একদিনে ঘুরেছি বারো ঘন্টার মধ্যে । পায়ের তলায় শর্ষেটা একটু বেশি মাত্রায়েই সক্রিয় ছিল এই দিনটায়, কিন্তু শুধু নিজের মতন করে চেনা-অচেনা ডেনমার্ক দেখার এই অদ্ভূত দিনের কথা চিরকাল মনে থেকে যাবে ।
লেখা ও ছবিঃ
ঋতম ব্যানার্জি
কলকাতা